গাঁয়ের পাশে বিরাট এক বন। সেই বনে থাকতো এক শিয়াল, আর বনের মাঝে গর্তে বাস করতো এক বেজি। শিয়াল আর বেজির খুব বন্ধুত্ব, কাউকে একদিন না দেখলে আর একজনের মন হয় উতলা। একদিন শিয়াল বেজিকে বলল, বন্ধু, চলো আমরা বিদেশে যাই। বেজি সানন্দে রাজী হলো। শুভ দিনক্ষণ দেখে দুই বন্ধু একদিন বেরিয়ে পড়লো অজানা অচেনা দেশ দেখতে। দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে গেলো, কিন্তু চলার পথে কোন খাবার জোগাড় করতে পারলো না। এদিকে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হতে চলেছে, দুই বন্ধুর পেটে কোন খাবার নেই। পানি পিপাসায় দু’জনেই কাতর হয়ে উঠেছে।
এমন সময় তারা এসে পৌঁছালো এক নদীর কাছে। কী সুন্দর টলটলে সে নদীর পানি, দুই বন্ধু লাফ দিয়ে নদীতে নেমে চোঁ চোঁ করে পেট ভরে পানি খেলো, ডুব দিয়ে সাঁতার কেটে সারা গা ভালো করে ডলে গোসল করলো। পানি থেকে উঠতেই ইচ্ছা করছিলো না তাদের। কিন্তু পেটে কোন খাবার নেই কারো, শুধু পানি খেয়ে কী আর থাকা যায়? খিদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তারা নদী থেকে ডাঙায় উঠলো। একটু দূরে একটা ঝাঁকড়া কুল গাছের দিকে চোখ পড়লো তাদের। দৌঁড়ে গেলো তারা সেই কুল গাছের কাছে, বেজি লাফ দিয়ে গাছে উঠে গপাগপ করে পাকা পাকা কুল খেতে শুরু করে দিল।
শিয়াল তো আর গাছে উঠতে পারে না, সে নিচে দাঁড়িয়ে বেজির কুল খাওয়া দেখতে লাগলো। তার মনের আশা বন্ধু তাকে অবশ্যই কুল দেবে, কিন্তু তার আশা পূরণ হয় না। বেজি শিয়ালকে একটা কুলও দিলনা, একা একা কুল খেয়ে পেট ভরাতে লাগলো। শিয়াল তখন নিচ থেকে বলল, বন্ধু, একা খেয়ো না, আমাকে দু’একটা কুল দাও। বন্ধু, ও বন্ধু, দোস্ত আমার, একটা কুল দাও না ভাই। বারবার এমন করে কাকুতি মিনতি করায় বেজি একটা কুল ফেললো নিচে, শিয়াল খপ করে ধরেই হপ করে মুখে দিলো। পর মুহূর্তেই থু থু করে ফেলে দিয়ে বলল, দোস্ত, একটা কুল দিলে, তা আবার পোকা ধরা, খেতেই পারলাম না। দোস্ত, বন্ধু আমার, আর একটা কুল দে। অনেক বার বলার পরে বেজি গাছের উপর থেকে একটা কুল ছুড়ে দিল, গাছের নিচে ছিল গোবর, কুল যেয়ে থপ করে পড়লো সেই গোবরের উপরে। শিয়াল এই কুলটাও খেতে পারলো না। খিদেয় শিয়ালের অবস্থা কাহিল, ওদিকে বেজি পেট ভরে কুল খেয়েই যাচ্ছে। শিয়াল আবারও কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। শেষে বেজি আরও একটা কুল ছুড়ে দিল তার দিকে, সেটা ঢালু জায়গায় পড়ে গড়াতে গড়াতে চলে গেলো একেবারে নদীতে। নদীর স্রোতে ভাসতে ভাসতে দূরে চলে গেলো সে কুলটা। আবারও কুল চাইবার জন্য উপরে তাকিয়ে শিয়াল দেখতে পেলো বেজি একটা মোটা ডালে শুয়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে। শিয়ালের আর কুল খাওয়া হলো না।
