অনেক অনেক দিন আগের কথা। কোনো এক বাদশার কথা বলছি। ওই বাদশার এক পুত্র সন্তান ছিল। রাজপুত্র। রাজপুত্রের নাম ছিল জামশিদ। জামশিদের বয়স যখন দশে পড়লো তখন তার মা মারা যান। মাতৃস্নেহহীন জীবন তার জন্য ছিল বেশ কষ্টকর হয়ে উঠলো। মনটা তার একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। কোনো কিছুই ভালো লাগছিলো না তার। আনমনা হয়ে থাকতো জামশিদ। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকতো। জামশিদ ছিল তার বাবার চোখের মণি। বরং বলা ভালো বাদশা তার আপন চোখের চেয়েও বেশি ভালবাসতো রাজপুত্রকে। তাই বাদশা বিচিত্রভাবে চেষ্টা করলো জামশিদকে তার বিষণ্ণ মন থেকে উদ্ধার করে হাসিখুশি রাখতে, স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরিয়ে নিতে।
কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। জামশিদ কোনো কিছুতেই কান দিলো না। একেবারেই মন বসলো না তার কোনো কাজে। সারাক্ষণ বসে বসে মনমরা হয়ে শুধু মায়ের কথাই ভাবতো। এরকম পরিস্থিতিতে একদিন এক লোক বাদশাকে পরামর্শ দিয়ে বললো: ‘যদি জামশিদের জন্য একটা সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা বা ‘সী-হর্স’ পাওয়া যেত তাহলে ও ভীষণ খুশি হতো এবং মায়ের জন্যে তার সকল দুঃখ, সকল ব্যথা বেদনা দূর হয়ে যেত, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেত রাজপুত্র’।
বাদশা সঙ্গে সঙ্গে উজিরকে ডেকে পাঠালো এবং বললো: ‘এক্ষুণি যাও! জামশিদের জন্য সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা সংগ্রহ করে আনো’।
উজির যথারীতি ‘জ্বী হুজুর’ বলে কাজে নেমে পড়লো। সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা বিষয়ে অভিজ্ঞ দুজন চাকরকে পাঠিয়ে দিলো সমুদ্রে। রাজপুত্রের জন্য সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা সংগ্রহ করে আনতে হবে-আদেশ দিয়ে দিলো। চাকরেরা আদেশ অনুযায়ী চলে সমুদ্রের তীরে। সেখানে গিয়ে তারা লুকিয়ে রইলো। একসময় সামুদ্রিক ঘোড়া উঠে এলো তীরে এবং বাচ্চা প্রসব করলো। চাকরেরা তখন সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা সংগ্রহ করে সোজা গিয়ে হাজির হয়ে গেল বাদশার আস্তাবলে। সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা সংগ্রহ করার খবর শুনে বাদশা ভীষণ খুশি হয়ে গেল এবং উজির আর তার চাকরদের উত্তম পুরস্কার দিলো। কিন্তু এই সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। সে পানির পরিবর্তে শরবত কিংবা গোলাব জল খেত। শুকনো ঘাসের পরিবর্তে জাফরান-চিনি-হার্বাল মিষ্টি ইত্যাদি খেত। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা ঠিক মানুষের মতো কথা বলতো।
জামশিদ যখন ওই সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার কথা শুনতে পেল খুশিতে বাগবাগ হয়ে তাকে দেখতে গেল। অনেকদিন পর মনে হলো বদ্ধ কুঁড়ি এবার মেলে ধরেছে তার পাপড়িগুলো। হেঁসে উঠেছে ফুল। বেদনানীল মেঘ যেন কেটে গেছে। জামশিদ সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে আদেশ দিলো তার সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার জন্য সুন্দর পরিপাটি একটি ঘর বানাতে। সোনার একটি গামলাও রাখা হলো তাকে পানি খাওয়ানোর জন্য। এমন ব্যবস্থা করা হলো সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার জন্য যেন সে সমুদ্র থেকেও আরামে থাকতে পারে। তার কাছে কাউকে ঘেঁষতে দিতো না। নিজেই তাকে সকল খাবার দাবার দিতো-মিষ্টি, গোলাব জল কিংবা শরবৎ। প্রতিদিন সকালে মক্তবে যাবার আগে জামশিদ তাকে দেখে যেত। দুপুর কিংবা বিকেলে বাসায় ফিরে সবার আগে সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার খবর নিতো, তাকে আদর যত্ন করতো।
বাদশা যখন দেখলো রাজপুত্র তার মাতৃহীনতার বেদনা ভুলে গিয়ে সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়েছে তখন তিনি স্বস্তি ফিরে পেলেন। বিরাট একটি দুশ্চিন্তা তার মাথা থেকে কেটে গেল।
দিনে দিনে জামশিদ বড়ো হয়ে গেল। বাদশার অপর এক স্ত্রী একদিন জামশিদের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেদিনের জামশিদ এখন আর ছোট্টটি নেই, বড়ো হয়ে গেছে। হিংসায় জ্বলে উঠলো তার ভেতরটা। সিদ্ধান্ত নিলো জামশিদকে যে করেই হোক মেরে ফেলবে। চাকরদের ডেকে বড়ো রকমের পুরস্কার দিয়ে বললো: জামশিদ প্রতিদিন যে রাস্তা ধরে স্কুলে যাওয়া আসা করে, সে রাস্তার মাঝে গর্ত খুঁড়ে গর্তের দেয়ালে বিষাক্ত ছুরি গেড়ে রাখতে আর গর্তটাকে একটা কার্পেট দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দিতে যেন কোনোভাবেই বোঝা না যায়। ব্যস, গর্তে পড়ামাত্রই হিংসার আগুন নিভে যাবে।
সেদিন জামশিদ স্কুল থেকে ফিরে সোজা গেল সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার আস্তাবলে। গিয়ে দেখলো সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে, কাঁদছো কেন?
