ফেলে চলে যেতে পারতো। কিন্তু গেল না। তরুণ বয়স হবার কারণে তার ছিল প্রাণবন্ত আগ্রহ আর সে প্রস্তুত ছিল অভিযানের জন্য। এরকম আরও আজব দৃশ্য সে দেখতে চাইল। যদি সম্ভব হয়, সে খুঁজে বের করতে চায় কখন এবং কীভাবে এটা বিড়ালদের শহর হয়ে উঠল।
এই তৃতীয় রাত্রিতে ঘণ্টা-ঘরের নিচের চত্বরে সে একটা গোলমালের শব্দ হতে শুনল। ‘হেই, মানুষ মানুষ গন্ধ পাচ্ছো?’ একটা বিড়াল বলল। ‘তুমি এখন বললা, গত কয়দিন ধইরাই এই উদ্ভট গন্ধটা আমি পাইতেছি মনে হইতেছিল,’ আরেকজন গলা মিলাল তার নাক টেনে টেনে। ‘আমিও পাইতেছি,’ আরেকটি বিড়াল বলল। “আজব তো। এখানে কোনো মানুষ কেমনে থাকবে,” কেউ যোগ করল, “না অবশ্যই না। এই বিড়ালের শহরে কোনো মানুষ আসার কোনো পথই নাই।” “কিন্তু গন্ধটা তো এখানে অবশ্যই আছে।” বিড়ালগুলো দলে দলে ভাগ হয়ে গেল এবং পর্যবেক্ষক দলের মতো করে খোঁজাখুজি শুরু করল। এটা তাদের বের করতে খুব অল্প সময়ই লাগল যে, ঘণ্টা-ঘরটাই গন্ধের উৎস। যুবক শুনতে পেল তাদের নরম থাবা ফেলে ফেলে থপ থপ করে উপরে উঠে আসার শব্দ। এই শেষ, তারা আমাকে পেয়ে গেছে! সে ভাবল। তার গন্ধ মনে হলো বিড়ালদের ক্রোধ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই শহরে হয়তো মানুষদের প্রবেশ করার কথা না। বিড়ালদের আছে বড় আর ধারালো নখর আর ধারালো শাদা দাঁত। যদি তারা তাকে খুঁজে পায় তাহলে না জানি কী ভয়ানক দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছে তার জন্য, তবে সে নিশ্চিত যে তারা তাকে এই শহর থেকে জীবিত ফিরে যেতে দেবে না।
তিনটি বিড়াল ঘণ্টা-ঘরের উপরে পর্যন্ত উঠে এলো এবং বাতাসে গন্ধ শুঁকল। একটা বিড়াল গোঁফ টেনে বলল, ‘অদ্ভুত! গন্ধ পাইতেছি মানুষের, অথচ কোনো মানুষ নেই।’
‘খুবই অদ্ভুত! আসলেই তো এখানে কেউ নাই।’ দ্বিতীয় বিড়ালটা বলল, ‘আচ্ছা চলো, অন্য কোথাও খুঁজি।’
বিড়ালগুলো মাথা খাড়া করল, বিভ্রান্ত হলো এবং ফিরে গেল নিচের সিঁড়িতে। যুবক তাদের পায়ের শব্দ রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে শুনল। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, কিন্তু বুঝতে পারল না কী ঘটল আসলে। তারা তাকে না পাবার কোনো কারণ নেই, তবে কোনো কারণে তারা তাকে পায় নি। যাহোক, সে মনস্থির করল যে, সকাল হলেই সে স্টেশনে যাবে এবং শহর ছেড়ে যাবার ট্রেন ধরবে। ভাগ্য তো সব সময়ের জন্য প্রসন্ন থাকে না।
পরদিন ভোরে, যাহোক, ট্রেনটি স্টেশনে থামল না। সে দেখল ট্রেনটি গতি না কমিয়ে চলে গেল। বিকাল বেলার ট্রেনের ক্ষেত্রেও ঘটল একই ঘটনা। সে দেখল নিয়ন্ত্রণ কক্ষে প্রকৌশলী লোকটি বসে আছেন। কিন্তু ট্রেনটি থামার কোনো লক্ষণ দেখাল না। যেন বা কেউই দেখেনি যে ট্রেনের জন্য এক যুবক অপেক্ষা করছে- যেন তারা স্টেশনটাকেও দেখে নি। রেলপথ ধরে অপরাহ্নের ট্রেন অদৃশ্য হয়ে যাবার পর জায়গাটা আগের থেকে বেশি নিঃশব্দ হয়ে এলো। সূর্য ডুবতে শুরু করল। তখন বিড়ালদের আসার সময়। যুবক বুঝল যে এমনভাবে হারিয়ে গেছে যে তার পুনরুদ্ধার অসম্ভব। এটা বিড়ালদের শহর নয়, সে অবশেষে অনুধাবন করল, এ এমন এক স্থান যেখানেই তার হারিয়ে যাবার কথা- এ অন্য এক জগৎ যা কেবল বিশেষভাবে তারই জন্য প্রস্তুত করা। আর কখনোই, অনন্তকালের জন্য, কোনো ট্রেন এই স্টেশনে তাকে তার জগতে ফিরিয়ে নেবার জন্য আর থামবে না।
তেংগো দুবার পড়ল গল্পটা। “এ এমন এক স্থান যেখানেই তার হারিয়ে যাবার কথা” বাক্যটি তার মনোযোগ কাড়ল। সে বইটা বন্ধ করল এবং চোখ দুটোকে ঘুরে বেড়াতে দিলো জানালার পাশে পিছিয়ে যেতে থাকা একঘেয়ে কারখানার দৃশ্যের উপর। একটু পরেই সে ঘুমের ভেতর তলিয়ে গেল- খুব দীর্ঘ ঘুম নয়, কিন্তু গভীর। সে জেগে উঠল ঘামে ভিজে। ট্রেন ছুটছিল মধ্যগ্রীষ্মের বোসো উপদ্বীপের দক্ষিণ দিকের তটরেখা ধরে।
