বিষ ও বাঁশরী—- মণীশ রায়

ক.
সেতু নামটি ওর পছন্দ নয়। আব্বু-আম্মু কেন এই নামটি রাখলেন এ সম্পর্কে কোনো সদুত্তর তারা কখনো ওকে দিতে পারেন নি।
‘তোমরা দুজন কলেজের অধ্যাপক। তাও সাহিত্যের। তবু সেতু রাখলে কেন তোমাদের একমাত্র মেয়ের নাম?’
ক্লাস নাইন পড়ুয়া মেয়ের এ প্রশ্নে ওরা দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। বলার মতো কিছু নেই। চোখেমুখে দুজনার বেশ একটা আমুদে ভাব। যেন আনেকদিন পর দুজন একত্রে একমাত্র মেয়ের নামকরণের সময়টিতে ঘুরে আসবার সুযোগ পেলেন।
একটুক্ষণ পর আব্বু ইশারায় দেখিয়ে দেন আম্মুকে। ভাবখানা এমন যে এ ব্যাপারে যত দায় এর সবটুকু আম্মুর।
আম্মুর কন্ঠে ঝাঁঝ, ‘আমার কি দোষ? রফিক স্যার যে সাতদিন সময় নিয়ে আমাদের মেয়ের নামকরণ করলেন। এই নামটি কিভাবে বাদ দিই বল? তুমিও তো তখন কিছু বলনি। বরং অসাধারণ নাম হয়েছে বলে স্যারকে কত তোয়াজ করলে।’
সেতু খানিক্ষণ চুপ থেকে ফিক করে হেসে ফেলে। তারপর আম্মুর দিকে চোখ রেখে বলল, ‘তুমি তো তোমার ভার্সিটির বাংলা বিভাগের প্রিয় শিক্ষকের কাছ থেকে আমার নামকরণটি করিয়ে আনলে। কিন্তু একই কাজ যদি আব্বু তার ইংরেজি বিভাগের প্রিয় স্যারের কাছ থেকে করিয়ে আনত তখন আমার নামটি কি হত বল? ব্রিজ? কালভার্ট? ওহ মাই গড। ভাবা যায় না! ’
আব্বু-আম্মু দুজনই হেসে উঠলেন উচ্চস্বরে। হাসি থামবার পর আব্বু মুখ খুললেন ‘তোমার নামটার সিম্বলিক একটা মিনিং রয়েছে। তুমি হচ্ছ আমাদের দুজনার মাঝখানের সেতুবন্ধন। সেতু বলতে তোমাকেই তোমার আম্মুর স্যার বুঝিয়েছেন। তুমি একে বাঁকাভাবে নিও না। প্লিজ।’
সেতু চুপ করে গেল এসময়। এই যুক্তিগুলো বহুবার বহুরকম করে শুনে এসেছে। কিন্তু বড় হবার পর এগুলোকে বরাবর খোঁড়া বলেই ভেবেছে। একটা ইট-পাথর আর লোহার তৈরি নির্মাণ-কর্ম কিভাবে ওর মতো উচ্ছ্বল-উজ্জ্বল প্রাণবন্ত একটা মেয়ের নাম হয় বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে সে কিছুতেই তা বুঝতে পারে না। ওর কাছে পুরো বিষয়টাই হাস্যকর লাগে।
খ.
কলিংবেলটা পাখির কণ্ঠের সুরেলা ডাক হয়ে বেজে উঠল। রিডিংরুমে বসে সেতু ভাবছে এসময় আবার কে এল বাসায়। কৌতূহল দানা বাধলেও উঠে গিয়ে ড্রয়িংরুমে দেখার মতো ধৈর্য নেই ওর। হাতে ধরা একটি সায়েন্স ফিকশন। কাল বান্ধবীকে ফেরত দিতে হবে। আজকের ভেতর শেষ না করতে পারলে উপায় নেই। অন্য বান্ধবী বায়না করে রেখেছে। বাজারে খুব কাটতি চলছে এই বইটির।
এসময় কাজের মেয়েটি এসে জানাল আম্মা ওকে ড্রয়িংরুমে ডাকছেন। সায়েন্স ফিকশনের তীব্র আকর্ষণ ছেড়ে সেতু ভুরু কুঁচকে আম্মুর সামনে এসে দাঁড়াল। ড্রয়িংরুমের সোফায় তখন একটি লোক বেশ জুবুথুবু হয়ে বসে রয়েছেন। পরনে জিন্সের প্যান্টের উপর টি-শার্ট। কথা বলছেন কার্পেটের উপর চোখ রেখে।
সেতু এসে যে ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়েছে লোকটি যেন খেয়ালই করলেন না। এ কি লজ্জা নাকি জড়তা বুঝতে পারে না সে।
আম্মু ইশারায় ওর পাশে বসতে বললেন। সোফায় বসে সরাসরি লোকটির দিকে তাকিয়ে সেতু বেশ হতাশই হলো। এরকম লোক আজকাল চলে নাকি? লোক নাকি ছেলে?
