বারবারিয়ান – অবনী চারিতা

চাচাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় রওয়ানা হয়েছি। চাচা গ্রামের বাড়ী থেকে মাঝে মধ্যে আসে এবং সব সময় অবাক হয় রাস্তায় এত জ্যামের মধ্যে কিভাবে থাকি, কিভাবে চলাফেরা করি আমরা! এবং প্রতিবারই তার প্রস্তাব থাকে বাড়ী চল বাপ, কত সুন্দর হাওয়া খাবি ন্ধ ঢাকার শহরের এই ধুলোবালি খেয়ে তো মারা যাবি!

ঢাকার শহরে তার ভাই আছে, বোন আছে। সে সকলের বাসায় আসা-যাওয়া করে পায়ে হেঁটে। এবার একটু কাহিল হওয়ায় আমার সাথে তার গাড়ীতে উঠতে হয়েছে, তাও আবার ছয় নাম্বার গাড়ী, ইচ্ছে ক’রে চাচাকে নিয়ে বাদুড় ঝোলা অবস্থায় উঠেছি, কতক্ষণ হ্যাণ্ডেল ধরে ঝোলার পর মগবাজার ওয়ারেলেস এসে ভিতরে ঢোকার চান্স পাওয়া গেল, অবশ্যই সিট পাওয়া গেল না। চাচার দিকে চেয়ে দেখি চাচা ঘেমে অস্থির, চোখ বড় করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, মারা যাওয়ার আগে মানুষ নাকি এরকম করে তাকায়। আমার বেশী খারাপ লাগল না, তবে খারাপ লাগল এই ভেবে যে এই লোকাল বাসে মারা গেলে দুপুর রোদে আমাকে বেশ ঝামেলায় পড়তে হবে। আমার আর এক ভাই আছে তার সাথেও চাচাকে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার সাথে চাচার মেয়ের ইয়ে থাকায় চাচাকে নিয়ে আমাকেই দৌড়-ঝাঁপ করতে হয়। চাচার আবার প্রতিবার চিড়িয়াখানায় না গেলে হয় না, প্রতিবারই আমাকে এই কাজটা যত্নের সাথে করতে হয়। বাঘ-সিংহের প্রস্রাবের গন্ধ অতি কষ্টে সহ্য করি, ইচ্ছে করে মাঝে মধ্যে বাঘের খাঁচার মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই চাচাকে। কিন্তু সেটা হয় না। আমার জীবনের কোন ইচ্ছাই এ পর্যন্ত পূরণ হয়নি ন্ধ এটা আবার নতুন কি চাচাত বোনকে নিয়ে দুইতিন মাস পটিয়ে রাজি করিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলাম। একবার একটু কাছাকাছি বসতে চেষ্টা করায়, সে সরে গিয়ে বললঃ দুই হাত দূরে বসো। একটুকুও কাছে ঘেষার চেষ্টা করবে না।

আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। দুই তিন মাস পটানোর জন্য আমার খা খা পকেটের ভিতরও যে কত খরচ হয়েছে তার শেষ নেই। তার মোবাইলে ফ্লাক্সি আমাকেই করতে হত, ফাস্ট্‌ ফুড খেতো সে বেইলি রোডে গিয়ে। এই সব টাকাই আমার ভাই-বোনদের কাছ থেকে এদিক সেদিক করে নেয়া ন্ধ আজকে আমাকে সে দু’ হাত সরে যেতে বলে! আমি আদুরে ভঙ্গিতে বললাম, তুমি আমার সাথে রাগ করছো? অত আল্লাদ করে কথা বলতে হবে না, সে বলল। আমি বললাম তুমি অত রাগছো কেন?

সে খেই খেই করে উঠল। বলল, তুমি তিনদিন আগে আমার বান্ধবী মিমকে নিয়ে বোট্যনিক্যাল-এ আসনি? আমার কান গরম হয়ে গেল। সর্বনাশ এ কথা রুমা জানল কি করে! আমার সমস্ত শরীর ঘামাতে শুরু করল, আমি কোনরকমের তোতলাতে তোতলাতে বললাম, তুমি আমার সাথে দুষ্টামি করছো। দুষ্টামি করছি না, আমি নিজের চোখে তোমাকে দেখেছি, আরো অনেক বান্ধবীও ছিল।

আমার চোখ বড়বড় হয়ে গেল মনে মনে বললাম, মিম তাহলে আমাকে ভাল করে ফাঁসিয়েছে। রুমা বলল, আমার বান্ধবীরা সবাই তোমাকে প্রতারক হিসাবে জানে, আমি বিশ্বাস করতাম না, সেদিন চোখে দেখলাম। আমার উপস্থিত বুদ্ধি খুব একটা খারাপ না এটা আমার সেদিন মনে হল। রুমাকে এত প্রতিকুল অবস্থায়ও ম্যানেজ করে ফেললাম, এবং দুই হাত দূরত্বও কমিয়ে ফেললাম।