কুল গাছের নিচে বসে থাকলো শিয়াল। একটু পরে হঠাৎ করে বেশ জোরে এলো বাতাসের ঝাপটা, কুল গাছের ডালে লাগলো জোর ঝাঁকুনি, আর সেই ঝাঁকুনিতে বেজি নিচে পড়লো ধপাস করে। আর শিয়াল করলো কী, দৌঁড়ে যেয়ে আস্ত বেজিটাকে খপ করে গিলে খেয়ে ফেললো। বন্ধুকে খেয়ে খিদে কমলো শিয়ালের, কিন্তু তার মন খু্ব খারাপ হলো। সে মন ভার করে একা একা হাঁটতে শুরু করলো। কিছু দূর যাবার পর রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট মেয়েকে শাক তুলতে দেখে সে থমকে দাঁড়ালো। মেয়েটা শিয়ালকে দেখে ভয় পেলো না, শিয়ালের মোটা পেট দেখে সে খুব বিস্মিত হলো আর বললো, ওরে বাবা, শিয়ালটার পেট কী মোটারে! শিয়াল এ কথা শুনে চটে উঠে বললো, পেট মোটা পেট মোটা বলিস না, আমি বন্ধুকে খেয়েছি, পেট মোটা বললে তোকেও খেয়ে ফেলবো। মেয়েটা তখন বললো, ইস বললেই হলো, খেয়ে ফেলবে, খা তো দেখি, পেট মোটা শিয়াল। অমনি শিয়ালটা ছুটে যেয়ে খপ করে ধরে মেয়েটাকে আস্ত গিলে ফেললো।
শাক তোলা মেয়েটাকে খেয়ে শিয়ালের মন বেশ খারাপ। সে রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে হেটে যাওয়া শুরু করলো। বেশ কিছু দূর যাবার পরে দেখা হলো এক ঘুঁটে কুড়ানী বুড়ির সাথে। শিয়ালকে দেখে বুড়ি বললো, আররে, শিয়ালটার পেট এত মোটা! শিয়াল বললো, পেট মোটা পেট মোটা করিস না, আমি বন্ধুকে খেয়েছি, একটা শাক তোলা ছুড়িকে খেয়েছি; পেট মোটা বললে তোকেও খেয়ে ফেলবো। বুড়ি বললো, ইস বললেই হলো, খেয়ে ফেলবে, খা তো দেখি, পেট মোটা, পেট মোটা শিয়াল। অমনি শিয়ালটা ছুটে যেয়ে খপ করে ধরে বুড়িটাকেও আস্ত গিলে ফেললো।
বুড়িকে খেয়ে শিয়াল আবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় দেখা হলো বর-বউয়ের ছয় বেহারার একটা পালকী আর বরযাত্রীদের সাথে। তারা শিয়ালকে দেখে বললো, দেখ দেখ শিয়ালটার পেট কেমন মোটা! শিয়াল এই কথা শুনে বলে উঠলো, পেট মোটা পেট মোটা বলিস না, আমি বন্ধুকে খেয়েছি, একটা শাক তোলা ছুড়িকে খেয়েছি, এক ঘুঁটে কুড়ানো বুড়িকে খেয়েছি; পেট মোটা পেট মোটা বললে তোদেরকেও খেয়ে ফেলবো। বেহারা ও বরযাত্রীরা সবাই বললো, ইস বললেই হলো, খেয়ে ফেলবে, খা তো দেখি, পেট মোটা শিয়াল। অমনি শিয়ালটা ছুটে যেয়ে খপ খপ করে তাদের সবাইকে পালকী সমেত গিলে ফেললো।
শিয়াল আবারও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর যেয়ে দেখতে পেলো একটা নাদুসনুদুস ছাগল নিজের মনে রাস্তার পাশের তাজা ঘাস খাচ্ছে। তার কাছাকাছি হতেই ছাগলটা শিয়ালকে দেখে বলে উঠলো, ও মাগো, শিয়ালটার পেট কী মোটা গো! শিয়াল এই কথা শুনে বললো, পেট মোটা পেট মোটা বলিস না, আমি বন্ধুকে খেয়েছি, একটা শাক তোলা ছুড়িকে খেয়েছি, এক ঘুঁটে কুড়ানো বুড়িকে খেয়েছি, বরযাত্রী বর-বউ বেহারা সমেত পালকী সব খেয়েছি; পেট মোটা পেট মোটা বললে তোকেও খেয়ে ফেলবো। ছাগল এই কথা শুনে বললো, শিয়াল ভাই, বাড়িতে আমার দুটো ছোট বাচ্চা আছে, তাদের দুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তুমি এখানে থাকো, আমি বাড়ি যেয়ে বাচ্চা দুটোকে দুধ খাইয়ে আসি, তারপর আমাকে খেয়ো। শিয়াল তার এই কথায় রাজি হলো। ছাগল গেলো তার বাচ্চাদের দুধ খাওয়াতে।
