ধূপের মালসাটি বিছানার কোণে রেখে য়ংদ্দ এসে আমার সামনে দাঁড়াল। কী যেন বলতে চায় মনে হল।আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কিছু বলবে?
য়ংদ্দ চুপ করে মাথা নীচু করে রইল। তারপর বলল, আপনি আজ এইখান থেইকে চইলে যান বাবু।
চলে যাব। কেন? আমি অবাক।
য়ংদ্দ ইতস্তত করে। তারপর বলল, আপনে এইখান থেইকে এখনি চইলে যান বাবু।
কী বলছ তুমি।মৃদু ধমক দিলাম লোকটাকে। আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। ধমক খেয়েও লোকটা ভড়কে গেল না। বরং বলল, নাইলে বিপদে পড়িবেন।
আমি য়ংদ্দর ওপর বিরক্ত হলাম। কী কারণে চলে যাব সেটাই তো বলছে না।ও স্থানীয় কুসংস্কারগ্রস্থ মানুষ। ওর কথায় আমি যাব কেন? আমার কেমন জেদ চেপে যায়। আজ ভোরে যামিনীরঞ্জন বলল, আজ কার্তিক মাসের সাত তারিখ। আজ রাতে মাইসাং ভিলায় মাইসাং চৌধুরি, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী জাগ্রত হবে। আপনি ভিলা থেকে চলে যান। আশ্চর্য! য়ংদ্দও আমাকে চলে যেতেবলছে। ভাবলাম এদের কথায় এখন ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে ফিয়াট পালিওসটা চালিয়ে সিধে কমলছড়ি থেকে ঢাকায় চলে গেলে ব্যাপারটা হাস্যকর দেখাবে না ?
ভোরে উঠে হাঁটাহাঁটি করি বলে আমি সাধারণত রাত দশটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি। তার আগে বিছানায় শুয়ে লেখাটায় একবার চোখবুলাই । মাথার কাছে টেবিলের ওপর কুপি জ্বলেছিল। ম্লান আলোয় পড়ছি। হাতে একটা বল পয়েন্ট। নতুন আইডিয়া এলে লিখে রাখি। এলোমেলো ভাবে লিখছি …,
এক্সটিএক্স-থ্রি গ্রহেরই অন্য একটি অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত উন্নত সভ্যতার আরেকটি নভোচারীর দল অবতরণ করবে। লৌহযুগে। ওদেরও স্মৃতি থাকবে এক্সটিএক্স-থ্রিবাসীর মনে । লিখিত ভাষার আবিস্কার পর তারা স্মৃতিকথা লিখে রাখবে। পরবর্তীতে এক্সটিএক্স-থ্রি গ্রহে উন্নত সভ্যতার বিকাশ হয়। আমাদের স্মৃতিকথাই একমাত্র সত্য- এই দাবিতে এক্সটিএক্স-থ্রিবাসী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে … লেখাটায় টেকনিক্যাল তেমন কিছু নেই। মহাকাশের দূরতম এক সৌরজগতের একটি গ্রহে ঘটনা ঘটছে বলেই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। এক্সটিএক্স-থ্রি গ্রহের সভ্যতার অগ্রগতি … সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিবর্তন … বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক উন্নতি … আণবিক শক্তির আবিস্কার…স্মৃতিকথা নিয়ে বিভেদ …
দরজার কাছে খুট করে শব্দ হল। মুখতুলে তাকালাম। ঘরের মধ্যে তিনটেআবছা ছায়ামূর্তি আমার দিকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। এর আগে এদের কখনও দেখিনি তা সত্ত্বেও মাইসাংচৌধুরি, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলীকে চিনতে পারলাম। … আমি জানি ওরা মিথ্যে। ছায়া। মরিচিকা। যামিনীরঞ্জনের গল্প থেকে উঠে এসেছে। এই মুহূর্তে আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কে যেন মাথার ভিতর থেকে বলল …
সোয়েব পালাও। ঘরে গিয়ে গাড়ির চাবি নাও। নীচে ফিয়াট পালিওসটা যাও দেরি করো না
