‘এইইইইইই পাখি নিবেন, পাখি। কথা বলা পাখিইইইইই।’
ঝন্টুদের উঠানে মার্বেল খেলছিল রাশেদ। পাখিওয়ালার ডাক শুনেই কান খাড়া হয়ে যায়। ভুলে যায় নিজের চালের কথা। পাখিওয়ালার ডাক কোন দিক আসছে, তা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর দৌড়ে বড় রাস্তায় গেলে পাখিওয়ালার সামনে পড়ে যায়। পাখিওয়ালার খাঁচায় কত পাখি! ময়না, চন্দনা, মুনিয়া, ডাহুক।
‘কোন পাখি কথা বলে।’
‘এই যে খোকা, ময়না পাখি।’
‘কথা বলতে বলেন তো।’
‘এখন তো ছোট, আর কয়েকদিন গেলে কথা বলবে। কিনবা।’
রাশেদ মাথা ঝাঁকায়।
‘আপনে এখানে থাকেন, আমি টাকা নিয়া আসছি।’
‘এক দাম ৬০ টাকা। খাঁচাসহ কিনলে ৮০ টাকা।’
রাশেদ দৌড়ায়। বাড়ি গিয়ে দেখে মা নেই।
নাসিমা বেগম এ সময়ে বাড়িতে থাকেন না । সরকার বাড়ি যান চরকায় সুতা কাটতে।
রাশেদ ভাবে, এটাই সুযোগ। ট্রাঙ্কের টাকা নিতে সমস্যা হবে না। মাকে সেদিন ট্রাঙ্কে শাড়ির ভাঁজে টাকা রাখতে দেখেছে।
ময়না পাখিটা পেয়ে রাশেদ খুব খুশি। সারা পাড়া ঘুরে একে-ওকে দেখায়। বেশি লোকজন দেখে ময়না ভীত হয়ে পড়ে। আর মুখ গোমড়া করে খাঁচার চারদিকে পায়চারি করে। দুই একবার উড়তে চেষ্টা করে। খাঁচায় বাধা পায়। ছটফট করে।
কতদিন ধরে পাখি পোষার শখ তার। একটা পাখি ধরার জন্য কতদিন যে গাছে গাছে চড়ে বেরিয়েছে! কত যে বিষ পিঁপড়ার কামড় খেয়েছে! এই সেদিনও দুই ঘণ্টা ধরে আমগাছের মগডালে বসে ছিল। নড়বড়ে চিকন ডাল। একটু জোরে বাতাস এলেই তা একদিকে নুয়ে পড়ে। রাশেদ ডাল আঁকড়ে বসে থাকে। তার নড়বার জো নেই। যেন গাছের একটা অংশ। বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি এসে যায়। তবুও তার দেখা মেলে না।
একবার অবশ্য দেখা দিয়ে চলে গেছে। ছটফটে মুখ বাড়িয়ে আবার ফুড়ুৎ।
এক দুই তিন… মিনিটগুলো পেরিয়ে যায়। আর অপেক্ষা করে সে। ঝিরিঝিরি বাতাস বয় কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ ঝাপটা বাতাস এসে নাড়িয়ে দিয়ে যায় তাকে। তখন মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যাবে!
তবুও পড়ে না সে। পায়ে ঝিঁ ঝিঁ নিয়ে বসে থাকে।
সন্ধ্যা হয়ে যায়। তবুও ঘরে ফেরার নাম নেই দোয়েল পাখিটির। রাশেদ দোয়েলের বাসার মুখে কালচে সবুজ পাতার ভিড়ে আরো কিছুক্ষণ নিজেকে মিশিয়ে বসে থাকে। বেশিক্ষণ অবশ্য বসে থাকতে পারে না। বাড়ির পেছনে আমগাছটির গা ঘেঁষা তেঁতুল গাছে ভূতদের আবাস। ভূতের কথা মনে পড়তেই তার গা ছমছম করে। কত গল্প যে সেই ভূতদের নিয়ে!
ভূতের ভয় নিয়ে রাশেদ গাছ থেকে নামে।
গত সপ্তাহে দোয়েল পাখির বাসাটি আবিষ্কার করে রাশেদ। তারপর থেকে ঠারে ঠারে অপেক্ষা। দোয়েলটাকে ধরে খাঁচায় রেখে পুষবে। কথা শেখাবে। ধ্যাৎ, দোয়েল কি কথা বলতে পারে! নিজেই নিজের জিহ্বা কাটে। রাশেদ মনে মনে একটা পরিকল্পনা করে, দোয়েল যখন বাসায় বসে দুপুরের ভাতঘুম দেবে, তখনই খপ করে ধরবে। দোয়েলটা মনে হয়, বুঝে গেছে রাশেদের উদ্দেশ্য। তাই দূরে দূরে থাকছে।
দূরে দূরে থাকলে কি হবে, সে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। এই গতকালও বুড়ি বাড়ির আড়া বনে, হিজল গাছের বাসায় আরাম করছিল ঘুঘু। চুপিচুপি উঠে গেছে গাছে। যেই বাসায় হাত দিয়ে ঘুঘুটি ধরবে, অমনি টের পেয়ে উড়ে গেছে। কিন্তু হাতের থাবায় ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে গেছে বাসাটা।
আচ্ছা, ঘুঘুরা কি এক বিকেলের মধ্যে বাসা বানাতে পারে?