এক সকালে, যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো, অনেক সতর্ক চিন্তার পর তেংগো ঘোষণা করেছিল যে রোববারগুলোতে বাবার সঙ্গে ঘোরাঘুরিতে যাওয়া সে বন্ধ করতে যাচ্ছে। সে তার বাবাকে বলেছিল যে, সময়টাকে সে পড়াশুনা করে এবং অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলে কাটাতে চায়। অন্য সবার মতোই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চায় সে।
তেংগো তার যা বলার দরকার বলেছিল সুনির্দিষ্টভাবে আর সংগতভাবে। তার বাবা, অবশ্যম্ভাবীরূপে যা হবার কথা, ফেটে পড়লেন। অন্য পরিবারগুলো কী করে তা তিনি থোড়াই কেয়ার করেন, তিনি বললেন, ‘আমরা আমাদের মতো করেই করি সবকিছু। আর তোমার কী সাহস যে তুমি ‘স্বাভাবিক জীবন’ নিয়ে বলছো! সবজান্তা সাহেব, ‘স্বাভাবিক জীবনের’ কী বোঝেন আপনি?’ তেংগো তার সঙ্গে তর্ক করার চেষ্টা করল না। সে শুধু তাকিয়ে থাকল চুপচাপ, সে জানে বাবা তার কথার কিছুই আমলে নেবেন না। শেষমেষ, সে যদি তার কথা না শোনে তাহলে তিনি তার ভরণ-পোষণ দেবেন না। তেংগোকে জাহান্নামে যেতে হবে।
তেংগোকে যা বলা হলো সে তাই করল। সে তার মনস্থির করে রেখেছিল। ভয় সে পাবে না। এখন তাকে এ খাঁচা ছেড়ে যাবার অনুমতি দেয়া হয়েছে, সে আগের থেকে বেশি নিরুদ্বেগ ছিল। কিন্তু দশ বছর বয়সী বালকের পক্ষে স্বনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকার কোনো উপায় ছিল না। দিনশেষে যখন তার ক্লাস শেষ হলো, সে তার দুর্ভাগ্যের কথা তার শিক্ষকের কাছে প্রকাশ করল। তার শিক্ষক ছিলেন মধ্য তিরিশের এক অবিবাহিত নারী, মুক্তমনা ও উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ। সহমর্মিতা নিয়ে তিনি তেংগোর কথা শুনলেন, সেই সন্ধ্যায় তেংগোকে সঙ্গে করে তিনি বাবার বাসায় গেলেন। দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা বললেন তারা।
তেংগোকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হয়েছিল, তাই সে নিশ্চিত ছিল না যে তাদের মধ্যে কি কি কথা হয়েছিল, তবে শেষমেষ তার বাবাকে তরবারির খাপে ভরতে হয়েছিল। তার রাগ যতো চরমই হোক, তিনি দশ বছর বয়সী কোনো ছেলেকে একা ছেড়ে দিতে পারেন না। কোনো বাবার সন্তানকে দেখভাল করার কর্তব্য আইনগত ব্যাপার।
বাবার সঙ্গে তার শিক্ষকের আলাপের ফলস্বরূপ তেংগো তার রোববারগুলো ইচ্ছামতো কাটানোর স্বাধীনতা পেয়েছিল। এটাই ছিল প্রথম একটি বাস্তব অধিকার যা সে তার বাবার কাছ থেকে জয় করে নিয়েছিল। তার মুক্তি ও স্বাধীনতার দিকে সে তার প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছিল।
স্বাস্থ্যনিবাসের অভ্যর্থনা টেবিলে তেংগো তার ও তার বাবার নাম দিলো।
নার্স জিগ্যেস করল, ‘আপনি কি আপনার আজকের সাক্ষাতের ইচ্ছার কথা কোনোভাবে আমাদেরকে জানিয়েছিলেন?’ তার কণ্ঠে কঠিন একটা তীক্ষ্মতা। অল্পবয়সী এক নারী, ধাতব-ফ্রেমের চশমা পরেছেন, আর তার বব-কাট চুল কিছুটা ধূসর।
‘না, আজ সকালে আসার কথা হঠাৎ করেই ভাবলাম আর ট্রেনে আসতে আসতে ইচ্ছা হলো,’ তেংগো সৎভাবেই বলল কথাটা।
নার্স খানিকটা বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘সাক্ষাৎকারীরা কোনো রোগীকে দেখতে আসার আগে জানানোই নিয়ম। আমাদের একটা শিডিউল আছে দেখা করার, আর রোগীর ইচ্ছার ব্যাপারটাকেও আমরা গুরুত্ব দিই।’
‘দুঃখিত! আমি জানতাম না।’
‘শেষ কবে দেখা করেছেন?’
‘দুবছর আগে।’
‘দু বছর আগে,’ হাতে একটা বলপয়েন্টসহ সাক্ষাৎকারীদের তালিকাটা পরীক্ষা করতে করতে বলল নার্স, “আপনি বলতেছেন, এই দুবছরে আপনি আর একবারও আসেন নাই?”
‘হ্যাঁ, তাই,” তেংগো বলল।
“আমাদের নথিপত্র অনুযায়ী আপনিই কাওয়ানা সাহেবের একমাত্র আত্মীয়।”
“ঠিক বলেছেন।”
মেয়েটি চকিতে তাকাল তারদিকে, কিন্তু কিছুই বলল না, তার চোখে নিন্দা ছিল না, সে কেবল তথ্যগুলো পরীক্ষা করছিল। দৃশ্যত, তেংগোর ঘটনাটা খুব ব্যতিক্রমী কিছু না।
‘এ সময়, আপনার বাবা গ্রুপ রিহ্যাবিটেশনে আছেন। আধা-ঘণ্টার মধ্যে শেষ হবে। তারপর দেখা করতে পারবেন।’
‘উনি কেমন আছেন?’
‘শারীরিকভাবে ভালো আছেন। অন্যান্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওঠানামা আছে,’ তর্জনী দিয়ে কপালের পাশে টোকা দিয়ে বলল মেয়েটি।
তেংগো তাকে ধন্যবাদ দিয়ে প্রবেশপথের পাশের লাউঞ্জে গেল অপেক্ষা করতে। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে গেল মাঝে মাঝে, সমুদ্রের গন্ধ ও পাইনসারির শান্ত ধ্বনিসহ। গাছগুলির শাখায় থাকা ঝিঁঝিপোকা হৃদয়বিদারক চিৎকার করে যাচ্ছিল। গ্রীস্মের চূড়ান্ত সময় এটা, কিন্তু ঝিঁঝিপোকাগুলো যেন এটা জানে যে সময়টা বেশিদিন থাকবে না।
অবশেষে চশমাপরা নার্সটি তেংগোকে বলতে এলো, এখন তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারে। ‘আমি আপনাকে তার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি,’ সে বলল। তেংগো সোফা থেকে উঠল এবং দেয়ালের লম্বা আয়নার সামনে দিয়ে যেতে যেতে প্রথমবারের মতো অনুধাবন করল কি পঙ্কিল পোশাক সে পরে আছে: জেফ কে জাপান ট্যুরের টি-শার্ট ফিকে হয়ে যাওয়া ডাংগারি শার্টের নিচে যার বোতামগুলো বিসদৃশ, খাকি রঙের আর এক হাতার কাছে পিৎজা সসের কণা লেগে আছে, মাথায় বেসবল খেলার টুপি- তিরিশ বছর বয়সী সন্তানের জন্য দু’বছর পর বাবাকে হাসপাতালে দেখতে আসার পক্ষে জুৎসই পোশাক নয়। তার সঙ্গে এমন কিছুও নেই যা এমন একটা উপলক্ষে একটি উপহারের কাজ করতে পারে। নার্স তার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাবে তাতে আর আশ্চর্য কি!
