গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
আধঘণ্টা পরে ছেলেটি ফিরে এল দু’বগলে দুটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে। তাই দেখে মিঃ অগাস্টাস ভাবলেন, বুড়ী বোধহয় তাকে বাড়িতে পেয়ে ভোজের আয়োজন করছে। বুড়ী তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল, “সবুর করো সায়েব ! কি করি তাই দেখো। গরীব মানুষ আমি ভোজ তোমাকে দেবো না,-ভোজ দেবো কুমীরকে।
এই বলে একটা ছাগলের বাচ্চা কেটে সে নাড়ীভুড়ি সব বের করে ফেলল। ঘর থেকে নিয়ে এল থলে বোঝাই সাদা খড়িমাটির মতো কি একটা জিনিস। সেগুলো সব ছাগলের পেটে বোঝাই করে সেলাই করে ফেলল। তারপর সাহেবের কোলে বাচ্চা দুটো দিয়ে বলল, “চলো তোমার কুমীর কোথায় আছে দেখি গে।
নদীর পাড়ে গিয়ে বুড়ী সাহেবকে লুকিয়ে রাখল একটা ঝোপের আড়ালে। মরা ছাগলটা নিজের কোলে লুকিয়ে রেখে জ্যান্তটাকে বেঁধে রেখে এল নদীর কিনারে জলের ধারে। বুড়ী উঠে আসতেই জ্যান্ত ছাগলটা ভয়ে ভ্যা-ভ্যা করতে লাগল। বুড়ীর সেদিকে খেয়াল নেই। মরা ছাগলটা কোলে নিয়ে সে পাড়ে উঠে বসেছে। বসে বসে মাথা নীচু করে ঘুমের ভান করছে। জ্যান্ত ছাগলটার ভ্যা-ভ্যা চীৎকার তখন আরো বেড়ে গেছে। এমনিভাবে কেটে গেল প্রায় ঘণ্টাথানেক! সাহেব ঝোপের আড়ালে চুপটি করে বসে বিষ পিঁপড়ের কামড় উপভোগ করছেন। মরা ছাগল কোলে বুড়ী আরামে ঝিমুচ্ছে। ভীত ছাগলছানা প্রাণপণ চীৎকার করছে-ভ্যা-ভ্যা-ভ্যা ।
কোথাও কিছু নেই-হঠাৎ নদীর এক জায়গায় দেখা দিল ছোট ছোট ঢেউ। একটু পরেই একেবারে পাড়ের কাছে নিঃশব্দে জেগে উঠল গাছের একটা প্রকাণ্ড গুড়ির মতো সেই কুমীরটি। অতি ধীরে ধীরে ডাঙ্গায় উঠে সে ছাগলের দিকে এগোতে লাগল। তাই দেখে বুড়ীর যেন হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি একটা গাছের ভাঙ্গা ভাল হাতে নিয়ে সে চীৎকার করতে করতে কুমীরকে তাড়া করে গেল। কুমীরটাও এক সেকেণ্ডে নদীতে পড়ে টুপ্ করে ডুবে গেল।
বুড়ী তখন জ্যান্ত ছাগলটা খুলে দিয়ে তার পরিবর্তে মরাটাকে ঠাকনা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে এল জলের ধারে। তারপর জ্যান্তটাকে নিয়ে এসে বসল তার আগের জায়গায়। বসে বসে বাচ্চাটাকে খোঁচাতে লাগল। বিরক্ত হয়ে বাচ্চাটাও আবার সেই একটানা চীৎকার জুড়ে দিল।
আশেপাশে কোথাও কিছুর শব্দ নেই, কিন্তু বিরাম নেই সেই ছাগলের চীৎকারের। তারপর সহসা আবার সেই পরিচিত শব্দ-ভো-ও-ওস্! কুমীর মশাই আবার মাথা তুলেছেন।
এদিকে বুড়ীও মাথা নীচু করে ঝিমুতে শুরু করেছে-ছাগলছানা করছে চীৎকার। অনেকক্ষণ ধরে তাই লক্ষ্য করে কুমীরভায়া এক লাফে উঠে মড়া ছাগলটি কামড়ে ধরল। ধরেই ঝাপিয়ে গিয়ে পড়ল নদীতে। আর তাকে পায় কে!
