
তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি, সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের মধ্যে মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, ধৈর্য-সহনশীলতা, সততা-বিশ্বস্ততা প্রভৃতি গুণ অবশ্যই থাকা উচিত। যেখানে এসব থাকে না সেখানে শান্তির পরিবর্তনে ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘাত-সংঘর্ষ, ফিতনা-ফাসাদ, সহিংসতা-উগ্রতা, এসব দেখা দেয়। মানব সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এসব কাজকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হলেও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণে বহু দেশ ও সমাজে যুগ যুগ ধরে তা চলে আসছে।
ন্যায়বিচার শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ আদল। যার বাংলা অর্থ- সোজা করা, সমতা রক্ষা করা, কম-বেশি না করা, ইনসাফ করা, ভারসাম্য রক্ষা করা ইত্যাদি। ইসলামী আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার ছাড়া যেমন ইসলামী আইন বাস্তবায়ন সম্ভব নয় তেমনি ইসলামী আইন ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও প্রায় অসম্ভব।
বন্ধুরা, এত কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে আজ আমরা পাখিদের মধ্যে বিভেদের সুযোগে বেড়ালের অন্যায় বিচার নিয়ে একটি গল্প শোনাব।
“বেড়াল যখন বিচারক”
পার্বত্য এলাকা। আশেপাশে গাছপালা ভর্তি। সেসব গাছপালার ভেতর বাস করত কিছু বুনো পাখি। বুনো পাখি মানে গৃহপালিত পাখি নয়, শিকারী পাখি। তাদেরই মতো আরো কিছু পাখির কাছে বড় একটি গাছের মগডালে বাসা বেঁধেছিল একটি কাক। কাকের বাসার পাশে ছিল একটি তিতির পাখির বাসা। শাহী তিতির। কাক আর তিতির প্রতিবেশি হিসেবে দীর্ঘদিন বসবাস করার সুবাদে দু’জনের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ভালোই কাটছিল তাদের।
একদিন তিতির পাখিটা একা একা গিয়েছিল মরুপ্রান্তরে। সেদিনই যে প্রথম একাকী প্রান্তরে গেছে তা নয়, প্রায়ই একাকী যেত এবং সময়মতো ফিরে আসত বাসায়। কিন্তু এদিন কেন যেন ফিরে এল না। কাক তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবল আসবে হয়তো, অপেক্ষা করা যাক। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে বেশ ক’দিন কেটে গেল। তবু তিতির ফিরে এল না। কাক এবার মনে মনে বলল নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। নৈলে ফিরবে না কেন। এসব ভাবার পর কাক সিদ্ধান্ত নিল বন্ধুর খোঁজে বের হবে।
এরিমাঝে তিতির প্রজাতির আরেকটি পাখি কোত্থেকে যেন কাকের বাসার পাশে উড়ে এসে বসল। তার গায়ের রঙ তিতিরের চেয়ে আরেকটু গাঢ় খয়েরি। দেখেই বোঝা যায় বন্ধু তিতিরের স্বজাতি নয় সে। একটু পরে তার নজরে পড়ল তিতিরের খালি বাসা। সে উড়ে গিয়ে তিতিরের বাসার কাছে গেল। পরিত্যক্ত বাসা দেখে ভাবল এখানে বোধহয় কেউ থাকে না। সে বাসাটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিল এবং বসবাস করতে শুরু করে দিল।
কাক দীর্ঘদিন একা একা থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সেজন্যে নতুন পাখিটির আগমনে সে মনে মনে খুশিই হলো। নতুন পাখি, নতুন প্রতিবেশি। বন্ধু বানিয়ে নিলে মন্দ কি! পুরনো বন্ধুর তো কোনো খোঁজ-খবরই নেই। কী আর করা! কাক আর কোথাও গেল না। পরের দিন কাক খয়েরি তিতিরকে স্বাগত জানানোর জন্যে উড়ে গেল তার বাসায়। গিয়েই তাকে স্বাগত জানাল এবং বলল- শাহী তিতির এখান থেকে চলে যাবার পর আমি দীর্ঘদিন একাকী হয়ে পড়েছিলাম। তুমি এসেছ, তাই ভালোই লাগল। নিঃসঙ্গ থাকতে হবে না। তোমারও এই নতুন বাসায় ভালোই কাটবে আশা করি।
খয়েরি তিতির অত্যন্ত খুশি হলো কাকের কথা শুনে। সেও বেশ আদব কায়দার সাথেই কাকের শুভেচ্ছা ও স্বাগত বাণীর জবাব দিল। পরদিন খয়েরি তিতির পাল্টা সফরে কাকের বাসায় গেল। এভাবে বেশ কিছুদিন একত্রে কাটল তাদের। এরইমধ্যে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। দুই বন্ধু সুখে শান্তিতেই কাটাতে লাগল।
হঠাৎ একদিন কোত্থেকে যেন শাহী তিতির ফিরে এল তার বাসায়। এসে দেখে তার বাসা দখল করে আছে খয়েরি তিতির। কী আশ্চর্য ব্যাপার। শাহী তিতির তার বাসায় আরেকজনকে দেখে ক্ষেপে গেল। কর্কশ কণ্ঠে বলল: তোকে আমার বাসায় থাকার অনুমতি দিয়েছে কে?
