নবুয়্যতের ধারা একটি কড়ির মালার মতো। এ মালার প্রথম কড়ির নাম আলম এবং শেষ কড়ির নাম মুহাম্মাদ। এ দুইটি কড়ির মাঝে রয়েছে শত শত হাজার হাজার কড়ি।
১। অনন্য তিন বৈশিষ্ট্য
অন্যসব নবী রাসুলের মতই মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন একজন মানুষ, একজন নবী ও একজন রাসুল। তবে মহা বিশ্বের মালিক আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্যসব নবী রাসুলদের দান করেননি। সে তিন বৈশিষ্ট্য হলো –
এক। সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তাঁর মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা নবুয়্যত ও রিসালাতের ধারা শেষ করেছেন। তাঁর নবুয়্যতী আদর্শই কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরনীয়।
দুই। বিশ্বনবী। মহান আল্লাহ তাঁকে জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে কিয়ামত পর্যন্তকার সকল মানুষের নবী ও রাসুল নিযুক্ত করেছেন।
তিন। সমগ্র মানব জাতির জন্যে রহমত ও আশীর্বাদ। তাঁকে পাঠানো হয়েছে রহমত, আশীর্বাদ ও অনুকম্পা স্বরূপ সমগ্র মানব জাতির জন্যে। এ তিনটি বিষয়ের প্রমান হল আল কুরআনের নিম্নোক্ত তিন আয়াত। –
১। মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং আল্লাহর রাসুল ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা আহযাব, আয়াত ৪০)
২। আমরা অবশ্যি তোমাকে রাসুল বানিয়ে পাঠিয়েছি সমগ্র মানব জাতির জন্যে সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। তবে অধিকাংশ মানুষই এলেম রাখেনা। (সূরা সাবা, আয়াত ২৮)
৩। হে মুহাম্মাদ, আমরা তোমাকে রাসুল মনোনীত করে পাঠিয়েছি সমগ্র জগতবাসীর জন্যে রহমত (অনুকম্পা ও আশীর্বাদ) হিসেবে। (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)
২। জীবনকাল
মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনকাল পূর্বকালের নবীগনের জীবনকালের মতো অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট নয়। ইতিহাসে তাঁর জীবনকাল জ্ঞাত ও সুস্পষ্ট। ঈসা (আঃ) এর পরে তাঁর জন্ম হয়েছে। ঈসা (আঃ) এর জন্ম সাল থেকে খ্রিষ্ট সাল চালু হয়েছে। মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনকালের হিসাব রাখা হয়েছে চন্দ্রমাসের হিসেবে। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা সেটাকে খৃষ্ট বর্ষের সাথে সংযুক্ত করেছেন। সে হিসেবে তাঁর জন্ম তারিখ হল ৯ই রবিউল আউয়াল, সোমবার, ২২ শে এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ। তবে পুরাবের মতটাই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে সঠিক। এই পার্থক্যটা হয়েছে পরবর্তীকালে চন্দ্র মাসের হিসাবকে খৃষ্ট সনের সাথে মিলাতে গিয়ে এবং চান্দ্র বর্ষ ও সূর্য বর্ষের মধ্যে আত/দশ দিন ফারাক থাকার কারনে। তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস ষোলো দিন, তখন তিনি নবুয়্যত লাভ করেন। এটা ছিলো ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। চন্দ্রমাস ছিল রমযান। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর।
তাঁর অফাত বা মৃত্যু হয়েছিলো সোমবার। এটা ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরি, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনকাল ছিল ৬৩ বছর। নবুয়্যত ছিল ২৩ বছর। নবুয়্যত পূর্ব জীবন ছিল ৪০ বছর। ফলে তাঁর জীবনকাল একেবারেই সুস্পষ্ট।
৩। জন্ম কোথায়, কোন বংশে?
মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জন্মস্থান মক্কায়। এটি একটি প্রাচীন শহর। মক্কা বর্তমানে সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত। এটি লোহিত সাগরের পূর্ব তীরের জেদ্দা নদী বন্দর থেকে পঞ্চাশ মাইল পূর্বে অবস্থিত। চৌদ্দ শত বছর পূর্বের মক্কা ছিলো তরুলতা বিহীন পাহাড় টিলা আর পাথর কংকরময় এক মরু শহর। তখন তাঁদের প্রধান ফসল ছিল খেজুর, কোন কোন এলাকায় আঙ্গুর ও যব। শহরটি প্রধানত ছিল ব্যবসা ও আমদানী নির্ভর। এছাড়া এখানকার লোকেরা উট ও মেষ পালন করতো। আর ঘোড়া ছিল তাঁদের বাহাদুরীর প্রতীক।
খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছরেরও কিছু আগের কথা। তখন মক্কায় কোন মানুষ বসবাস করতোনা। এটি ছিল জনমানবহীন পাথর পর্বতের এক ভুতুরে নির্জনভূমি। তখন মহানবী ইবরাহীম (আঃ) তাঁর দুই পুত্রের এক পুত্রকে এখানে পুনর্বাসন করেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল ইসমাঈল (আঃ)।
অতপর আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) মক্কার বুকে নির্মাণ করেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘর। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে ইসমাঈলের বংশধর। বাইরের কিছু লোকও এই শহরের আসে পাশে এসে বসবাস করতে থাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে মক্কা নগরী। হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের বংশধরেরা পরবর্তীতে কুরাইশ বংশ নামে খ্যাতি অর্জন করে। এ বংশেরই একটি শাখার নাম বনু হাশেম। বনু হাশেমই কুরাইশদের নেতৃত্ব দান করতো। এই বনু হাশেম বংশেই কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর ঔরসে এবং মা আমিনার গর্ভে জন্মগ্রহন করেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ)। সুতরাং মুহাম্মাদ (সঃ) হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর শ্রেষ্ঠ বংশধর।
৪। নবুয়্যত পূর্ব জীবন ও শৈশব
বিশ্বনবী (সঃ) মাতৃগর্ভে। এসময় তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফরে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি পথিমধ্যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। বিধবা হয়ে পড়েন মা আমিনা। মাতৃগর্ভে থাকতেই ইয়াতিম হয়ে পড়েন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সঃ)।
তাঁর জন্মকালে জীবিত ছিলেন কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিব, বড় চাচা আবু তালিব, অন্যান্য চাচা এবং ফুফুরা। কুরাইশদের বংশীয় রীতি অনুযায়ী জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই লালন পালন ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে ন্যস্ত করা হয় বেদুইন ধাত্রী মা হালিমার দায়িত্বে। ছয় বছর বয়েস হলে হালিমা তাঁকে মায়ের কোলে ফেরত দিয়ে যান। মা আমিনা ফিরে পান বুকের ধন মুহাম্মাদকে। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সবচেয়ে প্রিয় নাতী মুহাম্মাদ। চাচা এবং ফুফুদের কাছেও সর্বাধিক প্রিয়। শিশুকাল থেকেই সবাই হয়ে পড়েন তাঁর গুনমুগ্ধ। সুন্দরতম গুনাবলী আর মহোত্তম আচরনে তিনি শিশুকাল থেকেই সবার সেরা। ফলে সবার প্রিয় মুহাম্মাদ। ভবিষ্যতে নেতা এবং সেরা মানুষ হবার সব গুনাবলীই ফুতে উঠেছে শিশু মুহাম্মাদের চরিত্রের মধ্যে। মুহাম্মাদের বয়েস ছয় কি আট। এ সময় মা আমিনা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে দেখাতে মদীনায় নিয়ে যাবেন ওর মাতুলালয়ে। তাছাড়া ওর বাবার কবরও ওখানে। দেখিয়ে আনবেন বাবার কবরও। ফলে তারা মদিনায় এলেন। থাকলেন মাস খানেক। তারপর—তারপর ফিরে চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে প্রচণ্ড জ্বর আক্রমন করলো মা আমিনাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি পথেই মারা গেলেন। সাথে ছিলেন মায়ের সেবিকা উম্মে আয়মান। মায়ের মতই তিনি মুহাম্মাদকে লালন পালন করেছেন সারাজীবন। তিনি মুহাম্মাদকে কোলে জড়িয়ে ফিরে এলেন মক্কায়। দাদা আব্দুল মুত্তালিব পরম আদর যত্নে গড়ে তুলছিলেন নাতি মুহাম্মাদকে। কিন্তু এরি মধ্যে দুই বছরের মাথায় তিনিও ইহকাল ত্যাগ করেন। পরিবর্তন হয় অভিভাবক। এবার মুহাম্মাদের অভিভাবকের দায়িত্ব নেন বড় চাচা আবু তালিব। আবু তালিব নিজ সন্তানদের চেয়েও অধিক স্নেহ এবং আদর যত্ন করতেন এতিম ভাতিজা মুহাম্মাদকে। আবু তালিব একবার বারো বছর বয়সে মুহাম্মাদকে বাণিজ্যিক সফরে সিরিয়ায় নিয়ে যান। এ সফরে আবু তালিব মুহাম্মাদের মধ্যে প্রতক্ষ করেন অনেক অলৌকিকত্ব। এভাবে তিনি উপযুক্ত অভিভাবকের অধিনেই বেড়ে ওঠেন ছোট বেলা থেকে। এ প্রসঙ্গেই মহান আল্লাহ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন –
“তিনি কি তোমায় ইয়াতিম পাননি? তারপর আশ্রয় দেননি।” (আল কুরআন ; ৯৩-৬)
৫। নবুয়্যত পূর্বজীবন ; যৌবনকাল
এরি মধ্যে মুহাম্মাদ নিজেকে দক্ষ ও সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অপরদিকে সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার ও সমাজ সেবার মাধ্যমে তিনি মক্কার জনগণের নয়নমণিতে পরিনত হন। জনগন তাঁকে উপাধি দেয় ‘আল আমিন’ ও ‘আস সাদিক’। এর মানে পরম বিশ্বস্ত ও মহা সত্যবাদী। পঁচিশ বছর বয়েসে বিয়ে করেন খাদিজাকে। তিনি ছিলেন খাদিজা তাহিরা- পবিত্র নারী খাদিজা। রূপে গুনে এবং সহায় সম্পদে তিনি ছিলেন মক্কার সেরা নারী। মক্কার সেরা নেতা ও ধনীদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি নিজেই স্বামী হিসেবে পছন্দ করে নেন ভবিষ্যতের মহাপুরুষ মুহাম্মাদকে। খাদিজার গর্ভে জন্ম হয় বিশ্বনবীর চারকন্যা – উম্মে কুলসুম, যয়নব, রুকাইয়া এবং ফাতিমা। প্রথমে কাসেম নামে একটি পুত্রের জন্ম হয়, কিন্তু জন্মের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই কাসেম মারা যান। ইতোমধ্যে সামাজিক বিবাদ ফায়সালায়ও মুহাম্মাদের প্রশংসনীয় কৃতিত্ব সবার কাছে সমাদৃত হয়। জনগন তাঁকে তাঁদের ভবিষ্যতের নেতা ভাবতে থাকে। তাছাড়া সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, নযায়পরায়নতা ও মহৎ মানবীয় গুনাবলীর দিক থেকে জনগন এমন সেরা মানুষ আর কখনো দেখেনি।
৬। অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ
সেকালে মানব সমাজ ছিল সকল দিক থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। তারা ডুবে ছিল অন্ধ ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের অটল গহবরে। তাঁদেরকে গ্রাস করে ফেলেছিলো চরিত্রহীনতা ও নৈতিক অধঃপতন। গোত্রীয় ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ছিল তারা পর্যদুস্ত। কুসংস্কারের বলীতে তারা ছিলো ধংসোন্মুখ। তাঁদের উপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছিল অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব। অধিকাংশ মানুষ ছিল দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নারীরা ছিল সম্পূর্ণ অসহায় ও মর্যাদাহীন। ভাস্কর্য পূজা তাঁদের নামিয়ে দিয়েছিলো মানবতার সর্বনিম্নস্তরে। এমতাবস্থায় মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসার প্রয়োজন ছিল এক সাহায্যপ্রাপ্ত মহাবীর মুক্তিদুত। এতিম মুহাম্মাদকেই মহান আল্লাহ গড়ে তুলছিলেন সেই মুক্তিদুত হিসেবে।
৭। নবুয়্যত লাভ
এদিকে তাঁর বয়েস যখন চল্লিশের কাছাকাছি তখন তিনি নির্জনতা অবলম্বন করতে থাকেন। ক্রমান্বয়ে নির্জনতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। কা’বা থেকে মাইল তিনেক পূর্বদিকের একটি পাহাড়। এর বর্তমান নাম ‘জাবালুন্নুর’ বা জ্যোতির পাহাড়। এ পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে পশ্চিমমুখী বা কাবা মুখী একটি গুহা। গুহাটির নাম হেরা। জাবালুন নুরের চুড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় গিয়ে মুহাম্মাদ (সঃ) নীরবে নির্জনে ধ্যান করতে থাকেন। অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মানব সমাজের মুক্তির জন্যে তিনি এক আল্লাহর কল্যাণমুখী হন। ধ্যান করতে থাকেন। তাঁর মহিমা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর সমস্ত মন মস্তিস্কে এক আল্লাহর ধ্যান এবং ভাবনা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এভাবে তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস, তখন রমযান মাসের এক শুভরাত্রে তাঁর কাছে আগমন ক্রেন আল্লাহর দূত হযরত জিব্রাইল আমিন। তখনো তিনি হেরা গুহায় ধ্যানরত। জিবরীল এসে তাঁকে বললেন- ‘পড়ুন’। তিনি বললেন- ‘আমি পড়তে জানিনা’। এবার জিবরীল তাঁকে প্রচণ্ড জোরে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলেন – ‘পড়ুন’। জ্ঞানের আলোকে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠলো তাঁর হৃদয়। সাথে সাথে তিনি পড়তে শুরু করলেন – “ইকরা বি ইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলাক। ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাযি আল্লামা বিল কালাম। আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়ালাম।” অর্থ “ পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে শক্তভাবে আটকে থাকা শিশু থেকে। পড়ো, আর তোমার প্রভু বড়ই দয়াবান, মহিমা মণ্ডিত। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।”
এ অংশটি পরে রাসুল (সঃ) আল কুরআনের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত হিসেবে সংকলন করেন। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহর প্রতি এটিই ছিল কুরআন নাযিল হবার সুচনা। এটাই ছিল তাঁর নবুয়্যতী জীবনের সূচনা। আর এটা ছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ। ফেব্রুয়ারী মাস। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ কোন অভিনব নবী ছিলেন না। তাঁর পূর্বেও বিগত হয়েছেন বহু নবী রাসুল। ইতোপূর্বে আমরা চব্বিশজন নবী রাসুলের জীবনী আলোচনা করে এসেছি। মুহাম্মাদ (সঃ) নবুয়্যতী মালার সর্বশেষ কড়ি। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন আসমানী সর্বশেষ কিতাব। তাঁর রিসালাত ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন চিরন্তর এবং সার্বজনীন।
৮। আল্লাহর দিকে আহবানের গুরু দায়িত্ব
নবুয়্যত ও রিসালাত হল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক মহান দায়িত্ব। এ হলো, মানব সমাজের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব। এ হলো মানব সমাজকে এক অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে আহবান করার দায়িত্ব। তাই, মুহাম্মাদ (সঃ) মানব সমাজের জন্যে মহান আল্লাহর নিযুক্ত –
১। বার্তাবাহক (রাসুল)।
২। আল্লাহর দিকে আহবায়ক (দায়ী ইলাল্লাহ)।
৩। সুসংবাদদাতা (বাশীর)।
৪। সতর্ককারী (নাযির)।
৫। সত্যের সাক্ষী (শাহেদ)।
৬। সর্বোত্তম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) এবং
৭। মহাসত্যের অনাবীল আলো বিতরণকারী এক সমুজ্জ্বল প্রদীপ (সিরাজাম মুনিরা)।
এ দায়িত্বগুলো তাঁর উপর অর্পিত হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ গুরু দায়িত্ব পালন করার জন্যে তিনি পাহাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে। গুহায় বসে ধ্যান করার দিন শেষ। মানবতার মুক্তির যে মহান উদ্দেশ্যে তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়েছিলেন, সেই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের সঠিক দিশা এবং নির্দেশিকা এবার তিনি পেয়ে গেছেন। তাই এবার মানব সমাজকে ধংসের হাত থেকে মুক্তির লক্ষে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে।
তাঁকে প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন-
- হে মুহাম্মাদ, বলো- হে মানুষ, আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর বার্তাবাহক। (আল কুরআন ৭ ;১৫৮)
- গোটা মানবজাতির জন্যে আমরা তোমাকে বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছি। (আল কুরআন ৪ ; ৭৯)
- যাতে করে রাসুল তোমাদের উপর সাক্ষী হয়। (আল কুরআন ২ ; ১৪৩)
- হে নবী, আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী হিসেবে আর আলো বিতরণকারী সমুজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে। (আল কুরআন ৩৩ ; ৪৫-৪৬)
এসব দায়িত্ব পালনে তিনি নিজেকে এতোটাই নিবেদিত করেছিলেন যে, তিনি নিজের জীবনের প্রতিও অনেকটা বেপরোয়া বা বেখেয়াল হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তাঁকে এভাবে সতর্ক করেন-
“তারা এ বানীর প্রতি ঈমান আনেনা বলে সম্ভবত দুঃখে শোকে আর হতাশায় তুমি নিজেকেই বিনাশ করে ছাড়বে।” (আল কুরআন ১৮ ;৬)
৯। মানব সমাজকে মুক্তি ও সাফল্যের দিকে আহবান
মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সঃ) কে রিসালাতের দায়িত্বে নিযুক্ত করার পর তিনি মানুষকে যেসব বিষয়ের প্রতি আহবানব করেন এবং যেসব বার্তা তাঁদেরকে পৌঁছান, সংক্ষেপে তা হলো –
১। মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন, তিনিই মহান আল্লাহ। মহাবিশ্ব, পৃথিবী ও মানুষ সব কিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সবার প্রভু। তিনিই মহাজগৎ মহাবিশ্বের প্রতিপালক, পরিচালক ও শাসক।