বাড়িতে যেয়ে ছাগল তার বাচ্চাদের অনেক আদর করলো, পেট ভরে দুধ খাওয়ালো। তারপর তাদের বললো, সোনামনিরা, তোমরা সাবধানে থেকো, তোমরা এখন কিছুটা বড় হয়েছো, নিজেরা ঘাস খাওয়া শিখেছো। আমি যদি আর ফিরে না আসি মন খারাপ করো না। এরপর সে বাচ্চাদের সব কথা খুলে বললো, আরো বললো সে কী করতে যাচ্ছে। বাচ্চারা খুব মন খারাপ করে তার মাকে বিদায় দিল।
বাড়ি থেকে বের হয়ে ছাগল গেল তাদের গ্রামের এক কামারের বাড়িতে। কামার ভাই, কামার ভাই, বাড়িতে আছো? কামার বাইরে এলে তাকে বললো, কামার ভাই, আমার শিং দুটো ভালো করে ধারালো করে দাও। কেন ধারালো করতে চায় সে কথা জানতে চাইলে ছাগল বললো যে ফিরে এসে সব কথা জানাবে। শিং ধারালো করে নিয়ে ছাগল গেল কলু বাড়ি। সেখানে যেয়ে কলুকে ডাকলো, কলু ভাই কলু ভাই, বাড়িতে আছো? কলু বাইরে এলে তাকে বললো, কলু ভাই আমার শিংয়ে ভালো করে সরষের তেল মাখিয়ে দাও। কেন তেল দিতে চায় তা জানতে চাইলে ছাগল বললো যে ফিরে এসে সব কথা জানাবে। এর পর সেখান থেকে ছাগল গেলো শিয়ালের কাছে।
সারা দিনের পথ চলার ক্লান্তি, তার উপরে বন্ধু বেজি, শাক তোলা মেয়ে, ঘুঁটে কুড়ানো বুড়ি, পালকী বেহারা বর বউ বরযাত্রীদের খেয়ে ভরপেটে শিয়াল ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছাগল এসে তাকে ডাক দিলে আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জেগে ঘুম ঘুম চোখে সে ছাগলের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে তার সব কথা মনে পড়লো, সে তখন ছাগলকে খাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো। তখন ছাগল বললো, শিয়াল ভাই, আমাকে তো খেয়েই ফেলবে, তো মরার আগে আমার একটা শেষ ইচ্ছা আছে। শিয়াল জানতে চাইল, কী ইচ্ছা। ছাগল বললো, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, ঠিক তোমার পেটের নিচ বরাবর যে কচি ঘাস সেগুলো খাওয়ার আমার খুব ইচ্ছে করছে। শিয়াল ভাবলো, এ আর এমন কী? ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।
ছাগল ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল শিয়ালের দিকে, মুখ বাড়িয়ে শিয়ালের পেটের নিচের ঘাস খেতে শুরু করলো। মাথাটা যখন শিয়ালের ঠিক পেটের নিচে গেল, তখনই ছাগল তার ধারালো তেলমাখা শিং দিয়ে শিয়ালের পেটে খুব জোরে দিল এক ধাক্কা। এক ধাক্কাতেই শিয়ালের পেট ফুটো হয়ে গেলো, আর শিয়াল পেলো অক্কা। পেট থেকে বের হয়ে এলো বরযাত্রী বর বউ পালকী বেহারা, ঘুঁটে কুড়ানো বুড়ি, শাক তোলা মেয়ে, আর বন্ধু বেজি। তারা সবাই যে যার পথে চলে গেলো, ছাগল গেলো তার বাচ্চাদের কাছে। আর শিয়ালটা সেখানেই মরে পড়ে থাকলো।