‘এই হচ্ছে আমার মেয়ে। নাম সেতু।’ বলেই হেসে ফেললেন আম্মু, ‘যদিও আমাদের দেয়া নামটি ওর পছন্দ নয়।’
‘ও।’ তবু একটিবারের জন্যও ওর দিকে তাকালেন না তিনি । আজব নাকি- সেতু ভাবল।
‘ওর নাম পলাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স নিয়ে পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। খুব মেধাবী ছাত্র।’
‘তো আমি কী করব?’ মুখে না বললেও মনে মনে বলল।
‘ও আজ থেকে তোকে ফিজিক্স পড়াবে। রফিক স্যার পাঠিয়েছেন তোর জন্য।’
‘আবার রফিক স্যর? মাই গুডনেস।’ মনে মনে বলল। মুখে ঝুলিয়ে রাখল মিষ্টি হাসির রেখা।
লোকটির দিকে ভালো করে বেশ কবার তাকনোর পরও ওকে একবার চেয়ে পর্যন্ত দেখলেন না। যাকে পড়াবেন সে একটা গরু নাকি গাধা তাও কি বোঝার প্রয়োজন বোধ করছেন না ?
সেতুর অভিমান হলো বড়। সে একটুও দেরি না করে নিজের রুমে গিয়ে সায়েন্স ফিকশনটি পড়তে শুরু করে দেয়।
একটু পর ভুলে যায় সবকিছু।
গ.
প্রথম দিনেই সেতুর সন্দেহ হয়। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে যেরকম করে তিনি ঝিমোচ্ছিলেন তাতে ওর বুঝতে বাকি থাকে না লোকটি নেশাগ্রস্ত। এ সম্পর্কে ওর যে খুব একটা ধারণা রয়েছে তা নয়। যেটুকু ও জানে তা ওর বান্ধবী ঝিলমিলের কল্যাণে। ঝিলমিলের বড় ভাই মাদকাসক্ত। সেই হিসাবে বান্ধবীর কাছ থেকে নিয়মিত শুনে শুনে ওর কি করে যেন ধারণা জন্মায় যে সব কমবয়েসী পুরষগুলোই তলে তলে নেশাখোর। সেই ধারণা থেকেই বলা নেই কওয়া নেই পলাশ স্যারকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নটি করে বসল।
‘আপনি নেশা করেন?’
‘তাতে কি তোমার ফিজিক্সের পাঠ নিতে কোথাও অসুবিধা হচ্ছে?’ চাঁচাছোলা কথা বলবার ধরন। কিন্তু চোখের দিকে তাকালে অন্যরকম লাগে। ভাবালু আর মায়াবী; রসকষহীন কর্কশ কথাবার্তার সাথে ঠিক খাপ খায় না।
‘জানতে চাইছি।’
‘হ্যা।’
বলতেই ইউরেকা বলে মনে মনে চেঁচিয়ে উঠল সে। আন্দাজের প্রথম তীরটি লেগে গেল!
সেতু আর কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল লোকটিকে তাড়াবার একটা উপায় এসে গেছে হাতে। আব্বু-আম্মুর কাছে বলে দিলেই হয়ে গেল।
বলার প্রস্তুতি নিয়ে বেশ কবার ওদের মুখোমুখি হয়েও শেষ পর্যন্ত বলতে পারেনি। কোথ্থেকে যেন একরাশ দ্বিধা এসে ওকে আটকে দেয়।
সামনাসামনি সেতু কখনো নেশাগ্রস্ত মানুষ দেখেনি। এসম্পর্কে ওর ধারণা গড়ে উঠেছে বই, ম্যাগাজিন, টিভি নাটক এবং ইন্টারনেটের সৌজন্যে। কিছুটা ভয় আর শংকায় জড়ানো একটি চরিত্র। যার চোখ লাল টমেটো, কথা বলে এলোমেলো, হিংস্রতায় ভরপুর যার আচরণ – বলতে গেলে সেই তো নেশাগ্রস্ত মানুষ।
সেতুর পর্যবেক্ষণ শক্তি যে খোদ গৃহশিক্ষককেই শিকার বানাবে তা সে নিজেও বুঝতে পারেনি।
অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিল সে।
সেটি যে লেগে যাবে কে জানত। বান্ধবী ঝিলমিলের বড় ভাইকে প্রায়ই মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়। কিছুদিন ভালো থাকেন। তারপর যেই-সেই। ফের জড়িয়ে পড়ে এসবে।
ওকে জিজ্ঞাস করলে কেমন হয়?