২। তিনি এক ও একক। তিনি সন্তান গ্রহন করেননা। তিনিও কারো সন্তান না। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। কোন বিষয়েই তাঁর কোন শরীক বা অংশীদার নেই। কোন বিষয়েই তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কোন বিষয়েই কারো কাছ থেকে তাঁর কোন সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বোচ্চ ও সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র। সবাই ও সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর দয়া, অনুগ্রহ ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী।
৩। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করে তাঁকে একটি সময়ের জন্যে এই পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাঁর হুকুম ও বিধান মতো জীবন যাপন করার জন্যেই তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে নবী রাসুল পাঠিয়েছেন। মানুষের জন্যে জীবন যাপনের নির্দেশিকা সম্বলিত কিতাব পাঠিয়েছেন এবং পৃথিবীকে তাঁর বিধান মতো পরিচালনা করার জন্যে মানুষেরই উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
৪। তিনি বিবেক বুদ্ধি দিয়ে মানুষকে জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী বানিয়েছেন। মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি এবং নৈতিক প্রবৃত্তি অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। পাশবিক প্রবৃত্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করে বিবেক বুদ্ধি তথা নৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী ও বিকশিত করতে বলেছেন।
তাঁকে আল্লাহর বিধান ও নৈতিক শক্তিতে হয়ে পার্থিব জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন।
৫। পার্থিব জীবনের কার্যক্রমের জন্যে মানুষের বিচার হবে। আল্লাহর বিধান এবং মহৎ মানবীয় নৈতিক গুনাবলীর ভিত্তিতে সে তাঁর সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করেছে কিনা, সেটাই হবে বিচারের বিষয়। এ উদ্দেশ্যে মানুষকে পুনরুত্থিত করা হবে। বিচারে সাফল্য অর্জনকারী লোকদের তিনি অনন্তকালের জন্যে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। অপরদিকে বিচারে যারা অপরাধী সাব্যস্ত হবে তাঁদেরকে নিমজ্জিত করা হবে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির মধ্যে।
৬। হে মানুষ, মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছেন। তোমরা আমাকে আল্লাহর রাসুল মেনে নাও। আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের কিছুই বলছিনা। আমি তোমাদের কাছে কেবল আল্লাহর বার্তা ও নির্দেশাবলীই পৌঁছে দিচ্ছি।
৭। হে মানুষ, তোমরা আল্লাহকে এক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান মেনে নাও। তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করো। তাঁর সাথে কাউকেও এবং কোন কিছুকেই শরিক করো না। তোমরা তোমাদের মহৎ মানবীয় ও নৈতিক গুনাবলীকে উন্নত ও বিকশিত করে সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ মর্যাদা অর্জন করো। তোমরা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালোবাসো। সারাজীবন সমস্ত কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে করো। আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করো। পরকালীন সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করো। সর্বপ্রকার অন্যায়, অপরাধ, পাপ, পংকিলতা ও যুলুম অবিচার পরাহার করো। এটাই তোমাদের মুক্তি ও সাফল্যের একমাত্র পথ।
১০। মক্কায় তের বছর দাওয়াত ও আহবান
উপরে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো, সেগুলোই মুহাম্মাদ (সঃ) এর দাওয়াত ও আহবানের মূল বক্তব্য। মক্কায় তের বছর তিনি মানুষকে এই মূল বিষয়গুলোর দিকেই আহবান করেন। সর্বোত্তম পন্থা আর মর্মস্পর্শী উপদেশের মাধ্যমে তিনি মানুষকে আহবান করেন। তাঁর আহবানের উপকরন ছিল আল কুরআন। এই তের বছর তাঁর কাছে কুরআন নাযিল হয়েছে ঐ বিষয়গুলোকে চমৎকার যুক্তি, উপমা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত সহকারে বাস্তব ও আকর্ষণীয় ভংগীতে উপস্থাপনের মাধ্যমে। তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবান হিসেবে মানুষের কাছে হুবহু উপস্থাপন করেন আল্লাহর বার্তা আল কুরআন। যারা তাঁর আহবান গ্রহন করেন, তাঁদের তিনি জামায়াতবদ্ধ করেন। তাঁদের মাঝে কুরআনের আলো বিতরন করেন। তাঁদেরকে আল কুরআন শিক্ষা দেন। তাঁদের মানবিক গুনাবলী উন্নত ও বিকশিত করেন। তাঁদের নৈতিক চরিত্র সংশোধন করেন। তাঁদের মাধ্যমে গঠন করেন একটি নতুন সমাজ। মূলত তাঁর দাওয়াত ও আহবানের ছিলো পাঁচটি স্তর। সেগুলো হলো-
১। মানুষের জীবন লক্ষের পরিবর্তন।
২। মানুষের ধ্যান ধারনা, চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন।
৩। মানুষের নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন।
৪। সমাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন।
৫। নেতৃত্বের পরিবর্তন।
কুরআনের আলো বিতরন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষন, দৃষ্টান্ত স্থাপন, এক আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য এবং সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে তিনি সমাজ ও সাথীদের মাঝে এসব পরিবর্তন সাধন করেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন-
“এমনি করে আমরা তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের মাঝে পাঠিয়েছি একজন রাসুল। সে তোমাদের প্রতি তেলাওয়াত করে আমাদের আয়াত, তোমাদের জীবনকে করে উন্নত ও বিকশিত, তমাদেওর শিক্ষা দেয় আল কুরআন ও হিকমাহ। আরো শিক্ষা দেয় তোমরা যা কিছু জানতেনা।”(আল কুরআন, ২ ; ১৫১, ৩ ; ১৬৪, ৬২ ; ০২)
তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবানের তালিকায় নিয়ে এসেছিলেন –
১। প্রতিভাবান যুবসমাজকে।
২। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদেরকে।
৩। মজলুম ও সুবিধাবঞ্চিত মানুসদেরকে।
৪। নারী সমাজকে। এবং
৫। সত্য সন্ধানী ব্যাক্তিদেরকে। তিনি তাঁর এই দাওয়াত ও আহবানের কাজের সায়াহ্নের সেই মরু পথিকের মতই মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়িয়েছিলেন, যে পথিক সূর্যাস্তের পূর্বেই পেরেশান হয়ে পৌছতে চায় মানব বসতিতে। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন –
১। তাঁর বন্ধুদেরকে বন্ধুতার ভালোবাসায়।
২। দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়স্বজনকে আত্মীয়তার হোক আদায়ে।
৩। দাওয়াত দিয়েছেন ব্যাক্তি পর্যায়ে ব্যাক্তিগত যোগাযোগ করে।
৪। দাওয়াত দিয়েছেন হাট-বাজারে জনসমষ্টিকে সম্বোধন করে।
৫। দাওয়াত দিয়েছেন মেলায় গিয়ে, পূজা পার্বণে গিয়ে।
৬। দাওয়াত দিয়েছেন হজ্জে আগত হাজীদেরকে।
৭। দাওয়াত দিয়েছেন মক্কায় আগত বনিক ও পর্যটকদেরকে।
১১। দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া
সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবানের প্রতিক্রিয়া আছে। সমস্ত নবী রাসুল মানুষকে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবান করেছেন এবং তাঁদের আহবানের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। একইভাবে মুহাম্মাদ (সঃ) এর দাওয়াতেরও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাঁর দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া ছিলো নিম্নরূপ-
১। সত্য সন্ধানী ব্যাক্তিবর্গ, বিশেষ করে যুবক যুবতীরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়। তারা ঈমান এনে রাসুলের সাথে কুরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
২। কিছু লোক এই দাওয়াতকে সত্য বলে জেনেও অত্যাচার নির্যাতনের ভয়ে কিংবা স্বার্থহানীর আশংকায় ঈমান আনা থেকে বিরত থাকে।
৩। সমাজের কর্ণধাররা, ধর্মীয় পুরোহিতরা এবং অর্থনৈতিক শোষকরা কোমর বেধে তাঁর বিরোধিতায় নেমে পড়ে।
৪। অধিকাংশ মানুষ নিরবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
৫। আর কিছু লোক বিভিন্নভাবে বিরুদ্ধবাদীদের শিকলে আটকা থাকায় গোপনে ঈমান আনে এবং ঈমান আনার বিষয়টি সময় সুযোগের অপেক্ষায় গোপন রাখে।
প্রতিক্রিয়া যদিও এই পাঁচটি ধারায় বিভক্ত ছিলো, তবু এর মূল ধারা ছিলো দুইটি। অর্থাৎ
১। ঈমান এনে রাসুলের সাথীত্ব গ্রহনকারী ধারা। এবং
২। বিরুদ্ধবাদী ধারা।
