এক সময় বড় একটি শহরের উপকন্ঠে এক তরুণ বাস করত । গরিব মা ছাড়া তার সংসারে আর কেউ ছিল না। এই বয়সেও সে রয়ে গেল একরকম দুর্বল মনের এবং কোনো কিছু করতে গেলে আধখানা করার পর সব ভণ্ডুল করে দিত। অথবা পুরো কাজটি করতে পারলেও তার ভাগ্যে জুটত সামান্য খুদ কুঁড়ো। তার স্বভাবের দোষেই এরকম হত। এজন্য পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা তাকে উদ্ভট উদ্ভট কাহিনী বলে বিভ্রান্ত করে দিত বা বোকা বানিয়ে ছাড়ত। সেই বোকা-বকাই তরুণের জীবনে একটা কাণ্ড ঘটে গেল। সেদিন সে গ্রামের পাশের বিশাল তৃণপ্রান্তরে ঘুরতে গেল। সেখানে ফুটে আছে যত হলুদ চন্দ্রমল্লিকা, সাদা ও লাল ডালিয়া। ওদিকে গোলাপ ও গন্ধরাজ। সে ফুলগাছের পাশে গিয়ে বসল। সুগন্ধি ফুল তুলে পাশে রাখছে আর কখনো কখনো গন্ধ শুকে দেখছে। এমন সময় এক যুবক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে ডাক দিয়ে বলল, কী হে, এখানে বসে বসে কি করছ? তোমার তো দেখি পায়ের পাতা হলুদ হয়ে গেছে। তার অর্থ তুমি আর বাঁচবে না, তুমি মরতে বসেছ।’-এই বলে সে চলে গেল । এই গরিব তরুণ, বোকাপ্রায় লোকটি মৃত্যুর কথা শুনে খুব ভয় পেল। সে তখন পায়ের পাতাগুলো ভালো করে দেখতে লাগল। পাশে লাল-হলুদ ফুল থাকার কারণেই হোক অথবা সরল বিশ্বাসের জন্যই হোক সে সত্যিই তার পায়ের পাতার রঙ হলুদ হয়ে গেছে দেখতে পেল । আমনি সে মনে মনে বলতে লাগল, মরবই যদি তাহলে কবরটা খুঁড়ে রাখি। আমার মা তো বুড়ো মানুয, তার চেয়ে নিজেই কাজটা সেরে রাখি । তারপর সে চারদিক দেখে-শুনে ভিজে স্যাতসেতে নরম জায়গায় শরীরের সমান লম্বা ও সরু একটা কবর খুঁড়ে সেখানে শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল । কিছুক্ষণ পরে রাজার এক খানসামা সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল । তার হাতে ছিল একটা বড় মাটির জালা। সেই জালাটি ছিল তেলে ভর্তি। রাজার রান্নার তেল । সে কবরে শুয়ে থাকা তরুণকে দেখে দাড়িয়ে পড়ল। বলল, কী হে, তুমি অমন সরু একটা কবরের মতো গর্তে শুয়ে আছ কেন? ‘আমার পায়ের পাতা হলদে হয়ে গেছে। তুমি তো জানো ভাই, এটা নিৰ্ঘাত মৃত্যুর লক্ষণ। আমি মরতে বসেছি। সেজন্য নিজের হাতে নরম মাটিতে কবর খুঁড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে আছি। রাজার খানসামা বলে উঠল, “বোকার হদ আর কাকে বলে! তুমি যদি মরতে বসতে তাহলে এভাবে কথাই বলতে পারতে না। ওঠো তো দেখি! চলো আমার সঙ্গে । আমার এই জালাটি বয়ে নিতে সাহায্য করো। এতে রাজার রান্নার জন্য তেল আছে। এটা নিয়ে গেলে তোমাকে একটা মুরগি দেব।’ বোকা তরুণ ওর কথায় মৃত্যুর ভয় থেকে রেহাই পেয়ে উঠে দাঁড়াল । যেতে যেতে সে ভাবতে লাগল মুরগিটি পেলে সে কী করবে। সে ভাবল, মুরগিটি একদিন ডিম দেবে। অনেকগুলো ডিম হলে মুরগিকে ডিমগুলোতে তা দিতে বসিয়ে দেব। তারপর একদিন বাচ্চা ফুটবে। বাচ্চাগুলো বড় হবে। সেগুলো তারপর হাটে নিয়ে বিক্রি করে একটা গাই কিনব । গাই থেকে হবে বাচ্চা। বাচ্চাটা বড় হলে দুটিই বেচে দিয়ে একখানা সুন্দর ঘর বাধবো। ঘর হলে করব বিয়ে। তারপর আমাদের একটি ছেলে হবে। ছেলেটি বড় হলে তাকে স্কুলে দেব। আমি তাকে খুব ভালো শিক্ষা দেব। আমার ছেলে যদি ভালোভাবে লেখাপড়া শেখে তাহলে তাকে খুব আদর করব। ভালোবাসব। আর সে যদি দুষ্ট হয়, আমার কথা না শোনে তাহলে তাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেব। এইভাবে… ।’ বলেই সে এমন জোরে একটি লাথি ছুড়ে মারল যে টাল সামলাতে না পেরে নিজেই পড়ে গেল এবং পিঠের তেলের জালা পড়ে গিয়ে খান খান হয়ে গেল। তাই না দেখে রাজার খানসামা তো রেগে আগুন সে বলল, “এই বোকার হদ বোকা, তুই কী এমন দেখেছিস যে এত বড় লাথি ছুড়ে মারলি? এখন দেখ, তেলের জালা ভেঙে টুকরো টুকরো। রাজা তোকে এবার শূলে চড়াবে ।” বোকা তরুণ সত্যি কথাটা বলে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু রাজার খানসামা সে কথা শুনতে নারাজ। সে তাকে টেনে-হিঁচড়ে রাজার কাছে নিয়ে চলল । রাজার কাছে পৌছতেই রাজা বললেন, ‘খানসামা, কী ব্যাপার, ওকে তুমি এভাবে নিয়ে আসছ কেন ।” খানসামা তখন তেলের
জালা ভেঙে টুকরো টুকরো করার কাহিনী তার মতো করে রাজাকে বলল। রাজা তখন বোকা তরুণকে সমস্ত ঘটনা নিৰ্ভয়ে খুলে বলতে আদেশ দিলেন। বোকা তরুণ তখন বলল, মহারাজ, আপনার খানসামা আমাকে এই তেলের পাত্র বয়ে আনলে একটা মুরগি দেবে বলে কড়ার করে। তখন আমার মনে স্বাভাবিকভাবে ভাবনা আসে যে মুরগিটা পেলে আমি কী করব! আমি তখন ঠিক করলাম যে মুরগির অনেকগুলো ছানা হলে সেগুলো বেচে একটা গাই কিনব। সেই গাইয়ের বাচ্চা হবে, বাচ্চা বড় হবে। তখন দুটিকে বেচে দিয়ে আমি একখানা সুন্দর ছোট ঘর বাধব। ঘর বেঁধে বিয়ে করব, বাচ্চা হবে এবং সেই বাচ্চাকে যথাযথ শিক্ষা দেব। কিন্তু সে যদি তারপর অবাধ্য হয় তখন তাকে কী করে লাথি মারব তা পরখ করতে গিয়েই এই বিপত্তি, কিন্তু আমার ভাবনা মোটেই তুচ্ছ ব্যাপার নয় মহারাজ। আমার অবাধ্য ছেলেকে আমি শিক্ষা দেব না।’ এরকম হাস্যকর মজার-কাহিনী শুনে রাজা খুব আনন্দ পেলেন এবং তিনি প্রাণভরে হো হো করে হেসে উঠলেন। তিনি তখন বোকা তরুণকে এক টুকরো সোনা দিয়ে বললেন, যাও, তোমার মায়ের কাছে চলে যাও তুমি । বোকা তরুণ এবার ঘরে ছুটল। ঘরের দরজার সামনে এসেই সে দেখল একটা অচেনা কুকুর মুখে একটা বটুয়া নিয়ে চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছে। বটুয়ার ভেতরে দেখা যাচ্ছে টাকার বাণ্ডিল। দেখে সে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে মাকে ডাকতে লাগল, মা-মা, তোমার টাকার বটুয়া নিয়ে একটা কুকুর পালাচ্ছে।’ মা বেরিয়ে এসে ভাবল ছেলেটা তো বোকার হদ । তার টাকা টাকা চেচামেচিতে পড়শীরা জেনে যাবে তার টাকার কথা। এত লোকজন তাড়া করে কুকুর থেকে টাকা কেড়ে নিয়ে নিজের বলে দাবি করে আর দিতে চাইবে না তাকে । মা ছিল তখন ঘরের ছাদের উপরে। সে বুদ্ধি করে ছাদের উপর মিছরি ছড়িয়ে দিয়ে ছেলেকে ডাকতে লাগল। মায়ের বোকা ছেলেটি ছিল চিনি ও মিছরির ভীষণ ভক্ত। মিছরির কথায় সে কুকুরের কথা ভুলে গিয়ে ঘরের ছাদে উঠে গেল । মা তখন বলল, বাছারে, কী অবাক কাণ্ড দেখ, আজ আমাদের ছাদে চিনি ও মিছরির বৃষ্টি হয়েছে। তুই এগুলো তাড়াতাড়ি কুড়িয়ে নে ‘ ব্যাস্, ছেলে একেবারে কুপোকাত। চিনি ও মিছরির দানা সে একটি একটি করে কুড়োতে লাগল। দু’এক টুকরো মুখেও পুরে দিতে লাগল।