বিড়ালদের শহর : হারুকি মুরাকামি–দ্বিতীয় পর্ব

 

যারা আসতো তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতো। যদি লোকেরা দিতে না চাইতো তার বাবা তাদেরকে শাসাত কিংবা তোষামোদ করতো। যদি তারা না দেবার চেষ্টা করতে যেত তার বাবা গলা চড়াতেন। কখনো কখনো তিনি তাদেরকে পথভ্রষ্ট কুকুরের মতো অভিশাপ দিতেন। তার এসব অভিজ্ঞতা এমন ধরনের বিষয় না যা তার বন্ধুদের কাছে বলা যায়। বাবু শ্রেণির লোকদের মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের সমাজে সে তার আগন্তুকের অনুভবটাকে এড়াতে পারতো না। ভিন্ন ধরনের জগতে ভিন্নরকম এক জীবনযাপন করতো। সৌভাগ্যজনকভাবে, তার গ্রেড ছিল অসাধারণ, তার শরীরচর্চার ক্ষমতা ও সামর্থও ছিল তেমনি। কাজেই, সে যদিও ছিল আগন্তুকের মতো পরিত্যক্ত ছিল না মোটেও। সব ক্ষেত্রেই, সে সম্মানজনক ব্যবহার পেত। কিন্তু যখন অন্য ছেলেরা রোববারে কোথাও যেতে কিংবা তাদের বাসায় ডাকতো তাদেরকে তাকে বিমুখ করতে হতো। শিগগিরই তারা তাকে জিগ্যেস করাও বন্ধ করেছিল।

 

শ্রমজীবী তোহোকো অঞ্চলের এক খামারী পরিবারে তৃতীয় পুত্র হিসেবে জন্ম নিয়ে তেংগোর বাবা যত শিগগির সম্ভব বাড়ি ছাড়েন এবং ডেরাভান্ডা লোকদের দলে জুটে মানচুরিয়াত পাড়ি দেন ঊনিশ শতকের তিরিশের দশকে। তিনি সরকারের সেই দাবিতে বিশ্বাস করেন নি যে, মানচুরিয়া একটি বেহেশত যেখানে আছে অবারিত আর সমৃদ্ধ ভূমি। কোথাও যে বেহেশতের দেখা মিলবে না তা বোঝার পক্ষে যথেষ্টই জানতেন তিনি। তিনি ছিলেন স্রেফ দরিদ্র আর ক্ষুধার্ত। যদি সে বাড়িতে থাকে তবে বাঁচতে হতো অনাহারের কিনারা দিয়ে- এমনটাই সে ভাবতে পারতো। মানচুরিয়ায় তাকে এবং অন্য ডেরাভান্ডাদের দেয়া হয়েছিল কিছু খামারের সরঞ্জাম ও ছোটো ছোটো হাতিয়ার, এবং একসঙ্গে তারা চাষবাস শুরু করেছিল। জমি ছিল অনুর্বর আর পাথুরে, শীতে সবকিছু জমে যেত। কখনো কখনো তাদের খাবার জিনিস বলতে থাকতো পথভ্রষ্ট কুকুর। যদিও সরকারের সহায়তায় প্রথম কয়েক বছর চালিয়ে নিতে পেরেছে। তাদের জীবন শেষ অব্দি বেশ থিতু হয়ে আসছিল যখন, ১৯৪৫-এর আগস্টে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরোমাত্রায় আক্রমণ করে বসে মানচুরিয়ায়। আসন্ন পরিস্থিতি সম্পর্কে এক কর্মকর্তা যিনি তার সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিলেন, তার কাছে গোপনে খবর পাবার পর তেংগোর বাবা চাচ্ছিলেন এটা ঘটুক। যে মিনিটে তিনি খবরটা শুনলেন যে তারা সীমান্ত পার হয়েছে, তিনি তার ঘোড়ায় চড়ে বসলেন, এবং দা-লিয়েনের উদ্দেশ্যে শেষের আগের ট্রেনটিতে চড়ে বসলেন। তার খামারের সঙ্গীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি বছর শেষের আগেই জাপানে ফিরে গেছেন।

