বাতাসের ঘোড়া

তীব্র পিপাসায় কাতর তিনি। তার বুকটা যেন সাহারা মরুভূমি। কিসের পিপাসা? কিসের তৃষ্ণা? সে তো কেবল জিহাদের। সে তো কেবল শাহাদাতের। হ্যাঁ, এমনি তীব্রতর পিপাসা বুকে নিয়ে তিনি কেবল ছটফট করছেন। হৃদয়ে তার তুমুল তুফান। চোখের তারায় ধিকি ধিকি জ্বলে আরব মহাসাগর। কোথায়? কতদূর? আর কত অপেক্ষা এ প্রতীক্ষা বড় কষ্টকর। বড়ই যন্ত্রণার। তিনি ছুটে গেলেন প্রশান্তির মহাসাগর দয়ার নবীর (সা) কাছে। খুব মিনতির সুরে বললেন, “দেখুন দয়ার রাসূল (সা), আমাকে দেখুন। কেমন অস্থির হয়ে আছে আমার হৃদয়। হৃদয় তো নয়, যেন ধুধু পোড়া মাঠ। চৈত্রের দাবদাহ। হে রাসুল, আপনি আমার পিপাসা মেটান।”

পিপাসা! এ পিপাসা বড় কঠিন পিপাসা। এ পিপাসা বড় সুন্দর পিপাসা। কিন্তু হলে কি হবে, তার জন্য তো বয়স পূর্ণতার প্রয়োজন। রাসূল তো কেবল রাসূলই নন। তিনি একজন সেনাপতিও বটে। কত দিকে খেয়াল রাখতে হয় তাঁর। রাসূল দেখছেন পিপাসিত এক কিশোরকে। তিনি পিপাসিত বটে, কিন্তু তার পিপাসা মেটাবার মত তখন বয়স হয়নি। তবুও তার আরজির মধ্যে কোনো খাদ নেই। নেই এতটুকু কৃত্রিমতা।

রাসূল (সা) এবার ভালো করে চেয়ে দেখলেন তাকে। তারপর মৃদু হেসে কোমল কণ্ঠে বললেন, “তুমি জিহাদে যেতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু জিহাদে যাবার মত তোমার তো এখনও সেই বয়সই হয়নি!” তবুও নাছোড় তিনি। বললেন, “সামনেই উহুদ যুদ্ধ। দয়া করে এই যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিন, হে দয়ার রাসূল (সা)।”

রাসূল আবারও হাসলেন। বললেন, “না। তা হয় না। এত অল্প বয়সে যুদ্ধে যেতে চাইলেও আমি সেটার অনুমতি দিতে পারি না। তুমি ফিরে যাও।” রাসূলের (সা) দরদী কণ্ঠের সুধা পান করে তিনি ফিরে এলেন। ফিরে এলেন, কিন্তু বুকের ভেতর তৃষ্ণাটা রয়েই গেল আগের মত। মাঝে মাঝে সেটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। দিন যায়, প্রহর গড়ায়। সময়ের সাথে সাথে তার পিপাসাটাও বেড়ে যায়। কেবলই ভাবছেন, “কবে কখন আসবে আমার জন্য সেই মোহনীয় কাল? কবে?”

প্রতিটি প্রহর তো মহাকালের মত মনে হচ্ছে? না, এরপর আর বেশিদিন তাকে অপেক্ষা করতে হলো না। এসে গেল সেই প্রতীক্ষিত দিন। উহুদের পর এলো খন্দকের যুদ্ধ। উহুদের যুদ্ধে তিনি বয়স কম হবার কারণে যেতে পারেননি। রাসূল (সা) অনুমতি দেননি। কিন্তু এবার? খন্দকের যুদ্ধ। এটাও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যাবার জন্য তিনি রাসূলের (সা) অনুমতি চাইলেন। রাসূল (সা) এবার তাকে অনুমতি দিলেন। রাসূলের (সা) সম্মতি লাভের পর আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। মনে হলো তিনি এমন এক দুর্লভ সম্পদ লাভ করেছেন, যার মূল্য গোনার মত শক্তি কারো নেই।

