আমরা বলেছিলাম যে বাদশা তার ছেলে মালেক জামশিদের জন্য সামুদ্রিক ঘোড়া সংগ্রহ করে দিয়েছিল মা হারানোর বেদনায় ছেলের নির্বাক নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য। সামুদ্রিক ঘোড়া পেয়ে ছেলে ভীষণ খুশি হয়ে গেল এবং সারা দিনরাত তার ওই ঘোড়াকে নিয়েই কাটতে লাগলো। কিন্তু জামশিদকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চললো ভেতরে ভেতরে। যতবারই তাকে মারতে চাইলো ততবারই সামুদ্রিক ঘোড়া তাকে সতর্ক করে দিলো। বাদশার অন্য স্ত্রী যখন বুঝতে পারলো সামুদ্রিক ঘোড়াই তার ষড়যন্ত্র সফল হতে দিচ্ছে না, তখন সে ফন্দি আঁটলো। রোগের অভিনয় করে হেকিম ডেকে বাদশাকে বোঝালো তার ওই কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চার কলিজা ও হৃদয় পুড়িয়ে কাবাব করে খাওয়াতে হবে।
কী কঠিন সিদ্ধান্ত। অথচ জামশিদ কিছুই জানে না। সে যথারীতি স্কুল থেকে এসে সোজা চলে যায় তার প্রিয় ঘোড়ার কাছে। গিয়ে দেখে আজও সামুদ্রিক ঘোড়া কাঁদছে। আজ একটু বেশি। এমনভাবে কাঁদছে যে যে-ই দেখবে তারই খারাপ লাগবে। জামশিদ জানতে চাইলো: কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন?
ঘোড়ার বাচ্চা জবাব দিলো: জানতে চাও? তাহলে শোনো। তোমার সৎ মা বুঝতে পেরেছে আমার কারণেই তোমাকে মারার খায়েশ তার পূর্ণ হচ্ছে না। তাই সে এখন চাচ্ছে আমাকে মেরে তার পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলতে। সে অসুস্থতার ভান করে হেকিমকে দিয়ে বলাচ্ছে তার এই রোগের একমাত্র ওষুধ হলো আমার কলিজা ও অন্তর পুড়িয়ে কাবাব বানিয়ে খাওয়ানো।
সামুদ্রিক ঘোড়া আরও বললো: ‘সে ফন্দি এঁটেছে তোমাকে কিছুই বলবে না। আগামীকাল তুমি যখন স্কুলে যাবে কসাই ডেকে আমাকে জবাই করবে। তোমার শিক্ষককেও বলে দিয়েছে কাল যেন দুপুরের খাবার খেতে তোমাকে প্রাসাদে না পাঠায়।
জামশিদ এসব কথা শুনে মহা চিন্তায় পড়ে গেল। ভেবে পাচ্ছিলো না কী করে সামুদ্রিক ঘোড়াকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যায়। কী করলে ঘোড়াকে মারবে না বুদ্ধি খাটাতে লাগলো সে। সামুদ্রিক ঘোড়া বললো: কাল তিন বার হ্রেষা তুলবো। আমাকে যখন আস্তাবল থেকে বের করে বাইরে আনবে তখন প্রথম হ্রেষা তুলবো। দ্বিতীয় হ্রেষা তুলবো যখন আমার হাত-পা বাঁধতে চাইবে,তখন। আর তৃতীয়বার শব্দ করবো যখন কসাই আমার গলায় ছুরি চালাবে। যদি তুমি তৃতীয়বার হ্রেষাধ্বনি তোলার আগে আসতে পারো তাহলে একটা ধোঁকা দিতে পারবো এবং আমরা দুজনই প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যেতে পারবো। তা নাহলে আমার কাজ খতম হয়ে যাবে, তুমি আমাকে স্বপ্নে দেখা ছাড়া বাস্তবে আর দেখবে না।
পরদিন মালেক জামশিদ অত্যন্ত উৎকণ্ঠা মনে নিয়েই স্কুলে গেল। স্কুলে তো তার মন বসারই কথা নয়। মনের ভেতরে তো তার প্রিয় ঘোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল। টিচার কী বলছিল আর কী পড়াচ্ছিল কিছুই তার কানে ঢুকছিল না। এমন সময় হ্রেষাধ্বনি শুনতে পেল সে। অন্তর তার কেঁপে উঠলো। সাথে সাথে সে স্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না। টিচার পথ আটকে দাঁড়ালো এবং বললো: তুমি আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুলে থাকবে। কোনোভাবেই বাইরে যেতে পারবে না। কিন্তু জামশিদ কিছুতেই তা মানলো না। সে বললো: ‘যেভাবেই হোক বাবার কাছে আমাকে নিয়ে যাও’। শিক্ষক বললো: বাদশার আদেশ অমান্য করার সাধ্য তার নেই। এভাবে জামশিদের সাথে তার শিক্ষকের কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। এমন সময় দ্বিতীয় হ্রেষাধ্বনি হলো। জামশিদের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ শিক্ষকের হাত থেকে ছুটে দৌড়ে পালালো সে। সে কি দৌড়, একেবারে বিদ্যুতের মতো।
