বুড়ি ও ব্যবসায়ীর গল্প

এক বৃদ্ধা মহিলার গল্প। তাঁর ছিল দুটি ছেলে সন্তান। এক ছেলে ছিল গ্রামের মাতবর বা নেতা গোছের। আরেক সন্তানও ছিল বেশ লেখাপড়া জানা। শিক্ষিত এই ছেলের নাম ছিল বাহলুল। এক রাতে এক ব্যবসায়ী এসে বৃদ্ধার ঘরের দরজার কড়া নাড়ল। বৃদ্ধা দরজা খুলে দিল। ব্যবসায়ী বৃদ্ধাকে বলল, ‘আমাকে তোমার ঘরে থাকতে দেবে? রাত হয়ে গেছে, থাকার মতো কোনো জায়গাও নেই।’ বৃদ্ধা ব্যবসায়ীর অনুরোধ রাখল, তাকে ঘরে থাকতে অনুমতি দিল। একটু পরে ব্যবসায়ী বৃদ্ধাকে বলল, ‘রাতের খাবার তো খাইনি, খাবারদাবার কিছু আছে নাকি? থাকলে দাও, খাবো।’ বৃদ্ধা বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। অন্তত দশটা মুরগির ডিম আছে ঘরে।’ ব্যবসায়ী বলল, ‘তাই নাকি? এক কাজ করো, তোমার যদি কোনো সমস্যা না হয়, তাহলে ডিমগুলো সব আমার জন্য ভাজি করো।’

বৃদ্ধা ব্যবসায়ীর কথামতো দশটা ডিমই ভাজি করে নিয়ে এসে দস্তরখানে খেতে দিল। ব্যবসায়ী ডিমগুলো খেয়ে বলল, ‘দাম কত হলো?’ বৃদ্ধা জবাব দিল, ‘দশটা ডিমের দাম এক রিয়াল আর একটা রুটির দাম হলো অর্ধ রিয়াল। সব মিলিয়ে দাম হয়েছে দেড় রিয়াল।’ ব্যবসায়ী বলল, ‘ঠিক আছে, যাবার সময় তোমার টাকা হিসেব করে দিয়ে যাবো।’ সকালবেলা বৃদ্ধা ব্যবসায়ী লোকটার আগেভাগেই ঘুম থেকে জেগে মরু প্রান্তের দিকে গেল। ব্যবসায়ী লোকটার যখন ঘুম ভাঙল, দেখল বুড়ি ঘরে নেই। মনে মনে বলল, ‘পরের বছর যখন এখানে আবার আসব, তখন বুড়ির টাকা মুনাফাসহ একসাথে দিয়ে দেব।’ এই বলে ব্যবসায়ী রওনা হয়ে গেল।

সত্যি সত্যিই পরের বছর ব্যবসায়ী বুড়ির ঘরে ফিরে গেল এবং বলল, ‘হে বৃদ্ধা! গত বছর তুমি ঘরে ছিলে না, সেজন্য আমি তোমার ডিম-রুটির দাম পরিশোধ করতে পারিনি। এখন তোমাকে আমি দেড় রিয়ালের পরিবর্তে দশ রিয়াল দেব।’ বুড়ি দশ রিয়াল নিয়ে খুশিতে প্রতিবেশীর কাছে গেল এবং সকল ঘটনা খুলে বলল। প্রতিবেশী বুড়ির সব কথা শুনে বলল, ‘ওমা! ব্যবসায়ী লোকটা তো তোমাকে অনেক ঠকিয়েছে। ঐ দশটা ডিম যদি তুমি মুরগির পাখার নিচে তা দিতে, তাহলে দশটি বাচ্চা ফুটত। এক বছরে ঐ বাচ্চাগুলো বড় হতো। সেগুলো আবার ডিম দিত। ভাবতে পারো, তোমার কী পরিমাণ লাভ হতো? আর এখন তুমি মাত্র দশ রিয়াল পেলে! এটা কোনো টাকা হলো! তুমি এক কাজ করো, এখানে সময় নষ্ট না করে তোমার মাতবর ছেলের কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বলো।’