‘তোর স্যার? ভয় করে না? ভাইয়াকে তো ভীষণ ডরাই আমরা। টাকা না পেলে যে কী হিংস্র হয়ে যায়! আব্বু-আম্মু পর্যন্ত ভয়ে থরথর করে কাঁপেন। তুই কিভাবে পারিস?’ চোখ বড় বড় করে তাকায় ঝিলমিল।
‘পলাশ স্যার ঠিক তোর ভাইয়ার মতো এতটা হিংস্র নয়। কথাই বলে না আমার সাথে। বরং লেসনগুলো এত সুন্দর করে বোঝান যে না জানলে মনেই হবে না উনি মাদাকাসক্ত।’
‘ও।’ অভিজ্ঞ বান্ধবীটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জিজ্ঞাসা করে, ‘কী দিয়ে নেশা করে রে তোর স্যার?
‘তা তো জানি না?’
‘ওইটাই জানিস না? ধুত্তোরি!’ বলে ওকে পাত্তা না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।
রাতের বেলায় ইন্টারনেট ঘেটে বেশ কিছু নেশাদ্রব্যের নাম বের করে নেয় সেতু। মারিজুয়ানা, অপিয়াম, এলএসডি, ককেইন, একস্টেসি, পিসিপি, মেথ, এক রকমের মাশরুম এসব। এগুলোর যেকোনো একটি নিশ্চয় পলাশ স্যর গ্রহণ করেন। কিন্তু সেটা কি? সেতু অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে পরদিনের।
ঘ.
কিন্তু পরদিন পলাশ স্যার এলেন না। শরীর খারাপ বলে মায়ের মোবাইলে রিং দিয়েছিলেন। পুরো সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে তারপর এলেন।
পলাশ স্যারকে দেখামাত্র ওর কৌতূহলী মন নানারকমের জল্পনা-কল্পনা করছে। সায়েন্স ফিকশনের প্রভাব থেকে কিছুতেই মুক্ত হতে পারছে না। স্যারকে মনে হচ্ছে একটি চরিত্র। নেশাগ্রস্ত হয়ে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। সবাই জানে পলাশ একজন মেধাবী ছেলে। রফিক স্যার আম্মু সবাই।
সে-ই প্রথম বুঝতে পারে লোকটি নেশা করে বেড়ায় তলে তলে। নিজেকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে ডুবে রয়েছে সারাক্ষণ।
নিজেকে ধ্বংস করা আর মানবসভ্যতাকে প্রলয়ের দিকে ঠেলে দেয়ার মাঝে তফাত কি?
সায়েন্স ফিকশনে রয়েছে পৃথিবী ধ্বংস হবার মাত্র বিশ মিনিট বাকি। এর ভেতর কিছু না করতে পারলে পুরোটাই বৃথা। নায়ক বার বার করে ব্যর্থ হচ্ছে। কী যে সাসপেন্স। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুরছে আর টেনশন বাড়ছে পাঠকের।
‘স্যার আজও আপনি খেয়ে এসেছেন?’
‘কী?’
‘ওই যেগুলো দিয়ে নেশা করেন। ’
‘হু।’
‘কি দিয়ে নেশা করেন? মারিজুয়ানা, অপিয়াম, এলএসডি, ককেইন, একস্টেসি, পিসিপি, মেথ, এক রকমের মাশররুম?’ বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে সেতু।
স্যার ওর দিকে চোখ তুলে এক ঝলক তাকিয়ে মাথা নীচু করে ফেলল। এরপর সেতু কী বলবে বুঝতে পারে না। অগত্যা নিউটনের তৃতীয় সূত্রে মনোযোগ দেয়। এর আগে আরো কজন গৃহশিক্ষক ছিলেন ওর। ওদের সাথে কখনো পড়াশুনো ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে কথা হত না।
অথচ পলাশস্যরের সাথে শুরু থেকেই ওর এসব নিয়ে আলোচনা চলছে। উনি মুখ খুলতে চাইছে না। তবু ও পীড়াপীড়ি করছে। কতটুকু শোভন হচ্ছে সেতুর আচরণ?
‘স্যার , বললেন না তো ?’
‘কি? ’
‘কি দিয়ে নেশা করেন?’
পলাশ স্যার এবার একটুখানি নাটক করলেন ওর সাথে । প্যান্টের পকেট থেকে একটি শিশি বের করে গলায় কিছুটা ঢেলে ওর হাতে দিয়ে বলে ওঠেন, ‘এটা চেন?’
সেতু শিশিটার লেবেলের উপর চোখ বুলিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘এ তো সর্দিজ্বরের ওষুদ। আপনার ঠাণ্ডা লেগেছে?’
‘এটা খেলেই আমার নেশা হয়।’ বলে ফের মাথা নীচু করে ফেললেন।
সেতু থ। ঠাণ্ডা লাগার ওষুধ খেয়ে পলাশ স্যার নেশা করেন?
ঙ.
পরদিন স্কুলে গিয়ে বান্ধবী ঝিলমিলকে পেয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, ‘ঠাণ্ডার ওষুদ খান স্যার। এতে নেশা হয়?’
ঝিলমিল ভাইকে নিয়ে নানারকমের সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই একটা কিছু নিয়ে পরিবারে সমস্যা লেগে থাকে। তাই, পলাশ স্যারকে নিয়ে সেতুর এই কৌতূহল হোমিওপাথি ওষুদের মতো লাগে।
মনে মনে বিরক্ত হয়। ও যেটাকে নিয়ে মজা করতে চাইছে সেটি যে ঝিলমিল এবং তাদের পরিবারের জন্যে বড় অভিশাপ তা ও বুঝতে পারে না।
এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল, ‘এটা ফেন্সিডিল। নেশাখোরদের কাছে এটা ডাইল নামে পরিচিত।’
‘তোর ভাইও কি এগুলো খায়?’
‘না ।’
‘তাহলে?’
ঝিলমিল চুপ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে।
‘বল্ না। তোর ভাই কি দিয়ে নেশা করে? মারিজুয়ানা, অপিয়াম, এলএসডি, ককেইন, একস্টেসি, পিসিপি, মেথ, এক রকমের মাশররুম দিয়ে?’
ঝিলমিল এমনিতে ঠাণ্ডা টাইপের মেয়ে। রাগ-অভিমানের ধার ধারে না। কিন্তু সেতুর কথায় সহসা ক্ষেপে যায় ঝিলমিল। স্কুলমাঠের একটা কড়ই গাছের নিরিবিলি ছায়ার নীচে ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে কয়েক পলক ওর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে ঝিলমিল। তারপর হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,‘তোর কাছে বিষয়টা কি ফান বলে মনে হয়? বড় ভাইয়ার কারণে আমাদের পরিবারটা কানা হয়ে গেছে। আব্বার দুবার স্ট্রোক হয়েছে। আম্মার কিডনি বিকলের পথে। আর তুই ফান করিস?’
‘কোথায় ফান করলাম? আমি তো কেবল জানতে চাইছি।’ ভয় পাওয়া চোখে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে সেতু।
‘শোন, আমি বোকা নই। আমি সব বুঝি।’
‘এত যখন বুঝিস তো তোর ভাইয়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ভালো করে ফেল।’ এবার সেতুর কণ্ঠ কিঞ্চিৎ উচ্চকিত।
‘সবকিছু অত সহজ ভাবিস? আমাকে উপদেশ দেয়ার আগে তোর নেশাখোর স্যারটাকে ভালো করে তোলার চেষ্টা কর। দেখব কজন ডাক্তার তোর কাজে দেয়।’
‘আমি করব কেন? আমি কি পলাশ স্যারের বোন হই নাকি ফ্যামিলির কেউ?’
‘তাহলে ফান করিস কেন? কেউ কাঁটাতারের সাথে জড়িয়ে গেলে তাকে নিয়ে মজা করা ঠিক নয়। পারলে তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবি । কারো বিপদ নিয়ে মশকরা ভালো লাগে না।’ বলে মুখ ঘুরিয়ে ঝিলমিল চলে যায়।
সেতু গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ভাবে- কোনোকিছু সম্পর্কে কৌতূহল দেখানোটা কি খারাপ?
চ.
‘আপনি ওগুলো ছেড়ে দিন।’ পড়ার মাঝখানে আচমকা বলে বসে সেতু।
পলাশ স্যার এরই মাঝে বেশ সহজ হয়ে গেছেন সেতুর সাথে। পাড়শুনো ছাড়াও এটা-ওটা নিয়ে কথা বলেন। যদিও গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন প্রায়ই, সেতুর মনে হয় এই গাম্ভীর্য স্যারকে মানাচ্ছে না। কারণ, দুজনই ছাত্র, কমবেশ দুজনই আবেগতাড়িত।
‘আমাকে নিয়ে তোমার এত কৌতূহল কেন?’ ধমকে ওঠেন স্যার,‘নিজের পড়ায় মনোযোগী হও।’
সেতু চুপ হয়ে যায় কিছুক্ষণ। তারপর ফাঁক পেয়ে একসময় ফের বলে ওঠে,‘এগুলো ধরেছেন কখন?’