তেংগোর বাবা ঘরে ছিলেন, একটা চেয়ারে বসে ছিলেন খোলা জানালার পাশে, তার হাত দুটি ছিল হাঁটুর উপর। কাছের একটা টেবিলের উপর ছিল কিছু কোমল হলুদ ফুলসহ পাত্রে লাগানো একটি গাছ। মেঝে বানানো হয়েছে নরোম জিনিস দিয়ে যাতে কেউ পড়ে গিয়ে আহত না হয়। তেংগো প্রথমটায় বুঝতেই পারে নি বুড়ো যে লোকটি জানালার ধারে বসা ছিলেন তিনি ছিলেন তার বাবা। তিনি চুপসে গেছেন- ‘সঙ্কুচিত হয়ে গেছেন’ বলাটাই হয়তো বেশি সঠিক। তার চুল ছোটো এবং এত শাদা যেন তুষার ঢাকা উঠান। তার গাল বসে গেছে, একারণেই হয়তো তার চোখের কোটর দুটিকে বড় দেখাচ্ছিল আগের থেকে। কপালে তিনটি ভাঁজ পড়েছে। তার চোখের ভ্রু ছিল অনেক লম্বা আর ঘন, তার কানদুটিকে দেখাচ্ছে আগের থেকে বড়; লাগছে যেন বাদুড়ের পাখা। দূর থেকে, তাকে যতোটা না কম মানুষ বলে মনে হলো, তার চেয়ে বেশি মনে হলো অন্য কোনো প্রাণি, কোনো একটি ইঁদুর বা কাঠবিড়াল- খুব ধূর্ত কোনো প্রাণি। যাহোক, তিনি ছিলেন তেংগোর বাবা- কিংবা বলা যায় তার বাবার ধ্বংসাবশেষ। যে বাবাকে তেংগোর মনে পড়ে, তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ, পরিশ্রমী মানুষ। অন্তর্দৃষ্টি এবং কল্পনা হয়তো তার কাছে দূরের জিনিস ছিল; কিন্তু তার কাছে তার নিজের নৈতিক নিয়ম ছিল আর ছিল কঠিন বিষয়বোধ। যে লোকটিকে তেংগো সামনে দেখল তিনি একটি শূন্য খোলশ ছাড়া আর কিছ্ইু ছিলেন না।
‘কাওয়ানা সাহেব!’ নার্স তেংগোর বাবাকে বলল খুব সতেজ স্পষ্ট স্বরে- যা অবশ্যই রোগীদের সম্বোধনের জন্য তাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শেখানো হয়েছে। ‘কাওয়ানা সাহেব! দেখেন কে এসেছে! এই যে আপনার ছেলে এসেছে টোকিও থেকে।’
তেংগোর বাবা তার দিকে ফিরলেন। তার অভিব্যক্তিশূন্য চোখদুটি দেখে তেংগো ভাবল, সোয়ালো পাখির দুটি শূন্য বাসা ঘরের ছাঁইচ থেকে ঝুলছে।
‘হ্যালো,’ বলল তেংগো।
তারা বাবা কিছুই বললেন না। পরিবর্তে তিনি সোজাসুজি তেংগোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন যেন তিনি বিদেশি ভাষায় লেখা কোনো বুলেটিন পড়ছেন।
“ডিনার শুরু হবে সাড়ে ছ’টায়,” নার্স তেংগোকে বলল, “তখন পর্যন্ত আপনি নির্দ্বিধায় থাকতে পারেন।”
নার্স চলে যাবার পর তেংগো মুর্হূর্তের জন্য ইতস্তত করল আর তারপর তার বাবার কাছে গেল, বসল তার বিপরীত দিকে রাখা চেয়ারে। একটি ফিকে হয়ে যাওয়া, কাপড়-মোড়ানো চেয়ার, এর কাঠের অংশগুলো দীর্ঘ ব্যবহারে দাগ-পড়া। তার বাবার চোখ তার নড়াচড়াগুলোকে অনুসরণ করল।
‘কেমন আছেন?’ তেংগো জিগ্যেস করল।
‘ভালো। ধন্যবাদ,’ রীতিমাফিক বললেন তেংগোর বাবা। তেংগো জানতো না এরপর কী বলবে। তার ডাংগারি শার্টের তৃতীয় বোতামটি নিয়ে খেলতে খেলতে সে তার দৃষ্টি ফেরাল বাইরে পাইন গাছগুলির দিকে এবং তারপর বাবার দিকে ফেরাল আবার।
‘তুমি কি টোকিও থেকে এসেছ?’ জিগ্যেস করলেন তার বাবা।
‘হ্যাঁ, টোকিও থেকে।’
‘নিশ্চয়ই এক্সপ্রেস ট্রেনে এসেছ?’