ধ্যাৎ, এখন আর ঘুঘু নিয়ে ভাববে না! এখন তার ময়না পাখি আছে।
বিকেলে নাসিমা বেগম বাড়ি এসে ট্রাঙ্ক খুলে দেখেন টাকা নেই। তিনি ভেবে পান না, টাকা কই যেতে পারে। টাকার কি পাখা গজায়ছে! আচ্ছা, টাকা কি ঠিক ট্রাঙ্কে রেখেছিলেন?
ট্রাঙ্কেই রেখেছিলেন। ভুল হওয়ার কথা নয়। তবে আজকাল কি হয়েছে প্রায়ই মন ভুলো হয়ে যান। ঘরের এখানে সেখানে খেআঁজেন। না, নেই। চিন্তায় পড়ে যান তিনি। সপ্তাহের বাজারের সব টাকা ট্রাঙ্কে ছিল। টাকা না পেলে এ সপ্তাহ চলবে কিভাবে! ঘরের চাল ফুরিয়ে এসেছে। রাশেদের অংক খাতা কিনে দিতে হবে। ছেলেটা গত কয়েকদিন ধরে অংকের খাতা কেনার জন্য টাকা চাচ্ছে। নাসিমা বেগম ভেবে পাচ্ছেন না, টাকা না পেলে কি করবেন!
‘খা ময়না, খা। চাল খা। কখন থেকে না খেয়ে আছিস। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এবার খেয়ে ঘুমা।’
নাসিমা বেগম ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন, উঠানে বসে রাশেদ ময়নাটিকে চাল খাওয়াতে চেষ্টা করছে। তিনি বুঝে ফেলেন টাকা কি হয়েছে। তেড়ে এসে রাশেদের পিঠে দুমদাম দুইটা থাপ্পর বসিয়ে দেন।
‘এই জানোয়ার, পাখিকেই খাওয়া, তোর আর খেতে হবে না।’
রাশেদ কোনোকিছু গা করে না। ময়না পাখি পাওয়ার আনন্দে সবকিছু ভুলে থাকে।
ময়না পাখিটি নাসিমার অভাবের সংসারে আরো খানিকটা কামড় বসায়। ময়নাকে ভাত-চাল দিতে হয়, হাট থেকে ধান কিনে এনে খাওয়াতে হয়, পানি খাওয়ার অ্যালুমিনিয়ামের বাটি কিনতে হয়। ময়না পাখির জন্য রাশেদের এসব বায়না তাকে মেনে নিতে হয়। বাপ মরা একটাই ছেলে রাশেদ। তার আবদার যে করেই হোক নাসিমা রাখেন। এজন্য একবেলা না খেয়ে হলেও থাকবেন। তবে মাঝে মাঝে ময়নার ওপর রাগ হয়। সেই রাগে রাশেদ না থাকলে দু’একবার খাঁচা খুলে দিতে চেয়েছেন। ময়নাকে বিড়ালের মুখে তুলে দিতে চেয়েছেন। খাঁচার কাছে গেলেই ময়না ‘আম্মা, আম্মা’ বলে ডেকে উঠেছে। তখন আর ময়নাটিকে ছেড়ে দিতে পারেন নি। নিজের ভেতরে মাতৃসত্তা অনুভব করেছেন।
রাশেদ ময়নাটিকে নিয়ে বিপদে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে ভাত, চাল খেতে চায় না। তাই মাঝে মধ্যে স্কুল থেকে ফেরার পথে ফড়িং ধরে নিয়ে আসে। গর্তে পানি ঢেলে গুবরে পোকা বের করে ময়নাকে খেতে দেয়। রাইস মিলে পড়ে থাকা ধান খুঁটে আনে। ময়না কখনো খায়, কখনো খায় না। না খেতে খেতে ময়নাটা অনেক শুকিয়ে যায়। তাছাড়া, কথা শেখাতে গেলেও আজ আর শিখতে চায় না।
রাশেদের বন্ধু ইকবাল বুদ্ধি দেয় ছোলা খাওয়ানোর।
রাশেদ আবার ট্রাঙ্ক থেকে টাকা সরায়। ছোলা কিনে আনতে বাজারে যায়।
নাসিমা বেগম চুলায় ভাত চড়িয়ে কেরোসিন তেল কেনার টাকা নিতে ট্রাঙ্ক খুলে দেখেন, টাকা নেই।
বারান্দায় খাঁচায় ঝুলানো ময়নাটা তখন ‘রাশেদ, রাশেদ’ বলে ডাকতে থাকে। মেজাজ চড়ে যায় নাসিমা বেগমের।
খাঁচার দরজা খুলে ময়নাকে ছুঁড়ে মারেন আকাশের দিকে। রাগে গজগজ করতে করতে বলেন, ‘যা, উড়ে যা। আপদ বিদায় হ।’ ময়না বেশি দূর যায় না। উড়ে গিয়ে কাপড় শুকানোর তারে গিয়ে বসে। উড়ে যাচ্ছে না দেখে নাসিমা বেগম ঝাড়ু হাতে নিয়ে মারতে যান। তখনই ময়না ‘আম্মা’ বলে ডেকে উঠে। তার হাত থেকে ঝাড়ু পড়ে যায়। চোখ জলে ভরে উঠে। তিনি হাত বাড়িয়ে দেন ময়নার দিকে। যেন আপন সন্তানকে কোলে নিতে হাত বাড়িয়েছেন!