উত্তর না দিয়ে স্যার মাথা নুয়ে থাকেন। সেতু ভাবল স্যার বুঝি রেগে যাবেন। কিন্তু তিনি এবার না রেগে অতি সহজ করে বলে উঠলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমার খুব ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবার। আমার আব্বা-আম্মা অনেক টাকা খরচ করেছেন আমাকে মেডিক্যাল কোচিং করাতে। ময়মনসিংহ থেকে এসে বছরের পর বছর বাসা ভাড়া নিয়ে কোচিং করেছি। কিন্তু হলো না। পরপর দুই বছর হাজার চেষ্টা করেও আমি মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারিনি। আমার গরীব কৃষক মা-বাবা মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু আমি তাদের চোখের দিকে তাকাতে পাচ্ছিলাম না। একটা অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। তখন থেকেই এসবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তো ভুলে থাকা যায় সবকিছু। বাদ দাও তো। এই চ্যাপ্টারটা কমপ্লিট কর।’ বলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। হয়তো চোখের জল ঢাকবার চেষ্টা করেন।
সেতুর বড় মায়া হলো। সে পলাশ স্যারকে নিয়ে মস্ত সমস্যায় পড়ে গেল। সারাদিন ভাবে স্যারের কথা। বান্ধবীদের সাথেও সুযোগ পেলে এ প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে আসে।
বান্ধবীরা আড়ালে আবডালে ওকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। টের পেলেও সেতু কিছু বলে না।
কোনো কিছু ভালো লাগলে ও কি করবে?
রাত জেগে ইন্টারনেট ঘেঁটে সে যেটুকু খুঁজে পেল তাতে ওর কোনো হাত নেই। নেশার কবল থেকে কাউকে বের করে আনতে হলে ডাক্তারের প্রয়োজন, রিহ্যাব সেন্টার দরকার- সেগুলো সেতু কোথায় পাবে?
সে কি আব্বু আম্মুকে বলে দেবে? পরক্ষণে ভাবল ওদের কাছে বলে দিলে বিষয়টি তখন আর নিজের আয়ত্তের ভেতর থাকবে না। আব্বু যেরকম দিলদরিয়া মানুষ ঠিক ঠিক পলাশস্যরকে ভালো করে তুলবে। কিন্তু সেখানে সেতুর জায়গা কোথায়?
সে ভাবতে লাগল।
ছ.
‘স্যার , আপনাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?’ আহ্লাদ মাখানো কণ্ঠে প্রশ্ন করে সেতু।
‘মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার ভাগ্যকূল গ্রাম।’ কৌতুক ঝরে পলাশ স্যারের গলায়। কথার পিঠে ফের বলে ওঠেন, ‘তুমি যাবে?’
‘আমি?’ বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে পরক্ষণে সেতু প্রশ্ন করে, ‘কেন আপনাদের গ্রামটা কি খুব সুন্দর?‘
‘খুব। গাছগাছালি আর পাখপাখালিতে ঘেরা একটা গ্রাম। তুমি গেলে আর ফিরতে চাইবে না।’ পলাশ আগের চেয়ে অনেকখানি সহজ হয়ে গেছে ওর ছাত্রীটির সাথে। বিনা দ্বিধায় নিজের সম্পর্কে কথা বলতে পারে এখন। কোথাও বাধে না। ওর ধারণা- জীবন সম্পর্কে মেয়েটি অসম্ভব কৌতূহলী। মনটি একেবারে নিরাভরণ, কোথাও কোনো ক্লেদ নেই। কোনোকিছু না ভেবেই কাউকে সাহায্য করবার জন্য মুখিয়ে থাকে।
এ গুণটি পলাশের বড় ভালো লাগে। মা-মরা পলাশ একধরনের বাৎসল্য রসের স্বাদ নেয় এই অর্ধ-পরিচিত মেয়েটির কাছ থেকে।
‘জানেন, আমাদের কোনো গ্রামের বাড়ি নেই। আব্বার বাড়ি ছিল কসবায়। সেটি বিক্রি হয়ে গেছে বহু আগে। আমাদের যা কিছু সব এই ঢাকা-কেন্দ্রীক। ভাল লাগে না সবসময়।’ বলে মন মরা হয়ে থাকে সেতু।
পলাশের হাসি পায় ওর কথা বলবার ধরনে। কিছুটা মায়াও জন্মে ওর এই নাগরিক জীবনে হাঁফিয়ে ওঠার কারণে।
‘তুমি যাবে আমাদের গ্রামের বাড়ি? তাহলে তোমার আব্বু-আম্মুর সাথে কথা বলি। যাবে কিনা বল?’
একটুক্ষণ চুপ থেকে সে চিন্তা-ভাবনার একধরনের মুদ্রা তৈরি করে নেয় ভুরু-জোড়ায়। পলাশ উত্তরের আশায় সেতুর ছেলেমানুষিমাখা চেহারায় ভেসে বেড়ানো ভারিক্কিয়ানার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে এসময়। পলাশেরা চারভাই, কোনো বোন নেই। সেতু কি ওদের বোন হবে?