দৌড়ে গিয়ে হাজির হলো প্রাসাদে। দেখে সামুদ্রিক ঘোড়ার হাত পা বাঁধা হয়ে গেছে এবং বাগিচার পাশে নিয়ে গেছে জবাই করার জন্য। বাদশা ছেলেকে দেখে অবাক হয়ে গেল এই ভেবে যে কীভাবে জামশিদ জানতে পেল। জামশিদ এরইমধ্যে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগলো ঘোড়ার জন্য। বলতে লাগলো কেন তার ঘোড়ার বাচ্চাকে জবাই করা হচ্ছে। বাদশা ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো: তোমার মায়ের কঠিন রোগ হয়েছে। ওই রোগ ঘোড়ার বাচ্চার কলিজা ছাড়া সারবে না, তাই..। সমস্যা নেই। তোমার জন্য আরেকটা সামুদ্রিক ঘোড়ার বাচ্চা ধরে আনতে আদেশ দিচ্ছি।
জামশিদ বললো: আমার খুব শখ একদিন শাহী পোশাক পরবো, মাথায় তাজ পরবো এবং বেড়াতে যাবো যেখানে যেতে চায় মন। কিন্তু সে আশা তো আর পূর্ণ হলো না। বাদশা জামশিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো: এটা ভাগ্যের খেলা! তোমার মায়ের জীবন এই ঘোড়ার চেয়ে প্রিয়তর। জামশিদ বাদশার মন মোটামুটি তৈরি করে ফেলার পর বললো: আমি এখুনি শাহজাদার পোশাক পরাবো এবং এক ব্যাগ মুদ্রা রাখবো ঘোড়ার পিঠে। এরপর তার পিঠে চড়ে প্রাসাদের ভেতর একটু ঘুরবো। এতে তার ইচ্ছাটাও পূরণ হবে এবং ঘোড়াও কবরে গিয়ে শান্তি পাবে।
বাদশা ভাবলো ভালোই হলো! জামশিদ শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে। ঘোড়ায় চড়ে একটু বেড়ালেই ওর আবদার শেষ হয়ে যাবে আর তাদের কাজ করতে কোনো বাধা থাকবে না। তাড়াতাড়ি করে সোনালি রূপালি ঝকমকে পোশাক পরালো শাহজাদাকে। মাথায় তাজ পরালো। সামুদ্রিক ঘোড়ার হাত পা খুলে দিলো। জামশিদ ঘোড়ার পিঠে চড়লো। প্রাসাদের ভেতর কয়েক পাক দিলো। বাদশা ভেবেছিলো এবার শাহজাদা ঘোড়ার পিঠ থেকে নামবে তাই শাহজাদার কাছে এগিয়ে গেল তাকে নামাতে। ঘোড়ার গায়ে হাত বুলালো। ঘোড়া একটু পেছনে সরে গেল। একটু লাফিয়ে উঠে প্রাসাদের দেয়ালের বাইরে চলে গেল। এরপর দিলো দৌড়। একেবারে শহর পেছনে ফেলে চলে গেল মরুপ্রান্তরের দিকে। বাদশা, উজিরসহ সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আঙুল কামড়াতে লাগলো। বুঝলো শাহজাদা সবাইকে ধোঁকা দিয়েছে।
বাদশার স্ত্রী সবকিছু জানলার ফাঁক দিয়ে দেখছিল। ভীষণ ক্ষেপে গেল সে। ঘোড়া আর জামশিদ ছুটছে তো ছুটছেই। শহর মরু ছেড়ে তারা গিয়ে উঠলো অন্য এক শহরে। নিশ্চিন্ত হলো যে বাদশা বা তার লোকেরা এখন আর তাদের খুঁজে পাবে না। শহরের বাইরে গিয়ে মালেক জামশিদ ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলো। ঘোড়া বললো: তুমি নিজেকে এমনভাবে লুকাবে যাতে কেউ তোমাকে চিনতে না পারে। যদি কেউ চিনতে পারে তাহলে এই অচেনা শহরে তোমার ওপর নেমে আসবে কঠিন বিপদ। আমিও তোমার সাথে আসতে পারবো না কেননা সবাই বুঝবে তোমার মতো একটা গরিব ফকির ছেলে এ ধরনের ঘোড়ায় চলতে পারে না। তুমি এক কাজ করো। আমার ঘাড় থেকে কয়েকটা চুল ছিঁড়ে তোমার সাথে রেখে দাও! যখনই কোনো বিপদে পড়বে চুলগুলো আগুনে জ্বালাবে।#
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।