এবার সত্যিই বুড়ীর ঘুম ভাঙল ঝটপট সে উঠে দাঁড়াল লাঠিহাতে খুনখুনে বুড়ী এবার ধাই ধাই করে নাচতে লাগল; ব্যাপার দেখে সাহেব তো অবাক। ঝোপ থেকে তিনিও বেরিয়ে এলেন হাসতে হাসতে। আসল ব্যাপারটার কিছুই কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি।
হঠাৎ নদীতে যেন ঝড় উঠল। সারাটা নদীর জল তোলপাড় হয়ে উঠল। পিঠের কাঁটাগুলো জাগিয়ে কুমীরটা তীরের মতো ছুটে চলল। একবার ওদিকে ছুটে যায় আবার তেমনি বেগে উলটো দিকে ছুটে আসে। সেই ভীষণ ছুটোছুটির আর যেন বিরাম নেই। মিনিটের পর মিনিট কাটে, ছুটোছুটি বেড়েই চলে। তারপর নদীর জলে টিকতে না পেরে বেচারা উঠল এসে ডাঙ্গায়৷ উঠেই মাটিতে মাথা আছড়াতে লাগল।
গায়ের লোকজন অনেকে এসে তখন নদীর পাড়ে জড়ো হয়েছে। তারা সব চীৎকার করে উঠল। চারদিক থেকে শিলাবৃষ্টির মতো ইটপাটকেল পড়তে লাগল। তাদের অসহ্য উৎপাতে তিষ্ঠোতে না পেরে আবার গড়াতে গড়াতে কুমীর গিয়ে পড়লে নদীতে। নদীতে পড়েও চিৎপাত হয়ে সেই অস্থির সাতার। কিছুক্ষণ সাঁতারের পরেই আবার উঠে এল ডাঙ্গায়।
শুরু হল গ্রাম্য মেয়ে-পুরুষের মিলিত চীৎকার আর সঙ্গে সঙ্গে অবিরাম ঢিলপাটকেল। এবার কুমীরের আর হুশ নেই। মরার মতো পড়ে সে হাঁপাতে লাগল। বিশাল চোয়ালের দু’কুল বেয়ে ঝলকে ঝলকে বেরোতে লাগল ফেনিল রক্ত!
বিরাটকায় এ জীবটির মরণযন্ত্রণা সাহেবের আর সহ্য হচ্ছিল না। তাড়াতাড়ি তিনি বন্দুক ওঠালেন। ঘোড়া টিপবার আগেই বুড়ী তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে বলে উঠল, মরাকে মারতে পারে সবাই। সবুর করো সায়েব, মরতে কি কষ্ট ওকে বুঝতে দাও।
তার কথায় এবার কান না দিয়ে মিঃ অগাস্টাস কুমীরের ঘাড়ের কাছে একটি গুলি করেই তার ভবযন্ত্রণার অবসান করে দিলেন। তারপর আসল ব্যাপারটা জানতে চাইলেন বুড়ীর কাছে। বুড়ী আবার ফোঁকলা দাঁতে এক গাল হেসে বলল, চুন, সাহেব, চুন-পান খাবার পাথরচুন। ঘরে খানিকটা পাথরচুন ছিল তাই রক্ষে। বলি নিজের চক্ষেই দেখলে তো তোমার ঐ বন্দুকের চেয়ে আমার পাথরচুনের তেজ কতো বেশী!”
বিস্ময়ে অবাক হয়ে মিঃ অগাস্টাস সোমারভাইল চেয়ে রইলেন বুড়ীর মুখের দিকে। আমাদের বাংলাদেশের অশিক্ষিতা গেঁয়ে এক বুড়ীর বুদ্ধির কাছে তাকে কিনা মাথা নত করতে হল!
বাকি জীবনে এ ব্যাপারটা তিনি ভুলতে পারেননি। দেশে গিয়েও অনেক বন্ধুর কাছে তিনি গল্প করেছেন। তারপর বিলেতী এক পত্রিকায় আগাগোড়া কাহিনীটা তিনি প্রকাশ করে গেছেন।
গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।