বিজ্ঞাপনের ফাঁদে…..মেহেরুন নেছা রুমা

আলো থেকে অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়ার জন্য নারীর চলার পথে থাকে হাজারো চোরাবালি। ভালো কিছু করার প্রত্যাশায় ঘর থেকে বের হলেই তাদের চলার পথে এমন সব অন্ধগলির ফাঁদ পাতা থাকে যে, মনের অজান্তে, না বুঝে সে সেই অন্ধ জগতে পা দিয়ে বসে। যখন বুঝতে পারে, উত্তরণের কোনো উপায় থাকে না। এমনই এক মেয়ের জীবনের এক কঠিনতম বাঁকের কথা বলব, যে বাঁকের ফাঁদে পড়ে এখন তার জীবন কেবলই অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সুবর্ণার (ছদ্ম নাম) কাছেই শুনেছিলাম তার জীবনের ট্রাজেডির গল্প। মফস্বলের একটি অতি সাধারণ পরিবারের সুন্দরী মেধাবী মেয়ে সুবর্ণা। একদিন পত্রিকার পাতায় কোনো একটি মিডিয়ার দেওয়া ‘নতুন মুখ চাই’ শিরোনামের বিজ্ঞাপন দেখে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অভিনয় এবং বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়ার স্বপ্নে সুবর্ণার চোখ আটকে যায় সেই লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ওপর।

আগ্রহভরে সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় এবং তাকে সেই প্রতিষ্ঠানের পরবর্তী মিউজিক ভিডিওর ‘নতুন মুখ’ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তী কাজটির শুটিং হবে বাংলাদেশের বাইরে কয়েকটি দেশে। সুবর্ণা যদি তাদের সঙ্গে কাজ করতে রাজি থাকেন তাহলে যেন আজই তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। সঙ্গে সঙ্গে কী কী সুবিধা দেওয়া হবে তাও জানানো হয়। সুবর্ণা খুশিতে আত্মহারা। মেঘ না চাইতেই জল-ভাবতেও পারেননি কখনও। রাজি হয়ে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। মেয়ে তার যোগ্যতা অনুযায়ী কিছু একটা করতে যাচ্ছে দেখে পরিবার থেকেও অনুমতি পেয়ে গেলেন। এক সপ্তাহ পরই তার প্রথম বিদেশ সফর হবে ভারতে। ওই প্রতিষ্ঠান থেকেই সুবর্ণার যাওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন হচ্ছে। সুবর্ণাকে শুটিং উপযোগী বেশকিছু পোশাক এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার জন্য টাকা দেওয়া হলো। অগ্রিম বেতন দেওয়া হলো। সবকিছু মিলিয়ে সুবর্ণা চমকিত এবং পুলকিত। যথাসময়ে বিমানে চেপে সুবর্ণা পাড়ি জমালেন দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের একটি প্রদেশে। সেখানে পৌঁছার পর তাকে এক অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার মতো আরও মেয়ে রয়েছে। বিস্মিত সুর্বণা, কিছু বোঝার আগেই নেশাজাতীয় তরল পানিয় পান করিয়ে একটানা সাতটি দিন একটি ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হলো তাকে। তার মত আরও কিছু মেয়ে সেখানে। প্রতিদিন তাদের ওপর চললো বহুসংখ্যক পুরুষের পৈশাচিক নির্যাতন। না মুক্তির কোন উপায় ছিল না। সাত দিনের কার্যাবলি নিয়ে ওই চক্রটি সুবর্ণার নামে ধারাবাহিক ১০টি পর্নো সিডি তৈরি করে। ইস্ট এশিয়া ইউনিভার্সিটির (ছদ্মনাম) ছাত্রী সুবর্ণার হট ফিলম- এক. দুই. তিন…. এভাবে ১০টি সিরিয়াল। এই সিডির ব্যাপারটি সুবর্ণার পুরোপুরি অজানা ছিল। সাত দিন পর সুবর্ণা পাগলপ্রায় হয়ে কোনোমতে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু এই মুখ তিনি কাকে দেখাবেন, কীভাবে দেখাবেন! তার সঙ্গে যা ঘটেছে সে কথা কাউকে বলতে পারছেন না। বহুবার আত্মহত্যা করতে উদ্যোগ নিয়েও সাহস করে পেরে ওঠেননি। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এলে ভালো সম্বন্ধ আসল তার জন্য। সে রকমই এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে পাকা হয়ে গেল। সুবর্ণার মনে প্রচন্ড ভয়। কিন্তু বাবা-মায়ের কথা ভেবে রাজি হন। বেশ ভালোই চলছিল তার সংসার জীবন। নতুন বর, নতুন পরিবেশ- সবকিছু তাকে আবার নতুন করে বাঁচার আশা জোগালো। এক রোমাঞ্চকর বৃষ্টির রাতে নবদম্পতি কিছুটা আনন্দঘন মুহূর্ত কাটানোর অভিপ্রায়ে সুবর্ণার স্বামী অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে বিশেষ ফিলম নিয়ে আসেন দেখার জন্য। রাতে সে ফিলম প্লে করতেই প্রথমে স্ত্রীর নাম দেখতে পান স্বামী। এক নামে বহু মেয়ে থাকতেই পারে। হাসি-খুশি মনে ফিলম দেখতে বসেন। ধীরে ধীরে চোখ দুটি বড় হয়ে যায় সুবর্ণা এবং তার স্বামীর। এ কাকে দেখছেন তারা! এ তো সুবর্ণাই। স্বামী তাকান স্ত্রীর দিকে। স্ত্রীর আর দুনিয়ার কোনো কিছুর দিকে তাকানোর অবস্থা নেই। সুবর্ণাকে স্বামী জিজ্ঞাসা করছেন, এটা কি তুমি? স্ত্রী নির্বাক। স্বামীর মাথা গরম হয়ে গেল। হওয়াটাই স্বাভাবিক। বারবার প্রশ্ন করছেন- বল, এটা কী দেখছি? তুমি এ কাজ করতে? আমাকে ঠকালে কেন? এত নষ্টা, এতটা খারাপ মেয়ে তুমি? আরও কত কথা যে বললেন তার হিসাব নেই।

