পাড়ায় যেমন দুষ্টু বালকের দল দাদাগিরি করে বেড়ায় এরকম একটা বানরের দুষ্টু দল ছিল দক্ষিন সুন্দরবনের গহিনে। কটকা খালের পাশের চরের নাম টিয়াচর। এই চরে প্রচুর টিয়া পাখির বাস। গাছে গাছে টিয়া আর টিয়া। এখানেই এই দস্যি বানর তার দলবল নিয়ে আড্ডা মারে-ঘুরে বেড়ায়। এ দলের নেতা ছিল ভীষন রকমের দুষ্টু। ওর বয়স বারো-তের হবে তবুও ইঁচড়ে পাকার শেষ। নামটাও স্কুল পালানো বালকের মতো-বিল্লু। দুষ্টু বুদ্ধিতে বিল্লুর মাথা টসটস করে সারাক্ষন। বিল্লুর জ্বালায় সমস্ত বানরকুল অস্থির। বিল্লু তার বাড়ী থেকে শুরু করে সবার সাথেই সুযোগ পেলেই একটা দুষ্টুমি করবে। জন্মের পর থেকেই বিল্লু জ্বালানো শুরু করেছে মা-বাবাকে। এই যেমন এটা খাবো না ওটা খাবো। আমি এখন বড় হয়েছি বড় কলাটা আমাকে দাও, বাদামগুলো একলা খাবো। দাদাভাইকে আদর করো বেশি আমাকে করো না কতো তার পাকামো। আর ভাইদের সাথে ঝগড়া বোনেদের সাথে ঝগড়া করা তার নিত্যদিনের কাজ। এইরকম প্রতিদিনই নানান ভোগান্তি বিল্লুটা ভোগাতে থাকে। গতবছর দুষ্টুমিটা একটু বেশি করায় বাড়ি থেকেই না শুধু পাড়া থেকেও বের করে দিয়েছে বিল্লুর বাবা-মা। বলেছে, যাও তুমি আমাদের কথা শুনবে না শুধুই পাকামো আর মাস্তানী কর, তুমি এবার তোমার মতো চলো- তোমার জন্যে আর বানরজাতির মান সম্মান কিছুই থাকছে না। বিল্লু কিছুই বলেনি কেবল ভেবেছে তার অপরাধ; একটু-ই তো মজা করেছে-পাশের বাড়ির নতুন হাঁটতে শিখেছে যে বানরটা; ওই যে ছুট্টু ওকে চান্স পেয়ে লেজ ধরে ভোঁ ঘুর্ণি দিয়েছে- আর ছুট্টু চিঁইইইই… করে পুরো পাড়া একজায়গায় করে দিয়েছে। তিনদিন ছুট্টুটা কথা পর্যন্ত বলতে পারেনি, শুয়ে শুয়ে কেবল পেঁপের জুস আর বেলের জুস খেয়েছে। এইজন্যেই তো সবার সিদ্ধান্ত মতো বিল্লু আর এই পরিবার না, দল না পুরো পাড়ায় থাকতে পারবে না। কেন সে রোজ রোজ এই বজ্জাতি করবে?
কি আর করা, বিল্লু তাই একলাই বেরিয়ে পড়ে।
পথে দেখা হয়ে যায় তার প্রিয় বন্ধু লাট্টুর সাথে।
কি রে পাগলা কৈ যাস এই ভোঁ রোদ্দুরে, মন খারাপ না’কি?
লাট্টুর কথায় সায় দেয় হুম, কিছুই করলাম না ওমনি বাড়ী থেকে বের করে দিল। যা আমিও প্রতিজ্ঞা করেই বেরিয়েছি আর কখনোই ফিরবো না বাড়ী। আমি বড় হয়েছি আমারও তো একটা মান সম্মান আছে।
হ্যাঁ রে বন্ধু, তোর মতোন আমারও দশা। প্রতিদিন-ই কথা শোনায় বাবা, আমিও যাব তোর সাথে চল। তুই যাবি যেখানে আমিও আজ থেকে সেখানে।
বিল্লু অবাক হয়ে বলে ওঠে সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি, আমারও আর ভালো লাগে না। আজ থেকে আমরাই আমাদের গার্জিয়ান কী বলিস বলেই, লাট্টু নীচু করে বিল্লুর সামনের পায়ে বাঁধিয়ে দিল পা আর ফটাস্ করে পড়ে গেল বিল্লু।
তারপর আবার লাট্টু নিজেই বিল্লুর হাত ধরে উঠিয়ে বললো কী ওস্তাদ ক্যামন লাগলো, বিল্লু বললো- মন্দ না তোর বদমায়েশিটা বেশ পাকিয়েছিস দেখছি। চল বেরিয়ে পড়ি।
বিল্লুর খুব কাছের বন্ধু হলো লাট্টু। লাট্টুর সাথেও তেমন তার জমে যায়। দুটো একসাথে থাকলে পাড়ার সমস্ত বড় ভাইরাও ভয়ে কাঁপে। বিল্লু তার বন্ধু লাট্টুকে বললো, শোন আমাকে তো বের করে দিয়েছে আর তোকে তো কেউ গোনেই না তাহলে তুই আর আমি তো এক দলের এখন। লাট্টু বললো, হুঁ আমিও তাই ভাবছি। তাহলে কী করবো আমরা?
বিল্লু বললো, আমরাও একটা দল বানাবো, দুষ্টু বানরের দল। পুরো বনে আমাদের মতো সব দুষ্টু বানর এই দলে থাকবে। আমরা কেবল বনে বনে ঘুরে বেড়াবো আর যেখানে যা পাবো তাই খাবো। আর আমার এই যে ধনু-বান আছে এটা দিয়ে শিকার করবো।
যেই কথা সেই কাজ সাত-আট দিন ঘুরে ঘুরে সারা বনে দুষ্টু বানর খুঁজে পেল সাত জন। এই সাত জনেই সারা বনে ঘুরে ঘুরে পাকা পেঁপে, লিচু, জামরুল, আনারস যত্তো ফল খেয়ে নেয়। রাতের বেলায় সব পশুপাখি যখন ঘুমিয়ে যায় তখন বিল্লু তার দলবল নিয়ে নতুন নতুন ফন্দি আঁটে। কাল কার বারোটা বাজাবে, কার ক্ষেতে হানা দেবে কার কলাবাগানের কাঁদিটা কাটবে, কোন দলের উঠতি বাদরটা বেয়াড়া হয়ে গেছে একটু কান মলে দিতে হবে; এইসব তার দলের প্রতিরাতের আলোচ্য বিষয়। এখন তাদের আস্থানাটা টিয়াচর ঠিকই। তবুও তার একটা এলাকা আছে যেসব জায়গায় মাঝে মাঝে যায়, একটু গল্প করতে, আড্ডা মারতে। টিয়াচরের চারপাশে নদীর পানি ছোট ছোট গাছ কিনার দিয়ে এঁটে রয়েছে। নদীর ঢেউ এসে গাছের গায়ে লেগে গানের সুর তোলে আর মাঝে মাঝে বাওয়ালী-মউয়ালরা যায়। তবে বনের কেউ তাদের এই টিয়াচরের আস্তানার কথা জানে না। চরের বড় বড় কেওড়া ডালে রোজ গোসলের সময় হলে দোল খায় দোলনার মতো; বিল্লুর দলের সবগুলোই হলো ঘোর এঁচড়ে পাকা একজনকে দোল খেতে দেখলে বাকি ছয়টা এসে লেজ ধরে ঝুলে পড়ে আর টপাটপ লাইন ধরে নীচে পড়ে গিয়ে বলে উহুঃ আহঃ করতে থাকে। একবার তো বিরুট পাড়ার দস্যি বানর বাক্কুর হাতে এমন জোরে ব্যথা লাগলো যে তিন দিন মাস্তানী করতে পারেনি। বিল্লু অবশ্য বলেছিল, যা শেয়াল মামার কাছে আলাপ করে একটা ঔষুধ খাওয়ায়ে দে; সবাই তো বিল্লুর কথা শুনে থি-হি-হি করে হেসে শেষ। বিল্লু বললো হাসলি কেন দাদাগিরি করছিস সবগুলো?
তখন ব্যথা পাওয়া বাক্কু ও বললো, বিল্লুদা শেয়াল মামা তো পন্ডিত ব্যক্তি সে তো আর বদ্যি না। তখন বললো, ওই হলো একটা-তাইলে বদ্যির কাছে যা।
শীতের আগে আগে সময়টা বেশ মজা হয়। দুবলার চরে বসে রাস মেলা। জলপাই রঙের মোচঅলা লোকগুলো বড় বড় জাহাজে করে আসে। তারপর ছোট ছোট নৌকায় করে ঘুরে বেড়ায়। শহর থেকে কত্তো মজার মজার খাবার কিনে আনে। হরিণ শিকারে ওরা আবার আনন্দ পায় খুব। হরিণের দল এই সময়ে বেশ ভয়ে থাকে কখন কোথা থেকে এসে গুলি করে, জাল পেতে ধরে নিয়ে যায়; বিল্লুর দল আবার বেশ উপকারকরে হরিণদের আগে থেকে কোনো নৌকা বা জাহাজ দেখলে চিইইইইইই করে সাবধান করে দেয় হরিণদের। এবার অবশ্য বিল্লু একটু অন্যরকম বুদ্ধি এঁটেছে। যেভাবে হোক একটা নৌকার সব ফল নিয়ে নেবে। নৌকা দেখলেই তক্কে তক্কে থাকে চোখে চোখে রাখে তার দস্যিবাহিনী নিয়ে।
পাশের কটকা খালে একটা নৌকা ভিড়েছে খবর দিল হাক্কু বানর। জনা দশেক লোক আছে। আজ রাতেই যেভাবে হোক সব ফল আর খাবার দাবার নিতে হবে। বিল্লুর পরামর্শ হলো রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে তখন তারা চুপি চুপি গিয়ে নৌকা থেকে সমস্ত কিছু নিয়ে আসলে হয়ে যাবে। কেবল সাবধান থাকতে হবে ওরা টের না পায়। কিন্তু ঘটনাটা ঘটলো উল্টো। রাতে গিয়ে দেখা গেল কেউ নৌকায় নেই প্রচুর খাবার আর ফল-ফলারি পড়ে আছে। বিল্লুরা দেরি না করে সব বস্তায় ভরে টানতে টানতে নদীর কিনার থেকে একটু দূরে এসেছে তখন শোনা গেল কান্না। আমাকে ছেড়ে দাও আমাকে ছেড়ে দাও। আমি মার কাছে যাবো বাবার কাছে যাবো। বিল্লু থেমে গেল। বললো, তোরা দাঁড়া আমি দেখে আসি কার কী হলো। বিল্লু আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে গিয়ে ঝোপের আড়ালে দেখলো, একটা হরিণশাবক কাঁদছে। তার গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধা। সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে বেশ ক’জন লোক। হরিণশাবক কেঁদেই চলেছে। বিল্লু ভাবলো কী করা যায়, হরিণের বাচ্চাটাকে কীভাবে বাঁচানো যায়। এখনই না বাঁচাতে পারলে আর সম্ভব হবে না। তাহলে উপায় কী?
হরিণশাবকের জন্যে তার মন কেঁদে উঠলো। দ্রুত দলের কাছে চলে গেল। বললো, তোরা সবাই বস্তাটা টেনে নিয়ে লুকিয়ে পড়। আর বাক্কু, হাক্কু আমার সাথে আয়। বিল্লু ধনু-বান নিয়ে রেডি হয়ে গেল। বাক্কুকে বললো গোল ফল নিয়ে আরেক পাশে যেতে আর হাক্কুকে বললো- চিঁই্ই্ই্ করে ডাক দিতে দিতে এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে ডাকতে। তারপর যা বিল্লু তীর ছুঁড়ে মারতে লাগলো, বাক্কু একাধারে গোল ফল মারতে লাগলো আর হাক্কু চিঁইইইইইইই করতে করতে একগাছ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ডাকতে লাগলো। সে এক তান্ডব শুরু হলো যেন, ভয়ে লোকগুলো হরিণশাবকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাইলো। কেউ গিয়ে পড়লো নদীতে কেউ গিয়ে উঠলো গাছে কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলো। আর এদিকে ছোট্ট হরিণশাবক ছাড়া পেয়ে ছুটে পালাল বনের মধ্যে।