যাইহোক, চাচার এত খারাপ অবস্থা দেখে আমার করুণ চোখে না তাকাবার উপায় ছিল না। আমি তার দিকে করুণভাবে ভিখারির চোখের দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম।

চাচাকে এই কাবু অবস্থায় পেয়ে, আমি দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। আমি তাকে আরো কাবু করার জন্য ফন্দি-ফিকির আঁটতে শুরু করলাম।

রৌদ্রটাও মনে হয় একবারে আটত্রিশ ডিগ্রী ছাড়িয়েছে। বাসের ভিতর সিদ্ধ হয়ে যাবার মত অবস্থা, চারিদিকে ঘামের গন্ধ মৌ-মৌ করছে। বাহির থেকে বাতাস আসলে মনে হয় আগুনের লেলিহান শিখা সমস্ত শরীর পেঁচিয়ে ধরে বসে আছে।

তারপরও এত অসহায়ের ভিতর চাচাকে কাবু করতে পেরেছি এই ভেবে আমার একটু ভাল লাগল। কিন্তু সে মহাখালী যেতে যেতে একদম ‘ফিট’ হয়ে গেল, বুঝলাম প্রথম অবস্থায় হঠাৎ করে সে নিজেকে সামলাতে পারেনি। কিন্তু এখন সে নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়েছে, প্রকৃতির সাথে যুগে যুগে মানুষ যেভাবে তাল মিলিয়ে চলেছে ঠিক সেভাবে।

চাচা এই বদ্ধ বাসের ভিতর থেকে মহাখালী নামলেন দিব্যি সুস্থ হয়ে। বরং আমি একুট কাবু হয়ে পড়লাম। চাচা নেমেই ঘোষণা দিলেন তিনি পায়ে হেঁটে চিড়িয়াখানায় যাবেন, তার নাকি এখন আর গাড়িতে উঠতে ইচ্ছা করে না। আমার ভিরমি খাবার অবস্থা হল মহাখালী থেকে হেঁটে কিভাবে চিড়িয়াখায় যাব এই ভেবে।

চাচা আমাকে তোয়াক্‌কা না করেই লোকজনকে জিজ্ঞেস করে চিড়িয়াখানার দিকে হাঁটা শুরু করে দিলেন। তার হাঁটার স্পীড অসম্ভব দ্রুত। আমি তার সাথে দ্রুত হাঁটায় তাল মিলাতে পারছি না। আমি জীবনে কখনোই এত দ্রুত হাঁটিনি। মেয়েদের সাথে ঘুর ঘুর করা আমার স্বভাব, চাচার সাথে এ অবস্থায় আমি বেমানান হয়ে পড়লাম।

অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যে তিনি দ্রুত হাঁটছেন, আর আমি তার পিছন পিছন ঠেলা গাড়ীওয়ালাদের মত দম দিয়ে দৌঁড়াচ্ছি আর ভাবছি পরিচিত লোকজন দেখলে কি ভাববে, সবচেয়ে সমস্যা হবে আমার লেটেস্ট বান্ধবী ছবিকে নিয়ে। ছবি যদি আমাকে এ অবস্থায় দেখে ফেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কারণ তার কাছে আমি বলেছিঃ আমার বাবার দুইটা গাড়ি আছে, আমার জন্য সবসময় একটা রেডি থাকে, বাবা একদমই চান না আমি রৌদ্রের ভিতর বেরোই। ছবি এ কথা শুনে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায় যেন সে ধনীর আদরের অসূর্যম্পশ্য কোন সন্তানকে দেখছে। সে অস্ফুট স্বরে বলে তোমার বাবা তোমাকে বুঝি খুব বেশী ভালবাসে?

ন্ধ – বাসবে না? আমি তো তার একমাত্র সন্তান!
ন্ধ – ছবি তখন ইনিয়ে বিনিয়ে বিয়ের কথা তোলে। আমি চট করে নিজেকে সামলে নিই। এবার বলে দিই বাবা চায় আমি খুব দ্রুত বিয়ে করে ফেলি। এবার আরো বলি তাকেই আমার পছন্দ। ছবি হাসে হরিণ চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি তার হাতে হাত রাখি, গার্ডেনে ঘুরতে যেতে আমার পছন্দ সে কথাও বলি। ছবি হাসে। কোটিপতি বাবার একমাত্র ছেলের কোন কথাই সে ফেরাতে পারে না। তার সব কথাই তার কাছে অমৃতের মত মনে হয়।

কিন্তু ছবি যদি আজকে আমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার সব অমৃত টক তেতুল হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারপরও চাচার পেছন পেছন দৌঁড়াতে থাকি। চাচার সুন্দরী মেয়ের কথাও তো ভাবতে হবে।

চিড়িয়াখানার গেটের কাছে যখন পৌঁছলাম তখন আমি কোন রকমে জানে বেঁচে আছি। চাচা আমার বুকে থাপড় দিয়ে বললেন, ইয়ং ম্যান, কেয়া বাত হ্যায়?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!