সুবর্ণার স্বামী যে দোকান থেকে ওই সিডি কিনেছিলেন সেই দোকানে গেলেন। কারণ তিনি যখন সিডিটা কিনেছিলেন দোকানি বলেছিলেন, এ সিরিয়ালের ১০টি সিডি আছে। ভালো লাগলে নেবেন। কিন্তু তিনি ভালো লাগার জন্য যাননি। দোকান থেকে ১০টি সিডিই নিয়ে এলেন। দেখলেন ১০টির মধ্যেই স্পষ্ট তার স্ত্রী। সে রাতেই সুবর্ণার বাবা-মাকে খবর দেওয়া হলো। সুবর্ণাসহ তার মা-বাবাকে চরম অপমান করে স্ত্রীর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন স্বামী। মা-বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। লজ্জায়-ঘৃণায় মেয়ের মুখ আর জীবনে দেখবেন না বলে জানিয়ে দিলেন তারাও। সুবর্ণা সবকিছু খুলে বললেন। কিন্তু তার এ বলায় কারও মন গলল না।

স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবার ঘরেও ঠাঁই হলো না তার। আত্মীয়স্বজন মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সুবর্ণার গোপন কাহিনী দ্রুত ছড়িয়ে গেল সবখানে। কিছুদিন পথে-ঘাটে দিন পার করে জীবনের কোনো গতি না পেরে, সেই অন্ধকার গলিতেই পা বাড়ালেন, যেখানে থেকে তিনি ফিরে এসেছিলেন। কাছের সব মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন সুবর্ণা নতুন নামে, নতুন পরিচয়ে মিশে গেলেন অন্ধকার জগতের তারই মতো হতভাগা সুবর্ণাদের সঙ্গে।

ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন সবারই থাকে। কিন্তু আপনি মেয়ে বলে আপনাকে অনেক ভেবেই পা বাড়াতে হবে। কারণ পুরুষশাসিত সমাজ এবং পুঁজিবাদী সমাজ এখনও শোষণ এবং লাভের বস্ত্ত বলেই ভাবে নারীকে। কাজেই হিসাব করে পা ফেলুন, যেন সুবর্ণার মতো চোরাবালিতে ডুবে জীবন অন্ধকারে ঢেকে না যায়।

দুঃখিত!