বাবলা তলার শপথ —আমরা সেই সে জাতি –– আবুল আসাদ

৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাস। হজ্জযাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আরবের দিকে। এই মাস থেকে আগামী তিন মাস মক্কাভূতে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ থাকবে, মানুষ ভুলে যাবে তাদের দ্বেষ-দ্বন্দের কথা। এই উপলক্ষে মহানবী (সাঃ) মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘোষণা করে দিলেন তাঁর সিদ্ধান্তের কথা। আনন্দ ও উৎসাহের বন্যা বয়ে গেল মদীনায়।

নির্দিষ্ট দিন এলো। যাত্রা করলেন মহানবী (সাঃ)। তিনি তাঁর প্রিয় উট কাসওয়ার পিঠে সমাসীন। সাথে চৌদ্দশ’ সাহাবা। যোদ্ধা নয়, তীর্থযাত্রীর মতো তাদের। সঙ্গে কুরবানির ৭০টি উট। ছয় বছর আগে মদীনায় প্রবেশের পর এই প্রথম তিনি যাত্রা করলেন মক্কার উদ্দেশ্যে, কাবার পথে।

তিনি মক্কার সন্নিকটবর্তী ‘আসফান’ নামক স্থানে পৌঁছে শুনতে পেলেন, কুরাইশরা যুদ্ধের জন্য এগিয়ে আসছে। কিন্তু মহানবী (সাঃ) তো কোনো যুদ্ধের জন্য আসেননি। তিনি সরাসরি কুরাইশদের সম্মুখীন না হয়ে অন্য পথ ধরে মক্কার এক মঞ্জিলদূরে হুদাইবিয়া নামক গ্রামে উপস্থিত হলেন। স্থানীয় ‘খোজা’ গোত্রের দলনেতা বুদাইল থেকে তিনি জানতে পারলেন যে কুরাইশরা তাঁকে কিছুতেই মক্কা প্রবেশ করতে দিবে না। প্রয়োজন হলে যুদ্ধের জন্য তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

মহানবী (সাঃ) বুদাইলকে মক্কায় পাঠিয়ে কুরাইশদেরকে তাঁর শান্তিকামী আগমনের উদ্দেশ্য জানালেন। কিন্তু ফল কিছুই হলোনা। মুসলমানদের পর্যবেক্ষণের জন্য ‘ওবওয়া’ ও ‘বেদওয়া’ গোত্রের দলনেতাসহ কয়েক ব্যক্তি হুদাইবিয়া গ্রামে এলো। তারা মহানবীর (সাঃ) সদিচ্ছা সম্পর্কে কুরাইশদেরকে অবহিত করল। কিন্তু তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ হল। মহানবী (সাঃ) তাঁর সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে তার প্রিয় উট কাসওয়ার পিঠে খিরাশ নামক সাহাবীকে মক্কায় পাঠালেন। কিন্তু কুরাইশরা উটের ক্ষতি সাধন করল। আর কয়েকটি গোত্রের হস্তক্ষেপে খিরাশ কোন রকম প্রাণ নিয়ে ফিরে এল হুদাইবিয়ায়।

অবশেষে মহানবী (সাঃ) হযরত উসমানকে কুরাইশদের সঙ্গে কথা বলার জন্য মক্কায় পাঠালেন। আলোচনার ফলাফল জানার জন্য মুসলমানরা হযরত উসমানের আগমণ পথের দিকে চেয়ে রইলেন—ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু হযরত উসমানের দেখা নেই; দিগন্ত বিস্তৃত শূন্য মরুভূমি নির্জন পড়ে আছে সামনে। উদ্বেগ ও আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ল গোটা কাফিলায়। এমন সময় খবর এল, হযরত উসমান নিহত হয়েছেন।

শোকের বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলল প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়তন্ত্রীতে। বিশিষ্ট সাহাবী, মহানবীর (সাঃ) জামাতা, ইসলামের অদ্বিতীয় সৈনিক হযরত উসমানের শোকে মুহ্যমান মুসলমানদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল—এ তো উসমানের হত্যা নয়, সত্যের হত্যা। সত্য ও মিথ্যার চিরন্তন বিরোধেরই এটি একটি আংশিক প্রকাশ মাত্র। কেন তারা এ আঘাতকে নীরবে সহ্য করবে? উত্তেজনা ও শপথ দৃপ্ত হয়ে উঠল প্রতিটি মুসলমানের মধ্যে।

মহানবীর (সাঃ) দৃঢ় কণ্ঠে ধ্বনিত হলঃ
“আমাদের অবশ্যই উসমানের রক্তের বদলা নিতে হবে।”

মহানবীর (সাঃ) এ উক্তি হুদাইবিয়ায় উপস্থিত ১৪০০ বিশ্বাসীর হৃদয়কে আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় আকুল করে তুলল।

মহানবী (সাঃ) একটি বাবলা গাছের নীচে বসলেন। দৃপ্ত শপথে ১৪০০ সৈনিক একে একে মহানবীর (সাঃ) হাতে হাত রেখে শপথ নিলেন,
“হযরত উসমান হত্যার বদলা আমরা নেব। আমরা মরে যাব, তবু লড়াইয়ের মাঠ থেকে পিছু হটব না।”

শত্রু দেশে, শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় ১৪০০ মুজাহিদ। যুদ্ধের কোনো অস্ত্রশস্ত্রই তাঁদের কাছে নেই; আছে শুধু আত্মরক্ষার জন্য একটি করে তরবারি। তবু শত্রুর মোকাবিলা ও অন্যায়ের প্রতিকারের শপথ নিলেন তাঁরা। তাঁদের এ শপথের নির্ভরতা ছিল অস্ত্রের উপর নয়—ঈমানের উপর, ঈমানী শক্তির উপর। আর ঈমানের শক্তি অস্ত্রের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী। বাবলা গাছের সেই শপথ তা ক্ষণকাল পরেই প্রমাণ করে দিল। প্রমাণ করে দিল, অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মুসলমানরা যদি আত্মোৎসর্গিত হয়, আল্লাহর সাহায্য কত দ্রুত নেমে আসে।

মুসলমানদের শপথের কথা যথাসময়ে মক্কায় পৌঁছল। কুরাইশ বিবেক এবার চঞ্চল হয়ে উঠল। মুসলমানদের প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র না থাকলেও, এবং তারা নগণ্য সংখ্যক হলেও, তাদের ভীষণ শপথ কুরাইশদের ভীত করে তুলল। তারা মুসলমানদের শৌর্য-ভীর্য দেখল। জেনে গেল যে মুসলমানরা না মরে মারা যায় না। সুতরাং তারা তাদের ভুল সংশোধন করল। উসমানকে ছেড়ে দিল, এবং মহানবীর (সাঃ) সঙ্গে হুদাইবিয়ায় এসে সাক্ষাত করল কুরাইশ প্রতিনিধিরা।

বারবার প্রতিনিধি প্রেরণ ও পুনঃপুনঃ অনুরোধ কুরাইশদের যে যুদ্ধতৃষ্ণা মেটাতে পারেনি, যে বিবেকবোধ জাগ্রত করতে পারেনি, ঈমান দীপ্ত বাবলা গাছের শপথ তা সম্ভব করে দিল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!