বেওয়ারিশ

‘লোকটার বুক পকেটে একটা রঙ পেন্সিলের বাকশো আছে’-বাচ্চাদের কেউ একজন বলল। ‘তুই মরছ রঙ পেন্সিল লইয়া’-বড়দের কেউ একজন ধমকে উঠে। আরেকজন বলে, ‘আহা, কে করল এমন নিষ্ঠুর কামডা’! মাত্রই দেখে এসে একজন বর্ণনা দিচ্ছে, ‘ফুলহাতা শার্ট ইন করে পরা; পায়ের মোজা দেখে বুঝা যায় সু পরা ছিল। শার্ট আর প্যান্টের পকেট খুইজা এক বাকশো রঙ পেন্সিল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় নি’। ‘বাচ্চা-কাচ্চার জন্য হয়ত কিনছিল রঙ পেন্সিলের বাকশোটা’-নারীদের মধ্যে কেউ বলল।‘পিটাইয়া মারছে লোকটারে; তবে এইখানে মারে নাই; অন্য কোনোখানে মাইরা এইখানে ফালাইয়া গেছে’-একজন বৃদ্ধ বলল। ‘হ, এইখানে মারলে মাটিতে রক্ত থাকত; রক্ত শুকাইয়া লোকটার শার্ট-প্যান্ট একেবারে শক্ত হইয়া গেছে। এইখানে মাটিতে কোনো রক্ত নাই’-আরেকজন সমর্থন করে।

গ্রামের নাম বকুলপুর। বাংলাদেশের চিরচেনা গ্রামগুলোরই একটি। শান্ত-স্নিগ্ধ-ছায়া ঘেরা একটি পরিবেশ বিরাজ করে এখানে। আটটা-নয়টায় এখানে রাতের নীরবতা নেমে আসে। আবার সূর্য উঠার আগেই মানুষের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাখিদের কলকাকলির সাথে খুব ভোরে সূর্য উঠার অনেক আগেই শুরু হয়ে যায় মানব শিশুদেরও কলরব, ছুটাছুটি। আজও ব্যতিক্রম কিছু হওয়ার ছিল না। কিন্তু হঠাৎই সবকিছু কেমন উলটপালট হয়ে যায়। বকুলপুরে আজ সকাল হয়েছে একটা চাপা আতঙ্ক নিয়ে।

প্রথমে শুরু হয় ফিসফিসানি। তারপর আস্তে আস্তে ধাতস্ত হয়ে উঠে যেন তারা। তবে ভয় কাটে না। জনে জনে চলতে থাকে নানা আলোচনা, নানা গুঞ্জন। গ্রামের পাশে রাতের বেলা, কিংবা কে জানে হয়ত খুব ভোরে যখন গ্রামের কেউ জেগে উঠে নি তখন কে বা কারা যেন এখানে একটি মানুষ ফেলে গেছে। জীবিত মানুষ হলে কথা ছিল না। মানুষটা মৃত। একটা রাধাচূড়া গাছের নিচে সটান শুয়ে আছে।

অবারিত সবুজের সমারোহ এই বকুলপুর গ্রামে। একদিকে বিশাল ফসলের মাঠ, যা এই ভাদ্র মাসে পানির নিচে তলিয়ে আছে। আরেক দিকে আছে তুলনামূলক একটু উঁচু মাঠ যেখানে সাধারণত শাক-সব্জি চাষ হয়। স্থানীয় ভাষায় একে চাড়া বলা হয়। খুব বেশি পানি না হলে এখানে পানি উঠে না। এই চাড়া শেষ হয়েছে একটা মহা সড়কে গিয়ে। রাত দিন গাড়িঘোড়া চলে বিরামহীনভাবে। এখানে এই সড়কের পাশেই একটা রাধাচূড়া গাছ। এই গাছের নিচেই পড়ে আছে লেকটি।