এই তের বছরে তিন শতাধিক নারী পুরুষ প্রকাশ্যে ঈমান এনে ইসলামী কাফেলায় শরীক হয়ে যান। এরা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে ইসলামের পথে সব ধরনের ত্যাগ ও কুরবানী দিচ্ছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম দিকেই ঈমান আনেন খাদিজা তাহেরা, আবু বকর, আলী, যায়েদ বিন হারিসা, সায়ীদ বিন যায়িদ, ফাতিমা বিনতে খাত্তাব, যুবায়ের, সা’দ বিনাবি ওয়াক্কাস, উসমান বিন আফফান, আব্দুর রহমান, জাফর বিন আবু তালিব, আবু সালামা, উম্মে সালামা, আবু উবায়দা, তালহা, উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান, উমর বিন খাত্তাব, আবু যর, হামজা বিন আব্দুল মুত্তালিব, বিলাল বিন রিবাহ, মুসআব, আম্মার, ইয়াসার, সুমাইয়া, খাব্বাব, আরকাম, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ, সুহায়েব রুমী, উসমান বিন মাযঊন, উম্মে শুরাইক, রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মাদ, উম্মু কুলসুম বিনতে মুহাম্মাদ, নঈম বিন আব্দুল্লাহ, লুবাইনা, উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে হাশমা, তাঁর স্বামী আমের বিন রাবীয়া, তোফায়েল দাওসী এবং আরো অনেকে রাদিয়াল্লাহু আনহুম।
অপরদিকে মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহবানের এই মহোত্তম কাজের বিরোধীতায় অগ্রনী ভুমিকা পালন করে স্বয়ং রাসুল (সঃ) এর চাচা আবু লাহাব, তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল, আবু জাহেল, হাকাম বিন আস, উকবার বিন আবু মুয়িত, উতবা, শাইবা, আবুল বুখতরি, আস বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, মুনাব্বিহ, হিন্দা, আবু সুফিয়ান, সুহায়েল, আমর ইবনু আস, আকরামা, খালিদ বিন ওয়ালীদ এবং আরো অনেকে। অবশ্য এদের মধ্যে কয়েকজন পরে ইসলাম কবুল করে আল্লাহর সৈনিক হয়ে যান। তবে তাঁদের অনেকেই বদর যুদ্ধে নিহত হয়। সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের অনেকেই ইসলাম কবুল করেন। তবে সাহসী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যুবকরাই বেশীরভাগ ইসলাম গ্রহন করেন। অবশ্য নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ ব্যাক্তিই রাসুল (সঃ) ও তাঁর সত্যের দাওয়াতের বিরধীতায় অবতীর্ণ হয়। তারা ঈমানে দীক্ষিত তাঁদের যুবক ছেলে মেয়েদের, আত্মীয়-স্বজনদের এবং দাস-দাসীদের উপরে চরম নির্যাতন চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসুল (সঃ) এর নির্দেশে তাঁর আশির অধিক সাহাবী নবুয়্যতের পঞ্চম বছরে পার্শ্ববর্তী দেশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন।
১২। বন্দী জীবন
কিন্তু রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাথীরা ইসলামের পথ এবং দাওয়াত ও আহবানের কাজ ত্যাগ না করায় কাফির নেতারা আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রাসুল, তাঁর সাথীবৃন্দ এবং তাঁর গোত্র বনু হাশিমকে বয়কট করে। ফলে তারা শি’বে আবু তালিব নামক পার্বত্য উপত্যকায় অন্তরীন হয়ে পড়েন। এখানে চরম দুঃখ দারিদ্রের মধ্য দিয়ে তাঁদের দিন কাটতে থাকে। চরম খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা গাছের ছাল আহার করেন। তারা ক্ষুধা এবং রোগক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। নবুয়্যতের সপ্তম বর্ষ থেকে দশম বছরের সূচনা পর্যন্ত তিন বছর তারা এখানে বন্দী থাকেন। অতপর পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে বাধ্য হয়ে বিরোধী নেতারা রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাথীদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়। এই তিন বছরের নিপীড়নের ফলে এ বছরই অর্থাৎ নবুয়্যতের দশম বর্ষেই ইহকাল ত্যাগ করেন রাসুল (সঃ) এর অভিভাবক চাচা আবু তালিব এবং প্রেরনাদায়িনী স্ত্রী খাদিজা তাহেরা। এখন থেকে রাসুল (সঃ) নিরংকুশভাবে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে যান।
১৩। তায়েফে দাওয়াত
মক্কার পরেই তায়েফ ছিলো অধিকতর প্রভাবশালী শহর। মক্কার লোকদের আর ঈমান আনার লক্ষন ক্ষীন দেখে রাসুল (সঃ) তায়েফের সর্দারদের কাছে মহাসত্যের দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তায়েফ যান। তাঁদের দাওয়াত দেন আল্লাহর দিকে। মক্কার নেতারা তাঁর দাওয়াত গ্রহন না করায় এবং বিরোধিতা করায় তাঁরাও তাঁর দাওয়াত গ্রহন করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় তারা আল্লাহর রাসুল্কে লাঞ্ছিত করার লক্ষ্যে তাঁর পিছনে বখাটে যুবকদের লেলিয়ে দেয়। তারা রাসুল (সঃ) কে চরমভাবে নির্যাতন করে, লাঞ্ছিত করে। তাঁর সাথে গিয়েছিলেন তাঁর সেবক যায়েদ। অতপর তিনি যায়েদকে নিয়ে ফিরে আসেন মক্কায়।
১৪। মে’রাজ
চরম নির্যাতনের ফলে রাসুল (সঃ) এঁর একজন মহিলা সাহাবীসহ দুই তিনজন সাহাবী শাহাদাৎ বরন করেন। অনেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রাসুল (সঃ) তায়েফের দিক থেকেও নিরাশ হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে তো নিজের রাসুল নিযুক্ত করেছেন স্বয়ং মহাবিশ্বের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি তাঁর রাসুলগনকে এবং রাসুলদের সাথীদেরকে সবসময় বিরোধিতা, অত্যাচার, নির্যাতন এবং প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাইতো আল্লাহ পাক মুহাম্মাদ (সঃ) কেও বলে দিয়েছেন –
“তোমার পূর্বেও বহু রাসুলকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের মোকাবেলায় তারা অটল থেকেছে।” (সূরা ৬ আয়াত ৩৪)
এ সময় আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে সামনে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দিতে যাচ্ছিলেন তাঁর মূলনীতিগুলো জানিয়ে দিতে চাইছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁকে মে’রাজ করান। দশম নবুয়্যত বর্ষে মে’রাজ সংঘটিত হয়। আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে ইসলামী সমাজের মূলনীতি প্রদান করেন। এসময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর উম্মতের জন্যে পাচ ওয়াক্ত নামাজও ফরয করে দেন। তাছাড়া আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দেন তাঁর কাছে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রার্থনা করার জন্যে। মে’রাজ উপলক্ষে নাযিল হয়েছে সূরা বনী ইসরাইল। তখনকার প্রাসঙ্গিক উপদেশ ও মূলনীতিগুলো মওজুদ রয়েছে এই সূরা বনী ইসরাইলে।
১৫। মদিনায় ইসলামের আলো
মক্কায় রাসুল (সঃ) এর নবুয়্যতী জীবনের তের বছরের শেষ পর্যায়। নবুয়্যত বর্ষ বারো। হজ্জ উপলক্ষে মদিনা থেকে আগত ১২ জন লোক গোপনে রাসুল (সঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেন। তারা ঈমান আনার ঘোষণা দেন এবং মদিনায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে ফিরে যান। রাসুল (সঃ) তাঁর সাহাবী মুসআব –কে মদিনার লোকদেরকে ইসলাম শিক্ষা প্রদান এবং সেখানে ইসলামের দাওয়াতী কাজ প্রসারের উদ্দেশ্যে তাঁদের সাথে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। ফলে পরের বছর হজ্জ উপলক্ষে ৭৫ জন লোক এসে গোপনে আকাবা নামক স্থানে রাসুল (সঃ) এর হাতে বাইয়াত গ্রহন করেন। তারা রাসুল (সঃ) কে মদিনায় হিজরত করার দাওয়াত দিয়ে যান। মদিনা আক্রান্ত হলে জান-মাল দিয়ে তা প্রতিরোধ করারও শপথ নিয়ে যান।
১৬। হিজরতের প্রস্তুতি
সাহাবীগনের উপরে অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। রাসুল (সঃ) মনে মনে মদিনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সে হিসেবে সাহাবীদেরকে যার যেভাবে সম্ভব গোপনে হিজরত করে মদিনায় চলে যাবার অনুমতি দেন। ফলে যাদেরই হিজরত করার সামর্থ্য ছিলো, তারা হিজরত করে মদিনায় চলে যান। থেকে যান আবুবকর। রাসুল (সঃ) তাঁকে নিজের হিজরতের সাথী বানানোর কথা জানিয়ে দেন।
১৭। হত্যার ষড়যন্ত্র
নবুয়্যতের তের বছর মাত্র পূর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ সাহাবী হিজরত করে মক্কা ছেড়েছেন। এসময় ইসলামের শত্রুরা আল্লাহর রাসুলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক রাতে এসে তারা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সকালে বের হলেই তাঁকে হত্যা করা হবে। তাদের এ ষড়যন্ত্রের কথা পরবর্তীতে কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে –
“স্মরণ করো, কাফিররা তোমাকে বন্দী করার, কিংবা হত্যা করার, অথবা দেশ থেকে বহিস্কার করার ষড়যন্ত্র করছিলো। তারা লিপ্ত ছিল তাঁদের চক্রান্তে। এদিকে আল্লাহও তাঁর পরিকল্পনা পাকা করে রাখেন। আল্লাহই সবচে’ দক্ষ পরিকল্পনাকারী।” (সূরা আনফাল, আয়াত ৩০)