যুদ্ধের পর তেংগোর বাবা টোকিওতে ফিরে যান এবং কালোবাজারি করে এবং কাঠমিস্ত্রির শিক্ষানবিশ হিসেবে অর্থ আয়ের চেষ্টা করেন, কিন্তু সমর্থ হন কেবল কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। তিনি একটি মদের  দোকানের সরবরাহকারী হিসেবে যখন কাজ করছিলেন তখনই আচমকা দেখা পান মানচুরিয়ায় পরিচিত হওয়া সেই কর্মকর্তা বন্ধুর। লোকটা যখন জানলেন যে তেংগোর বাবা কঠিন সময় পার করছেন এবং একটা জুৎসই চাকুরি খুঁজে পাচ্ছেন না, তিনি এনএইচকের গ্রাহক বিভাগে তার এক বন্ধুর কাছে সুপারিশ করার প্রস্তাব দেন, এবং তেংগোর বাবা তা গ্রহণ করেন আনন্দের সাথে। তিনি এনএইচকের প্রায় কিছুই জানতেন না, তবে তিনি যে কোনো কিছু করতে চাইছিলেন যাতে তার একটা বাঁধা আয়ের নিশ্চয়তা থাকে।

 

এনএইচকে-তে তেংগোর বাবা দারুণ উৎসাহের সঙ্গে তার কর্তব্য পালন করেন। তার প্রধানতম সামর্থ ছিল দুর্দশার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার অধ্যবসায়। জন্মাবধি যে কখনো ভরপেট খাবার খায় নি তার পক্ষে এনএইচকের চাঁদা আদায় করা কষ্টের কোনো কাজ নয়। তার দিকে ছুঁড়ে দেয়া সবচেয়ে নিষ্ঠুর অভিশাপও তার কাছে কিছুই ছিল না। তাছাড়া তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে থেকে, খুব নিম্নপদস্থ সদস্য হলেও। তার সম্পাদিত কাজ আর তার দৃষ্টিভঙ্গি এতো অসাধারণ ছিল যে, বছর খানেক পর একজন অনুমোদিত সংগ্রাহক হিসেবে তাকে সরাসরি পুরোদস্তুর কর্মচারীর পদে নিযুক্ত করা হয়, এনএইচকেতে এমন অর্জনের কথা আর শোনা যায় নি। শিগগিরই, তিনি কর্পোরেশনের মালিকানায় থাকা বাসায় গিয়ে উঠতে সমর্থ হন এবং কোম্পানির স্বাস্থ্য-পরিচর্যার পরিকল্পনায় যুক্ত হন। এটা ছিল তার জীবনে সৌভাগ্যের সবচেয়ে বড় অভিঘাত।

 

শিশু তেংগোর বাবা কখনো তাকে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে শোনান নি, কখনো ঘুমানোর আগে কোনো বই পড়েও শোনান নি। পরিবর্তে তিনি ছেলেকে শোনাতেন প্রকৃত অভিজ্ঞতার গল্প। তিনি খুব ভালো গল্প কথক ছিলেন। শৈশব ও তরুণ সময়ের বর্ণনাগুলিতে আদতেই কোনো তাৎপর্য ছিল না, তবে খুঁটিনাটি বর্ণনাগুলি ছিল খুব জীবন্ত। তাতে হাসির গল্প, মর্মস্পর্শী গল্প আর হিংসাত্মক গল্পও ছিল। জীবনকে যদি তার কাহিনির রং ও বৈচিত্র দিয়ে মাপা যেত, তেংগোর বাবার জীবন তবে তার মতো করে অবশ্যই সম্মৃদ্ধ ছিল, হয়তো। কিন্তু যখন তার গল্পগুলি তার এনএইচকের কর্মচারী হওয়ার পরের সময় পর্যন্ত পৌঁছাতো সেসব তাদের ওজস্বিতা হারিয়ে ফেলতো। তিনি এক নারীর সাক্ষাৎ পেলেন, তাকে বিয়ে করলেন এবং একটি ছেলে হলো- তেংগো। তেংগোর জন্মের পর কয়েক মাস যেতে না যেতেই তার মা অসুস্থ হলো এবং মারা গেল। তারপর বাবা তাকে একা একা বড় করলেন, যখন তিনি এনএইচকের কঠিন চাকরিটি করছিলেন। তেংগোর মার সঙ্গে তার দেখা হবার ঘটনাটি কিভাবে ঘটল আর কীভাবে বিয়ে হলো, তিনি কেমন নারী ছিলেন, তাঁর মৃত্যুর কী কারণ ছিল, তার মৃত্যু কি খুব সহজ ছিল নাকি তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন- এসব বিষয়ে তেংগোর বাবা প্রায় কিছুই বলেন না। সে যদি জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করতো, তার বাবা কৌশলে তার প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন। বেশির ভাগ সময় এসব প্রশ্নে তার মেজাজ বিশ্রীভাবে বদলে যেত। তেংগোর মায়ের কোনো একটি ছবিও থেকে যায় নি কোথাও।