সেই তো শুরু। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাননি তিনি। যখনই জিহাদে ডাক এসেছে, তখনই তিনি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে গেছেন। আর প্রশান্ত ও পরিতৃপ্তির সাথে বলেছেন, “আমি উপস্থিত, আমি উপস্থিত, হে দয়ার নবীজী।”

রাসূল (সা) যুদ্ধ করেছেন উনিশটি। তার মধ্যে সতেরটি যুদ্ধেই শরীক হয়েছিলেন এই দুঃসাহী মুজাহিদ। আর কি বিস্ময়কর ব্যাপার, প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি ছিলেন সমান সাহসী। মুজাহিদ তো নয়, যেন বিদ্যুতের তেজ। বাতাসের ঘোড়া! হাওয়া দু’ভাগ করে তার তরবারি থেকে কেবলই ঠিকরে বেরুচ্ছে আগুনের ফুলকি।

মূতার যুদ্ধ! যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি শেষ। তিনিও চললেন যুদ্ধের ময়দানে। সঙ্গে আছেন আরেক দুঃসাহসী মুজাহিদ। সম্পর্কে চাচা। কিন্তু তিনি দুধারী তরবারির অধিকারী। দুটোতেই সমান দক্ষ। কোনোটার চেয়ে কোনোটাই কম নয়। একটি তার যুদ্ধের তরবারি, আর অন্যটি কলম। হ্যাঁ, কবি তিনি। বিখ্যাত কবি। তার কবিতার ফলায়ও সমান বিদ্ধ হয়। কাফের, মুশরিক, আর অগণিত ইসলামের দুশমন।

নাম তার আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তিনি রাসূলের (সা) একজন উঁচুমানের সাহাবী। আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তিনিও চলেছেন মূতার যুদ্ধে। একটি মাত্র উট। সেই উটে আরোহণ করেছেন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তার সাথে একই উটের দ্বিতীয় আরোহী তারই ভাতিজা, টগবগে এক মুজাহিদ। চাচা-ভাতিজা। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। কম নয় তাদের শাহাদাতের পিপাসা। দু’জনই সমানে সমান।

উট এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত সামনের দিকে। পিঠে তার দু’জন দুঃসাহসী মুজাহিদ। চাচা নামকরা এক বিখ্যাত কবি। উটের পিঠে চলতে চলতে তিনি আবৃত্তি করছেন কবিতা। ভাতিজা তার মুগ্ধ শ্রোতা। আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার কবিতার এক জায়গায় ছিল শাহাদাতের তীব্র স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কথা। সেই অংশটুকু শুনেই কাঁদতে শুরু করলেন সাথী ভাতিজা। তিনি কাঁদছেন! ভয়ে নয়। শঙ্কায় নয়। দুর্বলতায় নয়। তবুও তিনি কাঁদছেন ক্রমাগত। কিন্তু কেন?

বুঝে ফেললেন চাচা কবি আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। তার কান্নার কারণ বুঝে ওঠার সাথে সাথেই চাচা ঝাঁকিয়ে রাগের সাথে বললেন, “ওরে ছোটলোক! আমার শাহাদাতের ভাগ্য হলে তোর ক্ষতি কি?” যেমন চাচা, তেমনি ভাতিজা! শাহাদাতের পিপাসায় দু’জনই সমান কাতর। ভাতিজার শাহাদাতের পিপাসা মেটেনি বটে, তবে মিটেছিল জীবনের পিপাসা। কারণ, তিনি ছিলেন রাসূলের (সা) একান্ত আপন। রাসূলের স্নেহে তিনি ছিলেন ধন্য।

তিনি যেমন রাসূলকে (সা) ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে, তেমনি রাসূলও (সা) তাকে মহব্বত করতেন অঢেল, অনেক। কে তিনি? কে তিনি? যিনি ছুঁতে পেরেছিলেন আল্লাহ ও রাসূলের (সা) ভালোবাসার পর্বতের চূড়া? তিনি তো আর কেউ নন- এক দুর্বিনীত দুঃসাহসী বাতাসের ঘোড়া- যায়িদ ইবন আরকাম।

হিংসুকের শাস্তি

অন্ধকারে হাতি দেখা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *