মাইসাং চৌধুরির বয়স তখন প্রায় সত্তর। এসব কথা আমি আমার বাপঠাকুর্দার কাছে শুনেছি। সত্যমিথ্যা বলতে পারব না। বলে যামিনীরঞ্জন চুপ করে রইল।
তারপর? আমি ততক্ষণে গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছি। কিছুটা আঁচও করতে পারছি। দীর্ঘদিন গল্প লিখলে এ ধরণের ক্ষমতা জন্মায়।
তারপর মানে … ইয়ে আর কী …মাইসাং চৌধুরি নাকি উদ্ভিন্ন যৌবনা অমঙ্গলীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন । ওই বয়েসে … মানে বুঝতেই পারছেন … পথের কাঁটা দূরকরতে মাইসাং চৌধুরি পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন।
কথাটা শুনে আমার ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। এটাই তাহলে গল্পের ক্লাইমেক্স? বেশ কমন প্লট।
যামিনীরঞ্জন বলল, যামিনীরঞ্জন নামে মাইসাং চৌধুরির এক পোষা গুপ্তঘাতক ছিল।
যামিনীরঞ্জন? আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম।
হ্যাঁ। যামিনীরঞ্জন। বলে লোকটা মাথা নাড়ল।
আপনার … আপনার নামও তো যামিনীরঞ্জন। বলে লোকটার আঙুলের প্রবালের দিকে তাকালাম।
যামিনীরঞ্জন হাসল। আহা, জগতে কত লোকের নামই তো যামিনীরঞ্জন। আহ্, শোনেন না তারপর কী হল। কার্তিক মাসের এক শীতের রাত। যামিনীরঞ্জন ধারালো বার্মিজ কিরিচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঘুমন্ত থিরিথুধম্মার ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। তারপর বিভৎস মৃতদেহটা মাইসাং ভিলার পিছনে বাঁশবনে ফেলে রাখে । পাহাড়ি শেয়ালরা তার ক্ষতবিক্ষত শরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। বলতে বলতে কেমন ফুঁসে ওঠে লোকটা। মুখচোখ কেমন কুঁচকে গেছে।
আমি চমকে উঠলাম । আপনি … আপনি এসব জানলেন কি করে?
যামিনীরঞ্জন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, আহা, তখন আমি বললাম কী। বললাম না আমি এসব বাপঠাকুর্দার মুখে শুনেছি। সত্যিমিথ্যা জানি না।
আমি চুপ করে থাকি। ক্লাইমেক্সটা হঠাৎ করেই বিভৎস রূপ নেয়াতে অস্বস্তি বোধ করতে থাকি।
যামিনীরঞ্জন বলল, কার্তিক মাসেরসাত তারিখ রাতে যামিনীরঞ্জন থিরিথুধম্মা কে খুন করে । ওদিকে কী হল শুনুন। অমঙ্গলী থিরিথুধম্মার সাধনসঙ্গিণী ছিল বটে, তবে থিরিথুধম্মার মৃত্যুর পর অমঙ্গলী বৃদ্ধ চৌধুরির মনোরঞ্জনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু, কী এক অজ্ঞাত কারণে থিরিথুধম্মার মৃত্যুর এক বছর পরই ওই কার্তিক মাসেরই সাত তারিখ রাতে ধারালো বার্মিজ কিরিচ দিয়ে হাতের শিরা কেটে অমঙ্গলী আত্মহত্যা করে।
ওহ্। বেশ গোছানো প্লট। আমি গল্প লিখে আনন্দ পাই, আর যামিনীরঞ্জন গল্প বলে আনন্দ পায়। এ ধরণের কল্পনাপ্রবণ মানুষ আমি এর আগেও ঢের দেখেছি।
যামিনীরঞ্জন বলে চলেছে, অমঙ্গলীর আত্মহত্যার পর মাইসাং চৌধুরি নাকি উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। মাইসাং ভিলার পিছনে বাঁশবনে আনারস ক্ষেতে মূল্যবান রত্নপাথর ছড়াতেন। পাহাড়ি শিয়ালের ডাক শুনলে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্দুক দিয়ে গুলি ছুঁড়তেন। অমঙ্গলীর আত্মহত্যার ঠিক এক বছর পর কার্তিক মাসের সাত তারিখ রাতে একটি ছায়ামূর্তি ঘুমন্ত মাইসাং চৌধুরি বুকে বার্মিজ কিরিচ ঢুকিয়ে খুন করে। বলে চুপ করে রইল। আমি চেঙ্গী নদীর জলের শব্দ শুনছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলব কিনা ভাবছি।
