ছেলেবেলায় কারও নামের শেষে গোমেজ, ফার্নান্ডেজ ইত্যাদি পদবীগুলো দেখলেই মনে মনে কল্পনা করে নিতুম ধপধপে ফর্সা সুঠাম চেহারার কোনও বিদেশী মানুষকে। আমার বেশ কয়েকজন মুসলমান বন্ধুও ছিল। কিন্তু অপরিচিত হলেও আলি, হায়দার বা রহমান পদবীর মালিকদের কখনই আফগানিস্তান, ইরান-ইরাক এমনকি পাকিস্তানী বলেও মনে হত না, খুব বেশী হলে কল্পনায় বাংলাদেশ এলেও আসতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ কি আর বিদেশ হল? সেইতো আমাদের মতই ছোটখাটো চেহারার দু’বেলা মাছ ভাত খাওয়া কালোকালো লোকগুলো, যারা একটু অদ্ভুত টানে হলেও বাংলাতেই কথা বলে। সেতো আমাদের বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদা কিম্বা আমার মতই বর্ধমানের লোকেরাও নিজস্ব অদ্ভুত টানেই কথা বলে।
মুখ খুললেই আর বলে দিতে হবে না কার কোন জেলায় বাড়ি। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পেলেও খ্রিষ্টান সম্প্রদায় আমার কাছে অধরাই ছিল। গ্রাম বাংলার প্রতিটা জনপদে এক বা একাধিক মসজিদ চোখে পরলেও গির্জার সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। কালনায় একটা গির্জা ছিল। বড়দিনে দূর্গাঠাকুর দেখার মত করেই প্রতি বছর যিশুঠাকুর দেখতে যেতুম। কাটোয়ায় চলে আসার পর বড়দিনের নিয়ম করে যিশুঠাকুর দেখতে যাওয়াটা বাদ পড়লো। ওই লম্বা লম্বা পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুলের সাদা গাউন পরা যিশুঠাকুরের পূজো করা পুরুতমশাই গুলোকে কেন যে পাদ্রী বলে সেটাও জানলুম অনেক পরে, কারণ সবাই ওই পুরুতমশাই গুলোকে ফাদার বলেই ডাকতো।
ততদিনে ফাদার মানে যে বাবা সেটা জেনে গেছি। বাবার বন্ধু বা পিতৃস্থানীয় কাউকে কাকু, জ্যেঠু বা পিসেমশাই-মেসোমশাই সম্বোধনেই অভ্যস্ত ছিলুম। নিজের বাবা থাকতেও একটা বাইরের লোককে মানুষ কি করে বাবা বলে ডাকে বুঝতুম না। হলই বা ইংরেজিতে ফাদার, বাংলা মানেটা তো সেই বাবা-ই, নাকি? চার্চের যিশুপুজোর পুরুতমশাই গুলোকে কেন যে পাদ্রী বলে আর তাদের ফাদার বলে ডাকার কারণটাও জানলুম বাবলু, মান আমাদের বাবলু ফার্নান্ডেজের সাথে পরিচয় হওয়ার পর। ক্লাস ইলেভেনে আমাদের স্কুলে ভর্তি হল। বেশ সুঠাম বেঁটেখাটো চেহারা, একমাথা ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, কুচকুচে কালো রঙ, পুরো শরীর জোড়া জংলী আদিবাসীর ছাপ স্পষ্ট।
ওর বাবার নাম ছিল বিশু টুডু, যার কথা জিজ্ঞেস করতেই নির্বিকার মুখে বাবলু বলেছিল, – “মা বলে, ওইটে বেহেড মাতাল ছিল বটেক। পুটুস করি হাতির পায়ে পত্তেই, হুশ করে উপরে। মু দেখি নাই উঁয়াকে, মুর জন্মের আগেই……..” বাবলুর মুখেই শুনেছিলুম ওর বাবার দলা পাকানো দেহটা দেখেই মা ফুলমনি জ্ঞান হারিয়েছিল আর জ্ঞান ফিরতেই যাকে প্রথম চোখে পরেছিল তিনিই হচ্ছেন ফাদার ফার্নান্ডেজ, করজগ্রামের চার্চের পাদ্রী। সেই থেকেই সহায় সম্বলহীন গর্ভবতী ফুলমনি টুডুর আশ্রয়স্থল হল চার্চ আর ওই পাদ্রীর পদবীতেই পরিচিত হয়ে গেল বিশু টুডুর ছেলে বাবলু ফার্নান্ডেজ। ফাদার অবিশ্যি আদর করে নাম রেখেছিল ববি, ববি ফার্নান্ডেজ। কিন্তু একটু বড় হতেই ববি নামটা কেমন যেন মেয়ে মেয়ে মনে হয়েছিল বাবলুর। তাই নিজেই ফাদারের কাছে আবদার করে ববি থেকে বাবলু হয়ে গেছিল। পুত্র স্নেহে মানুষ করা বাবলুর আবদারে ফাদারও আপত্তি করেন নি, স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন বাবলু ফার্নান্ডেজ নামেই। নিজের নাম করনের ইতিহাস নিয়ে বাবলু মজা করে বলতো, – “মা বলে, মু বড্ড ইঁচড়ে পাকা। মুর লিজের নামটিকে তাই লিজেই দিছি।” আমাদের স্কুলের হোস্টেলেই থাকতো বাবলু। পড়াশুনার থেকে ফুটবলে নজর বেশি। পড়ার বইয়ের অক্ষরের থেকেও ফুটবল মাঠের সবুজ ঘাস বেশি আপন ছিল বাবলুর। পড়াশুনাতে একটু নড়বড়ে হলেও ফুটবল মাঠে অল্প দিনেই সকলের নজর কাড়লো। ক্লাসের শেষ পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই স্কুলের গেমস টিচারের কিনে দেওয়া বুটজোড়া হস্টেলের ঘর থেকে বগলদাবা করেই একদৌড়ে খেলার মাঠে।
পায়ে বুট গলিয়েই গায়ের সার্ট খুলে খালি গায়েই মাঠের মাঝে। খেলা শুরুর বাঁশি পরতেই শুরু হত বাবলুর দৌড়, বল পায়ে অথবা বলের দখল নিতে অবিরাম দৌড়। বলের দখলদারি যেন বাবলুর জন্মগত অধিকার এবং সেই অধিকারকে কায়েম রাখতেই যেন বাবলুর এই জীবনপণ বাজি। বল পায়ে বাবলুর চকচকে ঘামেভেজা শরীরটা একেবেকে পেরিয়ে যেত বাকী সবাইকে। জীবনযুদ্ধের লং-ডিস্টেন্স রানে বাকী সবার অনেক পেছন থেকে শুরু করা দৌড়ের অসম প্রতিযোগিতার খামতি মেটাতেই যেন এই ফুটবল মাঠে সবাইকে পেছনে ফেলে দেওয়ার এক অদম্য ইচ্ছে ফুটে বেরত বাবলুর চোখে মুখে, পায়ের পেশিতে আর দু’গাল বেয়ে চিবুক থেকে পরতে থাকা ঘামের প্রতিটা ফোঁটায়।
******* দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। কয়েক মাস পরেই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। সবার মধ্যেই পরীক্ষার প্রস্তুতির ব্যস্ততা কিন্তু বাবলুর কোনও হেলদোল নেই। পরীক্ষার প্রস্তুতির কথা বলতেই অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের স্বরে বলতো, – “মা বলে, মু উই করব বটেক, যিটা মুর ইচ্ছা।” বাবলুর প্রতিটা কথা এই “মা বলে” বলে শুরু করার অভ্যাসটা আমার ভারি অদ্ভুত লাগতো। আর পাঁচটা আড্ডাবাজ বাঙালী ছেলের মতই আমরাও ততদিনে কথার শুরুতে দু অক্ষরের অশ্লীল মাত্রাগুলো আয়ত্ত করে ফেলেছি, কিন্তু আমাদের দলে ওই জংলী, আদিবাসী ভাষায় কথা বলা বাবলু ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। আমাদের সভ্য ভাষা আয়ত্ত করার প্রতি ওর যেমন অনীহা ছিল ঠিক তেমনই আমাদের পুরুষোচিত গর্বের অশ্লীল মাত্রগুলোর প্রতিও বাবলুর ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অবজ্ঞা। ততদিনে ফুটবলার হিসেবে বাবলুর নাম জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যস্তরে পৌঁছে গেছে। অনূর্ধ্ব উনিশ বাংলা দলের ট্রায়ালে ডাক পেল বাবলু আর আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলুম পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। পরীক্ষা শেষ, বাবলু ছাড়া সবাই পরীক্ষা দিলুম আর বাবলু সেই সময় বেঙ্গল জুনিয়ার টিমের হয়ে খেলতে গেল কেরলে। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরতেই সবাই ছিটকে গেলুম বিভিন্ন দিকে। কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ মেডিকেল, কেউ কেউ কলকাতার বিভিন্ন কলেজে আর বাবলু ততদিনে পা দিয়ে ফেলেছে ফুটবলার হিসেবে ওপর দিকে ওঠার প্রথম সিঁড়িতে। তারপর আরও অনেক দিন দেখা হয়নি বাবলুর সাথে। অবিশ্যি মাঝে মাঝে খবরের কাগজে চোখে পরত বাবলুর নাম। কলকাতার বড়দলে খেলছে, ইন্ডিয়ার হয়ে দেশের বাইরেও খেলতে গেছে বেশ কয়েকবার। বন্ধুদের মুখেই শুনেছিলুম কোন একটা ব্যাংকেও চাকরী পেয়েছে, খেলার জন্যেই। বাবলুর জন্যে মনে মনে গর্ব হত। ভাবতুম ও এখনও ওই সাঁওতালী ভাষাতেই কথা বলে কিনা অথবা এখনও ওর প্রতিটা কথা শুরু করার আগে সেই “মা বলে” বলার অভ্যাসটা আছে কিনা।
******* বাবলুর সাথে যে আবারও কোন দিন একেবারে সামনা সামনি দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি। সুযোগটা এসে গেল আমাদের স্কুলের ১২৫তম বর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে। পুরনো, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ার লোভেই গিয়ে বসলুম একেবারে পেছনের সারির একটা চেয়ারে। অসংখ্য অপরিচিত মুখের মধ্যেও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতই মাঝেমাঝে ঝলক দিয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট কিছু পরিচিত মুখ আর তার হাত ধরেই খুঁজে ফেরা সেই রঙিন রাংতায় মোড়ানো ফেলে আসা বা হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। আরও অনেক কৃতি ছাত্রের সঙ্গে বাবলুও আজকের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথি। নাম করা ফুটবলার! আমাদের স্কুলের অনেক প্রক্তনিই আজকের নামজাদা ডাক্তার, সায়েন্টিস্ট অথবা শিক্ষাবিদ কিন্তু বাবলুর মত বিখ্যাত কেউ নয়। বাবলুই আজকের অনুষ্ঠানের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে।
ওকে কি করে হাতের সামনে পাওয়া যায় সেটাই ভাবছি। আজকের এই স্তাবকতাময় জগতে বাবলু নিশ্চয় স্তাবকদের ঘেরাটোপে হারিয়ে গেছে, এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ পিঠে অনুভব করলুম কার যেন ছোঁয়া। চমকে ঘাড় ঘোরাতেই আরও অনেক চেনা মুখের মাঝে সেই পরিচিত চকচকে চোখ, যেটা দেখলেই চিনে নেওয়া যায় বাবলু ফার্নান্ডেজকে। মাথার ঝাঁকরা চুল উধাও হয়ে বেশ কিছুটা মসৃণ টাক আর হালকা ভুঁড়ি স্বত্বেও এক নজরেই চেনা যায় বাবলুকে। ঘোর কাটিয়ে ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাবলুর কাঁধে হাত রেখে প্রথমেই অদ্ভুতভাবে কুশল বিনিময় না করেই অথবা ওর পরিবারের কথা বাদ দিয়ে সেই বোকাবোকা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নটাই করে বসলুম, – “তুই এখনও সেই সাঁওতালী ভাষাতেই কথা বলিস?” – “কেন বে? তুর অসুবিধা আছে বটেক?” বাবলুর স্বতঃস্ফূর্ত উত্তরে সবই হেসে উঠতেই সসংকোচে জিজ্ঞেস করলুম, – “বিয়ে করেছিস? ছেলে মেয়ে? আর তোর মা?” – “হ্যাঁ বিয়ে করেছি, একটাই ছেলে।” বলেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার চোখে চোখ রেখে কাঁপা কাঁপা গলায়, পরিষ্কার আমাদের ভাষায় বলল, – “বাপটা গেছিলো জন্মের আগেই আর মাও আমার হাঁটতে শেখার আগেই।
প্রথম পা ফেলেছি ফাদারের হাত ধরে, ফাদারের মুখেই শুনেছি বিশু আর ফুলমনি টুডুর গল্প। বাপকে দেখিইনি আর মাকেও মনে পড়েনা…..” – “কিন্তু তোর যে ওই প্রতিটা কথা বলার আগে ‘মা বলে’ দিয়ে শুরু করা….” আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চাপা হিসহিসে স্বরে যেন স্বগতোক্তি করল বাবলু, – “ওটা বললে মাকে সব সময় পাশে অনুভব করতাম, মনে জোর পেতাম আর সেদিনও আমি তোদের ভাষাতেই কথা বলতে পারতাম কিন্তু ইচ্ছে করেই কথা বলতাম আমার সেই কোনও দিনও চোখে না দেখা আসল বাবার ভাষাতেই আর ওতেই অদৃশ্য ছোঁয়া পেতাম বিশু টুডুর হাতের….” বলেই হনহন করে এগিয়ে গিয়ে জন সমুদ্রে হারিয়ে গেল আমাদের সেই জংলী আদিবাসী বন্ধু বাবলু ফার্নান্ডেজ…..