বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশাকরি যে যেখানে আছ ভাল ও সুস্থ আছ। তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছ, আমাদের সমাজে অনেকেই আছে যারা নিজেদের সবজান্তা হিসেবে পরিচয় দিতে খুব মজা পায়। নিজেকে বুদ্ধিমান, চালাক ও শক্তিশালী হিসেবেও তারা অন্যের কাছে তুলে ধরে। এ কাজ করতে গিয়ে তারা চালাকি, প্রতারণা ও মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এসব বুদ্ধি, বিবেকহীন মানুষের অজ্ঞতা ও দুর্বলতা যখন প্রকাশ হয়ে পড়ে তারা লজ্জায় পড়ে যায়। কিন্তু তখন আর করার কিছু থাকে না।
কেবল মানুষের মধ্যেই নয় পশুপাখিদের মধ্যেও এ ধরনের বদগুণ দেখা যায়। আমরা এক ঈগল পাখির বৃথা আস্ফালন নিয়ে একটি গল্প প্রচার করেছি। এরপর ঈগল সম্পর্কে জানা-অজানা কিছু তথ্য। প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।
একটি কাক বাসা বেঁধেছিল পাহাড়ে অবস্থিত এক বাগানের ঠিক মগডালে। পাখিদের একটা সুবিধা হলো উপর থেকে নীচের সবকিছু দেখতে পায়। যে পাখি যত উপরে উড়তে পারবে স্বাভাবিকভাবেই সে ততদূর তার দৃষ্টি মেলে ধরতে পারবে। কিন্তু কতটা সূক্ষ্ম কিংবা ঠিকমত দেখতে পায় সেটা বলা মুশকিল। তবে উপর থেকে অনেক পাখিই নীচের প্রাণী শিকার করে। অনেক পাখি পানির ভেতরে থাকা মাছও শিকার করে। এরকম এক শিকারী পাখি হলো ঈগল। কাক যেখানে বাসা বেঁধেছিল তারই পাশে পাহাড়ের উপরে একেবারে চূড়ায় ছিল একটি ঈগলের বাসা।
ঈগল প্রতিদিনই পাহাড়ের চূড়া থেকে অনেক উপরে উড়ে, একেবারে যেন আকাশের নীলিমায়। কাকের অন্তত তাই মনে হয়। সেও ভাবে, ঈগলের মতো যদি অনেক উপরে উড়তে পারতাম…! বহুবার চেষ্টাও করেছে সে কিন্তু পারেনি। না পারলে কী হবে, চোখের প্রশান্তি মেটাতে সে প্রতিদিনই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ঈগলের উর্ধ্বাকাশ পাড়ি। মনে মনে ভাবে, অত উপর থেকে কী দেখে ঈগল, বিশাল দু’টি ডানা মেলে কী সুখ পায়?
কাক প্রতিদিন ঈগলকে দেখে আর এসব ভাবে। ঈগলও প্রতিদিন আকাশে পাড়ি জমাতে গিয়ে কাকের চেয়ে থাকা টের পায়। কিন্তু কাক তো কাকই, সে তো আর ঈগল নয়। কাকের চেয়ে থাকা দেখে তার কী লাভ। আবার মনে মনে কৌতূহলও জন্ম নেয় কী দ্যাখে কাক আমি উড়ার সময়! কেন দেখে সে আমাকে!
একদিনের ঘটনা। ঈগল সরাসরি উড়াল দিয়ে আকাশের দিকে না গিয়ে নীচের দিকে মেনে এলো। কাক তো অবাক! আরো অবাক হলো ঈগলটা যখন একেবারে কাকের বাসায় এসে হাজির হলো। ভীষণ খুশি হলো কাক। ঈগলের মতো শ্রেষ্ঠ পাখি আজ তার অতিথি, একেবারে তার নিজের ঘরে! খুশিতে সে যে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কাকের অপ্রস্তুত অবস্থার ভেতরেই ঈগল তাকে জিজ্ঞেস করল: অবাক হয়েছো, তাই না?
কাক সে উত্তর না দিয়ে বলল: আমি প্রতিদিন তোমার উড়াল দেওয়া দেখি, খুব ভালো লাগে আমার। কী সুন্দর করে তুমি আকাশে উড়াল দাও…! আমি যদি তোমার মতো এরকম অনেক উপরে উড়তে পারতাম…!
ঈগল যখন দেখল কাক সম্মান দিয়ে কথা বলছে তখন সে খুশি হলো। বলল: এই চিন্তা একদম কর না। আমি হলাম ঈগল আর তুমি হলে কাক। কাক কি আর ঈগলের মতো উড়তে পারে?