‘হ্যাঁ,’ তেংগো বলল। “তাতেইমা পর্যন্ত, তারপর গাড়ি বদল করে চিকুরা পর্যন্ত এসেছি লোকাল ট্রেনে।”
‘সাঁতার কাটতে এসেছ?’ তার বাবা জিগ্যেস করলেন।
‘আমি তেংগো। তেংগো কাওয়ানা, আপনার ছেলে।’
তার বাবার কপালের ভাঁজগুলো গভীর হলো। ‘অনেক লোক তাদের এনএইচকে গ্রাহক চাঁদা দিতে চাইতো না বলে মিথ্যা কথা বলতো।’
‘বাবা।’ তেংগো তাকে ডাকল। অনেকদিন সে এই শব্দটা উচ্চারণ করেনি। ‘আমি তেংগো, আপনার ছেলে।’
‘আমার কোনো ছেলে নেই।’ তার বাবা ঘোষণা করলেন।
‘আপনার কোনো ছেলে নেই?’ তেংগো যন্ত্রের মতো পুনরুক্তি করল।
তার বাবা মাথা নাড়লেন।
‘তাহলে আমি কে?’ তেংগো জিগ্যেস করল।
‘তুমি কিছুই না।’ তার বাবা দুবার সংক্ষেপে মাথা নেড়ে বললেন।
তেংগো তার নিশ্বাস ধরে রাখল। সে কোনো শব্দ খুঁজে পেল না। তার বাবারও আর কোনো কিছু বলার ছিল না। প্রত্যেকেই নিঃশব্দে বসে রইল। নিজেদের চিন্তার জট হাতড়াতে হাতড়াতে। কেবল ঝিঁঝিপোকাগুলো কোনো বিভ্রম ছাড়াই চিৎকার করে গেল, সবচে উচ্চৈঃ স্বরে।
তিনি হয়তো সত্যই বলছেন, তেংগো ভাবল। তার স্মৃতি হয়তো ধ্বংস হয়ে গেছে- কিন্তু তার কথাগুলো হয়ত সত্য।
‘আপনি কী বুঝাতে চান?’ তেংগো জিগ্যেস করল।
‘তুমি কিছুই না।’ তার বাবা পুনরুক্তি করলেন, তার কণ্ঠস্বরে কোনো আবেগ নেই। ‘তুমি কিছুই ছিলে না, তুমি কিছুই না, আর তুমি কিছু হবেও না।’
তেংগো তার চেয়ার ছেড়ে উঠতে চাইল। সে স্টেশনে যাবে এবং তারপর টোকিওতে ফিরে যাবে। কিন্তু সে দাঁড়াতে পারল না। সে যেন সেই যুবক যে বিড়ালদের শহরে গিয়েছিল। তার কৌতূহল ছিল। তার দরকার ছিল একটা স্পষ্ট জবাবের। লুকিয়ে চলার বিপত্তি আছে অবশ্যই। কিন্তু সে যদি সুযোগটাকে চলে যেতে দেয় তাহলে হয়তো নিজের সম্পর্কিত রহস্যটি কখনো আর জানতেই পারবে না। তেংগো তার মাথার ভেতরের শব্দগুলোকে নানাভাবে সাজাতে থাকল যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সেগুলো বলার জন্য প্রস্তুত হলো। এ হলো সেই প্রশ্ন যা সে তার ছোটবেলা থেকে জিগ্যেস করতে চাইতো কিন্তু কখনোই বলে উঠতে পারেনি: ‘আপনি তবে বলছেন যে, আপনি আমার জন্মদাতা পিতা নন? ঠিক? আপনি বলছেন যে আমাদের মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই, তাই তো?’
‘রেডিও তরঙ্গ চুরি করা একটি বে-আইনি কাজ,’ তেংগোর বাবা বললেন তার চোখের দিকে তাকিয়ে, “এটা টাকা কিংবা অন্য মূল্যবান কিছু চুরি করার থেকে আলাদা কিছুই না, তাই না?’
‘আপনার কথা হয়তো ঠিক,’ তেংগো আপাতত সম্মত হলো।
“রেডিও তরঙ্গ আকাশ থেকে বৃষ্টি বা তুষারের মতো এমনি এমনি পড়ে না,” তার বাবা বললেন।
তেংগো তার বাবার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকল। হাতদুটো সোজাসুজি তার হাঁটু বরাবর রাখা। ছোটো, কালো হাতগুলি, দীর্ঘদিন বাইরে কাজ করার ফলে হাড়ের মতো ধূসর।
‘আমার মা তাহলে আদতেই অসুস্থ হয়ে মরে নাই, যখন আমি ছোটো ছিলাম, তাই না?” তেংগো জিগ্যেস করল অনুচ্চ স্বরে।
তার বাবা উত্তর দিলেন না। তার অভিব্যক্তি পাল্টাল না, এবং তার হাতগুলি নড়ল না। তার চোখ পড়ে থাকল তেংগোর ওপর যেন তারা অপরিচিত কিছু পর্যবেক্ষণ করছে।
‘আমার মা আপনাকে ছেড়ে গেছিল। সে আপনাকে এবং আমাকে ছেড়ে গেছিল। অন্য এক লোকের সঙ্গে চলে গেছিল সে। আমি কি ভুল বলছি?’
