গরিব সাজতে হবে জামশিদকে, তাই ঘোড়া তার সাথে থাকলে মানুষ সন্দেহ করবে। এ কারণে শাহজাদা ঘোড়ার ঘাড়ের কটি চুল সাথে নিয়ে রেখে দিলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো একটা যুবক ছেলে। রাখাল বালক। তাকে কিছু টাকা দিয়ে জামশিদ তার গায়ের রাখালি জুব্বাটা কিনে নিলো। তাকে আরো বললো একটা দুম্বার বাচ্চা জবাই করতে। রাখাল বালক তাই করলো। জামশিদ দুম্বার ভুঁড়ি ভালোভাবে পরিষ্কার করলো। রাখাল বালকের পোশাক পরে ভুঁড়িটা হ্যাটের মতো মাথায় দিলো। তারপর ঘোড়ার কাছ থেকে বিদায় নিলো। কিছুদূর গিয়ে শহরের দরোজা পেরুতেই দেখলো একটা বাগান।
সে ওই বাগানের দরোজায় কড়া নাড়লো। কেউ দরোজা খুললো না। দরোজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখলো কী বিরাট বাগান অথচ ভেতরে কেউ নেই। আশ্চর্য হলো সে। বাগানের ভেতর যে নালা দিয়ে পানি দেওয়া হতো ওই নালায় একটা লাঠি দিয়ে পানি ময়লা, ঘোলা করতে লাগলো। এবার ঠিকই বাগানের মালী দরোজা খুললো। বৃদ্ধ মালী জামশিদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো: এতো সুন্দর পানি ঘোলা করছো কেন? এরপর মোলায়েম স্বরে বললো: এটা বাদশার বাগান। তাই সাবধান। যে কাজ করেছো দেখতে পারলে তোমার জীবনটাও ধ্বংস হবে আর আমারও…। বাদশার মেয়েরা প্রতিদিন বিকেলে এই বাগানে বেড়াতে আসে। ওরা যদি দেখতে পায় পানি নোংরা তাহলে আমার সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। মালেক জামশিদ বললো: আমি এই শহরে একেবারেই নতুন। কিছুই চিনি না, জানি না। এটা যে কার বাগান তাও জানতাম না।
বৃদ্ধ মালী জামশিদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত নজর বুলালো। ছেলেটাকে তার বেশ নিরীহ মনে হয়। তার খুব দয়া হলো জামশিদের ওপর। বললো: তুমি চাইলে ভেতরে আসতে পারো আমার শাগরেদ হিসেবে। তবে হ্যাঁ! এমনভাবে থাকতে হবে যেন বাদশার মেয়েরা কিছুতেই তোমাকে দেখতে না পায়। কোনোরকম চালাকি করা যাবে না। যদি চালাকি করো তাহলে নিজের গর্দান যেমন যাবে তেমনি আমারও! মালেক জামশিদ শর্ত মেনে নিলো এবং কথা দিলো সে ওসব করবে না।
ওই শহরের বাদশার তিনটি কন্যা ছিল। সবাই ছিল বেশ সুন্দরী। রাজকন্যা বলে কথা। তারা সকলেই বিকেল বেলা বাগানে বেড়াতে আসতো। মালি পানির নালার পাশে খাটের ওপর গালিচা বিছিয়ে নাশতা তৈরি করে রাখতো যাতে রাজকন্যাদের কোনো অসুবিধা না হয়। রাজার মেয়েরা বাগানে ঢুকে খেলাধুলা আর হাসিতামাশায় মেতে উঠতো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে সবাই ফিরে যেত প্রাসাদে। ফিরে যাবার সময় মালী সবার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে দিত। জামশিদ প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলো মেয়েদের খেলাধুলা আর দৌড়ঝাঁপ।
একদিন জামশিদ মালিকে বললো সে নিজে ফুলের তোড়া বানাবে। কিন্তু মালী রাজি হলো না। বললো: এটা তোমার কাজ না। কিন্তু জামশিদ এমন পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলো যে মালী শেষ পর্যন্ত রাজি হলো। তবে বললো শুধু ছোট্ট মেয়েটার জন্য ফুলের তোড়া বানাবে সে, অন্যদের জন্য নয়। জামশিদ তাই করলো। চমৎকার কিছু ফুল সংগ্রহ করে একটা তাজ বানালো এবং মাঝখানে লাল একটা ফুল দিয়ে দিলো একেবারে ইয়াকুতের মতো। বানিয়ে মালীর হাতে দিলো। মালী তিনটা তোড়াই রাখলো মেয়েদের সামনে। তিনকন্যাই তাজটির দিকে হাত বাড়ালো আর বললো: সূর্য আজ কোন দিক থেকে উঠলো। মালীর দেখছি অনেক উন্নতি হয়েছে। কী চমৎকার ফুলের তাজ বানিয়েছে।
