সাত্তার মিয়াঁর ইদানিং টাকা পয়সার বড় আকাল যাচ্ছে।। ছোট ছেলেটার মেট্রিক পরীক্ষা সামনে।। বড় মেয়েটা বিবাহের উপযুক্ত।। সারাদিন ঘরে মন খারাপ করে বসে থাকে মেয়েটা।। পাড়ার লোকে নানান কথা বলে।। কিন্তু সাত্তার যে নিরুপায়।। যেই হারে যৌতুক চায় ছেলে পক্ষ, তাতে সাত্তারের মত একজন হতদরিদ্র ড্রাইভারের পুষায় না।। এইতো সেদিন ঘটক কাসেম আলী একটা সমন্ধ নিয়ে এসেছিলো।। কিন্তু ছেলে পক্ষের দাবি, কমপক্ষে একটা মোটর সাইকেল দিতে হবে আর সাথে দিতে হবে ৫০,০০০ টাকা ক্যাশ।।
হতাশ হয়ে চলে এসেছে সে ছেলের বাসা থেকে।। সাত্তার মিয়াঁ একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার।। ঢাকা শহরে ট্যাক্সি বলতে যেমন বোঝায় তেমন না।। গ্রাম অঞ্ছলে বেশিরভাগ ট্যাক্সি ড্রাইভারেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা।। যেখানে মানুষের ভাত খাওয়ার টাকা নেই, সেখানে ট্যাক্সি উঠাটা একপ্রকার বিলাসিতা।। যদিও নিজের ট্যাক্সি তারপরেও এর মাঝে নিজের বা পরিবারের জন্য টাকা জমানো হয়ে উঠেনি সাত্তারের।। টাকার তাড়নায় কয়েকদিন ধরেই অবৈধ খেপ মারা শুরু করেছে সাত্তার মিয়াঁ।। এলাকায় এখন করিম বাহিনীর হেভি দাপট।। বাহিনীর প্রধান করিম এখন লাখ লাখ টাকার মালিক।। বছরখানেক আগেও একটা ময়লা প্যান্ট পরে গ্রামের বাজারে বসে থাকতো।। মালামাল টানত।। “কুলি” “কামলা” ইত্যাদি কত নামেই না তাকে ডাকতো মানুষ।। আজকে ঐ মানুষগুলোই করিমকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠে।। সালাম দিয়ে পথ ছেড়ে দেয়।। করিমের এই দ্রুত উত্থানের পিছনে একটাই কারন রয়েছে।। চোখের পলক না ফেলে মানুষ মারতে পারে সে।। বয়স ২৭-২৮ বছর হবে।। কিন্তু এরই মাঝে ডজন খানেক খুন করে ফেলেছে।। তার মাঝে ২জন আবার পুলিশ।। তাকে ভয় না পেয়ে উপায় কি?? সাত্তার মিয়াঁ এই করিমের দলেই যোগ দেয়।।
যোগ দেয় মানে তাদের চোরা পথে আসা বিভিন্ন জিনিসপত্র মাঝে মাঝে নিজের ট্যাক্সিতে করে অন্য খানে দিয়ে আসে সে।। গ্রামে যানবাহনের অভাব আছে।। তাই দ্রুত সাপ্লাই দেয়ার জন্য সাত্তারকে ব্যাবহার করে তারা।। বিনিময়ে করিম তাকে টাকা দেয়।। সেই টাকা থেকে কিছু টাকা সাত্তার মিয়াঁ জমা করতে শুরু করেছে।। খারাপ না।। এভাবে কিছুদিন চললে হয়তো এক সময় মেয়েটাকে বিয়ে দেয়ার মত টাকা সাত্তারের হাতে চলে আসবে।। তারপর সে এই কাজ ছেড়ে দিবে।। টাকা পয়সা ঠিকই কামাচ্ছে, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে মনে শান্তি নেই।। খারাপ কাজে কখনো মনে শান্তি আসে না।। বৃহস্পতিবার রাত ১০ টা।। খাওয়া দাওয়া করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে সাত্তার মিয়াঁ।। হটাত ঘরের দরজায় কে যেনও জোরে নক করতে লাগলো।। সাত্তার মিয়াঁ উঁচা গলায় বলল, “কে??” কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে আরও জোরে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো আগুন্তক।। বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো সাত্তার মিয়াঁ।। তার স্ত্রী তখন রান্না ঘরে।। থালা বাসন সাজিয়ে রাখছে।। ছেলে-মেয়ে ২ টোই গভীর ঘুমে আছন্ন।। “আরে সাত্তার মিয়াঁ, আছো নাকি?? দরজাদা খোল একটু।। জরুরি তলব আছে।।” গলা শুনে আঁতকে উঠলো সাত্তার।। এতো সেলিমের গলা।। করিমের ডান হাত।। এতো রাতে সেলিম কেন আসলো?? আর জরুরি তলব মানে কি?? দরজা খুলল সাত্তার মিয়াঁ, “সেলিম ভাই যে।। অত রাত করি কি মনে করে??” “আমার লগে যাইতে হবে তোমার।। একটা খেপ আছে।।” “অত রাত করি কেমনে যাবো?? আমিত খায় নিয়ে ঘুমতে যাচ্ছিলাম।।” “করিম ভাই বইলেছে তোমারে নিয়ে জাতি।। ভালোয় ভালোয় সাথে চল।।” “আপনি খারান।। আমি আমার বউরে কয়ে আসি।।” মনে মনে করিম আর সেলিমকে হাজার খানেক কুৎসিত গালি দিল সাত্তার মিয়াঁ।। রাগে গাঁটা জ্বলে যাচ্ছে।। বউকে ভালো মত দরজা জানালা আটকে শুয়ে পড়তে বলে বের হল সে সেলিমের সাথে।। ট্যাক্সি স্টার্ট দিল সাত্তার মিয়াঁ।। ১০ টা মানে গ্রাম অঞ্ছলে ভালো রাত।। মানুষজন তো দুরের কথা, একটা কুকুরও চোখে পড়ছে না।। একটানা ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।। দূরে কোথায় একটা শিয়াল ডেকে উঠলো।। রাতটা কেমন যেনও থেমে থেমে আছে।। এমন রাতে বাইরে বেরুলেই গাঁ ছমছম করে।। সাত্তারের বাসা থেকে করিম মিয়াঁর আড্ডাখানা মোটামুটি ভালো দূরত্বে।। হটাত করে নিজেকে খুব অসহায় মনে হল সাত্তারের।। নিজেকে এমন করে বিক্রি করে দেয়া ঠিক হয়নি।। এখন সে হয়তো বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে ঘুমুতে পারত।। তা না করে যেতে হচ্ছে “জরুরি তলবে”।। করিমকে দেখে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেলো সাত্তারের।। শার্টের কয়েক জায়গায় রক্তের দাগ।। হাতে একটা দেশি মদের বোতল।। একটু পরপর সে বোতল থেকে খানিকটা গলায় ঢালছে।। সাত্তার আর সেলিমকে দেখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল।। চিনতে পারছে না যেনও।। তারপর হটাত বলে উঠলো, “ভালো আছো সাত্তার??” একটা ঢোক গিলে উত্তর দিল সাত্তার, “জে ভাইজান, ভালো আছি।। আপনি জরুরি তলব দিছেন দেখি চলি আইসেছি।।” “ভালো করেছ।। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাম দিতে চাই তোমারে।। ঠিক মতন করে দিতে পারলে মেলা টেকা পাবা।। কিন্তু কথাটা যেন চাপা থাকে খেয়াল করবা।। নইলে কইলাম জানে বাছবা না।।” এই বলে সেলিমকে কাছে ডাকল করিম।। কি যেনও ফিসফাস করলো।। সাত্তারের দিকে তাকিয়ে একটা ভয়ঙ্কর হাসি দিল সেলিম।। তারপর এগিয়ে এসে সাত্তারকে নির্দেশ দিল তার পিছু পিছু যাওয়ার জন্য।। বাড়িটায় অনেকবার এসেছে সাত্তার।। কিন্তু বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকেনি কখনো।। আজ ঢুকতে পারলো।। আসলে, তাকে ঢোকান হল।। সেলিমের পিছু নিয়ে ৩-৪ টা ঘর পেরিয়ে একটা ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ২ জন।। সাত্তারকে উদ্দেশ্য করে বলল সেলিম, “এদা আমরার করিম ভাইয়ের ঘর।। জুতা খুইলে ধুকবা।। ভাই কইলাম মেলা পরিষ্কার কিসিমের।।” ঘরটা সুন্দর করে সাজানো।। মেঝের কার্পেটটা রেশমের।। পা দিলেই আরাম আরাম একটা অনুভুতি হয়।। টিভি মনিটরটা অন করে।। তাতে বাংলা গানে কোমর দুলিয়ে নাচছে এক জলহস্তি সাইজের নায়িকা।। সব ঘুরে বিছানার দিকে নজর গেলো সাত্তারের।। বিছানাটা ঘরের পরিপাটি অবস্থার সাথে একদমই মিলছে না।। চাদরটার উপর যেনও কয়েকদফা যুদ্ধ হয়ে গেছে।। দলা মোচরা করে পাকান একটা কম্বল পরে আছে দেয়াল ঘেঁষে।। আর তার পাশে পরে আছে একটা লাশ।। একটা মেয়ের লাশ।। সেলিম গিয়ে দক্ষতার সাথে লাশটা কম্বল দিয়ে মুরিয়ে দিল।। অনেকদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো।। তারপর ডাক দিল সাত্তার মিয়াঁকে।। “আরে মিয়াঁ, খারাই খারাই কি দেহ?? আহ, হাত লাগাও।। গাড়ি পন্ত নেয়ন লাগব।।” মনে মনে একনাগাড়ে দোয়া দরুদ পড়ছিল সাত্তার মিয়াঁ।। সেলিমের ডাক শুনে অপ্রকিতস্থের মত এগুল।। লাশটা ঠিক মত ঢাকতে পারেনি সেলিম।। মনে হয় ঠিক মত ঢাকার চেষ্টা ও করেনি।। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখটাকে ঢেকে রেখেছিল এতক্ষণ।। চুলগুলো সরে যেতেই ছোট একটা চিৎকার বের হয়ে গেলো সাত্তারের মুখ দিয়ে।। খুবই কম বয়সী একটা মেয়ের মুখ।।
চোখগুলো কেমন মায়া মায়া।। মেয়েটাকে এর আগেও দেখেছে সাত্তার মিয়াঁ।। এই গ্রামেরই এক রিকশাচালকের মেয়ে।। শেফালি নাম।। সাত্তারের ছেলের সাথে একই ক্লাসে পড়ত।। নিথর হয়ে পরে আছে দেহটা।। গলা চেপে মারা হয়েছে দেখে কিনা কে জানে, জিহ্বাটা বের হয়ে এসেছে।। বড় বড় হয়ে যাওয়া চোখ দুটোতে যেনও রাজ্যের জিজ্ঞাসা।। লাশটা নিজেই ঢেকে দিল সাত্তার।। চোখ দুটো বন্ধ করে দিল।। মৃত মানুষের চোখ যত দ্রুত বন্ধ করা যায় ততই মঙ্গল।। নইলে পরে বন্ধ করা যায় না।। শরীরটা এখনও গরম।। মেরেছে বেশি সময় হয়নি হয়তো।। দুইজন ধরাধরি করে লাশটা বাইরে নিয়ে আসলো।। আসার পথে একবার করিমের দিকে চোখ পড়েছিল সাত্তার মিয়াঁর।। একটু ভয়ার্ত কি মনে হল?? লাশটা ট্যাক্সির পিছন দিকে রাখা হল।। রেখে ট্যাক্সি স্টার্ট দেয় সাত্তার।। সেলিমের নির্দেশ অনুযায়ী গোপালপুর স্টেশনের দিকে চলল সে।। পথে একটা জংলা মত জায়গা পরে।। সেখানে লাশটা ফেলে রাখার প্ল্যান করেছে পিশাচটা।। মানুষজন জায়গাটা এড়িয়ে চলে।। দিনের বেলায়ও কেউ তেমন একটা যায়না।। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেলো সাত্তারের।। প্রায় ৩০ মিনিটের রাস্তা।। কিন্তু ৭-৮ মিনিট পড়ি হটাত পেছন থেকে জোরে ডেকে উঠলো সেলিম, “অমা গো।। ঐ কাকা, খারাও।। কাকা খারাও।।” সাথে সাথে ব্রেক কষে সাত্তার।। চোখের পলকে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় মারে সেলিম।। কিছুদুর গিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে গাড়ির পেছনের সিটে রাখা লাশটার দিকে।। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে সেলিমের কাছে ছুটে যায় সাত্তার।। “ও বেদা কি হইছে?? নামই পড়লে কেনে??” ভয়ে সেলিমের গলা দিয়ে যেনও কথা বের হচ্ছে না।। আঙ্গুল তুলে লাশটাকে দেখাল সে, “ঐটা জ্যান্ত কাহা।। একটা হাত বাড়ায় আমারে দইরল।। আমি টের পাইলাম।। বাস্তব কইলাম কাকা।। আমার পা ধইরা যেন টান মাইরল।।” কিছুটা ভয় পেলো সাত্তার।। কিন্তু আমল না দিয়ে বলল, “ধুরু ভাই, এদি কি কউ?? লাশ আবার পা ধরি টান দেয় নাহি??” “আমি ইমানে কইলাম কাহা।। দেহ, আমার গায়ের বেবাক পশম খারায় গেছে।। দেহ কাহা, দেহ।।” হাতের দিকে তাকাল সাত্তার।। ঠকঠক করে কাঁপছে সে দুটো।। এতো বিরাট বিপদে পড়া গেলো।। এতো রাতে ভুতের ভয়ে কাবু একজনরে নিয়ে কিভাবে যাবে সে।। বলল, “আচ্ছা ভাই, তুমি আমার লগে সামনে বহ।। বেশিদূর তো না।। আর আমিতো আছি লগে।।” কিছুক্ষণ ভয়ে না করলো সেলিম।। কিন্তু শেষমেশ রাজি হয়।। সামনের সিটে উঠে বসে সাত্তারের সাথে।। সেলিমকে চোখ বন্ধ করে রাখতে বলল সাত্তার।।
এতে ভয় কম লাগবে।। ভয়ে সুবোধ বালকের মত আচরণ করছে সেলিম।। চোখ আসলেই বন্ধ করে ফেলল।। মনে মনে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে সাত্তার মিয়াঁ।। জীবনে বহু লাশ সে দেখেছে।। এক সময় মাটিকাটার কাজ করতো।। বহু লাশ দাফন করেছে নিজের হাত দিয়ে।। এইসব তার কাছে বড় কোনও ব্যাপার না।। কিন্তু আজকে এমন লাগছে কেনও?? কেনও মনে হচ্ছে যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না।। তার এখন কি করা উচিত?? কিছুদূর আসার পর হটাত পেছনে কেমন যেনও একটা আওয়াজ হল।। অনেকটা ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙ্গার মত।। সাত্তার মিয়াঁ পাত্তা না দিয়ে চালাতে লাগলো।। কিন্তু ততখনে সেলিমের খবর হয়ে গেছে।। তড়াক করে জেগে উঠলো, “কাহা, পেছনে কিয়ের আওয়াজ হইল?? সুইনলে??” “আরেহ না।। কিয়ের আওয়াজ হবে আবার?? ব্যাটা ভয় পেয়েছ তাই লাইগছে।। চুপচাপ থাকো।। আইশা পড়লাম বলি।।” এইবার সত্যি সত্যিই দোয়া দরুদ পড়া শুরু করলো সাত্তার মিয়াঁ।। কেন যেনও মনে হচ্ছে কোথাও কোনও একটা সমস্যা আছে।। রাস্তার পাশের জংলাটার কাছাকাছি চলে এসেছে তারা।। গাড়ি থেকে নেমে পিছনের সিটের দিকে যেতে লাগলো সাত্তার।। লাশটা নামাতে হবে।। সেলিমকে ডাকল।। কিন্তু ভুলেও লাশের আশেপাশে যাবে না সেলিম।। ভালো ভয় পেয়েছে।। সাত্তার কোন মতেই রাজি করাতে পারলো না।। অগত্যা, নিজেই নেমে গেলো।। গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষা করতে লাগলো সেলিম।। এখনও ভয়ে কাঁপছে।। গাড়ির পিছনের সিটে গিয়ে এইবার ঠিকই ভয় পেলো সাত্তার।। লাশটার মুখ বেড়িয়ে এসেছে।। চোখ দুটো খোলা।। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে আছে যখন সেলিমকে সামনের সিটে নিয়ে যায় তখনো লাশটার মুখ ঢাকা ছিল।। শুধু ঢাকা না, রশি দিয়ে বাঁধা ছিল।। ঘটনা কিছুই বুঝে পেলো না সাত্তার।। আবছা ভাবে মনে পড়লো, নিজের হাতেই চোখ বন্ধ করেছিল সেটার।। সব কেমন যেনও তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।। আর ভাবতে চাইলো না সাত্তার।। লাশটা তোলার জন্য হাত বাড়ালও।। একা মানুষ, তাই পাঁজাকোলা করে তুলে নিবে ঠিক করলো।। আশ্চর্য, লাশটার গা একজন জীবিত মানুষের মত গরম।। কিন্তু যেই সময় তাদের লেগেছে আসতে আসতে তাতে এটা গরম থাকার কথা নয়।। রাতের বেলা বাতাস অনেক ঠাণ্ডা থাকে।। সাধারন একটা মানুষেরই গা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, আর সেখানে লাশের গা তো অনেক আগেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবার কথা।।
মনে মনে একনাগাড়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো সাত্তার।। খারাপ কোনও সম্ভবনা টের পাচ্ছে সে।। কিছু যেনও হতে যাচ্ছে।। চারপাশের ভারি হয়ে থাকা বাতাস যেনও তারই সঙ্কেত দিচ্ছে।। একাই লাশটা জংলা পর্যন্ত নিয়ে গেলো সাত্তার।। সেলিম দূর থেকে ফলো করছে।। লাশটা নামানর পর থেকে সাত্তারের কাছাকাছি আসেনি।। এইবার ধমক লাগাল সাত্তার, “ঐ ভাই, জলদি আহ এইদিক।। গর্ত করো একটা দাফন দেই।।” বিস্মিত হল সেলিম, “আ?? পাগল হইলা নি কাহা?? লাশ ফালায় রাখি চলে আউ।। দাফন কইরবার লাগব না।।” “এভাবি লাশটা ফালায় রাখলি পড়ে, শেয়াল কুত্তায় খাইয়ে ফেলবে।। দাফন দি যাই।। বেশি টাইম তো লাগবে না।।” “কাহা জলদি উঠি আউ, নইলে পড়ে করিম ভাইরে দিয়ে বেবস্থা নিব তোমার।।” এইবার আর কথা বাড়ায় না সাত্তার।। লাশটাকে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখে সে।। করুন দৃষ্টিতে শেষবারের মত দেখে মেয়েটাকে।। এখনও ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে।। নিরব থেকেই যেনও চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।। জংলা থেকে উঠে আসতে যাবে, এইসময় যেনও পরিষ্কার মেয়েলি গলায় কেউ বলে উঠলো, “আমারে এমনি ফালায় রেখে চলে যাবে তোমরা??” “ওমা গো”, “ও বাবা গো” বলে গাড়ির দিকে দৌড় দিল সেলিম।। সাত্তার বুঝেছে কাহিনি খারাপ।। ধীর পায়ে গাড়ির দিকে যেতে লাগলো সে।। একবারও চোখ ঘুড়িয়ে পেছনে তাকাল না।। একবারের জন্যও না।। তাড়াহুড়াও করলো না।। আস্তে হেঁটে যেতে লাগলো যেমন কিছুই হয়নি।। সে শুনেছে, এইসব ব্যাপারে ভয় পেলে তাদের সাহস আর বেড়ে যায়।। তাই ভয় পাওয়া যাবে না।। কোনও অবস্থাতেই না।। ভালোয় ভালোয় গাড়ি পর্যন্ত আসলো সাত্তার।। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে মৃগী রোগীর মত কাঁপছে সেলিম।। বিকারগ্রস্থের মত বলতে লাগলো, “কাহা জলদি স্টার্ট দাও।। ঐ *গীর আত্মা বাইর হয়নাই।। *গী আমগরে পাইলে মারি ফালব।। কাহা জলদি স্টার্ট লউ।।” গাড়ি স্টার্ট দেয় সাত্তার।। এই পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি সে।। শেষে জিজ্ঞেস করলো, “করিম মাইয়াদারে মাইরল কেন??” অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল সেলিম।। করিমকে সবসময় করিম ভাই বলে সম্বোধন করে সাত্তার মিয়াঁ।। আজকেই প্রথম তার মুখ থেকে শুধু করিম শুনল সে।।
প্রথমে ভাবল বলবে না।। কিন্তু সাত্তার দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করলো।। এবার প্রশ্ন নয়, কেমন যেনও আদেশের মতন লাগলো কথা গুলো।। ধ্যানে পাওয়া মানুষের মত বলতে লাগলো সেলিম, “করিম ভাই মাইয়াদার লগে ফুর্তি করবার লাগি ধরে আনছিল।। ফুর্তি শেষ করার পরে যাইতে দিতে চাইছিল।। কিন্তু মাইয়াদা চিৎকার করি কইতে লাগলো, সবাইরে কয়ে দেবে।। করিম ভাইরে জেইলের ভাত খাওয়াবি।। করিম ভাই নেশায় আছিল।। গলা টিপি ধইরল।। আমাগ চোখের সামনেই মারি ফালাইল।। কিছুই করতি পারলাম না।।” “কুত্তার বাচ্চা, তোর বইন হইলে পরে মরতে দিতি?? ফুর্তি করতে দিতি?? জবাব দে, নইলে জানে মারি ফাইলবো।। জবাব দে।।” আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো সেলিম, “না দিতাম না।।” এই সাত্তারকে যেনও চেনে না সে।। এই সাত্তার করিমের তোয়াক্কা করে মনে হয় না।। রাত ৩টার দিকে সাত্তারের ট্যাক্সি করিমের বাসায় থামে।। সে রাতে ঐ বাসা থেকে কয়েকজন মানুষ গায়েব হয়ে যায়।। তার মধ্যে করিমের নামও রয়েছে।।
পরিশেষঃ প্রায় ১০ দিন পর রাস্তার পাশের ঐ জংলাটা থেকে ২টা লাশ উদ্ধার করা হয়।। তার মাঝে একটা মেয়েলোকের লাশ।। আরেকটি লাশের পরিচয় মেলেনি।। তবে গায়ের পোশাক দেখে পুলিশ অনুমান করে যে সেই লোকটা করিম।। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এই ১০ দিনেই লাশটিতে পচন ধরেছে এবং প্রায় অর্ধেক লাশ শেয়াল কুকুরের পেটে চলে গেছে।। মুখটাতে খামচানোর দাগ স্পষ্ট।। একটা চোখ পিঁপড়া খেয়ে ফেলেছে, আরেকটা কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে প্রায়।। অনেকটা ফাঁসিতে ঝোলা আসামিদের যেমন হয়, তেমনই।। মূলত লাশ পচার গন্ধেই আকৃষ্ট হয়ে মানুষ সেই লাশ ২টা উদ্ধার করে।। অথচ মেয়েটির লাশটি প্রায় তেমনই আছে, যেমন মরার সময় ছিল।। ঘটনার পরদিন থেকেই সেলিমের মাঝে আকুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।। সে এখন নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে।। খুব ঘনিষ্ঠ জনের কাছে সে জানিয়েছে, সে রাতে করিমের বাসায় ঢুকার পর তারা ঘুমুতে যায়।। কিন্তু সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তখনো মাথায় গুরপাক খাচ্ছিল দেখে ঘুমুতে পারেনি সেলিম।। কিছু সময় পর করিমের রুমে ধস্তাদস্তির শব্দে সে উঠে পড়ে।। সাহসে কুলিয়ে উঠেনি তাই নিজের দরজার কাছ থেকে গলা বাড়িয়ে উকি দেয়।। সে নাকি দেখতে পায় একটা লম্বা ছায়ামূর্তি মাটিতে হেচরিয়ে কাউকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।। ঘর অন্ধকার থাকায় সে মূর্তি অথবা টেনে নিয়ে যাওয়া বস্তুটা দেখতে পায়নি।। তবে যেই মুহূর্তে ঘর ছেড়ে বের হতে নেয় তখন চাঁদের আলো এসে ঐ ছায়ামূর্তির গায়ে পড়ে।।
স্পষ্ট দেখতে পায়, সেটা আর কেউ না, বরং শেফালি।। সাত্তার মিয়াঁ এই রাতের পর ট্যাক্সি চালানো ছেড়ে দেয়।। ট্যাক্সি বিক্রি করে দিয়ে মেয়ের বিয়ে সে ঠিকই ধুমধাম করে দিয়েছে।। সে এখন সপরিবারে ঢাকায় বসবাস করে।। সাত্তার কাঠের দোকানে কাজ করে।। ভালোই কেটে যায় তাদের তিনজনের পরিবার।। শেফালির মতন অনেক মেয়েই বেঘোরে প্রান হারায় বা নিহত হয় আমাদের সমাজে বসবাসকারী কিছু কীটের নোংরামির স্বীকার হয়ে।। সবাই হয়তো সেই খুনের বদলা নিতে পারে না।। হয়তো শেফালি পেরেছিল।। হয়তো পারেনি।। কে জানে, কিছু রহস্য হয়তো তৈরিই হয় অমীমাংসিত থাকার জন্য।।