তার বাবা মাথা নাড়লেন, ‘রেডিও তরঙ্গ চুরি করা ভালো না। কারণ যা ইচ্ছা তাই করে তুমি পার পেতে পারো না।’
এই লোকটা আমার প্রশ্নগুলো ঠিকই বুঝেছে। সে শুধু সরাসরি উত্তর দিতে চাইছে না। তেংগো ভাবল।
‘বাবা,’ তেংগো তাকে সম্বোধন করে বলল, ‘তুমি হয়ত আসলেই আমার বাবা নও, কিন্তু এখন আমি তোমাকে এটা বলেই ডাকব কারণ আমি জানি না তোমাকে অন্য আর কি বলা যেতে পারে। সত্যি বলতে কি, আমি তোমাকে কখনো পছন্দ করি নি। হয়তো আমি তোমাকে বেশির ভাগ সময় ঘৃণাই করেছি। তুমি সেটা জান, তাই না? কিন্তু যদি আমি ধরেও নিই যে আমাদের মধ্যে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই, তোমাকে আমার ঘৃণা করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। জানি না ততটা দূর আমি যেতে পারতাম কিনা যাতে আমি তোমার প্রিয় হতে পারি, কিন্তু আমার ধারণা এখন আমি যতটা বুঝি তোমাকে নিদেনপক্ষে তার চেয়ে বেশি বুঝতে চেষ্টা করতে পারতাম। আমি সবসময় জানতে চেষ্টা করেছি আমি কে আর কোথা থেকে এসেছি। এটাই শুধু। এখন এখানে যদি তুমি সত্য বলো, তোমাকে আমি আর ঘৃণা করব না। আসলে, আমি এই সুযোগটা নিতে চাইব যে যাতে তোমাকে আর ঘৃণা করতে না হয়।”
তেংগোর বাবা অভিব্যক্তিহীন চোখে তার দিকে তাকিয়েই থাকলেন, কিন্তু তেংগো অনুভব করল সে ওই সোয়ালোর শূন্য বাসার গভীরে অবশ্যই কোথাও মৃদু আলোর একটা দীপ্তি দেখতে পাবে।
‘আমি কিছুই না, তুমি ঠিকই বলেছ,’ বলল তেংগো, ‘আমি এমন একজন যাকে রাতের সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়েছে, যে একা একা ভাসছে। আমি কোথাও যাই, কিন্তু কেউই নাই সেখানে। কোনোকিছুর সঙ্গেই আমার সংযোগ নাই। একটি পরিবারের সবচেয়ে কাছের সত্তাটাই তুমি, কিন্তু তুমি একটা রহস্য ধারণ করে আছো। ইতোমধ্যে, দিনকে দিন খারাপ হয়ে চলেছে তোমার স্মৃতি। তোমার স্মৃতির সঙ্গে সঙ্গে আমার সম্পর্কিত সত্যটাও হারিয়ে যাচ্ছে। সত্যের সাহায্য ছাড়া, আমি কিছুই না আর আমি হতেও পারব না কোনোকিছু। তোমার কথাটাই ঠিক।’
‘জ্ঞান খুব মূল্যবান সামাজিক সম্পদ,’ একঘেয়ে সুরে বলতে থাকলেন তেংগোর বাবা, যদিও তার স্বর আগের থেকে কিছুটা শান্ত, যেনবা কেউ ভল্যুমটা কমিয়ে দিয়েছে, “এটা এমন একটা সম্পদ যা অবশ্যই বিপুলভাবে মজুদ হবে এবং সর্বোচ্চ সতর্কভাবে ব্যবহৃত হবে। অবশ্যই তা কার্যকররূপে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হবে। সেই কারণেও এনএইচকের জন্য সমস্ত গ্রাহক চাঁদা পরিশোধ করা জরুরি এবং …।’
সে তার বাবাকে থামাল। ‘আমার মা কেমন মানুষ ছিলেন? তিনি কোথায় গেছেন? কী হয়েছিল তার?’
তার বাবা তার মন্ত্রযপ করা থামালেন, তার ঠোঁটদুুটি একদম বন্ধ হয়ে গেল।
তার কণ্ঠস্বর নরোম হলো আরও, তেংগো বলতে থাকল, ‘মাঝে মাঝে একটা ছায়াচিত্র দেখি মনের মধ্যে- একটাই ছবি বারবার। আমার সন্দেহ হয় সেটা বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনোকিছুর স্মৃতি কিনা। আমার বয়স তখন দেড় বছর, আর মা আছেন আমার পাশেই। তিনি এবং এক যুবক পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আছেন। লোকটা আপনি নন। তিনি কে সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই, কিন্তু অবশ্যই আপনি নন।’ তার বাবা কিছুই বললেন না, তবে তার চোখ দুটি স্পষ্টত অন্যকিছু দেখছিল- যা এখানে নেই।
‘আমি চাইছি যে তুমি কিছু একটা পড়ে শোনাও,’ তেংগোর বাবা খুব আনুষ্ঠানিক স্বরে বললেন, একটা দীর্ঘ বিরতির পর, ‘আমার দেখার দৃষ্টি এতোটা খারাপ হয়ে গেছে যে কোনো বই আর পড়তে পারি না। ঐ শেল্ফে কিছু বই আছে। তোমার পছন্দ মতো একটা বেছে নাও।’
তেংগো উঠল এবং বুকশেল্ফের প্রধান খ-গুলো খুঁটিয়ে দেখল। বেশির ভাগই ঐতিহাসিক উপন্যাস যার প্রেক্ষাপট প্রাচীন সময় যখন অঞ্চলটিতে সামুরাইরা ঘুরে বেড়াত। পুরোপুরি সেকেলে ভাষায় লেখা ছাতাপড়া প্রাচীন বইগুলো থেকে তার বাবাকে পড়ে শোনাতে পারল না তেংগো।
‘যদি আপনি কিছু মনে না করেন, আমি বরং বিড়ালদের শহর নিয়ে একটা গল্প পড়ব,’ তেংগো বলল, ‘আমার পড়ার জন্য যে বইটা এনেছিলাম ওতেই আছে গল্পটা।’
‘বিড়ালদের শহর সম্পর্কে গল্প,’ তার বাবা বললেন শব্দগুলোর স্বাদ নিতে নিতে, ‘আচ্ছা পড়ে শোনাও আমাকে যদি তোমার খুব অসুবিধা না হয়।’
তেংগো তার ঘড়ির দিকে তাকাল। “মোটেও কোনো সমস্যা না। আমার ট্রেন ছাড়ার আগে অনেকটা সময় হাতে আছে। খুব অদ্ভুত একটা গল্প এটা। আমি জানি না, এটা আপনার পছন্দ হবে কিনা।”
তেংগো তার পেপারব্যাক বইটা বের করল এবং ধীরে ধীরে পড়া শুরু করল, খুব স্পষ্ট, শ্রুতিযোগ্য স্বরে, নিঃশ্বাস নেবার মাঝে দুই কি তিনবার থেমে থেমে। সে যখন পড়া থামাচ্ছিল, তার বাবার দিকে চকিতে তাকাচ্ছিল কিন্তু আপাত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল না তার মুখে। তিনি কি গল্পটা উপভোগ করছিলেন? সে বলতে পারবে না।
‘বিড়ালদের শহরে কি টেলিভিশন আছে?’ তার বাবা জিগ্যেস করলেন তেংগো যখন থামল। গল্পটা জার্মানিতে লেখা হয়েছিল ১৯৩০-এর দশকে। তখন তাদের টেলিভিশন ছিল না। তবে রেডিও ছিল।’
‘শহরটি কি বিড়ালরাই বানিয়েছিল? নাকি বিড়ালেরা সেখানে থাকতে আসার আগে মানুষই সেটাকে বানিয়েছিল?’ তার বাবা জিগ্যেস করল, যেন তিনি জিগ্যেস করছেন নিজেকেই।
‘আমি জানি না,” তেংগো বলল, ‘তবে মনে হয় মানুষই শহরটাকে বানিয়েছিল। হয়ত তারা কোনো কারণে চলে গিয়েছিল, যেমন, তারা হয়ত সবাই কোনো একটা মহামারিতে মারা গিয়েছিল আর বিড়ালেরা এসেছিল সেখানে থাকতে।”
তার বাবা মাথা নাড়লেন, ‘যখন একটা শূন্যতা তৈরি হয়, কোনোকিছুকে এসে পূরণ করতে হয় সেই শূন্যতা। এটাই সবাই করে।’
‘এটাই কি সবাই করে?’
‘একদম তাই।’
‘কোন ধরনের শূন্যতাকে পূরণ করছেন আপনি?’
তার বাবা মুখ গোমড়া করলেন। তারপর তিনি তার কণ্ঠে একটা বক্রোক্তির ছোঁয়া এনে বললেন, ‘তুমি সেটা জানো না?’
‘আমি জানি না,’ তেংগো বলল।
তার বাবার নাসারন্ধ্র জ্বলে উঠল। একদিকের ভ্রু উপরে উঠল কিঞ্চিৎ। “যদি তুমি ব্যাখ্যা ছাড়া সেটা বুঝতে না পারো, ব্যাখ্যা সহ বললেও তুমি বুঝতে পারব না।”
তেংগো দৃষ্টিটাকে সরু করে তাকাল, বোঝার চেষ্টা করল লোকটার অভিব্যক্তি। তার বাবা কখনোই এমন অসুবিধাজনক, সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করেন নি। তিনি সব সময় কথা বলতেন মূর্ত, ব্যবহারিক শব্দ ব্যবহার করে।
‘বুঝলাম। আপনি এক ধরনের শূন্যতা পূরণ করেছেন,’ তেংগো বলল, ‘ঠিকাছে, তাহলে আপনি যে শূন্যতা সৃষ্টি করে যাবেন কে তা পূরণ করবে?’
‘তুমি,’ তার বাবা ঘোষণা করলেন, সোজা তেংগোর দিকে তার তর্জনী তাক করে, “এটা কি খুব স্পষ্ট না? আমি একটা শূন্যতা পূরণ করে চলেছি যা কেউ তৈরি করে রেখে গেছে, কাজেই তুমিও সেই শূন্যতা পূরণ করবে যা আমি রেখে যাচ্ছি।’
“যেভাবে বিড়ালেরা এসে মানুষের চলে যাবার পর শহরের শূন্যতা পূরণ করেছিল।”
‘হ্যাঁ,’ বললেন তার বাবা। তারপর তিনি শূন্যমনে তাকিয়ে থাকলেন তার বাড়ানো তর্জনীর দিকে যেনবা কোনো রহস্যময়, স্থানচ্যূত কোনোকিছুর দিকে।
তেংগো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘হ্যাঁ, তাহলে কে আমার বাবা?’
‘একটা শূন্যস্থান। তোমার মা তার শরীরকে যুক্ত করেছিল একটা শূন্যতার সাথে এবং তোমার জন্ম দিয়েছিল। আমি সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছি।’
এতটা বলার পর তার বাবা তার চোখ দুটি এবং মুখ বন্ধ করলেন।
‘আর তিনি চলে যাবার পর আপনি আমাকে লালন পালন করলেন। এটাই কি আপনি বলতে চাইছেন?’