মহান আল্লাহ তাঁদের চক্রান্তের খবর আগেই তাঁর রাসুলকে জানিয়ে দেন। তিনি তাঁদের চোখে ধুলা দিয়ে বেড়িয়ে পড়েন হিজরতের উদ্দেশ্যে। ব্যর্থ হয়ে যায় আল্লাহর রাসুলকে হত্যার ষড়যন্ত্র।
১৮। রাসুলুল্লাহর হিজরত
রাসুলুল্লাহ (সঃ) হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে প্রিয় সাথী আবুবকরের বাড়িতে আসেন। আবু বকরও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। এবার দু’জনে বেড়িয়ে পড়লেন মদানার উদ্দেশ্যে। শত্রুদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মক্কা থেকে মদিনা উত্তর দিকে হলেও তারা প্রথমে রওয়ানা করেন দক্ষিন দিকে। কয়েক মাইল দক্ষিনের সওর নামক পাহাড়ের গুহায় তিন দিন অবস্থান করেন। তিন দিন পর সেখান থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এদিকে তার রক্ত পিপাসুরা হন্যে হয়ে খুজেও তাঁর নাগাল পায়নি। তারা তাঁকে ধরার জন্যে শত উট পুরস্কার ঘোষণা করে।
১৯। মদিনায় রাসুলুল্লাহ
রাসুলুল্লাহ (সঃ) আসছেন এ খবর আগেই পৌঁছে গেছে মদিনায়। আনন্দে মাতোয়ারা মদিনা। সম্বর্ধনার বিরাট আয়োজন। মদিনার আবাল বৃদ্ধ জনতা সানিয়াতুল বিদা উপত্যকা পর্যন্ত এগিয়ে এসে তাঁকে সম্বর্ধনা জানায়। মক্কা ত্যাগ করে। মদিনা তাঁকে বরন করে নেয়। তিনিও বরন করে নেন মদিনাকে। মক্কা বিজয়ের পরেও তিনি ত্যাগ করেননি মদিনা।
২০। মদিনার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু
মদিনার পূর্ব নাম ছিলো ইয়াসরিব। রাসুলুল্লাহর আগমনের ফলে পাল্টে যায় ইয়াসরিবের নাম। তখন থেকে এ শহরের নাম হয়ে যায় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। সংক্ষেপে মদিনা। মদিনায় আগমনের পরপরই তিনি এখানে ইসলামী সমাজ নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। শুরুর দিকে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেন। যেমন –
- ১। প্রথমে চৌদ্দ দিন কুবা নামক স্থানে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
- ২। তারপর আসেন মূল অবস্থানের জায়গায়। এখানে জমি ক্রয় করেন। কেন্দ্রীয় মসজিদ ‘মসজিদে নববী’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- ৩। এই মসজিদকে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের কেন্দ্র ঘোষণা করেন। এখান থেকেই তিনি পরিচালনা করেন ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র।
- ৪। হিজরত করে আসা সহায় সম্বলহীন মুসলিম এবং মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। ফলে মুহাজিররা আনসারদের পরিবারের সদস্য হয়ে যায়।
- ৫। ‘মদিনা সনদ’ নামক খ্যাত মদিনার প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে নেন মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদেরকে, মদিনায় অবস্থানরত বিভিন্ন গোত্র ও কবিলাকে এবং সেখানকার ইহুদী গোত্রগুলোকে। এদের সবাইকে একটি ভৌগোলিক জাতি ঘোষণা করেন। শত্রুদের আক্রমন প্রতিহত করার ব্যাপারে সবাই মুহাম্মাদ (সঃ) এর নেতৃত্বে চুক্তিবদ্ধ হয়।
২১। ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যক্রম
মুহাম্মাদ (সঃ) মহান ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মদিনায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন। এ রাষ্ট্রের আদর্শকে ভবিষ্যতের বিশ্ব ব্যবস্থায় রূপদানের কার্যক্রম তিনি হাতে নেন। এ মহান রাষ্ট্রের কয়েকটি প্রধান প্রধান মূলনীতি ও কার্যক্রম হলো। –
- ১। তিনি এ রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এক আল্লাহর সার্বভৌম বিধানের ভিত্তিতে।
- ২। এ রাষ্ট্রের আদর্শ, প্রেরনা ও আইনের উৎস ছিল আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।
- ৩। এ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল জনগনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি, কল্যাণ ও সাফল্য।
- ৪। এ রাষ্ট্রের সরকার ও নাগরিকদের প্রধান দায়িত্ব ছিলো স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য পালন এবং সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালন।
- ৫। এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মসূচী ও কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ও মূলনীতি ছিল জননিরাপত্তা, সুবিচার ও মানবকল্যাণ।
- ৬। এ রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্মসূচী ছিলো – ১। রাষ্ট্র ও জনগনের নিরাপত্তা প্রদান, ২। এক আল্লাহর ইবাদাত প্রবর্তন ও সালাত কায়েম। ৩। শোষণমুক্ত ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থার প্রচলন ও যাকাত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। ৪। পরামর্শ ভিত্তিক শাসন পরিচালনা। ৫। সততা, সুনীতি, সৎকর্ম ও সদাচারের সম্প্রসারন। ৬। দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের অপসারন। ৭। ভালো কাজে প্রেরনা ও সহযোগিতা প্রদান। ৮। মন্দ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। ৯। জনগনের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের ব্যাপক সম্প্রসারন। ১০। জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিধান ও গণপূর্ত।
- ৭। বিশ্বব্যাপী মানবসমাজকে শান্তি ও কল্যাণের দিকে আহবান।
২২। কুরাইশদের আশংকা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি
মুহাম্মাদ (সঃ) হিজরত করে মদিনায় চলে আসার কারনে কুরাইশরা নিজেদেরকে বড় ধরনের বিপদের ঝুকির মধ্যে অনুভব করছিলো। তারা চিন্তা ভাবনা করে দেখলো –
- ১। মদিনায় থেকে মুহাম্মাদ স্বাধীনভাবে তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করার সুযোগ পেয়ে গেলো।
- ২। মুহাম্মাদ গোটা আরবে তাঁর ধর্ম ছড়িয়ে দেবে এবং সব গোত্র ও কবিলার উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করবে।
- ৩। মুহাম্মাদ রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জন করবে।
- ৪। তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
- ৫। সুযোগ মতো মুহাম্মাদ মক্কা আক্রমন করে আমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহন করবে এবং আমাদের মক্কা থেকে উৎখাত করবে।
এসব ভেবে কুরাইশরা রাসুল (সঃ) এর ভিত মজবুত হবার আগেই মদিনা আক্রমন করে তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২৩। রাসুলের বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধ
এদিকে কুরাইশদের পক্ষ থেকে মদিনা আক্রমন হতে পারে এ কথা রাসুল (সঃ) নিজেও ভেবে রেখেছেন।
বদর যুদ্ধ – কুরাইশরা আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। তাঁদের কাছে ছিল ঘোড়া এবং আধুনিক সব সমরাস্ত্র।
রাসুল (সঃ) তাঁদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে তিনশো তের জনের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করেন। বাহিনীর কাছে অশ্ব এবং আধুনিক অস্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিলোনা। দ্বিতীয় হিজরির ১২ বা ১৭ রমযান বদর প্রান্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ছিলো এক ঐতিহাসিক আদর্শিক যুদ্ধ। —
- ১। এক পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো আল্লাহর জন্যে, আল্লাহর পথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষে। অপর পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো তাগুতের পক্ষে, মিথ্যা বাতিলকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেএবং নিজেদের অবৈধ স্বার্থ হাসিলের পথ নিরাপদ রাখতে।
- ২। এক পক্ষ নির্ভর করেছিলো আল্লাহর সাহায্যের উপর। অপর পক্ষ নির্ভর করেছিলো নিজেদের সমর শক্তির উপর।
- ৩। এক পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো জীবন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করার জন্যে। অপর পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো নিজেদের জীবন রক্ষা করার জন্যে।
- ৪। এক পক্ষের যুদ্ধ ছিল প্রতিরক্ষামূলক। অপর পক্ষের যুদ্ধ ছিলো আগ্রাসী।
- ৫। এক পক্ষের যুদ্ধ ছিলো ব্যাক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থের ঊর্ধ্বে। অপর পক্ষের যুদ্ধ ছিল ব্যাক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থ রক্ষার লক্ষে।
অবশেষে এ যুদ্ধে ইসলামী বাহিনী বিজয়ী হয়। আগ্রাসী কুরাইশ বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে আগ্রাসী কুরাইশদের সেনাপতি আবু জেহেল সহ ৭০ জন নিহত হয় এবং আরো ৭০ জন মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়। এদিকে ২২ জনজন মুসলিম সেনা শাহাদাৎ বরন করেন। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায়।
উহুদ যুদ্ধ- কুরাইশরা বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পরের বছর তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে আবার মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। এবার তারা তাঁদের প্রভাবিত পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে নেয়। তারা তিন হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। রাসুল (সঃ) যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। যুবকদের আগ্রহের কারনে তিনি মদিনার বাইরে গিয়ে উহুদ পাহাড়ের কাছে শত্রু বাহিনীর মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। সাতশো জানবাজ সাহাবীর বাহিনী নিয়ে তিনি উহুদে এসে পৌঁছান। উহদ পাহাড়কে পেছনে রেখে রাসুল (সঃ) যুদ্ধ লড়ার স্থান নির্ধারণ করেন। পেছনের আইনান পাহাড়ে একটা সুড়ঙ্গ ছিলো। শত্রু বাহিনী এ সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে তাঁদের পেছন দিক থেকে আক্রমন করতে পারে এ আশংকায় রাসুল (সঃ) সুড়ঙ্গ মুখে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনী নিযুক্ত করেন। তাঁদের নির্দেশ দেন, যুদ্ধে আমাদের জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমরা কোন অবস্থাতেই এ স্থান ত্যাগ করবেনা। যুদ্ধ শুরু হল। মুসলিম বাহিনীর আক্রমনের তীব্রতায় টিকতে না পেরে কুরাইশ বাহিনী তাঁদের সাজ সরঞ্জাম ফেলে পালাতে শুরু করে। মুসলিম বাহিনী তাঁদের চরম তাড়া করে। এদিকে সুড়ঙ্গ মুখে নিয়োজিত লোকেরা ভাবলো, যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়ী হয়েছে। ফলে তাড়া তাঁদের সেনাপতি আব্দুল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে মূল বাহিনীর সাথে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। আব্দুল্লাহ মাত্র বারো জন তীরন্দাজ নিয়ে নিজের অবস্থানে অটল থাকেন। এদিকে শত্রু পক্ষের অশ্বারোহী দলের প্রধান খালিদ বিন ওয়ালিদ সুড়ঙ্গ পথ অরক্ষিত পেয়ে এখান দিয়ে ঢুকে পড়েন। আব্দুল্লাহ এবং তাঁর সাথীরা তাঁদেরকে প্রতিহত করার প্রানপন চেষ্টা করে শাহাদাৎ বরন করেন। খালিদ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা করে। মুসলিম বাহিনী এদের প্রতিহত করার জন্যে পেছনমুখী হলে পলায়নপর শত্রু বাহিনী ঘুরে দাড়ায়। শুরু হয় দ্বিমুখী আক্রমন। ফলে মুসলিম বাহিনী হতভম্ব হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে রাসুল (সঃ) সবাইকে একত্রিত করেন এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুপক্ষকে তাড়া করেন এবং তারা মক্কায় ফিরে যায়। এরই মধ্যে মুসলিম বাহিনীর বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। ৭০ জন সাহাবী শাহাদাৎ বরন করেন। আহত হন অনেকে। কয়েকজন সৈনিক কর্তৃক সেনাপতির নির্দেশ লংঘনের ফলে মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে এই বিরাট বিপর্যয়।
খন্দকের যুদ্ধ – পঞ্চম হিজরি সন। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হতে না পারলেও কুরাইশরা ভালোভাবেই বুঝেছিল, তাঁরাও বিজয়ী হতে পারেনি। ইসলামী রাষ্ট্র পূর্বের অবস্থায়ই সদর্পে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তারা বিশাল প্রস্তুতি নেয়। আশেপাশের সব মিত্র গোত্রের যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে তারা অগ্রসর হয় মদিনার দিকে। এদিকে রাসুল (সঃ) যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। এবার তিনি এক অভিনব কৌশল গ্রহন করেন। তাহলো, মদিনায় প্রবেশের গোটা এলাকা জুড়ে তিনি পরীখা খননের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজে এবং সক্ষম সকল সাহাবীরাই পরীখা খননের কাজে অংশ নেন। দশ গজ চওড়া, পাঁচ গজ গভীর সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ পরীখা তারা খনন করে ফেলেন। এতে প্রায় তিন লাখ আট হাজার বর্গগজ মাটি খনন ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়ে রাসুল (সঃ) মাত্র পনের দিনে এ বিশাল যুদ্ধ কৌশল বাস্তবায়ন করেন। এতেই বুঝা যায়, তারা কতটা পরিশ্রম করেছেন। মাথা প্রতি প্রায় এক হাজার বর্গগজের চাইতে বেশী মাটি কাটতে ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। পরিখা খননের কাজ শেষ হতে না হতেই কম বেশী দশ হাজার বাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে কুরাইশরা মদিনার উপকণ্ঠে এসে হাজির হয়। কিন্তু অভিনব কৌশলের পরিখা দেখে তাঁদের মাথায় হাত। তবে মদিনার ঘরের শত্রু ইহুদীরা কুরাইশদের সাথে গপনে হাত মিলিয়ে ফেলে। ফলে মুসলিমদের বাড়ি ঘরগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। কিন্তু মহান আল্লাহর সাহায্যে কুরাইশ বাহিনী দীর্ঘ এক মাস মদিনা অবরোধ করে রেখেও কোন সুবিধা করতে পারে নি। এ সময় এক রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড় কুরাইশদের তাঁবুগুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁদের বাহিনী পুরোপুরি মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং রাতের অন্ধকারেই তারা মদিনা অবরোধ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পরপরই রাসুল (সঃ) মদিনা সনদ ভঙ্গকারী ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযাকে চরমভাবে শায়েস্তা করেন। মহান আল্লাহ এ যুদ্ধের পর্যালোচনা করেছেন সূরা আহযাবের ৯-২৭ নং আয়াতে। মহান আল্লাহ বলেন-
“হে মুমিনরা, স্মরণ করো তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের এখানে এসে পড়েছিলো, তখন আমরা তাঁদের প্রতি পাঠিয়েছিলাম ঝরো হাওয়া আর এমন এক বাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি।” (আহযাব, আয়াত ৯)
কুরাইশরা চলে যাবার পড়ে রাসুল (সঃ) ঘোষণা দিলেন- “কুরাইশরা আর কখনো মদিনা আক্রমন করতে পারবেনা। ”
এগুলো ছিল বড় বড় যুদ্ধ, এ ছাড়াও আরো অনেক ছোট খাটো অভিযান পরিচালিত হয়েছে।
২৪। হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং এর সুফল
ষষ্ঠ হিজরি সন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বপ্নে হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার নির্দেশ পান। জেনে রাখা ভালো, নবীদের স্বপ্নও অহী। সে অনুযায়ী তিনি এবছর যিলকদ মাসের শেষ দিকে চৌদ্দশত সাহাবী নিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সাথে করে নেন কুরবানীর উট। হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের বাধা দেয়া মক্কার সনাতন ধর্মেও নিষেধ ছিলো। কিন্তু কুরাইশরা রাসুল (সঃ) এর কাফেলাকে মক্কার নিকটবর্তী হুদাইবিয়া নামক স্থানে এসে বাধা দেয়। তিনি উসমান (রা) –কে মক্কায় পাঠান তাঁদের নেতাদের একথা বলার জন্যে যে, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আসিনি। আমরা হজ্জ, উমরা, কুরবানী ও যিয়ারত শেষে চলে যাবো। আমরা কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা তাঁর কথা শুনেনি। তারা তাঁকে আটকে রাখে। উসমানকে অর্থাৎ রাসুলের দূতকে আতক করার সংবাদ শুনে সাহাবীগন উসমানকে উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞা করেন। তারা এ উদ্দেশ্যে রাসুল (সঃ) এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহন করেন। এ শপথে সন্তুষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ সাহাবীদের প্রসঙ্গে বলেন –
“আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।” (সূরা আল ফাতাহ, আয়াত ১৮)
অবশ্য পরে কুরাইশরা উসমান (র) কে ছেড়ে দেয়। তিনি ফিরে আসেন। তারা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে আসে। রাসুল (সঃ) তাঁদের আরোপিত শর্তানুযায়ী সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সন্ধির অধিকাংশ শর্তই ছিল বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্যে অপমানজনক। কিন্তু তাতে দশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ না করার একটি ধারা ছিল। সাহাবীগন মনঃক্ষুণ্ণ হওয়া সত্যেও রাসুল (সঃ) এই ধারাটিকে লুফে নিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে এ বছর উমরা না করে পরের বছর উমরা করার একটি শর্ত ছিলো। সে অনুযায়ী রাসুল (সঃ) কাফেলা নিয়ে ফিরে চললেন মদিনার দিকে। পথিমধ্যেই নাযিল হল সূরা আল ফাতাহ। এ সুরার প্রথম আয়াতেই বলা হয়েছে-
“হে নবী, আমরা তোমাকে এক সুস্পষ্ট বিজয় দিলাম।’’
সত্যিই এ ছিলো এক সুস্পষ্ট বিজয়। রাসুল (সঃ) সাহাবীগণকে নিয়ে নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারন করতে থাকলেন। দুই বছরের মধ্যেই কুরাশরা বন্ধুহীন হয়ে পড়লো। খালিদ বিন অয়ালিদ এবং আমর ইবনুল আস সহ কুরাইশদের অনেক বড় বড় সেনাপতি এরই মধ্যে ইসলাম গ্রহন করেন।
২৫। মক্কা বিজয়
হুদাইবিয়ার সন্ধিতে যে অন্যায় শর্তাবলী দিয়ে চুক্তি সম্পাদিত করেছিল, সেগুলো তাঁদের জন্যেই বুমেরাং হয়ে দাড়ায়। ফলে সে চুক্তি তারা নিজেরাই ভংগ করে। অপরদিকে রাসুল (সঃ) নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াতী কাজ করতে থাকেন। ইসলামী জনবল বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আরবের অধিকাংশ গোত্রই পর্যায়ক্রমে কুরাইশদের সাথে মিত্রতা ত্যাগ করে। যাই হোক, চুক্তি ভংগের কারনে রাসুল (সঃ) মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। অষ্টম হিজরি সনের ১০ রমযান। রাসুল (সঃ) দশ হাজার জিন্দাদিল ইসলামী সেনাদল সাথে নিয়ে রওয়ানা করলেন মক্কা অভিমুখে। ২০ রমযান মুহাম্মাদ (সঃ) বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন মক্কায়। আজ আর তাঁকে বাধা দেয়ার কোন শক্তি কারো ছিলো না। সম্পূর্ণ বিনা বাধায় আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে তিনি এবং তাঁর সাথীরা মক্কার হারাম শরীফে প্রবেশ করেন।
ভেঙ্গে ফেলেন আল্লাহর ঘরে রাখা ৩৬০ টি ভাস্কর্য মূর্তি। তাঁকে চরম কষ্ট দিয়ে থাকলেও তিনি ক্ষমা করে দেন মক্কার লোকদের। তিনি তাঁদের বলেন- ‘আজ আর তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত। মক্কার আশেপাশের গোত্রগুলোতে রক্ষিত মূর্তিগুলোও নির্মূল করা হলো। মক্কা ভূমি থেকে উৎপাটিত করা হলো শিরকের শিকড়। ঘোষণা করা হলো আল্লাহর একত্ব, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহর রাসুল (সঃ) কয়েকদিন মক্কায় অবস্থান করেন। এখান থেকে গিয়ে অভিযান চালিয়েই জয় করেন, হাওয়াযীন ও বনু সাকিফ। হোনায়েন প্রান্তরে যুদ্ধ হয় এদের সাথে। তারা চরমভাবে পরাজিত হয়। এ সময় তিনি তায়েফও অধিকার করেন। মক্কা বিজয় উপলক্ষে রাসুল (সঃ) উনিশ দিন মক্কায় অবস্থান করেন। হোনায়েন ও তায়েফ যুদ্ধের পর ফিরে আসে মদিনায়।
২৬। ইসলামের ছায়াতলে জনতার ঢল
মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহনের জন্যে জনতার স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে মদিনার অভিমুখে। আরব উপদ্বীপের ছোট বড় সব গোত্র তাঁদের প্রতিনিধি দল পাঠাতে থাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে তাঁদের ইসলামের ছায়াতলে আগমনের সংবাদ জানাবার জন্যে। মক্কা বিজয়ের পরবর্তী বছর বড় ছোট শতাধিক প্রতিনিধিদল মদিনায় এসে তাঁদের এবং তাঁদের গোত্রের ইসলাম গ্রহনের ঘোষণা দেয়। ইসলামের ছায়াতলে এই জনস্রোতের আগমনের কথা মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন –
“যখন এসেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, এবং তুমি দেখতে পাচ্ছো, লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করছে আল্লাহর দীনে। তখন তোমার প্রভুর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করো তাঁর কাছে। অবশ্যি তিনি পরম ক্ষমাশীল দয়াবান।” (সূরা আন নাসর)
২৭। তাবুক যুদ্ধ
রাসুলুল্লাহ (সঃ) কর্তৃক সবচেয়ে বড় অভিযান ছিলো তাবুক অভিযান। এ অভিযান ছিলো বর্তমান সিরিয়া ও জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত তৎকালীন বৃহৎশক্তি রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। অভিযানের রয়েছে পূর্ব ঘটনা। তাহলো, হুদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসুল (সঃ) মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে গোটা আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতী প্রতিনিধি দল পাঠান। এছাড়া সর্দার ও শাসকদের কাছে পত্র মাধ্যমে দাওয়াত দিয়ে দূত পাঠান। সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি তাঁর একটি পনের সদস্যের দাওয়াতী প্রতিনিধিদলকে খ্রিষ্টানরা হত্যা করে। প্রানে বেঁচে আসে শুধুমাত্র দলনেতা কাব বিন উমায়ের গিফারী। একই সময় রাসুল (সঃ) বুসরার গভর্নরের কাছে দাওয়াত নিয়ে পাঠিয়েছিলেন হারিস বিন উমায়েরকে। কিন্তু রোম সম্রাটের অনুগত এই খৃষ্টান সর্দার আল্লাহর রাসুলের দূতকে হত্যা করে। রোম সাম্রাজ্যের এসব অন্যায় ও অপরাধমূলক আগ্রাসী থাবা থেকে আরব অঞ্চলকে নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে অষ্টম হিজরির জমাদিউল উলা মাসে রাসুল (সঃ) হযরত যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সিরিয়ার দিকে পাঠান। কিন্তু এই সেনাদলটি মাআন নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন, বুসরার গভর্নর শুরাহবিল এক লাখ সৈন্য নিয়ে তাঁদের মোকাবেলা করার জন্যে এগিয়ে আসছে। সামনে অগ্রসর হয়ে মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লাখ সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তিন হাজার জিন্দাদিল মুসলিম এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ব্যাপক হতাহত হয় শুরাহবিল বাহিনী। এ যুদ্ধে বারোজন মুসলিম সেনাও শহীদ হন। এই বারো জনের মধ্যে মুসলিম বাহিনীর তিন সেনাপতিও অন্তর্ভুক্ত। তারা হলেন- যায়িদ বিন হারিসা, জাফর বিন আবু তালিব এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা)। পরের বছর নবম হিজরিতে রোম সম্রাট কাইজার মুসলমানদের থেকে মুতা যুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়া এবং তাঁদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে সিরিয়া সীমান্তে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। জানা যায়, তারা সীমান্তে দুই লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। আরব ভূখণ্ডের দিকে আর এক কদমও অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই রাসুল (সঃ) তাঁদেরকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ অভিযান ছিল ব্যাপক দূরত্বের অভিযান। ছিলো গরমের মওসুম, অর্থনৈতিক সমস্যা, ফসল পাকার মওসুম, সোয়ারীর অভাব। তা সত্যেও রাসুল (সঃ) বৃহৎ শক্তির হামবড়া ভাব স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। নবম হিজরির রযব মাসে তিনি ত্রিশ হাজার জিন্দাদিল মুজাহিদকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করেন সিরিয়া সীমান্তের দিকে। এদিকে রোম সম্রাট ত্রিশ হাজার মুসলিম সৈন্যের আগমনের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। বিশ্বনবী (সঃ) তাবুক নামক স্থানে পৌঁছে খবর পান, কাইজার সিরিয়া সীমান্ত থেকে তাঁর বাহিনী গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে সিরিয়া প্রবেশ না করে রাসুল (সঃ) বিশ দিন তাবুকে অবস্থান করেন। আরব ভূখণ্ডে কাইজারের যেসব ছোট ছোট করদ রাজ্য ছিলো, তিনি সেগুলোর সর্দারদের উদ্দেশ্যে ছোট ছোট বাহিনী পাঠান। এতে করে তারা মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এভাবে আল্লাহ পাক স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসলামের প্রভাব সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সূরা আত তওবার ৩৮-৭২ নং আয়াত তাবুক যুদ্ধে যাত্রার প্রাক্কালে এবং ৭৩ থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত আয়াতগুলো তাবুক থেকে ফিরে আসার পরে নাযিল হয়। এ আয়াতগুলোতে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্যে উৎসাহ প্রদান এবং তাবুক যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়েছে। সূরা তাওবার এ আয়াতগুলো পড়লে তাবুক যুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া যাবে।
২৮। বিদায় হজ্জ