বুড়ি তাই করল। তাড়াতাড়ি ছেলের কাছে গিয়ে ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। মায়ের কথা শুনে ছেলে রেগেমেগে ব্যবসায়ীকে আটক করে কারাগারে বন্দী করে রাখল। বুড়ির অপর ছেলে, শিক্ষিত ও ন্যায়বিচারক বাহলুল, কোনো এক কাজে তার ভাইয়ের ঐ কারাগার পরিদর্শনে গেল। সেখানে গিয়ে ব্যবসায়ীকে আটক দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আবার কী অন্যায় করেছ যে এই কারাগারে তোমাকে আটকে রাখা হয়েছে?’ ব্যবসায়ী লোকটা পুরো ঘটনা বাহলুলকে খুলে বলল। ব্যবসায়ী লোকটা যখন বৃদ্ধা মহিলার নাম-ঠিকানা বলল, তখনই বাহলুল বুঝতে পেরেছিল, ঐ মহিলা তাদেরই বৃদ্ধা মা। তাই বাহলুল ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বৃদ্ধা মহিলা যেই দশটা ডিম তোমাকে দিয়েছিল, সেই ডিমগুলো কি রান্না করা ছিল নাকি কাঁচা, অর্থাৎ রান্না না করা ছিল?’

ব্যবসায়ী লোকটা বলল, ‘ডিমগুলো সব পাক করা ছিল। আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তাই রান্না করা সেই ডিমগুলো রুটিসহ আমাকে খেতে দেওয়া হয়েছিল।’ বাহলুল ব্যবসায়ীকে বলল, ‘তোমার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি এই মর্মে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো যে তুমি অবশ্যই মুক্তি পাবে।’ এই বলে বাহলুল সোজা চলে গেল তার মাতবর ভাইয়ের কাছে। গিয়ে ভাইকে বলল, ‘আমাকে এক বস্তা গম দাও তো, গমের চাষ করব।’ মাতবর ভাই খুশি হয়ে বলল, ‘তুমি গমের চাষ করতে চাও, খুব ভালো। তোমাকে এক বস্তা না, দুই বস্তা গম দিচ্ছি, যাও চাষ কর।’ বাহলুল দুই বস্তা গম নিয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে। বাড়িতে গিয়ে মাকে বলল, ‘আমাকে বড় বড় দুইটা পাতিল দাও তো!’ মা জিজ্ঞেস করল, ‘বড় পাতিল দিয়ে কী করবে?’ বাহলুল বলল, ‘কাজ আছে! দুই বস্তা গম এনেছি, গমের চাষ করব। সেজন্য ভাবছি, এগুলো ভালো করে সিদ্ধ করে জমিতে লাগাব। সিদ্ধ করা গমের চারা অনেক বেশি সবুজ হবে।’

এই বলে বাহলুল বড় বড় দুইটা পাতিল চুলার ওপরে বসিয়ে দিল। পাতিলে পানি দিল, গমও ঢালল। গণগণে আগুনে সিদ্ধ হতে লাগল গম। মা এই দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি মাতবর ছেলের কাছে চলে গেল। ছেলেকে বলল, ‘তোমার ভাই তো সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। দুই বস্তা গম সিদ্ধ করছে চাষ করার জন্য, বলছে ওগুলো জমিতে লাগালে নাকি অনেক বেশি সবুজ হবে।’ আজগুবি সব কথা শুনে বৃদ্ধার মাতবর ছেলে ভাইয়ের কাছে গেল। ভাইকে বলল, ‘কী করছ তুমি এসব? সিদ্ধ গমের আবার চারা হয় নাকি!’ বাহলুল জবাবে বলল, ‘কেন হবে না? রান্না করা দশটা ডিম থেকে যদি মুরগির বাচ্চা হতে পারে, তাহলে সিদ্ধ গম থেকে সবুজ চারা গজাবে না কেন? আমি চাচ্ছি জমিতে সিদ্ধ গম লাগাব। সবুজ গমের চারায় চারায় ভরে যাবে আমার ক্ষেত-খামার।’

ফেরিওয়ালা বাহরাম

খকন চিনের কন্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *