স্যার গাড়ি আর যাবেনা। ড্রাইভারের কথায় সচকিত হল জহির আবেদিন। সহকারী ফরিদুল ইসলাম সহ গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল দু’জন। ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে এখানেই থাকার নির্দেশ দিল। হাতে থাকা নোট বুকটি এক ফলক দেখে নিল জহির আবেদিন। আজ তারা যে বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে যাচ্ছে ম্যাপ অনুযায়ী আরো চার মাইল ভিতরে। হেঁটেই যেতে হবে বাকী পথ। দু’জনের জন্যেই পথটি অচেনা। হাতে থাকা নোটবুকটিই একমাত্র ভরসা। দু’জন হাঁটা শুরু করল সরু পথ ধরে। পথের দু’ধারে সবুজ ঘাসের কার্পেট একটু আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির কারণে ঘাসগুলো খুব সতেজ দেখাচ্ছে। এঁটেল মাটি হওয়ায় পুরো রাস্তাই কর্দমাক্ত তাই শক্ত জায়গা দেখে খুব সতকর্তার সাথে পা ফেলতে হচ্ছে। কেননা একটু অসতকর্তা মানে যে কোন মুহর্তে পা পিছলে চিৎ পটাং। এই কাদা মাটি জামা কাপড় যেখানেই লাগুক তাড়াতাড়ি না ধুয়ে ফেললে সহজেই উঠেনা। তাই খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। রাস্তার ডান দিকে বিশাল ধান ক্ষেত। আর বাম পাশ দিয়ে এঁকে -বেঁকে বয়ে গেল ছোট খাল। খালের ওপাড়ে দেখা যাচ্ছে পানের বরজ, খেসারী ও কাউনের ক্ষেতও রয়েছে মাঝে মাঝে। রাস্তার দু’ধারে রয়েছে ফল-ফলাদী গাছ। আছে রেইন ট্রি, শীল করই ও খেজুর গাছসহ অনেক নাম না জানা জংলী গাছও। দূরে ধান ক্ষেতের মাঝখানে দেখা যাচ্ছে একটি লম্বা তালগাছ। তাতে ঝুলে আছে বাবুই পাখির বাসা। আসলে বাবুই শ্রেষ্ঠ শিল্পী পাখি।
ঠোঁট দিয়ে এত সুন্দর বুনন। সত্যিই মহান আল্লাহর অপার কুদরত ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেক পথ হেঁটে এসেছে দু’জন কিন্তু পথে তেমন লোকজনের দেখা মেলেনি। সামনে তিন মুখি রাস্তা কোন দিকে যাবে। খালের ঐ পাড়ে একজন কৃষক কাজ করছিল তাকেই জিজ্ঞেস করল উজান তলি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কোন দিকে। এই খালের পাড়ে পাড়ে আরো এক- দেড় মাইল যেতে হবে। দু’জন আবার হাঁটা শুরু করল। পারাপারের জন্য বাঁশ ও কাঠের সাঁকোগুলো তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। মাঝে মাঝে রাস্তাটি খুব এবড়ো-থেবড়ো হলেও দু’জনের খুব ভালই লাগছে গ্রামীণ মেঠো পথে হাঁটতে। আধুনিক এই যুগেও পুরো গ্রামে আধুনিকতার বিন্দু মাত্র ছোঁয়া লাগেনি। মাথায় বোঝা নিয়ে আসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, বিদ্যালয়টি কোন দিকে? ঐ যে দেখছেন বাড়িটি, এর একটু পরেই দেখবেন বিশাল বটগাছটির নিচে মজিদ স্যার পড়াচ্ছে ছাত্রদেরকে। আর মজিদ স্যার না খুব ভাল মানুষ। আমিও স্যারের কাছে পড়েছি দুই বছর। ছাত্রদেরকে নিজ ছেলের মত আদর করেন। আমাদের পাঁচ-সাত গ্রামে স্যারের খুব সুনাম, তৈ আন্নেরা কি স্যারের কাছে যাইবেন?
খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় শেষের কথাগুলো বললো লোকটি। হ্যাঁ, আমরা বিদ্যালয়টি দেখতে এসেছি। সাথে স্যারের সাথেও কথা বলব। লোকটি যেদিক ইংগিত করেছে পথটি একেবারেই সরু। আইলের মতো হবে। কোন মতে একজন হাঁটা যায়। বাড়িটি পার হয়ে দেখতে পেল বিশাল বট গাছটি। নিচে বসে আছে একজন শিক্ষক শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে সামনে নিয়ে।
যে চেয়ারটিতে বসে আছেন তিনি, দেখেই বুঝা গেল বেশ কয়েকবার মেরামত করা হয়েছে তাতে। একটি বেত হাতে নিয়ে বসে আছেন তিনি। দেখে তেমন বৃদ্ধ মনে হচ্ছে না। এই চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর বয়স হবে। মাথার বৃহদাংশ জুড়ে রয়েছে টাক। চুলগুলো অনেকটাই সাদা হয়ে গেছে। দাড়ি মেহেদী করা তবে একটু বেশীই লাল দেখাচ্ছে। চোখে বড় মাপের একটি চশমা লাগানো। আগন্তুকদ্বয়কে দেখে খুব বিনয়ের সাথেই চেয়ারটি বেড়ে দিলেন তিনি। শহর থেকে এসেছি স্কুলটি পরিদর্শন করতে। বলল জহির আবেদিন।
আপনার বিদ্যালয়টি কোথায়?-এটাইতো আমাদের বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের নিজস্ব কোন ঘর নেই? না। এইভাবে কত বছর থেকে পড়াচেছন। এই
ধরেন আঠার-বিশ বছর হবে। এর আগে কেউ পরিদর্শনে আসেনি? দু’বার এসেছিল তবে গত পাঁচ বছর ধরে কেউ আসেনি।
তাদেরকে বলেননি বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন দরকার?
হ্যাঁ, বলেছিলাম। সরকারের কাছে আমাদের জন্য এক খন্ড জায়গার সুপারিশ করতে। তারা কথা দিয়েছিল সুপারিশ করবে কিন্তু পরে আর কোন খোঁজ খবর আসেনি।
ছাত্রদেরকে কোন কোন বিষয় শিক্ষা দিচেছন? বাংলা, ইংরেজি ও অংক। প্রতিদিন সকালে আরবিও পড়াই সকল ছাত্রকে।
আপনি কি একাই সব বিষয় পড়ান?
হ্যাঁ। সকল ছাত্রকে কী একই পড়া পড়াচেছন?
না। এই যে তিন ভাগ দেখছেন এখানে তিন ক্লাশ-ওয়ান, টু ও থ্রি কে পড়াচ্ছি।
বারটার পর বাকি দু’ক্লাশ আসবে।
জহির আবেদিন ক্লাশ থ্রি-র একজন ছাত্রকে ইংলিশ বই এর রিডিং পড়তে দিল। খুব তরতর করে রিডিং পড়ে গেল। একটুও আটকেনি। এরপর আরো কয়েকজন ছাত্র ছাত্রীকে প্রশ্ন করল। সকলেই শুব্ধ উত্তর দিল। তাদের উত্তরে জহির আবেদিন সন্তষ্ট। গত এক বছর থেকে অনেক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন কিন্তু এমন ভাল ছাত্র-ছাত্রী পায়নি। এই রকম নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকও আর পায়নি। সত্যিই ভাল শিক্ষকের বড় অভাব।
জহির আবেদিন বুঝতে পারেনা। সরকার শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখলেও কেন বিশ বছরে বিদ্যালয়টি এক খন্ড জায়গা পায়নি? কেন পায়নি নিজস্ব ভবন? কেন এই নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক দীর্ঘ বিশ বছরে এক দিনেরও বেতন পায়নি? তিনি কি পারবেন বিদ্যালয়টির জন্য এক খন্ড জায়গা মঞ্জুর করাতে? গড়ে দিতে একটি ভবন? প্রশ্নগুলো তাকে খুব ব্যথিত করছে। ব্যথিত হৃদয় নিয়েই মহান শিক্ষক থেকে বিদায় নিলেন জহির আবেদিন।