কাক বলল: তাতো বটেই। কিন্তু আশা করতে তো দোষ নেই, তাই না! এই যে ইচ্ছা পোষণ করেছি তাতেই আমি খুশি। আচ্ছা! তুমি যে এতো উপরে যাও আমার বাসা, এই গাছপালা কিংবা গাছপালার চারপাশের জমীনকে কী রকম দেখতে পাও?
ঈগল বলতে চেয়েছিল- ঘরবাড়ি, গাছপালা উপর থেকে এতই ছোটো মনে হয় যে, মাঝে মাঝে নজরেই পড়ে না। কিন্তু ঈগল কি আর কাকের কাছে সে কথা বলতে পারে! ছোট হয়ে যাবে না! তাই আসল কথা গোপন করে ফেলল। বলল: “আমি যে কেবল উড়তেই পটু তাই নয়, অনেক দূর পর্যন্ত আমি সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। আমি যে অ্যাতো উপরে যাই সেখান থেকেও চড়ুই পাখির বাসায় পেড়ে রাখা ডিম দেখতে পাই সহজেই। এমনকি মাটিতে পড়ে থাকা ছোট্ট শস্যদানাটিও ভালোভাবে দেখতে পাই, কোনো অসুবিধা হয় না।”
ঈগল যত চমৎকার করেই তার দূরদৃষ্টির বর্ণনা দিক না কেন, কাকের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। সে তাই ঈগলকে জিজ্ঞেস করল: ঠিকাছে, বলতো, ওই যে দূরে, তুমি কী দেখতে পাচ্ছো? ঈগল খুব ভালোভাবে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু সে কথা কাককে বললে কি মানসম্মান থাকে? তাই চালাকি করে সে বলল: ও, ওখানে, ওখানে তো দেখছি কিছু শস্যদানা পড়ে আছে। কাক তার চোখ মেলে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না। ঈগলকে বলল: আমার মন চাচ্ছে বিশ্বাস করি-তুমি যেমন উড়তে পার তেমনি দেখতেও পার অনেক দূর পর্যন্ত। সেজন্যে দেখে আসতে ইচ্ছে করছে, আসলেই শস্যদানা পড়ে আছে কিনা। চল, তোমার সাথে আমিও যাব। আমার সকল শক্তি দিয়ে তোমার পেছনে পেছনে উড়ে যাব।
ঈগল রাজি হলো। একসাথে দু’জনেই উড়াল দিল। কিন্তু কাক তো আর ঈগলের সাথে উড়তে পারে না। তাই সে পেছনে পড়ে গেল। ঈগল ভাবতে লাগল- অ্যাতো দূরের পথে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও গম বা ডাল বুটের দানা দেখতে পাওয়া যাবেই। আর সেখানেই নেমে গিয়ে কাককে বলবে ‘এগুলোই আমি দেখেছিলাম’। ঈগল শস্যদানা খুঁজতে অনেক নীচে নেমে এসে উড়তে লাগল। এই ভেবে উড়তে উড়তে একটু পরেই তার নজরে পড়ল কিছু শস্যদানা। মনের আনন্দে পেছনে দেখে নিল কাক কদ্দুর এসেছে। না, কাক আসলে কাকই, ঈগল তো নয়, অনেক পেছনে পড়ে আছে।
কিন্তু ঈগলের তো এখন দেরি সহ্য হচ্ছে না। সে উপর থেকে সোজা নীচে নেমে আসতে চাইল শস্যদানাগুলোর কাছে। তার আগে আরেকবার কাকটাকে দেখে নিল এবং বোঝানোর চেষ্টা করল সে কোথায় নামতে যাচ্ছে। ঈগল শস্যদানার কাছে যেতে নীচে নেমে আসতেই তার পাগুলো কীসে যেন আটকে গেল। পা ছাড়াতে চেষ্টা করতেই পাখা পালকসহ আরো বেশি জড়িয়ে গেল। ঈগল এবার বুঝতে পারল এই শস্যদানাগুলো শিকারীর আর তারই জালে আটকা পড়েছে সে।
ঈগল এখন চাচ্ছে শিকারী তাড়াতাড়ি এসে তাকে ধরে নিয়ে যাক, তবু কাক যেন এ অবস্থায় তাকে না দেখে। তাহলে লজ্জার সীমা থাকবে না। কাকের কাছে মান সম্মান সব যাবে। কিন্তু শিকারী তো জালে ধারে কাছেও নেই। সে সকালে ফাঁদ পেতে চলে যায় আর বিকেলে কাজ সেরে এসে জাল গুটিয়ে নেয়। এখন কী করবে ঈগল! এসব ভাবতে ভাবতে কাক এসে হাজির।
জালে আটকে পড়া ঈগলকে দেখেই সে আশ্চর্য হয়ে গেল। কাক কী করবে না করবে ভাবছিল। সেই ফাঁকে ঈগল কাককে বলল: দেখ, এই শস্যদানাগুলোর কথাই আমি বলছিলাম। এগুলোই দেখেছিলাম সেই গাছের ডালে, তোমার বাসার পাশে বসে।
কাক তো এতোক্ষণে সব ঘটনা বুঝে ফেলেছে। বুঝে ফেলেছে ঈগলের চালাকি। কাক জবাব দিল: কী অবাক ব্যাপার! তুমি এতো ছোট ছোট দানা কত দূর থেকে দেখতে পেয়েছ অথচ এতো বড় জালটা দেখতে পাওনি?
