আমার প্রিয় ঋতু শীত। কিন্তু গ্রীষ্মকাল আমার একেবারেই অসহ্য লাগে। বর্ষাও ভাল লাগে বেশ। কারণ তখন গাছের ডালে কোকিল ডাকে। বসমত্ম কার না ভাল লাগে। সে সময় বাগানে ফুল ফোটে। শরৎকে ভাল লাগে নদীর ধারে কাশফুল ফোটে বলে। হেমমেত্ম নবান্ন উৎসব হয়। তখন পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে চারিদিক আমোদিত থাকে। মায়ের হাতের পিঠার কথাতো না বললেই নয়।
তখন অমাদের চালাঘর ছিল। প্রতি বছর শীত এলে আমার কৃষক বাবা খড়ের সেই পুরনো চাল ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন খড়ের ছাউনি দিতেন। কখনো একা একা কাজ করতেন আবার কখনোবা ইসমাঈল কাকাকে বেগার নিতেন। ইসমাঈল কাকা আগে সৌদি আরব থাকতেন। ওমরা করতে গিয়ে দুই বছর থেকে গেছেন। আমাদের এখানে কাজ করতে এলে তিনি সৌদি আরবের গল্প করতেন। তিনি সে দেশে একটা বিড়াল পুষতেন, সেটার গল্প। আমি মনোযোগ সহকারে তার গল্প শুনতাম। গল্প শুনে আনমনা হয়ে যেতাম।
খড়ের নতুন ছাউনি দেয়ার সময় আমাদেরকে একরাত খড়বিহীন চালের নিচে থাকতে হত। মনে পড়ে, আমরা ভাই-বোনেরা মিলে একসাথে কাঁথা মুড়িয়ে ঘরের ভেতর ঘুমাতে যেতাম। সাথে চলত কাঁথা টানাটানি। তখন চাঁদের শরীর থেকে ঝরে পড়ত রজনীগন্ধার মত সাদা মিষ্টি আলো। এমনি সময় কনকনে শীতের রাতে কখনোবা মধ্যরাতে বাবা হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে বাজার থেকে ফিরতেন। দূর থেকে হারিকেনের সেই আলোকে মনে হত বড় কোন জোনাক পোকা বুঝি জ্বলছে। হারিকেনটি জোনাকীর মতো মিটিমিটি আলো ছড়াতো চারপাশে। আলোয় বাবার পরণের লুঙ্গি দেখা যেত। মা বেড়ার ফুটো দিয়ে তাকিয়ে বাবাকে দেখতেন। বাবা যখন বাড়ির দরজায় আসতেন তখন ঘরের ভেতর আসা পর্যমত্ম গলা খাকারি দিতেন। পা ঝেড়ে আওয়াজ দিতেন। প্রায় সময় দশটা কি এগারটার সময় বাবা বাজার থেকে আসতেন। তখন আমরা গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকতাম। শুধু আমার মা কুপি জ্বালিয়ে একা একা জেগে থাকতেন স্বামীর প্রতীক্ষায়।
অনেক ছোট বয়সে মায়ের বিয়ে হয়। বিকালে বাবা মরিচ-বেগুনের চারা নিয়ে বাজারে যেতেন। বিক্রি করে চাল-ডাল আনতেন। মা রান্না করতেন। বাবা আমাদেরকে ডেকে তুলে ভাত খাওয়াতেন। আমরা সবাই উঠতাম। গরম গরম ভাত খেতাম। প্লেটের উপর দিয়ে ধোঁয়া উঠত। কিন্তু সেজো ভাই জয়নাল (এখন সৌদি আরব থাকেন) কিছুতেই উঠতনা। পরদিন সকালে বলত, — ‘অাঁরে ভাত খাইবাল্লায় ডাকেননাই কিল্লায়?’
-‘তোরে কতবার ডাইকছি তার কো খবর নাই’-মা বলতেন।
আসলে ডাকলেও তিনি উঠতেন না। উঠলেও ঘুম লাগা চোখ কচলিয়ে কেঁদে কেটে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন।
এভাবে শীতের সাথে আমার কৈশোরের সোনাঝরা স্মৃতি জড়িয়ে আছে গায়ে দেয়া চাদরের মত। যেভাবে প্রিয়া চাঁদগলা জোৎস্না রাতে তার প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে ঠিক সেভাবে। সকালে বাবা খেজুর গাছ থেকে রস নামাতেন। মা পিন্নী রাঁধতেন। কখনো ভাঁপা পিঠা বানাতেন। আমরা সবাই খেতাম। ফজরের আযান দিলে বাবা গরম কাঁথা ছেড়ে উঠে মসজিদে যেতেন। আমাকে ডাকতেন। আমি কখনো উঠতাম, কখনো শীত বেশি পড়লে উঠতাম না। না উঠলে বাবা তাঁর লাঠি দিয়ে আমার গায়ে মৃদু আঘাত করতেন। আমার তেমন ব্যথা লাগত না। কারণ, আমি কাঁথা মুড়িয়ে থাকতাম। বাবা মসজিদ থেকে এসে সূর্য উঠা পর্যমত্ম কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাবার কোরআন তেলাওয়াতের সুর আমার কানে এসে লাগত। প্রকৃতির চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ত সে সুরের লহরি। গাছের সবুজ পাতা আনন্দে নেচে উঠত। আমি তখনো কোরআন পড়তে শিখিনি। তখন শুয়ে শুয়ে আনমনা হয়ে বাবার কোরআন তেলাওয়াত শুনতাম। পরে বাবার কাছ থেকেই কোরআন পড়া শিখেছি। বাবা কোরআন তেলাওয়াত শেষ করে লাঙল-জোয়ান কাঁধে করে গরুর রশি ধরে দক্ষিণের মাঠের দিকে যেতেন। তখন কিশোরী মেয়ের নাকফুলের মত শিশির জমে থাকতো ঘাসের ডগার উপর। সূর্য থেকে ঠিকরে পড়ত আলোর দ্যূতি। এভাবে শীতের সাথে আমি এবং আমার বাবার জীবনের প্রতিচ্ছবি একাকার হয়ে মিশে আছে।
প্রতি বছর শীত আসে শীত যায়। কিন্তু বাবা আর আসে না। তাই আমি এখন চেয়ে থাকি সময়ের দিকে। সময় আমাকে কোন জবাবই দেয়না। সময়ও এখন অনেক পাল্টে গেছে। সে বড় নিষ্ঠুর। সে বড় স্বার্থপর। সে সবকিছু ভুলে যায়। সবকিছুকে সে ভুলিয়ে দেয়। এখন না আছে আমাদের চালা ঘর, না চাঁদের আলো, না বাবার গলার কণ্ঠ, না তাঁর পায়ের আওয়াজ। সবকিছু এখন কেবলই স্মৃতি। তাই এখনো মধ্যরাতে শুনতে পাই বাবার পদধ্বনি।
আমার লক্ষ্মী বাবা, সরল বাবা, ভালো বাবা তুমি ভালো থেকো সুখে থেকো অনেক অনেক ভালো; অমরাবতীর সবুজ কাননে। আরা তোমার এই দুষ্টু ছেলের জন্য বদদোয়া করোনা; দোয়া করো, যেন তোমার খোদাভীরুতা আর সরলতার পবিত্র গুণে বিভূসিত করে নিজের জীবনকে সাজাতে পারি।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।