বিড়ালদের শহর : হারুকি মুরাকামি–তৃতীয় পর্ব

 

তেংগোর পক্ষে কেবল যে শরীরী বৈশিষ্ট্যের কারণে বাবার সঙ্গে সাদৃশ্য করা কঠিন হতো তা নয়, তাদের মনস্তাত্ত্বিক গড়নও ছিল আলাদা। তার বাবার মধ্যে কখনো এমন কিছুর চিহ্ন দেখা যেত না যাকে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রহ বলা চলে। সত্য যে, একটা গরিব পরিবারে জন্ম নিয়ে তিনি উপযুক্ত শিক্ষা পান নি। বাবার পরিস্থিতির ব্যাপারে তেংগোর মনে একটা মাত্রায় দুঃখবোধ আছে। কিন্তু জ্ঞান অর্জনের বনিয়াদী যে ইচ্ছা- তেংগোর ধারণা যে জিনিসটা হচ্ছে মানুষের ভেতরকার কম-বেশি স্বভাবগত তাড়না তার মধ্যে এটার অভাব ছিল। তার ভেতরে এক ধরনের ব্যবহারিক প্রজ্ঞা ছিল যা তাকে টিকে থাকার সামর্থ দিয়েছে- কিন্তু তেংগো কখনো তার বাবার মধ্যে নিজেকে খননের, বৃহত্তর ও বিস্তৃত জগৎকে দেখার সদিচ্ছার কোনো চিহ্ন উপলব্ধি করতে পারেনি। তার খিল আটকানো ছোটো জীবনের স্থবির হাওয়া কখনো তেংগোর বাবার মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দিত না। তেংগো কখনোই একবারের জন্যেও তাকে হাতে বই তুলে নিতে দেখে নি। সঙ্গীত কিংবা সিনেমায় তার কোনো আগ্রহ ছিল না, তিনি কখনো ভ্রমণও করতেন না। একটা মাত্র বিষয় যাতে তিনি আগ্রহ পেতেন তা হলো তার চাঁদা সংগ্রহের রুট। তিনি এলাকাটার একটা মানচিত্র তৈরি করতেন, রঙিন কলম দিয়ে তাতে দাগাতেন এবং যখনই সময় পেতেন সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, যেভাবে একজন জীবতাত্ত্বিক ক্রোমোজম পর্যবেক্ষণ করেন।

 

বিপরীতক্রমে, সবকিছুতেই তেংগোর আগ্রহ। একটা বিস্তৃত ক্ষেত্র থেকে সে জ্ঞান আহরণ করতো মাটি খোঁড়ায় সমর্থ বেলচার দক্ষতায়। ছোটোবেলা থেকেই তাকে দেখা হতো গণিতের বিস্ময় হিসেবে, সে উচ্চ বিদ্যালয়ের অংক কষতে পারতো যখন সে তৃতীয় গ্রেডে পড়তো। তরুণ তেংগোর কাছে গণিত ছিল তার বাবার সঙ্গে যুক্ত জীবন থেকে প্রস্থানের উপায়। গণিতের জগতে, সে হেঁটে যেত এক দীর্ঘ করিডর ধরে, নম্বর বসানো একটার পর একটা দরজা খুলে। প্রতি ক্ষেত্রে একটি করে নতুন দৃশ্য উন্মোচিত হতো তার সামনে, বাস্তব জগতের কদর্য চিহ্নগুলি একদম মুছে যেত। যতদিন পর্যন্ত সে তৎপর হয়ে অনন্ত সঙ্গতির জগতের অনুসন্ধান করতো, ততদিন সে ছিল মুক্ত।

 