খয়েরি তিতির বলল: তোমার মাথা কি ঠিক আছে। আমি আমার নিজের বাসায় বসবাস করব না তো কী করব? কে তুমি? আমাকে ডিস্টার্ব করছো কেন? আর এ রকম চিৎকার চেঁচামেচি করছ কেন?
শাহী তিতিরের মাথা এবার সত্যিই খারাপ হবার উপক্রম হল। বিরক্তির সাথে সে বলল: এটা আমার বাসা। তুই এক্ষুণি আমার বাসা থেকে চলে যা। খয়েরি তিতির জবাব দিল: দখলিসূত্রে এই বাসার মালিক এখন আমি।
এভাবে জবাব পাল্টা জবাবে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠল। তাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের বিচিত্র পাখিও এসে জড়ো হলো। তাদের মাঝে শাহী তিতিরের বন্ধু কাকও ছিল। তারা বহুভাবে চেষ্টা করল দুই তিতিরের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে একটা ফয়সালা করে দিতে। কিন্তু তিতিরেরা রাজি হলো না। তারা ঝগড়া করেই চলল।
অন্যান্য পাখি তো জানতো না এই বাসার প্রকৃত মালিক কে? কিন্তু কাক তো জানতো। সেজন্যে কাক চেয়েছিল দু’জনের মাঝে মিটমাট করে দিতে। তাও কোনো কাজে এল না। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো তৃতীয় কোনো বিচারকের কাছে যাবে। যে হবে নিরপেক্ষ। সে-ই দুজনের মধ্যে কার কথা সত্য ফয়সালা করে দেবে।
কিন্তু কে হবে মধ্যস্থতাকারী তা নিয়ে সংকট দেখা দিল। অনেকেই প্রস্তাব দিয়েছিল যেহেতু কাক তাদের নিকটতম প্রতিবেশি এবং সব ঘটনা আগে থেকেই জানে, সুতরাং কাকই তাদের ঝগড়া মিটিয়ে দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে সবচেয়ে উপযুক্ত। কিন্তু কোনো পক্ষই তাতে রাজি হলো না।
শাহী তিতিরের মনে তো ক্ষোভ আছে, কাক তার খোঁজে একটিবারও যায়নি, আবার দখলদার তিতিরকেও বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে সে, ফলে তার ওপর ভরসা করা যায় না। অন্যদিকে খয়েরি তিতির ভাবল- কাক তো প্রকৃত সত্য সম্পর্কে জানে ফলে পুরনো বন্ধুর দিকেই সে টানবে-সেটাই স্বাভাবিক। তাই কাকের ওপর ভরসা করা বোকামি।
এবার তাই বিচারকের সন্ধান করতে লাগলো সবাই। বিচারকের সন্ধান করতে করতে পাখিদের মধ্য থেকেই একটি প্রস্তাব এল। প্রস্তাবটি হলো এই ফয়সালা পাখিদের কেউ করতে পারবে না। অন্য জাতির কাউকে বিচারক বানাতে হবে যাদের বাসার কোনো প্রয়োজন নেই।