‘যাবো। তবে একটা শর্তে।’ ফিক করে হেসে ফেলে সেতু।
‘নেশা ছাড়তে হবে?’
‘কিভাবে বুঝলেন?’
‘এছাড়া তোমার আর কি আব্দার থাকতে পারে বল?’
‘বলুন না ছাড়বেন কিনা।’
‘আজ নয়। কাল বলব। ওকে? এখন পড়ায় মনোযোগী হও। নইলে পরীক্ষায় লাড্ডু পাবে।’
সেতু পড়ায় মন দেয়।
জ.
ঝিলমিলের সাথে সেতুর সম্পর্কটি একেবারে বাসযাত্রীর মতো। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না।
কাছাকাছি এলেই দুজনার কড়ই গাছতলার মনোমালিন্যের কথা মনে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে পরস্পরকে এড়িয়ে যায় দুজন।
ব্যাপারটি কারোরই ভালো লাগবার কথা নয়। কারণ, দুজন খুবই পুরনো বন্ধু। এভাবে কথা না বলে কদ্দিন থাকা যায়?
সেতু ভাবছে পলাশ স্যার ওকে চূড়ান্তভাবে বলে দিক যে তিনি নেশা ছেড়ে দেবেন। তারপর ওর মুখের উপর বলে দেবে, ‘আমার পলাশ স্যার ওসব আর খায় না।’
‘কিভাবে সম্ভব হল?’ নিশ্চয়ই বিস্ময় ঝরবে ঝিলমিলের গলায়। আর সামনে দাঁড়িয়ে বান্ধবীর মুখে-চোখে ভেসে বেড়ানো বিস্ময়বোধের ছোঁয়া পেয়ে সেতু মনে মনে এক অপার্থিব আনন্দের দোলায় দুলতে শুরু করবে। কিছুটা অহংকার এক চিমটি লবণের মতো এসে যোগ হবে তাতে। মনে মনে বান্ধবীকে বলবে, ‘দেখলি?’
কথাটা বান্ধবীকে বলতেই হবে। আর সেটি বলবার জন্য সেতু আজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওর স্যারের আগমনের। কারণ, আজই স্যার ওকে বলবে তিনি ওসব ছাড়বেন কিনা।
বিকালে পলাশ স্যার এসে পৌঁছাতেই ওর দমবন্ধ অবস্থা। সেতুদের তিনতলা বাড়ি। ওরা থাকে দোতলায়। জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তার বলতে গেলে সবটুকু দেখা যায়।
স্যারকে রাস্তায় দেখেই সে ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করতে থাকে। পলাশ স্যার সত্যি সত্যি ওর কথা রেখে ওগুলো ছেড়ে দেবে তো?
একটু পর ওকে অবাক করে আম্মাসহ স্যার ওর ঘরে প্রবেশ করেন।
আম্মা বললেন, ‘কিরে তুই যেতে চাস পলাশের বাড়িতে? সমস্যা কি। আমরা সবাই মিলে যাবো। এই শুক্রবারেই একটা প্রোগ্রাম করা যেতে পারে।’
সেতু হেসে ফেলল। এত সহজে আম্মু রাজি হবে তা সে নিজেও কল্পনা করেনি। খুশিতে ডগমগ হয়ে পলাশ স্যারের সামনে আম্মুকে বলে ওঠে,‘ইউ আর সো লাভলি।’
আম্মু নিজের ঘরে চলে যেতেই সেতু এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে, ‘স্যর, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? বলেন না স্যার। আপনি ওগুলো ছেড়ে দেবেন তো?’
পলাশ স্যার হাত নেড়ে ওকে শান্ত হতে বললেন। তারপর গম্ভীরকণ্ঠে সেতুর দিকে তাকিয়ে আচমকা বলে উঠলেন, ‘তুমি আমাদের বোন হবা?’
ঝ.