…আমি উঠে দাঁড়ালাম। তারপর দাঁড়িয়ে থাকলাম। মাইসাং চৌধুরি থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আমি দাঁড়িয়েই থাকলাম। ভীষণ ঘামছি। তৃষ্ণা টের পেলাম। য়ংদ্দ ! বলে আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার গলায় স্বর ফুটল না।
আমার ঘুম ভেঙে গেল …
ঘরে অন্ধকার। কূপি কখন নিভে গেছে। জানালার কাছে জ্যোস্নার আলো। বাতাসে হালকা ধূপের গন্ধ। এখন ক’টা বাজে? টেবিলের ওপর হাতঘড়িটা আছে । আন্দাজে হাত বাড়ালাম। তিনটে বাজতে দশ মিনিট।লেখাটা পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। টেবিলের ওপর একটা জগ আর গ্লাস। অসম্ভব তৃষ্ণা পেয়েছে। পানি খেলাম।
আজ রাতে আর ঘুম হবে না। গায়ে চাদর ধরিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। আকাশে পূর্ণিমার ধবধবে সাদা আলোয় কুয়াশার মিশেল । বেশ শীতও করছি। ভিলার পিছনে ঘন বাঁশঝাড়ের দিক থেকে পাহাড়ি শেয়াল ডাক ভেসে এল। ডাকে শরীরের রক্ত জমে যায়। ভালো করে তাকিয়ে নীচে য়ংদ্দ কে দেখলাম। আশ্চর্য! এত রাতে য়ংদ্দওখানে কি করছে? য়ংদ্দর ঠিক পাশে যামিনীরঞ্জন দাঁড়িয়ে । আমি চমকেউঠলাম। লোকটা য়ংদ্দ কে কী যেন বলছিল। কিন্তু, ওখানে … ওখানে যামিনী রঞ্জন কেন? কুয়াশায় কী যেন নড়ছিল। ভালো করে চেয়ে দেখি বুনো শেয়াল। একটি-দুটি নয- অজস্র। গুণে শেষ করা যাবে না। আমি সিগারেটে টান দিতে ভুলে গেছি। কুয়াশা ফুঁড়ে তিনটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। আমি চমকেউঠলাম। আমার হাত থেকে সিগারেট খসে পড়ল। এদের আমি এর আগে কখনও দেখিনি। তবে মাইসাং থংজা, থিরিথুধম্মা আর অমঙ্গলী কে চিনতে ভুল হল না। অমঙ্গলী মুখ তুলে ওপরে তাকালো। আমাকে দেখছে?আমি আর ওই দৃশ্য এই মুহূর্তে মায়াছায়া মিথ্যে মরিচিকা ভাবতে পারলাম না । আমি জানি এবার আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে না। আমি তিনটি প্রেত দেখতে পাচ্ছি। যারাঅনেক অনেক দিন আগে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মরে গিয়েছিল। ঠিক তখুনি আমার মাথার ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল …
সোয়েব! পালাও। ঘরে গিয়ে গাড়ির চাবি নাও। তারপর নীচে নেমে যাও। দেরি করো না। যাও। আমি ঘরে চলে এলাম। টেবিলের ওপর গাড়ির চাবি নেই। আমার বুক ধক করে উঠল…কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। কারা যেন উঠে আসছে। আমার পা আটকেআছে। দরজার ওপাশে বুনো শেয়ালরা ভয়ানক গর্জন । আমার চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এল ….
আমার চোখেমুখে গরম লাগছিল টের পেলাম । চোখ খুলে একটা গাছ দেখতেপেলাম । ডালপালার ফাঁকে সূর্যেরআলো। গাছটা কৃষ্ণচূড়া বলে মনে হল। কাকপাখিরা সব ডাকছিল। টের পেলাম মাঝ্যাং বিহারের ঠান্ডা চাতালের ওপর শুয়ে আছি।
আমি এখানে এলাম কী করে? আমার পাশে লাল রঙের চীবর পরা সেই বৃদ্ধ ভিক্ষু বসে আছেন। বৃদ্ধেরপাশে একটি তামার পাত্র। তাতে টলটলে পানি। পানিতে কয়েকটি পদ্মপাপড়ি। বৃদ্ধ ভিক্ষু আমার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলেন। কীঠান্ডা সুগন্ধী পানি। হৃদয়ে গভীর প্রশান্তি অনুভব করলাম …