এক পাখি তখন প্রস্তাব দিল বেড়ালের বাসার প্রয়োজন হয় না। মানুষের মাঝে বাস করতে করতে সে অনেক কিছু শিখেছে। কীভাবে বিচার-আচার করতে হয় মানুষের কাছ থেকে সব জেনেছে। সে-ই সবচেয়ে উপযুক্ত। তাছাড়া বেড়াল খুবই নিরীহ একটি প্রাণী। কাউকে বিরক্ত করে না। সে পারবে ন্যায়বিচার করতে।
তিতিরেরা এই প্রস্তাব মেনে নিল এবং সবাই মিলে বেড়ালের কাছে গেল। কাকও গেল সবার সাথে কী ঘটছে তা দেখার জন্যে।
বেড়াল এ সময় তার ঘরেই বসে ছিল। সে খাবারের সন্ধানে ছিল। কী খাওয়া যায়, কোথায় পাওয়া যায়, তা-ই ভাবছিল। তিতিরদের পায়ের শব্দ শুনে চোখ বুঁজে মনে মনে বলল: বাহ বাহ! তাজা পাখির ঘ্রাণ পাচ্ছি..আ..হ!
পাখিরা বেড়ালকে বাসায় দেখতে পেয়ে খুশি হলো। অপেক্ষা করতে লাগল কখন বেড়ালের ঘুম ভাঙে। বেড়াল চোখ খুলতেই পাখিরা তাকে সালাম জানাল। তারপর বেড়ালের কাছে সব ঘটনা খুলে বলল এবং ন্যায়বিচার করে দিতে আবেদন জানালো।
বেড়াল বিচার করে দিতে রাজি হলো এবং দু’পক্ষকেই জিজ্ঞাসাবাদ করলো। উভয় পক্ষই তাদের দাবীর পক্ষে যুক্তি দিল। বেড়াল হঠাৎ চিৎকার করে বলল: যেমনটা ভেবেছি..তোমাদের ঝগড়ার বিষয় হলো পার্থিব এই জগতের সম্পদ নিয়ে।
আসলে দুনিয়াবি সম্পদ একেবারেই ভালো না, খালি ঝগড়াঝাটি আর মারামারি কাটাকাটি ডেকে আনে। আমি এখন বুড়ো হয়েছি, চোখেও ভালো দেখি না, কানেও ঠিকমতো শুনতে পাই না। তোমরা কে যে কী বলেছো, ঠিকমতো শুনতে পাই নি। আরো কাছে এসে একটু জোরে জোরে বলো যাতে ভালো করে শুনে ন্যায়বিচার করতে পারি।
বেড়ালের কথা শুনে পাখিরা আরো কাছে এল। তিতিরেরা আবারো তাদের আর্জি পেশ করলো এবং উপযুক্ত বিচার প্রার্থনা করল।
বেড়াল বলল: তোমাদের মধ্যে কে প্রকৃতপক্ষে বাসার মালিক! একটু জোরে বলো যেন শুনতে পাই। পাখিরা বেড়ালের কথায় ভাবলো ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে। তাই আরো কাছে এল। পাখিরা বেড়ালের কথার জবাব দিতে যাচ্ছিল অমনি বেড়াল লাফ মেরে দুই তিতিরকেই তার পায়ের নখে আটকে ফেলল এবং মজা করে দুপুরের খাবার খেল।
খাবার সেরে জিহ্বাটাকে দুই ঠোঁটের ওপর বুলিয়ে লেগে থাকা পাখির পালকগুলো পরিষ্কার করে নিয়ে প্রশান্ত মনে বলল: দুই দুর্বল যখন নিজেদের অধিকার নিয়ে নিজেদের মাঝে ফয়সালা করতে রাজি হয় না, ফয়সালা করতে অভিযোগ করে তাদের চেয়ে শক্তিমানের কাছে……… তখন প্রকৃত ন্যায় হলো আগে নিজের পেট ঠাণ্ডা করা।