একটু পর নিরবতা ভেঙে যামিনীরঞ্জন বলল, মাইসাং চৌধুরি, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী… এরা তিনজন আজও কার্তিক মাসের সাত তারিখ রাতে মাইসাং ভিলায় ফিরে আসে।
কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম না। কারণ এই কথাটা বিশ্বাসযোগ্য না।মৃত ব্যাক্তির ফিরে আসা ভৌতিক কাহিনীর খুবই একটা কমন প্লট। যা একুশ শতকের লেখকেরা এড়িয়েই যান।তবে ক্যামেরার কাজ ভালো হলে এ ধরনে হরর ফিলম বেশ উপভোগ্যই হয়।
যামিনীরঞ্জন উঠে দাঁড়াল। গায়ে ভালো করে চাদর জড়িয়ে বলল, আজ কার্তিক মাসের সাত তারিখ। আজ মধ্যরাতে মাইসাং চৌধুরি, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী মাইসাং ভিলায় জাগ্রত হবে। আপনি আজই এখান থেকে চলে যান। নইলে বিপদে পড়বেন । বলে লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলেন। একটু পর কুয়াশায়মিলিয়ে গেল।
আমি পাথরের বসে থাকি। মনের মধ্যে ক্ষীণ অস্বস্তি পাক খাচ্ছে। মাঝ্যাং বিহারে যাওযার ইচ্ছে ছিল। মনটা দূষিত হয়ে যাওয়ায় আজ আর মাঝ্যাং বিহারে যাব না ঠিক করলাম। মনের মধ্যে অস্থিরতা নিয়ে মাইসাং ভিলায় ফিরে এলাম।
বাথরুম থেকে ফিরে একটা সিগারেট ধরালাম। তারপর দোতলায় বারান্দায় বসলাম। আটটার মতন বাজে। কার্তিক সকালের টলটলে রোদ। বাতাসে সূর্যমূখি ফুলের গন্ধ। য়ংদ্দ চা নিয়ে এল। তাকে কেমন গম্ভীর দেখালো। তার হলদে মুখটি কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। কী যেন বলতে চায়। যামিনীরঞ্জন আজ যে গল্পটা বলল তা কি য়ংদ্দ জানে? য়ংদ্দ কদ্দিন ধরে মাইসাং ভিলা তে আছে?
সকাল বেলাটায় লিখে কাটল। মহাকাশের দূরতম এক সৌরজগতের এক গ্রহে পৃথিবীর নভোচারীরা অবতরণ করেছে। এদের মধ্যে বাঙালি নভোচারী সায়েম হকও রয়েছে । গ্রহটির একটি ডিজিটাল নাম দিয়েছি। এক্সটিএক্স-থ্রি।এই অবধি লিখেছি। কাহিনীতে এখনও ক্লাইমেক্স আনতে পারছি না। ক্লাইমেক্স ছাড়া গল্প জমবে না। লিখতে- লিখতে যামিনীরঞ্জনের গল্পটা কখন ভুলে গেছি …
দুপুরে খেতে বসে দেখি য়ংদ্দ ছোট ছোট পাহাড়ি আলু দিয়ে বনমোরগের মাংস রেঁধেছে । ঝাল ঝাল স্বাদ । লালচে ধোওয়া ওঠা জুমভাতের সঙ্গে মাখিয়ে খেতে ভালোই লাগছিল। বুনো জলপাইয়ের আচার ভাতের আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
লেখায় বিষম ঘোর লেগেছিল। লিখে- লিখেই দুপুর আর বিকেলটা কেটে গেল। সন্ধ্যার ঠিক আগে-আগে আজকের মতো লেখা শেষ করলাম। নীচের বাগানের সূর্যমূখীর ঝাড় খুব টানছিল। ভাবছি নীচে নেমে একবার বাগানে যাব কিনা। ঠিক তখনই চা নিয়ে এল য়ংদ্দ । একটা সিগারেট ধরালাম। য়ংদ্দ কী এক বুনোপাতা মিশিয়েছে চায়ে; লেবু -লেবু স্বাদ। আশ্চর্য! দুধ চায়ে কেমন লেবু-লেবু স্বাদ! বেশ লাগছিল কিন্তু চুমুক দিতে। দুধটাও টকে যায়নি।
সন্ধ্যার পর টলটলে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়ল । বেশ কুয়াশা ছড়িয়েছে। আমি সাধারণত সন্ধ্যার পর লিখি না। তাছাড়া মাইসাং ভিলায় ইলেকট্রিসিটিও নেই। বারান্দায় শীত করছিল। ঘরে এসে গায়ে চাদর জড়িয়ে একটা ইজিচেয়ারে বসেছি। য়ংদ্দ কূপি জ্বালিয়ে এনে টেবিলের ওপর রাখল। সন্ধ্যার পর মশা তাড়ানোর জন্য ধূপও জ্বালায় । এদিকটায় মশার ভীষণ উৎপাত। দক্ষিণ এশিয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। অবশ্য ঢাকা থেকে প্রয়োজনীয় ঔষুধপত্র সবই এনেছি।