ঈগল বুঝে ফেলল কাককে অতোটা বোকা মনে করা ঠিক হয় নি, সে সবই বোঝে। তাই এখন নিজের বাহাদুরি ঝেড়ে ফেলে বলল: আমাকে মাফ করে দাও! আমি আসলে মিথ্যে বলেছিলাম তোমাকে। এখন এসব বলার সময় নেই, এখান থেকে কী করে আমাকে ছাড়ানো যায় তুমি সেই চেষ্টা কর তাড়াতাড়ি।
কাক বলল: এটাতো ইঁদুরের কাজ। শিকারী এসে পড়ার আগেই ইঁদুর খুঁজে আনতে হবে। ও খুব সহজেই জাল কেটে তোমাকে মুক্ত করে দিতে পারবে। ইঁদুরের দাঁতগুলো খুবই চিকন এবং ধারালো।
কাটতেও পারে দ্রুত। জালে দাঁত লাগাবে আর তুমি ছুটে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু ইঁদুরের খোঁজ যদি না পাই, তাহলে কী হবে কে জানে……! ঈগল বলল: সময় নষ্ট কর না। তাড়াতাড়ি যাও….
শিশু-কিশোর বন্ধুরা! তোমাদের কী ধারণা! কাকের কথা ইঁদুর বিশ্বাস করবে তো? কারণ কাক আর ইঁদুরের মধ্যে শত্রুতা চিরদিনের। তাই কাকের কথায় ইঁদুর যদি না আসে তাহলে ঈগল কোনোভাবেই জাল থেকে বের হতে পারবে না।
বন্ধুরা, এই গল্পে চালাক ঈগলের বিপদের কথা জানলে। এবার আমরা ঈগল পাখি সম্পর্কে কিছু জানা অজানা তথ্য তোমাদের জানাব। ঈগল এক ধরনের বড়, শক্তিধর ও দক্ষ শিকারি পাখি। এরা সাধারণত বনে বা ঘন জঙ্গলে বসবাস করে। বানর, ছোট জাতের পাখি, টিকটিকি, হাস-মুরগী খেয়ে জীবনধারণ করে তারা। একটি পূর্ণবয়স্ক ঈগলের ওজন প্রায় ৩০ কেজি এবং লম্বায় প্রায় ৩০-৩৫ ইঞ্চি হয়ে থাকে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- একটি পূর্ণবয়স্ক সুস্থ ঈগল ১১ হাজার ফুট উপরে উঠতে পারে।
শীতকালে এরা তুলনামূলক কম শীতের এলাকায় চলে যায়। যেসব এলাকায় মানুষজন নেই, সেসব এলাকায় কমপক্ষে ১০০ ফুট উপরে বাসা তৈরি করে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে বসবাস করে। জীবন রক্ষার জন্য ঈগলের বড় হাতিয়ার তাদের পায়ের নখ। নখগুলো এতই তীক্ষ্ণ যে নিমিষের মধ্যে শিকারকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ঈগল পাখি খুব সহজেই একটি হরিণ শাবক মেরে ফেলতে পারে। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে সেই শাবকটিকে নখের মাধ্যমে আঁকড়ে ধরে উড়তেও পারে।
বাংলাদেশে একসময় সাদা বুকের সমুদ্র ঈগল, কুড়া বা পলাশ মেছো ঈগল, কুল্লে বা সাপখেকো ঝুঁটি ঈগল এবং ছোটনখের ঈগল দেখা যেত, কিন্তু বর্তমানে তারা বিলুপ্তির পথে।