হজ্জ ফরয হওয়ার পর রাসুল (সঃ) একবারই হজ্জ করেন। আবার এ হজ্জেই তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। সে কারনে এ হজ্জকে বিদায় হজ্জ বলা হয়। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বিদায়ী হজ্জ। দশম হিজরি সন। এ বছর বিশ্বনবী, বিশ্বনেতা মুহাম্মাদ (সঃ) হজ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন পর্যন্তকার গোটা মুসলিম মিল্লাতকে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, রাসুলুল্লাহর হজ্জে যাবার খবর। সব গোত্র ও কবিলার সামর্থ্যবান মুসলিমরা হজ্জে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। চতুর্দিকে বইয়ে চলছে আনন্দের বন্যা। দশ হিজরি সনের ২৬ জিলকদ তারিখে আল্লাহর রাসুল (সঃ) হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। ৫ জিলহজ্জ তারিখে মক্কায় পৌঁছান। হজ্জ শেষে ১৪ যিলহজ তারিখে ফিরে রওয়ানা করেন মদিনা অভিমুখে। এ হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর রাসুল (সঃ) দুটি ভাষণ প্রদান করেন। একটি আরাফার ময়দানে অপরটি মিনায়। তাঁর এ ভাষণ ছিলো ইসলামী রাষ্ট্রের মেনিফেস্টো। এক লাখ চব্বিশ হাজার, কোন কোন বর্ণনায় এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবী তাঁর সাথে হজ্জে শরীক হয়েছিলেন। তাঁর এ হজ্জই মুসলিম উম্মাহর জন্যে হজ্জের মডেল।
২৯। বিদায় হজ্জের ভাষণ
হজ্জ উপলক্ষে রাসুল (সঃ) দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন। একটি ৯ যিলহজ্জ তারিখে আরাফার ময়দানে। অপরটি ১০ যিলহজ্জ তারিখে মিনায়। এ দুটি ভাসনে তিনি অনেকগুলো মৌলিক নির্দেশনা তিনি প্রদান করেছিলেন। তাঁর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো—
- ১। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মাদ তাঁর দাস ও রাসুল।
- ২। আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর ইবাদাত ও উপাসনা করবে।
- ৩। তোমাদের প্রত্যেকের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র। পরস্পরের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন নিষিদ্ধ করা হলো।
- ৪। আমানাত তাঁর প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে দেবে।
- ৫। সুদ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো।
- ৬। জাহেলী যুগের সমস্ত কুসংস্কার রহিত করা হলো।
- ৭। খুনের প্রতিশোধ যুদ্ধ রহিত করা হলো।
- ৮। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অনিচ্ছাকৃত হত্যার দণ্ড একশো উট।
- ৯। তোমরা শয়তানের আনুগত্য করোনা।
- ১০। তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের উপর স্বামীদের অধিকার হলো তারা স্বামী ছাড়া আর কারো সাথে যৌনাচার করবেনা। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তারা তাঁর অর্থসম্পদ খরচ করবেনা।
- ১১। স্বামীদের উপর স্ত্রীদের অধিকার হলো, তারা পবিত্র জীবন যাপন করলে স্বামী প্রচলিত উত্তম পন্থায় তাঁদের জীবন সামগ্রী প্রদান করবে।
- ১২। একজনের অপরাধের জন্যে আর একজনকে দণ্ড দেয়া যাবেনা।
- ১৩। তোমাদের নেতা কোন নাক বোঁচা হাবশি হলেও সে যদি আল্লাহর কিতাবের আনুগত্য করে, তবে তাঁর আদেশ পালন করবে।
- ১৪। মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই।
- ১৫। সমস্ত মানুষের স্রষ্টা একজন। সবার পিতাও একজন। সুতরাং কোন মানুষের উপর অপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
- ১৬। তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান সে, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু ও ন্যায়নীতিবান।
- ১৭। তোমাদের অধিনস্তদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হও। তাঁদের প্রতি অন্যায় করোনা। তাঁদের আঘাত করোনা। তোমরা যা খাবে, পরবে, তাদেরকেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
- ১৮। বিবাহিত ব্যাভিচারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
- ১৯। উত্তরাধিকার কে কতটুকু পাবে, স্বয়ং আল্লাহ তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ারিশদের জন্যে আর অসিয়ত করা যাবেনা।
- ২০। মনে রেখো, ঋণ অবশ্যি পরিশোধ করতে হবে।
- ২১। মনে রেখো, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা। (দলাদলি ও কট্টরপন্থা অবলম্বন করবেনা।)
- ২২। আমার পরে আর কোন নবী আসবেনা। আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতোদিন এ দুতিকে আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন তোমরা বিপথগামী হবেনা। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং অপরটি হলো সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ।
যারা এখানে উপস্থিত আছো, তারা এ ফরমানগুলো অনুপস্থিতদের কাছে, পরবর্তীদের কাছে পৌঁছে দেবে।
৩০। মুহাম্মাদ (সঃ) এর মৃত্যু
কোন নবী রাসুলই চিরজীবী হননি। সবারই মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি মানুষেরই মৃত্যু অবধারিত। মুহাম্মাদ (সঃ) সম্পর্কেও আল্লাহ বলেন – “হে মুহাম্মাদ, তুমিও মরনশীল, তাঁরাও মরনশীল।” (আল কুরআন ৩৯ ; ৩০)
হজ্জ শেষে রাসুল (সঃ) যিলহজ মাসের শেষার্ধেই মদিনায় ফিরে আসেন। এরপর মহররম মাস মোটামুটি ভালোভাবেই অতিবাহিত করেন। সফর মাস থেকে তাঁর অসুস্থতা দেখা দেয়। ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেন আখিরাতের দিকে। মৃত্যুর চার পাচদিন আগে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী লোকেরা তাঁকে ধরাধরি করে মসজিদে নিয়ে এসেছিলো। সেদিন তিনি সাহাবীগনের মজলিশে সর্বশেষ একটি ছোট্ট ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন-
“তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাঁদের নবী ও পুণ্যবান লোকদের কবরকে সিজদার জায়গা বানিয়েছিল। তোমরা এমনটি করোনা। আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার কবরকে সিজদা ও উপাসনার জায়গা বানিয়ো না। যারা নবী ও পুণ্যবানদের কবর পূজা করবে, তাঁদের উপর আল্লাহর গযব। আমি তোমাদেরকে একাজ করতে নিষেধ করছি। আমি তোমাদের কাছে সত্য বানী পৌঁছে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।”
৩১। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা
মুহাম্মদ (সঃ) এর মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে গেলো নবী রাসুল আগমনের সিলসিলা। পৃথিবীতে আর কোন নবী রাসুল আসবেন না। তাই মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সঃ) এর মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম বা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের উপযোগী করে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। বিদায় হজ্জ উপলক্ষে আরাফার ভাষণের সময় মহান আল্লাহ অহী নাযিল করে এ সংক্রান্ত ডিক্রি জারি করেন। তিনি বলেন-
“আজ আমি তোমাদের জন্যে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম তোমাদের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা), পরিপূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত (কুরআন) এবং তোমাদের জন্যে দ্বীন (ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা) মনোনীত করলাম ইসলামকে।” (আল কুরআন ৫ ; ৩) এ ছাড়াও মহান আল্লাহ কুরআন মজীদে আরো বলে দিয়েছেন-
- ১। “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে দ্বীন হলো ইসলাম।” (আল কুরআন ৩ ; ১৯)
- ২। “যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (ধর্ম, মতাদর্শ ও জীবন পদ্ধতি) গ্রহন করবে, তাঁর থেকে তা গ্রহন করা হবেনা। আর আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” (আল কুরআন ৩ ; ৮৫)
- ৩। “আল্লাহ কাউকেও সঠিক পথে চলার তৌফিক দিতে চাইলে ইসলামের জন্যে তাঁর হৃদয়কে উম্নুক্ত করে দেন। আর তিনি যাকে বিপথগামী করতে চান, তাঁর অন্তরকে করে দেন সংকীর্ণ। তখন তাঁর কাছে ইস্লামে প্রবেশ করাটা সিঁড়ি বেয়ে আকাশে উঠার মতই কষ্টসাধ্য মনে হয়। যারা ঈমান আনেনা, আল্লাহ এভাবেই তাঁদের লাঞ্ছিত করেন।” (আল কুরআন ৬ ; ১২৫)
- ৪। “আল্লাহ যার হৃদয় উন্মুক্ত করে দেন ইসলামের জন্যে এবং যে রয়েছে তাঁর প্রভুর প্রদত্ত আলোর মধ্যে, সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য, যার অবস্থান এরকম নয়?” (আল কুরআন ৩৯ ; ২২)
- ৫। “ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় যালিম আর কে? যাকে ইসলামের দিকে ডাকা হলে সে মিথ্যা রচনা করে আল্লাহর দিকে আরোপ করে? ’’(আল কুরআন ৬১ ; ৭)
- ৬। “আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটি আলোকবর্তিকা (মুহাম্মাদ সাঃ) এবং একটি সুস্পষ্ট কিতাব (আল কুরআন)। এর মাধ্যমে আল্লাহ সে সব লোকদের সালামের (ইসলামের, শান্তির ও নিরাপত্তার) পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তোষ লাভের আকাঙ্ক্ষী। আর তিনি নিজ অনুমতিক্রমে তাঁদের বের করে আনেন অন্ধকাররাশি থেকে আলোতে এবং তাঁদের পরিচালিত করেন সরল সঠিক পথে।”
(আল কুরআন ৫ ; ১৫-১৬)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।