বাবা, এক সাইজ বড় জুতা নিয়া আমি কোথায় যাবো?

তখন আমার বয়স কত? মনে নাই। আমার ভাইয়ের বয়স? তাও না। তাহলে কি মনে আছে? সেইটা ভাইবা দেখা যাইতে পারে। তখন গুলিস্তানে যাওয়ার পথে জয়কালি মন্দির হাতের বামে ফালায় আগাইলে একটা রহস্যময় মার্কেট চোখে পড়ত। যেখানকার বেশিরভাগ দোকান নির্মিয়মান। আরো একটু আগাইলে কালো কালো বাক্স নিয়া কিছু লোক খাড়ায়া থাকত। কারা যেন সেই বাক্সে মাথা গলায়া কি কি যেন দেখত। আর ম্যাজিসিয়ান এর মত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খাড়ায়া থাকা লোকটা কি যেন করত মনোযোগ দিয়া। পাশের একটা নোটিস বোর্ডে ঝুলত কত মানুষের কল্লার ছবি। ‘এইখানে গলাকাটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি তোলা হয়’। আমি বাবার সাথে রিক্সায় যাইতে যাইতে যতটুকু দেখা যাইত দেইখা ফালাইতাম। বাবারে কোন প্রশ্ন করার কুদরত ছিল না। বাবায় রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডে দেখায়া খালি কইত ‘ সাইনবোর্ডে কি লেখা পড়ত’ আমি গম্ভীর ভঙ্গিতে বানান কইরা সাইনবোর্ড পইরা শুনাইতাম বাবারে। যুক্তাক্ষর হইলে আর রক্ষা নাই। আর ইংরাজি সাইনবোর্ডের ক্ষেত্রেও একই ক্রাইসিস। বাবার সাথে রাস্তায় বের হইলে এই এক অগ্নীপরীক্ষা আমারে নিয়মিত দিতে হইত। বাবার সাথে সিনেমা দেখতে গেলেও সেম কেস। পর্দার হিরো বা হিরোইনরে দেখায়া কইত ‘ওই রকম হবি?’ আমি সিনেমা হলের অন্ধকারে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তাম। তখন বাবায় কইত ‘তাইলে মন দিয়া লেখাপড়া করবি’। তখনও আমি মাথা নাড়তাম। যাক সে কথা। ম্যালাদিন আগে কোন এক সিয়েস্তার সময়। বাবার সাথে গুলিস্তান গেসিলাম জুতা কিনতে। সাথে ছিল আমার ছোট্ট ভাইটাও। গুলিস্তান এর রাস্তাটা আমার বিশেষ প্রিয় ছিল তখন। বলা যায় নয়া দিগন্ত। রাস্তার ডানপাশে বঙ্গভবন ফালায়া সেই রহস্যময় মিউজিসিয়ানের বাক্স তারপর সারিবাদি শালশার দোকান, প্রিয়ার কাছে গোপন প্রেমপত্র বা সোনাবন্ধু টাইপ গানের বই এর দোকান, ওলটকমল, তোকমা আর নানাবিধ ওষধিগাছের রসের শরবত সাথে রসিক বিনে আসিক মিলে না ও বন্ধুরে’ গান ঝমঝম বাজত। আমরা পুরান জুতার মার্কেটে গিয়া থামলাম। বাবা আমারে আর আমার ছোট ভাইরে দুইজোড়া সেকেন্ডহ্যান্ড কেডস জুতা কিনা দিছিল। সেইটাই আমার প্রথম আয়োজন কইরা জুতা কেনার স্মৃতি। অসাধারন একটা মূহুর্ত। জুতা পায়া আমরা যার পর নাই খুশি। কতক্ষনে বাসায় গিয়া জুতা পরুম। বাসায় আসার পর আমার আনন্দে ভাটা পড়ল। কারন আমার কেডস জোড়ার একটার সাইজ বড়। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাবারে কিছু বল্লাম না। মাকে বললাম। মা বিষয়টা পাত্তা দিল না। তার কথা হইল এক সাইজ বড় জুতায় কোন সমস্যা নাই।

 