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে তিনি বললেন, যেনবা একটা সহজ সত্যকে কমবুদ্ধির শিশুকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, ‘সেকারণেই আমি বলেছি, ‘যদি তুমি ব্যাখ্যা ছাড়া বুঝতে না পারো, তবে ব্যাখ্যার সাহায্য নিয়েও তুমি বুঝতে পারবা না।”
তেংগো তার হাত দুটি ভাঁজ করে কোলের উপর রাখল এবং তার বাবার মুখের দিকে সরাসরি তাকাল। এই লোকটা শূন্য খোলস নয়, সে ভাবল। একজন রক্ত-মাংসের মানুষ তিনি, খুব সংকীর্ণ, গোঁয়ার যার আত্মা, সমুদ্রের ধারের এক টুকরা ভূমিতে থেমে থেমে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছেন। নিজের ভেতর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা শূন্যতার সঙ্গে বাঁচা ছাড়া অন্য কোনো উপায় তার নেই। অবশেষে ঐ শূন্যতা অবশিষ্ট স্মৃতিকেও গ্রাস করবে, কেবল সময়ের ব্যাপার।
বিকাল ৬টার একটু আগে তেংগো তার বাবাকে বিদায় বলল। যখন সে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল, তারা জানালার পাশে পরস্পরের কাছাকাছি বসে থাকল কিছুই না বলে। তেংগোর আরও অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ছিল, কিন্তু সে জানতো যে কোনো উত্তর সে পাবে না। তার বাবার শক্ত করে এঁটে রাখা ঠোঁটদুটি দেখে তাই বোঝা গেল। যদি তুমি ব্যাখ্যা ছাড়া কোনোকিছু না বোঝো, ব্যাখ্যাসমেতও তুমি তা বুঝতে পারবে না, তার বাবা যেমনটা বলেছিলেন।
যখন তার সময় নিকটবর্তী হলো, তেংগো বলল, ‘আজ আপনি অনেক বলেছেন, পরোক্ষ কথা এবং কখনো কখনো বোঝা দুঃসাধ্য, কিন্তু হয়ত এতটা সৎ এবং খোলাখুলি হতে পারাই আপনার পক্ষে সম্ভব। আমি অবশ্যই এর জন্য কৃতজ্ঞ থাকব।’
তখনও তার বাবা কিছুই বললেন না, তার চোখ একটি দৃশ্যে নিবদ্ধ যেন কোনো পাহারার দায়িত্বে থাকা সৈনিক, মনস্থির করেছেন দূরের পাহাড়ের উপর বর্বর জাতির লোকদের পাঠানো অগ্নি-সংকেত কোনোক্রমেই দৃষ্টিচ্যূত করবেন না। তেংগো বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে দেখবার চেষ্টা করল, কিন্তু বাইরে কেবলই পাইন উদ্যান, আসন্ন সূর্যাস্তের আভায় রঞ্জিত।
‘এ কথা বলার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু বস্তুত আমি কিছুই করতে পারি না আপনার জন্য, শুধু এই আশাটুকু রাখতে পারি যে, যে প্রক্রিয়ায় আপনার শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে তা বেদনামুক্ত হোক। আমি নিশ্চিত যে, আপনি অনেক যাতনা সয়েছেন। আপনি আমার মাকে এতটা গভীরভাবে ভালোবেসেছেন যতটা আপনার পক্ষে সম্ভব। আমি তা বুঝতে পারি। কিন্তু তিনি চলে গেছেন, সেটা অবশ্যই কঠিন ছিল আপনার জন্য- যেন এক শূন্য শহরে বাস করা। তবু, সেই শূন্য শহরে আপনি আমাকে বড় করে তুলেছেন।’
একদল কাক উড়ল আকাশে কা কা করতে করতে। তেংগো উঠে দাঁড়াল। বাবার সামনে গেল আর তার হাত রাখল তার কাঁধের উপর। “বিদায়, বাবা। আমি শিগগিরই আবার আসব।”
দরজার হাতলে হাত রেখে, তেংগো শেষবারের মতো ফিরে তাকাল এবং দুঃখ পেল বাবার চোখ থেকে একফোটা জল গড়িয়ে পড়তে দেখে। সিলিংয়ের ফ্লুরোসেন্ট আলোর নিচে তা চকচক করল ঘোলাটে রূপালি রঙের মতো। জলের ফোটাটি ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ল তার গালে এবং পড়ে গেল তার কোলের উপর। তেংগো দরজা খুলল এবং চলে গেল সেই ঘর ছেড়ে। স্টেশন পর্যন্ত সে একটা ক্যাব নিলো এবং চড়ে বসল সেই ট্রেনে যেটি এখানে তাকে নিয়ে এসেছিল।
[জ্যায় রবিনের ইংরেজি অনুবাদ থেকে]
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।