বাদশা জামশিদ ও তার ছেলের গল্প (চতুর্থ অংশ)

জামশিদের সৎ মায়ের ষড়যন্ত্রে সামুদ্রিক ঘোড়াকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র থেকে কৌশলে পালিয়ে গিয়ে অন্য এক শহরে উঠেছিল জামশিদ আর তার ঘোড়া। সেখানকার বাদশার মেয়েদের সাথে তার পরিচয় হয় মালির মাধ্যমে। বাদশার ছোটো মেয়ে বুঝতে পেরেছিল জামশিদ আসলে মালির শাগরেদ নয় তার পরিচয় ভিন্ন। সে তার প্রেমে পড়ে যায়।

বাদশার ছোটো মেয়ে তার কামরায় বিশ্রাম নিচ্ছিলো। তার বাকি দু’বোন তাকে দেখতে এলো। ছোটো মেয়ে বললো: আমরা তিনজন এমন বয়সে পৌঁছেছি যে এখন আর বাবার বাসায় থাকা আমাদের ঠিক না। আমাদের এখন বিয়ের বয়স হয়েছে। অথচ বাবার কোনো চিন্তাই দেখছি না। তাই আমাদের এমন কিছু করতে হবে যাতে বাবা সচেতন হতে বাধ্য হয়। মেয়েরা বললো: তাই তো, ব্যাপারটা আমাদের মাথায় ঢোকে নি কেন? এখন কী করা যায়। ছোটো মেয়ে বললো: তোমাদের কিচ্ছু করতে হবে না। আমি যা করার করবো। বোনেরা মেনে নিল।

 

পরদিন মেয়ে মালিকে বললো তিনটা তরমুজ কিনে আনতে। একটা একেবারে পাকা, আরেকটা মোটামুটি পাকা আর তৃতীয়টি অর্ধপাকা। মালি তিনটা তরমুজ নিয়ে এলো এবং গোলাম মেয়ের আদেশ অনুযায়ী সেগুলো ট্রেতে করে নিয়ে হাজির করলো বাদশার সামনে। গিয়ে বললো: আপনার মেয়েরা এগুলো পাঠিয়েছে। বাদশা অনেক চিন্তাভাবনা করেও বুঝে উঠতে পারলো না মেয়েরা কেন এগুলো পাঠালো। অবশেষে বাদশা তার এক উজিরকে ডেকে পাঠালো। উজিরকে বলতেই উজির হেসে বললো: আপনার মেয়েরা কী বোঝাতে চেয়েছে তা স্পষ্ট। মেয়েরা বিয়ে করতে চায়। এবার বাদশার টনক নড়লো। ভাবলো, মেয়েরা তো ঠিকই বলেছে, আমি তো মেয়েদের জীবন নিয়ে ভাবতেই ভুলে গিয়েছিলাম।

 

 

ওই শহরে একটা রেওয়াজ ছিল। বাদশার মেয়েরা বিয়ে করতে চাইলে শহরের সকল যুবককে প্রাসাদে ডাকা হতো। যুবকেরা লাইন ধরে দাঁড়াতো আর শাহজাদি যার গায়ে লেবু দিয়ে আঘাত করতো সে-ই হতো মেয়ের স্বামী। নিয়ম অনুযায়ী শহরের যুবকদের ডাক পড়লো। বাদশার পাইক পেয়াদারা ঢাকঢোল পিটিয়ে হাটে-বাজারে, অলিতে গলিতে ঘোষণা করে দিলো বাদশার তিন মেয়ে বিয়ে করতে চায়। আগ্রহী যুবকরা যেন পরদিন প্রাসাদের সামনে হাজির থাকে।

 

পরদিন তো একেবারে শোরগোল উঠলো প্রাসাদের সামনে। বাদশার বড় মেয়ে ডান পাশের মন্ত্রীর ছেলের বুকে লেবু দিয়ে আঘাত করলো। মেজো মেয়ে আঘাত করলো বাম পাশের মন্ত্রীর ছেলের বুকে। তারা চলে গেল প্রাসাদের ভেতর। কিন্তু ছোটো মেয়ে জামশিদকে এই ভিড়ের মাঝে খুঁজে না পেয়ে কারো বুকেই আর লেবুর আঘাত করলো না। লেবু তার হাতের মুঠোয় রয়ে গেল।

 