পলাশ স্যারের গ্রামের নাম ভাগ্যকূল। পদ্মানদীর পাড় ঘেঁষা ছায়া সুনিবিড় গ্রামের বাড়ি। বাড়িটি থেকে কয়েক কদম এগোলেই পদ্মানদীর ঢেউ দেখতে পাওয়া যায়। পিচের হাইওয়ে থেকে একটা সরু কংক্রিটের রাস্তা চলে গেছে ভেতরের দিকে।
সেতুদের মাইক্রোটি সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর এগনোর পর একটা বড় উঠোনওলা বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় এসে থামে।
গাড়ি থেকে প্রথমে পলাশ স্যার নামেন। তারপর আব্বা-আম্মা। এবং সবশেষে সে নিজে।
জায়গাটাকে ঘিরে রয়েছে প্রচুর গাছগাছালির ছায়া। প্রতিটি বাড়ির উঠোনে সব্জির মাচা। কোনটায় কার্কল, কোনটায় ঝিঙ্গে ঝুলে রয়েছে। কারো কারো জমিতে এমনিভাবে সারি সারি লাউ ফলেছে যে মনে হচ্ছে অনেকগুলো শিশু একসঙ্গে শুয়ে আছে ক্ষেতের মাঝখানে।
চারপাশে বুনো ঝোপ। বর্ষার মওসুম হওয়ায় ছোট ছোট নালা নর্দমাগুলো জলে টইটুম্বুর।
সেতু এই ভেজা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক পলক। মনে হচ্ছে – এক্ষুণি ওকে কেউ ঘুমাতে বললে ঘুমিয়ে পড়বে। এমনি মোহময় জায়গাটার রূপ-বৈচিত্র।
পলাশ স্যারের বাড়ির উঠোনে পা রেখে সেতু হতবাক। ব্যাপারটা কি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না। মাঝ উঠোন জুড়ে ত্রিপল টাঙানো। একপাশে রান্না হচ্ছে। ধোঁয়া উড়ছে বর্ষার বাতাসে। পোলাও-কোর্মার মনকাড়া সুগন্ধ এসে সেতুর নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। খাওয়ার চেয়ে কেন যেন এই গন্ধটা ওকে বেশি টানে।
এক কোণে কজন বাদ্যকর জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে। পলাশ স্যারের ইশারা পেতেই ওরা ঢাক-ঢোল আর ক্লেরিওনেট বাজিয়ে জায়গাটাকে গরম করে ফেলল।
সেতু বেশ মজা পেল তাতে। পলাশ স্যারকে বলে উঠল, ‘কি হচ্ছে এখানে? বিয়ে টিয়ে নাতো?’
হো হো করে হেসে ওঠেন পলাশ স্যার। সাথে যোগ দেন আব্বু -আম্মু।
‘কী ব্যাপার? বলবা তো?’ বোকার মতো বলে ওঠে সেতু। এমনি সময় পলাশ স্যারের আব্বা, দুজনা খালা টাইপের মহিলা আর স্যারের ছোট তিনভাই এসে ওদের সাদরে ভেতর ঘরে নিয়ে বসায়।
আশেপাশের প্রচুর কৌতূহলী নারী দরজার ফাঁক দিয়ে ওদের এক ঝলক দেখে পরক্ষণে অহেতুক লজ্জায় কেটে সেখান থেকে পড়ছে। সবার চোখ যেন কেবল ওকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। অস্বস্তিবোধ চেপে ধরছে সেতুকে। কী দেখছে ওরা?
আম্মুকে সেতু বলে উঠল, ‘এখানে কি হচ্ছে?’
‘তোর ভাইদের জিজ্ঞাস কর? এখন থেকে তোর চার ভাই।’
আব্বুর চোখে-মুখে মিষ্টি হাসির রেখা।
‘কি বলছ?’ কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে সেতু।
এসময় পলাশ স্যার এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। চোখেমুখে উচ্ছ্বাসের ছাপ।
‘কি হচ্ছে এসব স্যার?’
‘বোন হিসাবে তোমাকে বরণ করে নেবার উৎসব আজ। গ্রামের সবাই তাই এই বোনটাকে দেখতে এসেছে। চারভাই এর এদ্দিন কোন বোন ছিল না। আজ থেকে তুমি আমাদের বোন। বড় আদরের ছোট বোন। তাই এই আয়োজন।’ আবেগ ঝরে স্যারের কন্ঠে।
শুনে সেতু থ। আনন্দে উদ্বেলিত হবে নাকি অভিমানে চোখের জল ঝরাবে বুঝতে না পেরে সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। মাথার ভেতর শূন্যতাবোধ ছাড়া আর কিছু নেই।
কিছুক্ষণ বাদে ও একা একা বাইরে বেরিয়ে এল। নিজের মতো করে চারপাশে ঘুরে দেখতে গিয়ে স্যারের মুখোমুখি পড়ে যায়।
এতটুকু ইতস্তত না করে পলাশ স্যারকে সে বলে ওঠে, ‘আপনি ওগুলো ছাড়বেন কিনা বললেন না কিন্তু।’
পলাশ স্যারের চোখে মুখে আশকারা। মনে হচ্ছে আজ এমন এক মুহূর্ত যে সামনে দাঁড়ানো এই বোনটি যা চাইবে তাই দিয়ে দিতে পারে।
পলাশ স্যার গ্রামের প্রকৃতির মতো প্রাণখোলা একটি হাসি হেসে উত্তর দিলেন, ‘আমরা চার ভাই মিলে যে মুহূর্তে অনুষ্ঠান করে তোমাকে বোন হিসাবে বরণ করে নেব সেই মুহূর্তে তুমি জানবে আমি ওসব ছেড়ে দিয়েছি। এই কথা দিচ্ছি, আমার বোনটি।’ বলে ওর মাথা ছুঁইয়ে দেয়।
সেতুর যে কী হলো, সহসা কান্না পেয়ে গেল। এক দৌঁড়ে আব্বুর-আম্মুর কাছে ছুটে এসে কান্না ভেজা অনুযোগের গলায় বলে উঠল, ‘আমাকে এসব আগে বলো নি কেন?’