বকুলপুর গ্রাম কিংবা তার আশপাশে কোথাও এই রাধাচূড়া গাছ নেই। অনেকে এই গাছের নামও জানে না। গ্রামের মানুষ কিছু একটা জিনিসে রহস্যের গন্ধ পেলেই হল, সেটা নিয়ে নানা গল্প নানা কল্প-কাহিনী গড়ে তুলতে ভালবাসে। এই রাধাচূড়া গাছটি ঠিক এখানে কীকরে জন্মালো তা নিয়েও গ্রামে প্রচলিত আছে নান কাহিনী।তবে কারো মনে না থাকলেও গাছটিতে অতিপ্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার নেই। এখান থেকে দুই আড়াই শ’ গজ দক্ষিণ দিকে এগোলে একটা হাইওয়ে রিসোর্ট এন্ড রেস্টুর‌্যান্টআছে। যখন এই রিসোর্টটি উদ্ভোধন করা হয় তখন তারা রাস্তার দুই পাশে অনেক দূর পর্যন্ত নানা রকম গাছ লাগিয়েছিল। পরবর্তীতে যত্নের অভাবে সেসব গাছ আর বেঁচে না থাকলেও এই রাধাচূড়া গাছটি বেঁচে আছে দিব্যি। এই ভাদ্র মাসে হলুদ আর লালচে ফুলে গাছটি কেমন প্রাণবন্ত হয়ে আছে।

সকাল সকালই পুলিশ চলে আসে ঘটনাস্থলে। কেউ খবর দিয়েছে কিংবা পুলিশ খবর পেয়েই যায়। মহাসড়ক ধরে পুলিশের গাড়ি আসতে দেখেই মানুষ সরে যেতে থাকে। তবে চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ স্থানীয় নেতাগোছের লোকজন একে একে এসে জমা হয়। আস্তে আস্তে সবাই আশ্বস্ত হয় এবষিয়ে আপাতত গ্রামবাসীর ভয়ের কোনো কারণ নেই। ফলে লোকজন আবার জমায়েত হতে থাকে। আশপাশের গ্রামের মানুষও আসতে থাকে।

বেলা যত গড়াতে থাকে ভীড়ও বাড়তে থাকে। পুলিশ সূরতহাল রিপোর্ট আর উপস্থিত কয়েকজনের জবানী নেয়। তারপর লাশ হাসপাতালে নিয়ে যায় ময়না তদন্তের জন্য। কিন্তু রাধাচূড়া গাছকে কেন্দ্র করে এখানে মানুষের জটলা একটুও কমে না; বরং আস্তে আস্তে যেন বাড়তে থাকে। এক সময় জটলার মাঝে গুঞ্জন উঠে এই লাশের কোনো পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না তাই বকুলপুরবাসীকেই বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে এটা দাফন করতে হবে। সন্ধ্যা নাগাদ সত্যি সত্যি সেই লাশ আবার বকুলপুর ফিরে আসে এবং বেওয়ারিশ হিসেবে গ্রামবাসী কর্তৃক বকুলপুর গোরস্তানে দাফন করা হয়। পুলিশ আইনগত সব কার্যক্রম শেষে এই কাজে গ্রামবাসীকে সব রকমের সহায়তা করে।

একটা পুলিশের জীপ বকুলপুর থেকে ফিরে যাচ্ছে। জীপে মানুষ আছে মোট তিনজন। পেছনে আছে একজন কনস্টেবল। সামনে ড্রাইভার আর ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছেএসআই আবদুল বারেক। আবদুল বারেককে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একটা বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে তাকে বেশ ছুটাছুটি করতে হয়েছে আজ। কোথায় যেতে হবে ড্রাইভারকে সেই নির্দেশ দিয়ে হাতের ওয়াকিটকিটা এক পাশে রাখে এসআই আবদুল বারেক। প্যান্টের ডান পকেটে হাত দিয়ে বের করে আনে একটা কম দামী মোবাইল সেট। একটা একটা করে এগারটা ডিজটি চাপে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওপাশের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি সাড়া দিল-‘হ্যালো’।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!