অনেক দিস্তা দিস্তা কাগজ নষ্ট হয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে ঘিরে। কতশত কাহিনী আর কল্পকাহিনীর ভিড়ে বারমুডা আজও রহস্যঘেরা। তবে কি বারমুডা রহস্যাবৃত থেকে যাবে? তবে কি সত্যিই অস্তিত্ব রয়েছে ভিনগ্রহের অন্য কোনো প্রাণী বা অন্য কোনো শক্তির? অনেকে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের বিষয়ে লিখিত বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের (USA) কোস্ট গার্ড ব্যাপক অনুসন্ধান করে অনুমোদন করেছে যে, এই অঞ্চলে অস্বাভাবিক কিছু নেই। বর্তমানে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কথিত রহস্যজনক এলাকা দিয়ে প্রতিনিয়তই কোনোরকম বিপদ বা অস্বাভাবিকতা ছাড়াই হাজার হাজার জাহাজ ও বিমান চলাচল করছে।
এসব জাহাজ ও বিমান যেসব প্রতিষ্ঠানে বীমা করা হয়, যেমন একটি মেরিন বীমা কোম্পানি “লয়েড’স অব লন্ডন (Lloyd’s of London)”, অনুসন্ধান করে নিশ্চিত করেছে যে ঐ এলাকায় এমন কোনো অস্বাভাবিক কিছু নেই যার জন্য তারা ঐ অঞ্চল দিয়ে যাওয়া জাহাজ থেকে অতিরিক্ত মাশুল আদায় করতে পারে। উল্লেখ্য, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে চলাচলকারীদের কাছ থেকে বীমা কোম্পানি অতিরিক্ত মাশুল আদায় করে।
বারমুডাকে রহস্যাবৃত করার কাজে নিয়োজিত অন্যতম লেখক John Wallace Spencer (1969) তাঁর Limbo Of The Lost বইয়ে ভি.এ. ফগ (V.A. Fogg) নামের একটি ট্যাঙ্কারের বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,
“ঐ ট্যাঙ্কারের সব আরোহী অদৃশ্য হয়ে গেছে; শুধুমাত্র এর ক্যাপ্টেনকে তার কেবিনের টেবিলে, হাতে কফির মগ ধরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।”
অথচ কোস্ট গার্ডরা সেই বিধ্বস্ত ট্যাঙ্কারের ছবি তুলেছিল এবং বেশ কিছু মৃতদেহও উদ্ধার করেছে। টিভি সিরিয়াল NOVA / Horizon এর “The Case of the Bermuda Triangle” (১৯৭৬-০৬-২৭) পর্বে বলা হয়েছিল—
“যে সব দুর্ঘটনার কথা বলা হয়, সেগুলো ভিত্তিহীন।”
১৯৪০ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কিছু দুর্ঘটনার জন্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো গেলেও, ১৯৯০ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ১৯ বছরে তেমন কোনো দুর্ঘটনার জন্য দোষ চাপানো যায়নি। তাহলে কি বারমুডার রহস্য হঠাৎ করে মিলিয়ে গেল?