তেংগোর জন্য গণিত যখন জাঁকালো একটা কল্পনার অট্টালিকা, সাহিত্য তার কাছে বড় এক জাদুর অরণ্য। গণিত অনন্তভাবে প্রসারিত হয় উপরের স্বর্গের দিকে, কিন্তু গল্পগুলি তার সামনে এমন ভাবে ছড়িয়ে থাকে যে তাদের কঠিন শিকড়গুলি প্রসারিত হয় মাটির গভীরে। এই অরণ্যে কোনো মানচিত্র নেই, কোনো দরজা নেই। তেংগো যখন বড় হয়েছে, কাহিনির অরণ্যটি গণিতের জগতের চেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তার হৃদয়কে। অবশ্যই উপন্যাস পড়াটা ছিল মুক্তির ভিন্ন একটা ধরন- যখন সে বই বন্ধ করতো, তাকে ফিরে আসতে হতো বাস্তবের দুনিয়ায়। কিন্তু কখনো কখনো সে খেয়াল করতো উপন্যাসের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসা ততটা বিধ্বংসী আঘাত ছিল না যেমনটা ছিল গণিতের জগৎ থেকে ফিরে আসা। কেন তেমনটা ছিল? অনেক চিন্তার পর সে একটা সিদ্ধান্তে এসেছিল, কাহিনির অরণ্যের বস্তুগুলি যতো স্পষ্টই হোক তাতে কোনো সোজাসাপ্টা সমাধান ছিল না, যেমনটা আছে গণিতে। কাহিনির ভূমিকা হলো মোটাদাগে একটা সমস্যাকে অন্যরূপে পক্ষান্তরিত করা। সমস্যার প্রকৃতি এবং অভিমুখের উপর ভিত্তি করে বয়ানের ভেতর একট সমাধান অবশ্যই দেয়া থাকতো। তেংগো সেই সমাধান হাতে করে ফিরে যেত বাস্তবের জগতে। সেটি ছিল জাদুর কবজের দুর্বোধ্য লেখা সমেত একটুকরা কাগজের মতো। সেটা কোনো অব্যবহিত ব্যবহারিক উদ্দেশ্য পূরণ করতো না, কিন্তু এটা একটা সম্ভাবনাকে ধারণ করতো।

 

তেংগো তার পড়া থেকে সম্ভাব্য একটা সমাধান বের করতে পারতো: আমার প্রকৃত পিতা অবশ্যই অন্য কোনোখানে আছে। ডিকেন্সের উপন্যাসের দুর্ভাগা এক শিশুর মতো তেংগো হয়তো চালিত হচ্ছিল অদ্ভুত সব পরিস্থিতির দ্বারা যাতে সে এই প্রতারকের হাতে পালিত হতে পারে। এরকম একটা সম্ভাবনা ছিল একই সঙ্গে একটা দুঃস্বপ্ন এবং একটা আশা। অলিভার টুইস্ট পড়ার পর লাইব্রেরি গিয়ে তেংগো ডিকেন্সের সবগুলো খ- চষে বেড়ালো। সে যখন ডিকেন্সের গল্প পড়ল, সে তার নিজেরই জীবনের পুনঃকল্পিত এক সংস্করণের ভেতর দাঁড় করাল নিজেকে। এই ফ্যান্টাসিগুলে বেড়ে চলল এবং আরো জটিল আকার নিতে থাকল। সেসবে একটা প্যাটার্ন যেমন ছিল তেমনি তাতে ছিল নিঃসীম বৈচিত্র। সব গল্পেই তেংগো নিজেকে বলতো যে, তার বাবার বাড়িতে সে থাকে না। ভুলক্রমে সে এই খাঁচার ভেতর আটকা পড়ে গেছে এবং একদিন তার সত্যিকার বাবা তাকে খুঁজে পাবে এবং তাকে উদ্ধার করবে। তখন তার কল্পনার সুন্দর রোববারগুলো সে ফিরে পাবে।

 

তেংগোর বাবা তার সন্তানের অসাধারণ গ্রেডের কারণে গর্ব বোধ করতেন এবং প্রতিবেশীদের কাছে অহংকার প্রকাশ করতেন। যাহোক, একই সঙ্গে তেংগোর মেধা ও প্রতিভার কারণে তিনি এক ধরনের বিরক্তিও প্রকাশ করতেন। মাঝে মধ্যে, তেংগো যখন পড়ার টেবিলে, পড়ছে, তার বাবা তাতে ব্যাঘাত ঘটাতেন, তাকে টুকিটাকি কাজের কথা বলে বা বানোয়াট কোনো অন্যায় ব্যবহারের জন্য জ্বালাতন করতেন। তার বাবার জ্বালাতনের বিষয় ছিল সর্বদা একই রকমের: প্রত্যহ নিজেই জ্বালাতন সহ্য করে অনেক পথ তিনি ঘুরতেন এবং লোকজনের শাপ-শাপান্ত সহ্য করতেন- তেংগো তখন কিছুই করতো না, শান্তি বজায় রাখতে সবকিছুকে সহজভাবে নিতো- “আমি যখন তোমার বয়সী ছিলাম আমাকে লেজ গুটিয়ে কাজ করতে হতো, যে কোনো কিছু নিয়েই আমার বাবা আর বড় ভাইয়েরা আমাকে পিটিয়ে কালশিরা ফেলে দিতো, তারা আমাকে পর্যাপ্ত খেতে দিতো না। তারা আমাকে দেখতো একটা জানোয়ারের মতো। আমি চাই না যে, তুমি কয়টা ভালো গ্রেড পেয়ে নিজেকে অসাধারণ ভাবো।”

 

লোকটা আমাকে নিয়ে ঈর্ষান্বিত, তেংগো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে ভাবতে শুরু করল। তিনি ঈর্ষান্বিত ছিলেন আমাকে নিয়ে কিংবা যে জীবন আমি যাপন করছি তাই নিয়ে। কিন্তু কোনো বাবা কি আসলেই তার সন্তানের প্রতি ঈর্ষা অনুভব করতে পারেন? তেংগো তার বাবাকে নিয়ে বিচারে বসছে না, কিন্তু তার কথা আর কাজ থেকে বেরিয়ে আসা মর্মন্তুদ নীচতা সে অনুভব না করে পারল না। ব্যাপারটি এমন না যে, তেংগোর বাবা তাকে ব্যক্তি হিসেবে ঘৃণা করে, বরং তিনি তেংগোর ভেতরের কোনোকিছুকে ঘৃণা করেন যে ব্যাপারটাকে তিনি ক্ষমা করতে পারেন না।

 

ট্রেন যখন টোকিও স্টেশন ছাড়ল, তেংগো তার কিনে আনা পেপারব্যাক বইটি বের করল। বইটা ছিল ভ্রমণ বিষয়ক গল্পের একটি সংগ্রহ এবং এতে একটি গল্প ছিল যার শিরোনাম “বিড়ালদের শহর”- একটি ফ্যান্টাসি ধরনের গল্প, এক জার্মান লেখকের লেখা যিনি তেংগোর পরিচিত কোনো লেখক নন। বইয়ের পূর্বকথা অনুসারে গল্পটি লেখা হয়েছে দুই মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি কোনো সময়ে।

 

গল্পটি এরকম: এক তরুণ একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিশেষ কোনো গন্তব্য মাথায় না রেখে। সে কোনো ট্রেনে চড়ে বসে আর যে কোনো একটা স্টেশনে নেমে পড়ে যদি জায়গাটি তার মধ্যে আগ্রহ জাগায়। সে একটা ঘর ভাড়া নেয়, জায়গাগুলো ঘুরে দেখে এবং যতদিন তার ভালো লাগে সেখানেই থাকে। আগ্রহ মিটে গেলে অন্য কোনো ট্রেনে চড়ে। সে এভাবেই তার প্রত্যেক ছুটি কাটায়।

 

একদিন সে ট্রেনের জানালা থেকে একটা সুন্দর নদী দেখল। শান্ত সবুজ পাহাড়গুলি আঁকাবাঁকা প্রবাহের ধার দিয়ে, এবং সেসবের নিচে পুরানো পাথরের সেতু সহ খুব ছোট্ট একটা শহর, যেখানকার একটা স্টেশনে ট্রেন থামল। আর যুবক তার ব্যাগ সমেত নেমে পড়ল। অন্য আর কেউ নামল না, আর, যখনই সে নামল ট্রেনটা চলে গেল।

 