উত্তরে সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা তাকে মেরে ফেলার সকল ষড়যন্ত্রের কথা জামশিদকে বলে দিলো। জামশিদ বললো: ‘সমস্যা নেই। আমি অন্য পথ ধরে আমার রুমে যাবো’। এই বলে সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার জন্যে তৈরি করে আনা মিষ্টি খাবার দাবার দিয়ে নিরাপদ পথে চলে গেল তার কামরায়।
বাদশার স্ত্রী তো ওঁৎ পেতে ছিলো দেখার জন্য কখোন জামশিদ গর্তে পড়ে। কিন্তু যখন দেখলো ভিন্ন চিত্র তখন ভিন্নরকম ষড়যন্ত্রের কথা ভাবতে শুরু করলো। একদিন জামশিদ যখন স্কুলে গেল তার খাবারে সে বিষ ঢেলে দিলো। জামশিদ যথারীতি স্কুল থেকে ফিরে আগে সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার ঘরে গেল। সেখানে গিয়ে দেখলো সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা কাঁদছে। আজো জিজ্ঞেস করলো: ‘কী হয়েছে তোমার, কাঁদছো কেন’।
সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা বললো: ‘তোমার সৎ মা তোমার খাবারে বিষ মাখিয়ে রেখেছে তোমাকে মারার জন্য’। জামশিদ বললো: ‘ঠিকাছে! আজ তাহলে খাবারই খাবো না’। এই বলে ফিরে গেল তার রুমে। রাতে যখন তার জন্য খাবার আনা হলো, এক লোকমা খাবার তুলে সে বেড়ালকে দিলো। বেড়াল ওই খাবার খেয়ে মরে গেল। সে আর খাবার খেল না।
পরদিন সকালবেলা যখন চাকরেরা খাবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল সৎ মা চিন্তায় পড়ে গেল ‘কে তাকে এভাবে আগাম খবর জানিয়ে দেয়’! প্রথমে সে সন্দেহ করেছিল চাকরদেরকে। পরে ভাবলো-না..হ! এটা হতে পারে না। হঠাৎ তার মনে হলো-এটা নিশ্চয়ই সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার কাজ। আগেভাগে সব জামশিদকে জানিয়ে দেয় আর তার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। মনে মনে সে সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চাকে মেরে ফেলার চক্রান্ত করলো। রুগী সেজে হেকিমকে ডেকে পাঠাবে। হেকিম যখন আসবে তখন তাকে দেখে যেন বলে: তার রোগের একমাত্র ওষুধ হলো সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার কলিজা এবং হৃদয়। এজন্য হেকিমকে অনেক পুরস্কার দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিলো।
বাদশার স্ত্রী যথারীতি রোগের অভিনয় শুরু করে দিলো। তার তোশকের নীচে শুকনো রুটির টুকরো রাখা হলো। সবাই যখন তাকে দেখতে এলো সে এপাশ ওপাশ হতেই রুটির টুকরো ভাঙার শব্দ হলো। সবাই ভাবলো বাদশার স্ত্রীর হাঁড়ের শব্দ। হলুদ এবং জাফরানও মাখা হলো তার চেহারায় যাতে সত্যিকারের রোগীর মতো লাগে তাকে। চীৎকার চেঁচামেচি শুনে বাদশা হেকিমকে খবর দিলো এবং নিজেও গেল তাকে দেখতে। হেকিম রোগীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময় রোগী এপাশ ওপাশ হচ্ছিলো আর হাড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। হেকিম বললো: ‘কঠিন রোগ। এই রোগের একমাত্র ওষুধ হলো সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার কলিজা ও হৃদয়’।
বাদশা নিশ্চিন্তে বলে দিলো: কোনো ব্যাপারই না। জামশিদ স্কুলে গেলে একজন কসাইকে খবর দিয়ে এনে সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার মাথা কেটে তার হৃদয় এবং কলিজা বের করে আনার কথা বললো।#
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।