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল-এ খ্যাত অঞ্চলের কিছু অংশে স্থলভাগও রয়েছে। যেমন পোর্তো রিকো (Puerto Rico), বাহামা, এমনকি বারমুডা নিজেই। এসব জায়গায় কোনো রকম রহস্য দেখা না পেয়ে মানুষজন নিশ্চিন্তে বসবাস করছে। এছাড়াও এই অঞ্চলের ফ্রীপোর্ট শহরে বড়সড় জাহাজ কারখানা এবং একটি বিমানবন্দর রয়েছে, যেখানে বছরে ৫০ হাজার বিমান ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়, কোনরকম গোলযোগ ছাড়াই।
একসময় পুরো দুনিয়া ও সাগর জুড়েই অনেক দুর্ঘটনা ঘটত। এমনকি আজকের তথ্য-প্রযুক্তির যুগেও অনেক দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করা যায় না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির “Air Crash Investigation” সিরিজ যারা দেখেন, তারা বিষয়টি জানেন।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মতো আরও বিভিন্ন জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু শুধুমাত্র বারমুডাকেই কেন বিশেষভাবে হাইলাইট করা হলো? সংশয়বাদী গবেষকগণ (Ernest Taves এবং Barry Singer) এই বিষয়ে গবেষণা করে বলেছেন—
“মিথ্যে রহস্য তৈরি করা বেশ লাভজনক। কারণ তখন ঐ মিথ্যে রহস্যের ওপর ভিত্তি করে বই লেখা বা টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়।”
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির “Naked Science” সিরিজে প্রচারিত একটি ফিচার রয়েছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে ছড়ানো কল্পগল্পের অসারতা প্রমাণে ডিসকভারি চ্যানেলও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। যদিও আজকাল ডিসকভারের ভারতীয় ভার্সনে বারমুডাকে রহস্যময় বলে প্রচার করা হয়।
প্রাকৃতিক ঘটনার মাধ্যমে রহস্যের ব্যাখ্যা:
এই বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও অনেক ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। মানুষের জ্ঞান সীমাবদ্ধ হলেও, অনেক ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। তবুও যে সকল ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, সেগুলোকে খুঁজে বের না করে অলৌকিক আখ্যা দেওয়ার প্রবণতা আমাদের রয়েছে।
একই সাথে, অনেক ঘটনারই সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। আমরা চেষ্টা করব বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল-এর কথিত রহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে।
মিথেন হাইড্রেটস:
বিশ্বের যেসব স্থানে গ্যাস হাইড্রেট যুক্ত পলি আছে বা রয়েছে বলে অনুমান করা হয়, যেমন ১৯৯৬ সালে পশ্চিম আটলান্টিকের উপরে দিয়ে উত্তর দিকে বয়ে চলা উপসাগরীয় স্রোতের ক্ষেত্রে। কন্টিনেন্টাল শেলভে (continental shelf) জমে থাকা বিপুল পরিমাণ মিথেন হাইড্রেট অনেক জাহাজ ডুবে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখা গেছে। অস্ট্রেলিয়ার পরীক্ষাগারে দেখা গিয়েছে, বাতাসের বুদবুদ পানির ঘনত্ব কমিয়ে দেয়।
সাগরে যখন পর্যায়ক্রমিক মিথেন উদগীরণ হয়, তখন পানির ভাসানোর ক্ষমতা কমে যায়। যদি এমন ঘটনা ঐ এলাকায় ঘটে থাকে, তবে সতর্ক হবার আগেই কোনো জাহাজ দ্রুত ডুবে যেতে পারে। ১৯৮১ সালে United States Geological Survey (USGS) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যাতে উল্লেখ আছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ উপকূলের বিপরীতে ব্ল্যাক রিজ (Blake Ridge) এলাকায় মিথেন হাইড্রেট রয়েছে।
তবে গত ১৫০০ বছরের মধ্যে ঐ এলাকায় তেমন হাইড্রেট গ্যাসের উদগীরণ ঘটেনি।
কম্পাসের ভুল দিক নির্দেশনা:
কম্পাসের পাঠ নিয়ে বিভ্রান্তি অনেকাংশে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কাহিনীর সঙ্গে জড়িত। মনে রাখা প্রয়োজন যে, কম্পাসের চুম্বক মেরুর দূরত্বের উপর ভিত্তি করে দিক নির্দেশনায় বিচ্যুতি ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র উইসকনসিন (Wisconsin) থেকে মেক্সিকোর উপসাগর (Gulf of Mexico) পর্যন্ত সরলরেখা বরাবর চুম্বক উত্তর মেরু ভৌগোলিক উত্তর মেরুকে সঠিকভাবে নির্দেশ করে।
এই সাধারণ তথ্য যে কোনও দক্ষ পথপ্রদর্শকের জানা থাকা উচিত। সমস্যা সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে, যারা বিষয়টি জানে না। ঐ ত্রিভূজ এলাকা জুড়ে কম্পাসের বিচ্যুতি তাদের কাছে রহস্যময় মনে হয়। তবে এটি একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা।
–সংগৃহীত
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।