 

তেংগো তার বাবার গল্প ঝেড়ে পুছে অবিশ্বাস করতো। সে জানতো তার মা তার জন্মের কয়েক মাসের মাথায় মারা যায় নি। তার মায়ের একটি স্মৃতি ছিল তার মাথায় যখন তার দেড় বছর বয়স, তার মা তার দোলনার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক লোকের বাহুলগ্না হয়ে, যিনি তার বাবা ছিলেন না। তার মা ব্লাউজ খুলে ফেলেন। নামিয়ে ফেলেন অন্তর্বাসের ফিতা এবং লোকটি যে তার বাবা ছিল না, তাকে তার স্তন চুষতে দেন। তেংগো তাদের পাশেই ঘুমাচ্ছিল, তার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু, একইসঙ্গে এটাও সত্য যে, সে ঘুমিয়ে ছিল না। সে তার মাকে দেখছিল।

 

এটাই ছিল তেংগোর কাছে তার মায়ের ছবি। নিখুঁতভাবে পরিষ্কার দশ সেকেন্ডের এই দৃশ্যটি তার মগজের ভেতর গেঁথে গিয়েছিল। তার কাছে থাকা এটাই ছিল তার মা সম্পর্কিত একমাত্র বস্তুনিষ্ঠ তথ্য, যা তার মায়ের সঙ্গে তার একটি ক্ষীণ যোগসূত্র তৈরি করতে পারে। সে ও তার মায়ের সঙ্গে এটাই ছিল প্রাকল্পিক এক নাড়ির সম্পর্ক। যাহোক, তার বাবার কোনো ধারণা ছিল না যে, এই জীবন্ত দৃশ্য টিকে আছে তেংগোর স্মৃতিতে, যেনবা ময়দানে রয়ে গেছে একটা গরু! তেংগো অন্তহীনভাবে তার অংশগুলোকে উগরে দিচ্ছিল চিবানোর জন্য, এ এক জাবর কাটা যা থেকে সে নেয় তার অপরিহার্য পুষ্টি। পিতা ও পুত্র: প্রত্যেকেই বন্দী ছিল তার তার গোপনতার এক গভীর অন্ধকার আলিঙ্গনে। পরিণত বয়সে তেংগো মাঝেমধ্যে সন্দেহ করেছে তার মনের ছবিতে যে তরুণ লোকটি তার মার স্তন্য চুষছিল সেই তার জন্মগত পিতা। কারণ এনএইচকেতে সংগ্রাহকের কাজ করা তার পিতার সঙ্গে কোনো দিক থেকেই তার কোনো মিল নেই। তেংগো ছিল দীর্ঘদেহী, হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ আর কপালটা বেশ চওড়া, সরু নাক এবং বর্তুলাকার কান। তার বাবা ছিলেন বেঁটে ও মোটা এবং খুবই অনাকর্ষণীয়। তার কপাল ছিল ছোটো, নাক চ্যাপ্টা এবং ঘোড়ার মতো সুচ্যগ্র কান। তেংগো যেখানে নিরুদ্বেগ, উদার দৃষ্টি, তার বাবাকে দেখাতো মাথা-গরম এবং একজন দৃঢ়মুষ্ঠীর লোক, তাদের দুজনের মধ্যে এসব দিক তুলনা করে লোকেরা প্রকাশ্যেই তাদের বিসদৃশতা নিয়ে টিপ্পনী কাটতো।

গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!