গ্রাম আমদির পাড়া। চারদিক সবুজে ঘেরা, আমাদের পাড়া। মাঠে রাখালের বাঁশি বাজানো সুর, চলে যায় গ্রাম পেরিয়ে বহুদুর। রাতে জোনাকী পোকার মিটমিট আলো, আহা খুব সুন্দর লাগে দেখতে ভালো। এই গ্রামকে কেন্দ্র করে, আছে একটা বটগাছ। বটগাছটির বয়স প্রায় শত বছর হবে। এই বটগাছটির চারদিক দিয়ে গড়ে উঠেছে জনপদ। বটগাছের দক্ষিণে যমুনা নদী, এবং পশ্চিমে বাঙ্গালী নদী। বটগাছের আশে পাশে বেশ কয়েকটা দোকান আছে। দক্ষিণে জুমারবাড়ী বাজার, উত্তরে সাঘাটা থানা, কয়েক কিলো দুরে গাইবান্ধা জেলা। বটগাছের নিচে বসে অনেক শ্রমজীবি লোকজন বিশ্রাম নেয়। বটগাছটা থাকার কারনে ভ্যান চালক ভাইয়েরা ও গ্রামের লোকেরা এর নাম দিয়েছে বটতলী। বটতলী নামেই এই জায়গাটা বর্তমান পরিচিত। এই আমদির পাড়া গ্রামের আগপাড়ায় থাকে অনু ও তার পরিবার। অনুর জন্ম এই গ্রামেই। তার ছোট্ট মেয়ে জান্নাতি, বয়স সাত বছর। ক্লাস ওয়ানে পড়ে মেয়েটা। অনুর একমাত্র সন্তান এই জান্নাতি। দিন এনে দিন খায় অনু। তবুও আল্লাহ্ তাআলার রহমতে তার ঘরে সুখের জোয়ার যেন ভাসে সব সময়। অনু তার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে নিয়ে সুখেই আছে। বড় আদরের মেয়ে জান্নাতি।
দাদা দাদী তার খেলার সাথী জান্নাতিকে বাড়ির সবাই ভালোবাসে। বাবা জান্নাতিকে খুব ভালোবাসে মা ও ভালোবাসে তবে সব সময় যেন জান্নাতিকে শাসনে রাখে। জান্নাতি মাকে দেখলে খুব ভয় পায় তাই তার মনের চাওয়া মনের কথা বলে বাবাকেই। সেদিন ভুলেই মাকে বলে তার স্কুলের এক ছাত্রী অর্থ্যাৎ তার বান্ধবী একটা নীল জামা কিনেছে। তারও চাই। এই কথা মাকে বললে মা রেগে যায় এবং জান্নাতিকে ধমক দেয়। কারন টাকার নাই এর মধ্যে সেদিন জান্নাতিকে একটা জামা এনে দিয়েছে। জান্নাতির বাবা অনু। জান্নাতি ওর দাদীর কাছে গিয়ে কাঁদছে আর বলচ্ছে আম্মু ভালো না, আব্বু ভালো। এর মধ্যে বাবা বাজার থেকে আসে। জান্নাতি বাবাকে দেখে আরো কেঁদে উঠে। বাবা জান্নাতিকে বুকে নিয়ে বললো, মা কী হয়েছে? এর মধ্যে আসে মা। আর কিছু বলেনা জান্নাতি। বাবা আবার বললো কি হয়েছে বলো মা। জান্নাতি বললো তাহলে বাহিরে চলো। বাবা জান্নাতিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন বাড়ির দক্ষিণে মসজিদের সামানে আমগাছটার নিচে। গরমের দিন এখানে চারদিক থেকেই বাতাস আসে। তাই রাত দিন সব সময় সেখানে দুই একজন করে থাকেই। বাবা আর জান্নাতি বসলো একটা গাছের গুড়িতে। জান্নাতি বললো, বাবা আমাকে নীল একটা জামা দিতে হবে নইলে আমি কাল স্কুলে যাবো না। আমার স্কুলের অনেক মেয়ের নীল জামা আছে আমার নাই । এই কথা মাকে বলেছিলাম আর মা রেগে গিয়ে আমাকে বকেছে । আর বলে কী জানো তুমি নাকী আমাকে খুব কষ্ট করে না খেয়ে গতকাল লাল জামাটা এনে দিয়েছো। বাবা বললো মা, তোমার মা তো সত্যি বলেছে। মা, তবুও আমি তোমাকে এনে দিবো নীল জামা । তবে আমার কিছু কথা শোনো। জান্নাতি মা, আর মনে রাখবে। তুমি কী কখনো না খেয়েছিলে। জান্নাতি বললো, না। বাবা বললো তোমার মামার বাসায় যে মেয়েটা কাজ করে ওর নাম ইতি। ওতো তোমার মতোই ওর বাবা নাই, মা নাই। তোমাদের আছে একটা টিনের ঘর। ইতিদের তাও নাই। গায়ে ভালো একটা জামাও নাই। নাই তোমার মতো খেলার সাথী দাদা আর দাদী। ও স্কুলেও যেতে পারেনা। পায় না কারো কাছ থেকে একটা টাকাও ইচ্ছা মতো কিছু খাবে। তুমি তো স্কুলে পড় ফ্যানের নিচে বাতাস খেতে খেতে। আর সোমা কাজ করে রোদের মধ্যে বসে। মা, তুমি একটু ভাবো ইতি কত কষ্ট করে তার জীবন বাঁচায়। তুমি আমার কথা নিশ্চয় বুঝেছো।
আমি তোমাকে কত টাকা দেই। তোমার দাদা-দাদী কাকা, মামা, নানা-নানী সবাই টাকা দেয়। সেগুলো দিয়েই তুমি তোমার জামা এনেও অনেক টাকা বাঁচবে। মা, সব সময় নিচের দিকে তাকাও উপরে না। তুমি দেখো তোমার নিচে যারা আছে তাদের চেয়ে তুমি কত সুখে আছো। তোমার টাকা তুমি ইচ্ছা মত খরচ করো। আমি তোমার আম্মু, কিছুই বলবে না। বাবা তাকিয়ে দেখলো জান্নাতির দু’চোখে যেন ঝরনার মতো পানি বইছে। জান্নাতি বাবার বুকে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো বাবা আমার জামা লাগবেনা। সত্যি বলছি বাবা, আমার কাছে যে টাকা আছে তা আমি তোমায় দিবো। তুমি সেই টাকা দিয়ে এবারের ঈদে ইতির জন্য একটা আমার মতো লাল জামা এনে দিবে। বাবা জান্নাতির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো হ্যা মা দিব। জান্নাতি বললো বাবা আরো একটা কথা মামাকে বলে ইতিকে স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে । বাবা বললো ঠিক আছে মা তাই হবে। জান্নাতি এবার বাবাকে চুমা দিয়ে বললো তুমি আমার লক্ষী বাবা। সবার সেরা বাবা। আমি তোমাকে ভালোবাসি। বাবা বললো তুমি ও কথা দাও স্কুলে যাবে নিয়মিত। জান্নাতি হেসে বললো, হ্যাঁ। আমি কথা দিলাম কাল থেকে স্কুলে যাবো। আর কোনদিন বলবো না, আমি স্কুলে যাবো না। বাবা খুশি হয়ে জান্নাতিকে বুকে নিয়ে বাড়ির দিকে গেলেন।
-=— পাঠিয়েছেন –জুমারবাড়ী আদর্শ কলেজ, সাঘাটা, গাইবান্ধা।