স্টেশনটিতে কেউ কাজ করে না, খুব কম তৎপরতা সেখানে লক্ষ করা গেল। যুবক সেতু পার হলো এবং শহরের ভেতর ঢুকল। দোকান-পাট সব বন্ধ, শহরটাও ফাঁকা। শহরের একমাত্র হোটেলের ডেস্কে কোনো লোক নেই। জায়গাটিকে একেবারেই বসতিহীন মনে হলো। হয়তো সমস্ত লোক অন্য কোথাও ঘুমাতে গেছে। কিন্তু এখন সবেমাত্র সকাল সাড়ে দশটা বাজে, বৈকালিক ঘুমের জন্য খুব অসময়। হয়তো কোনো কারণে সবাইকে শহর ছাড়তে হয়েছে। যাই হোক, আগামীকাল সকালের আগে পরবর্তী ট্রেন আসবে না, কাজেই তার কোনো বিকল্প নেই এখানে রাত কাটানো ছাড়া। সে সময় কাটানোর জন্য শহরটাতে ঘুরে বেড়ালো।

 

আসলে এটা বিড়ালদের শহর। যখন সূর্যাস্ত হতে শুরু করল, সেতু পার হয়ে অনেক বিড়াল দলবেঁধে আসতে শুরু করল- সমস্ত ধরনের ও রঙের বিড়াল। এরা সাধারণ বিড়ালের থেকে বেশ বড়ো, কিন্তু তবু তারা বিড়ালই। এ দৃশ্য দেখে যুবক ধাক্কা খেল। সে দৌড় দিয়ে শহরের কেন্দ্রে ঘণ্টা-ঘরে গেল এবং  চূড়ায় উঠে লুকিয়ে থাকল। বিড়ালেরা তাদের কাজে গেল, দোকানের  ঝাঁপ খুলে কিংবা নিজেদের ডেস্কে গিয়ে বসে তাদের দিনের কাজ শুরু করল। শিগগিরই আরও বিড়াল এলো, অন্যদের মতো সেতু পার হয়ে। তারা দোকানগুলোতে ঢুকল কেনাকাটা করতে কিংবা টাউন হলে গেল তাদের প্রশাসনিক কাজকর্ম করতে কিংবা হোটেল রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবার খেল কিংবা পানশালায় ঢুকে বিয়ার পান করল এবং বিড়ালদের গান গাইল প্রাণোচ্ছলভাবে। বিড়ালেরা যেহেতু অন্ধকারে দেখতে পায়, তাদের প্রায় দরকারই পড়ে না আলোর, কিন্তু সেই বিশেষ রাতটিতে চারদিকে পূর্ণ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল শহর। সেই আলোয় যুবক ঘণ্টাঘরের উচ্চাসন থেকে দেখতে পাচ্ছিল খুঁটিনাটি সবকিছুই। যখন ভোর হয়ে এলো, বিড়ালেরা তাদের কাজ শেষ করল, বন্ধ করল দোকান-পাট, এবং দল বেঁধে ফিরে গেল সেতু পার হয়ে।

 

সূর্য উপরে উঠে আসার পর, বিড়ালেরা চলে গেল, আবারও ফাঁকা হয়ে গেল শহর। যুবক নেমে এলো নিচে, হোটেলের একটা বিছানা খুঁজে নিলো নিজের জন্য, এবং ঘুমাতে গেল। যখন তার ক্ষুধা পেল হোটেলের রান্নাঘরে পড়ে থাকা অবশিষ্ট কিছু রুটি আর মাছ খেল। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে সে ঘণ্টা ঘরে গিয়ে আবারও লুকিয়ে পড়ল এবং সকাল না হওয়া পর্যন্ত বিড়ালদের কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। ট্রেনগুলি স্টেশনে থামল দুপুরের আগে এবং বিকাল পড়ে এলে। নতুন কোনো যাত্রী নামল না আর কোনো যাত্রী উঠলও না। যদিও ট্রেনগুলি স্টেশনে থেমে থাকল ঠিক এক মিনিট সময় ধরে তারপর আবারও চলে গেল। সে এই ট্রেনগুলির কোনো একটি ধরতে পারতো এবং বিড়ালদের এই ছমছমে শহরটাকে পেছনে …

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!