একথায় আম্মু কিছু বললেন না। শুধু মাথায় ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
আব্বু উত্তর দিলেন, ‘ভালোবাসার কথা আগাম বলে দিলে হয় না। এটি নিজের মতো করে বুঝে নিতে হয়।’
ঙ.
স্বুলে গিয়ে সেতু ঝিলমিলকে খুঁজতে থাকে। মনে মনে ঠিক করে নেয় ওকে কী বলবে।
‘ঝিলমিল, আমি পেরেছি, বুঝলি? খুব তো বড় বড় কথা বললি সেদিন কড়ই গাছতলায়।’
সেতুর চোখে-মুখে ডোন্ট-কেয়ার ভাব। কিছুটা অবজ্ঞার ছাপও।
‘কি বুঝব?’ খনখন করে ওঠে ঝিলমিল।
‘আমি আমার পলাশ স্যারকে ঠিকই ওইসব মরণনেশা থেকে ফেরাতে পেরেছি। বুঝলি?’
একথা শোনার পর নিশ্চয়ই ঝিলমিলের চোখ বড় বড় হয়ে যাবে বিস্ময়ে। সে ওকে বাহবা দেবে নাকি ঈর্ষায় এড়িয়ে যাবে তাই ভাবছে।
নিশ্চয়ই শেষ প্রশ্নটি ও না করে পারবে না, ‘কিভাবে? ভালো ডাক্তার ধরিয়ে দিলি?’
‘না।’
‘তাইলে?’
এর উত্তরে একবার বলে ফেলতে চাইবে সত্যি কথাটা, ‘ভালোবাসা।’
কিন্তু তা না বলে রহস্য মিশিয়ে উত্তর দেবে, ‘এমনি।’
‘আমি বিশ্বাস করি না।’
উত্তরে সেতু খিলখিল করে হেসে উঠে বলে উঠবে, ‘আমি জিতে গেছি। আই ওউন ইট। হিহিহি।’
এগুলো বলার জন্যই ঝিলমিলকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। কিন্তু ওকে কোথাও পাচ্ছে না। ওদের বাড়ির পাশে থাকে এমন একজন স্কুল বান্ধবীকে সে হেলাভরে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঝিলমিল কোথায় রে? ও আসেনি?’
‘কেন তুই জানিস না?’ চোখ বড় বড় করে পাল্টা প্রশ্ন করে মেয়েটি।
‘কি জানব?’
‘কেন ওর বড়ভাইটা যে নেশা করত সে মারা গেছে গত শুক্রবার। জানিস না তুই? সবাই তো জানে। সবাই তো দেখতে গেছে। ঝিলমিলটা খুব নরম। একটাই ভাইয়া তো। খুব কেঁদেছে ভাইয়াটার জন্য। পারলে একবার দেখে আয়। চোখের পানি রাখা যায় না।’ শেষের দিকে মেয়েটির কণ্ঠ ধরে আসে আবেগের তোড়ে।
এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ সেতু কিছুই জানে না? বুকটা টনটন করে উঠল ঝিলমিলের জন্যে।
এক পা দুপা করে সেতু কখন যে স্কুল মাঠের কড়ই গাছটার নীচে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পায়নি।
বেশ কিছুক্ষণ একাকী দাঁড়িয়ে থাকে গাছটার নীচে। সহসা মনে হলো সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশের একটা খাটিয়া ওর সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। লাশের মুখটা ঢাকা থাকবার কথা কিন্তু সেতু স্পষ্ট যাকে দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠল সে ঝিলমিলের বড় ভাইয়া নয়, সেতুর পলাশ ভাইয়া! সেতুর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল এক অজানা ভয় আর শংকায়।
শ্বাসকষ্টের রোগীর মতো দমবন্ধ তীব্র এক বিষণ্ণতাবোধ ওর বুকের কাছে আটকে থাকে।
কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারে না সেতু।
একসময় ধরা গলায় বিড়বিড় করে কাকে যেন সে বলে ওঠে, ‘আমাকে মাফ করে দিস। আমি আগে বুঝিনি।’

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!