মালিকে ডাকলো তারা। জিজ্ঞেস করলো: কে এই তাজ বানিয়েছে। মালী অপ্রস্তুত হয়ে অবশেষে বললো: আমার শাগরেদ। রাজকন্যারা এতোদিন জানতো মালী একাই বাগান দেখাশোনা করে। আজ একথা শুনে জিজ্ঞেস করলো: কবে থেকে তোমার শাগরেদ হলো? মালী বললো: আমার ভাইয়ের ছেলেটা কদিন আগে এসেছে,আমাকে একটু কাজে সাহায্য করছে। মেয়েরা বললো: ফুল দিয়ে চমৎকার তাজ বানিয়েছে সে। কাল থেকে যেন সে-ই ফুলের তোড়া বানায়। মালী খুশিতে হাসতে হাসতে জামশিদের কাছে ফিরে গিয়ে বললো: কাজ হয়েছে! এখন থেকে প্রতিদিন তোমাকেই ফুলের তোড়া সাজাতে হবে।
জামশিদ আল্লাহর কাছে যা চেয়েছিলো তাই হলো। প্রতিদিন সে এমনসব ফুলের তোড়া বানাতে লাগলো যেগুলো মেয়েরা কোনোদিনও দেখে নি। কদিন এভাবে যাবার পর মেয়েরা বলাবলি করতে লাগলো: মালী বোধ হয় সত্য বলছে না। যে শাগরেদের কথা বলছে সে তার ভাইপো নয়। এই শাগরেদকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। বেশ মেধাবী এবং রুচিবান। একদিন মেয়েরা বললো: যে এই ফুলের তোড়া বানায় তাকে বলবে নিজে যেন নিয়ে আসে। মালী ভয়ে ভয়ে জামশিদকে মেয়েদের কথাটা বলে বললো: খবরদার! মেয়েদের সাথে বেফাঁস কোনো কথা বলবে না।
পরদিন জামশিদ এমনভাবে ফুল সাজালো যে স্বয়ং বাদশা দেখতে পেয়ে তারও চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল। জামশিদ তিনটি তোড়া বানিয়ে একটি ট্রেতে সাজিয়ে মেয়েদের সামনে রাখলো। প্রথমে সে সম্মান জানালো। বাবার প্রাসাদে যেভাবে শিখেছে ঠিক সেভাবেই সে সম্মান দেখালো। ফুলের তোড়ার ট্রে মেয়েদের সামনে রেখে পিছনে দশ কদম গেল এবং বুকে হাত রেখে দাঁড়ালো। মেয়েরা ভালো করে দেখলো এবং বুঝলো এই ছেলে মালীর শাগরেদ নয়। কোনো শাগরেদ এভাবে শাহী কায়দায় সম্মান জানাতে পারার কথা নয়। দেখেই বোঝা যায় ছোটোবেলা তার রাজপ্রাসাদে কেটেছে। মেয়েরা প্রতিদিন মালিকে তিনটি করে রুপার কয়েন দিতো আজ জামশিদকে দিলো তিনটি সোনার মুদ্রা। জামশিদ মুদ্রাগুলো নিয়ে সম্মান জানিয়ে মালীর কাছে গিয়ে মুদ্রাগুলো তার হাতে বুঝিয়ে দিলো।
এ কয়েকদিন পর মালী জামশিদের দিকে তাকিয়ে বললো: আজ মেয়েরা শিকারে যাবে। বাগানে আসবে না। আমিও বাজারে যাবো। তুমি চাইলে আজ বাগানে ঘুরে বেড়াতে পারো। জামশিদ খুশি হয়ে গেল। সামুদ্রিক ঘোড়ার জন্য মন কাঁদছিল। আজ সুযোগ এসেছে। মালী চলে যাবার পর জামশিদ ঘোড়ার চুলগুলো আগুনে জ্বালালো। অমনি ঘোড়া চলে এলো তার কাছে। জামশিদ তার রাজকীয় পোশাক পরে ঘোড়ার পিঠে চড়লো। ঘটনাক্রমে এই সবই বাদশার ছোট মেয়েটা জানলার ফাঁক দিয়ে দেখে ফেললো। তার সর্দি লেগেছিল বলে সে শিকারে যায় নি। ঘোড়ায় চড়ে কিছুক্ষণ ঘুরে জামশিদ নেমে পড়লো। রাজকীয় পোশাক খুলে ফেললো এবং আবার সেই রাখালের পোশাক পরে মাথায় পরলো ভুঁড়ির হ্যাট। আবারো ঘোড়ার ঘাড়ের কয়েকটা চুল রেখে দিলো।
বাদশার মেয়ে এসব দেখে বুঝে ফেললো এই ছেলে রাজপুত্র ছাড়া অন্য কেউ নয়। সে তার প্রেমে পড়ে গেল। কিন্তু মালীর শাগরেদ এখানে কীভাবে এলো, কেন এলো? এই প্রশ্ন মেয়ের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। কিন্তু তার উত্তর পেল না।#
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।