কোন রকম গেটিস দিয়া চালায়া নেয়া যাবে। আমাদের অভাবের সুখী সংসার তখন আমার মায়রে এইভাবেই ভাবতে শিখাইসিল। আমি মার সাথে তর্ক না কইরা দুই পায়ের দুই রকম সাইজ জুতা নিয়া হেপি থাকার চেষ্টা করলাম। সবকিছু শুইনা বাবায় রাতের বেলা কইল ‘ঠিক আছে কালকে দুপুরে গিয়া বদলায়া আনুম নে’। শুইনা আমার ঠোঁট চাঁদের মত বাকায়ে গেল। হাসি হাসি মুখ নিয়া আমি টেংরা মাছে কামড় বসাইলাম। কিন্তু দুনিয়ায় হেপি হওয়া কঠিন ছিল তখনও আমি জানতাম না। পরদিন সিয়েস্তার সময় আবার আমরা তিনজন একটা রিক্সায় চাইপা বামপাশে জয়কালি মন্দির. সারিবাদি শালশা, গলাকাটা পাসপোর্ট ছবির দোকান ইত্যাদি ফালায়া আবার সেই পুরান জুতার মার্কেটে গিয়া হাজির হইলাম। কিন্তু এই আনহেপি জগতে একই জুতাওলাকে দুইবার খুইজা পাওয়া যায় না। তিনি রূপকথার কোন চরিত্রের মত অদৃশ্য হয়া গেছেন। আমরা তিন পিতা-পূত্র সেই জুতাওলারে আর খুইজা পাইলাম না। তারপর আমরা তিনজন ক্লান্ত হয়া কোন একটা রেস্টুরেন্টে ঢ্ইুকা কিমা পুরির খোজ করি। এবং বিকালের নাস্তা শেষে মন খারাপ কইরা বাসায় ফিরি। কোন একটা উৎসব ছিল তখন। মহল্লায় ভাল কাপড় পড়া লোকজন বেশি চোখে পড়ে। পোলাপানের হাতে হাওয়াই মিঠাই কি লবন-মরিচ মাখানো আমড়া, কটকটি, গজামজা ইত্যাদির বিক্রেতাদের আনাগোনা চোখে পড়ে। বিভিন্ন বাসার জানলা থিকা মুরগীর সুরুয়ার সুঘ্রান হাওয়ার সাথে মিশা ম ম করত। আমি উপায়ন্তর না দেইখা মায়ের কথায় কনভিন্স হয়া এক পায়ে এক সাইজ বড় জুতাটা পইরা মন্দিরের উদ্দেশ্যে বারায়া গেলাম। বড় জুতাটার ভিতরে বিভিন্ন কাগজ আর কাপড় দিয়া গেটিস দিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমি খেয়াল করলাম আমার সমস্ত কনসানট্রেশন আমার এক পায়ে আইসা ঠেকছে। যে পায়ে এক সাইজ বড় জুতা পরছি সেই পায়ে। আমি খেয়াল করলাম আমার এক পা ভারি হইতে শুরু হইছে। তবু আমি মন্দিরের দিকে যাইতে থাকলাম। কিন্তু জুতা বিষয়ক অস্বস্তি আমার বাড়তেই থাকল। বন্ধুরা প্রথমে বুঝতেই পারল না আমার দুই পায়ে দুই সাইজ জুতা।আমি ওদের সামনে স্থীর থাকি না। হাঁটাহাঁটি করি। ওদের এড়ায়া যাই। কিন্তু ওরা ততই আমার জুতার প্রতি আগ্রহী হয়া ওঠে। জুতা বিষয়ক নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হইতে থাকি। এই জুতা কয় টাকা দিয়া কিনছি, দেশি না বিদিশি, কে কিনা দিছে, কত দাম, কতদিন টিকবো, কেডস পড়লে পায়ের জন্য ভাল না খারাপ? ইত্যাদি। আমি ওদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিই কিন্তু তবু আমার ভয় কাটে না আমার খালি মনে হইতে থাকে একবার যদি কোন বন্ধু আমার জুতার রহস্য বুইঝা যায় তাইলে তারা স্কেল নিয়া মাপতে বইসা যাবে। ভরা মজলিসে ওরা দম ফাটায়া হাসবে। আমি আর কোনদিন লোকনাথ বাবার মন্দিরে ক্ষীর পায়েস খাইতে আইতে পারুম না। কিন্তু বন্ধুরা নাছোর বান্ধা ওইদিন তারা ম্যাকগাইবার নিয়া আলাপ করল না, দ্য এ টিম নিয়াও না, থান্ডার ক্যাটসও না। তাদের সবার আলোচনার বিষয় যেন আমার এক সাইজ বড় জুতাটা। অনেক কৌশলে সেদিনের মত আমি বন্ধুদের কাছে ছাড়া পাইলাম। বাসায় আইসা বাবার উপর বেদম রাগ হইল। কোন কিছুতেই মন বসল না। মনে হইল বটি দিয়া জুতাটা কাইটা ফালাই। ঝামেলা শেষ। কিন্তু মহান দারিদ্য আমাকে এমন কিছু ঘটাইতে দিল না। আমি আমার এক সাইজ বড় জুতাটা নিয়া নতুন পরিকল্পনা ফাঁদলাম।ততদিনে আমি জুতা আবিস্কার গল্পটা পইরা ফালাইছি। আর সেই গল্পটা যেইখানে এক কিপ্টা লোকের জুতার বিরম্বনার কথা বলা হইছে।

 

কি নির্মম নিয়তিবাদি গল্প। সেই লোক যেখানেই তার ছেঁড়া জুতাটা ফালায়া আসে ফিরে ফিরে অমঙ্গলের মত সেই জুতাটা তার কাছেই আসে। তার যেন নিস্তার নাই সেই অলুক্ষুনে জুতার হাত থেকে। আমি তখন অবসরে এইসব ভাবতাম। আমার অবস্থাও কি তাইলে এমন হবে? এই এক সাইজ বড় জুতাটার থেইকা কি কোন মুক্তি নাই? খেয়াল করলাম আসলেই নাই। কারন আমি যখন অন্য জুতা পইরা হাঁটি তখনও মনে হইতে থাকে আমার পায়ের একটা জুতা বড়। সেই বড় জুতার খবর কেউ যদি পায় তাইলে আমারে নিয়া হাসাহাসি করব। আমি তখন পা চালায়া হাঁটতাম। মনে হইত মানুষকে কেন জুতা পড়তে হয়? ঘাস পা খালি পা’ইতো ভাল। আমি দেখতে দেখতে মানসিক রোগিতে পরিণত হইলাম। একদিন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম আমি গুলিস্তানের রাস্তা দিয়া হাঁটতেছি। রাস্তার সবাই আমার পায়ের দিকে তাকায়া আছে। আমি ছাড়া সবার খালি পা। আমি সবার চোখের দিকে তাকায়া ভয় পায়া যাই। আমি পা চালায়া হাঁটি। লোকজন আমাকে ফলো করতে থাকে। জয়কালি মন্দিরের পুরোহিত, শালশার দোকানদার, তোকমার শরবতওলা, গলাকাটা পাসপোর্ট ছবিওলা ওরা সবাই আমার দিকে ধাবিত হয়। এক পায়ে এক সাইজ বড় জুতা নিয়া আমি দৌড়াতে থাকি। আমার সাথে সাথে রাস্তার লোকগুলাও। একসময় আমি হোঁচট খায়া পইরা যাই। তবু তারা আমার দিকে আগাইতে থাকে। আমি জুতা খুইলা রাস্তায় ছুইড়া মারি। তারপর আবার দৌড়াতে থাকি। হঠাৎ পিছনে তাকায়া দেখি আমার এক সাইজ বড় জুতাটা অন্য জুতাটা সহ আমার পেছন পেছন দৌড়াইতেছে যেন কোন অদৃশ্য কেউ সেই জুতাটা পড়ে আছে। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি হাঁপায়া পড়ি তারপর আমার ঘুম ভাঙলে দেখি আমার সারা শরীর ঘামে ভেজা। ঘরের কারেন্ট চইলা গেছে। মা হাত পাখা দিয়া বাতাস করতেছে। আমি হালকা ঘুমের মধ্যেই টের পাই আমি মন্দির থিকা ফিরা জুতাটা আর খুলিনাই। এক পায়ে একসাইজ বড় জুতা নিয়া ঘুমায়া পড়ছিলাম। স্বপ্ন ভাঙার পরে টের পায়া ফের আমি ঘুমায়া পড়ি।

দুঃখিত!