বড় বোনেরা তাই বলতে লাগলো ‘তুই নিজেই তো বিয়ে করার কথা বললি! এখন কী হলো যে কাউকেই নির্বাচন করলি না! ছোটো বোন তখন বললো: আমি যাকে চাই সে এই যুবকদের মাঝে নেই। সাথে সাথে পেয়াদারা চলে গেল চারদিকে। আরো কয়েকজন যুবককে তারা খুঁজে বের করে নিয়ে এলো। তাদের মাঝে মালেক জামশিদও ছিল। ছোটো মেয়ে মালেক জামশিদ দেখেই তারদিকে লেবু ছুঁড়ে মারলো। লেবু সোজা গিয়ে পড়লো জামশিদের বুকে। বাদশা এবং দরবারের সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এতো ভালো ভালো এবং সুদর্শন যুবকেরা এলো অথচ মেয়ে তাদের কাউকে পছন্দ করলো না। আর এখন একটা চুলহীন ছেলেকে পছন্দ করে বসলো! বাদশা তো বিমূঢ়চিত্ত হয়ে পড়লো।

 

 

কী আর করা! বাদশা শেষ পর্যন্ত উঠে মেয়ের কাছে গিয়ে বলল: এই শহরে আমার তো আর মান ইজ্জত কিছু রাখলি না। তুই যেহেতু এই রাখাল বালককে পছন্দই করলি, যা তার সাথে গিয়ে বসবাস কর, প্রাসাদে ঢুকিস না। মেয়ে তাই করলো। কিছুই বললো না। রাখাল বালকের সাথে চলে গেল বাগানের ভেতর মালির বাসায়। বাসাটা যেমন ছোট্ট তেমনি নোংরা, ময়লা এবং স্যাঁতস্যাঁতে। সেখানেই সে মালির শাগরেদের সাথে জীবনযাপন করতে লাগলো। এদিকে বাদশা সাত দিনের আনন্দ উৎসবের আয়োজন করলো বড় দুই মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। চারদিকে একেবারে সাজসাজ অবস্থা, জাঁকজমকপূর্ণ সেই সাতদিন সবাই আনন্দে মেতে উঠলেও বাদশার মনে কিন্তু কোনো আনন্দ ছিল না। কেননা ছোট্ট মেয়ের কাজে বাদশা একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। এতোই ভেঙে পড়লো যে শেষ পর্যন্ত বাদশা কঠিন অসুখেই পড়ে গেল। শয্যাশায়ী হয়ে গেল বাদশা।

 

অসুস্থ বাদশার চিকিৎসার জন্য শহরের সকল ডাক্তারকে আনা হলো । কিন্তু কোনো কাজ হলো না। কোনো ডাক্তারই বাদশার রোগ শনাক্ত করতে পারলো না। যার ফলে ঠিকমতো ওষুধ দিতে পারলো না এবং রোগও সারলো না। অপরদিকে বাদশার বড় দুই জামাই অর্থাৎ দুই উজিরের ছেলে তাদের নিজ নিজ স্ত্রীকে বলে দিয়েছে তারা যেন তাদের ছোটো বোনের সাথে কোনোরকম মেলামেশা না করে। ছোটো বোন তাই কিছুই জানতে পারলো না বাবার অবস্থা সম্পর্কে।

 

 

একদিন এক ডাক্তার এলো ওই শহরে। বাদশার উজিরেরা ওই ডাক্তারকে নিয়ে গেল বাদশার চিকিৎসার জন্য। প্রাসাদে গিয়ে ডাক্তার বাদশার চেহারা সুরৎ দেখে বললো: এই রোগীর চিকিৎসা হলো শিকারের মাংস। তরতাজা পশু শিকার করে এনে বাদশাকে খাওয়ালে বাদশা আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে। বড় দুই জামাই তাড়াতাড়ি করে চলে গেল শিকারে। তারা এটাই চেয়েছিল। শিকার করে এনে বাদশাকে খাইয়ে সুস্থ করে তুলতে পারলে বাদশার কাছে তাদের সম্মান এবং মর্যাদা বাড়বে। তারা নিজেরো বলাবলি করতে লাগলো: বাদশার যেহেতু কোনো ছেলে নেই তাই যে জামাই তাড়াতাড়ি করে বাদশার জন্য শিকারের মাংস এনে দিতে পারবে সে-ই হবে বাদশার স্থলাভিষিক্ত।

 

বাদশাও আদেশ দিলো দুই জামাই যেন একসাথে শিকারে যায়। দুই জামাই তীর ধনুক নিয়ে দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে বসলো শিকারে যেতে। মালেক জামশিদ এই ঘটনা শুনে বাদশার কাছে গিয়ে বললো, আমিও তো এক জামাই। আমাকেও একটা ঘোড়া দিন, শিকারে যাই। বড় দুই জামাই ছোটো জামাইর কথা শুনে হাসলো। শেষ পর্যন্ত জামশিদকে একটা দুর্বল রোগা ঘোড়া আর ভাঙা তীর কামান দিলো শিকারে যেতে। মালেক জামশিদ কিচ্ছু না বলে সেগুলো নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলো শিকারের উদ্দেশ্যে।#

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!