আজও কিছু লেখেনি গোলাপ। পাতায় পাতায় শূন্যতা। ফোঁটা ফোঁটা শিশিরে ভিজে আছে পাতা। মূর্ছনার মুঠোতে নতুন চিঠি। সেখানে আছে অভিমান, আছে অনুরাগ। কালও রাত জেগে চিঠি লিখেছে মূর্ছনা। একুশ রাত পেরিয়ে ভোর হয়, মূর্ছনা এসে দাঁড়ায় গোলাপের পাশে। আজ বুঝি গোলাপ একটি শব্দ হলেও লিখবে। বিদায় নেয় যে সূর্য—তার কাছে আকুতি থাকে, কাল ফিরে এসে যেন গোলাপের পাতায় প্রথম আলোটি ফেলে। সেই আলোয় মূর্ছনা পড়বে গোলাপের লেখা শব্দবাহার। অভিমান পর্বের শুরুর দুই-তিনদিন চাঁদের কাছেও সুপারিশ নিয়ে গেছিল মূর্ছনা,এক ফোঁটা চন্দ্রআলো যদি পড়ে গোলাপের পাতায়, তাহলে চোখ বুঁজেই ও পড়ে নিতে পারবে গোলাপের পঙ্ক্তিমালা। গোলাপ যেদিন নতুন ঠিকানা নিল—সেদিন ছিল চাঁদের অবসর। অন্ধকার এসে নেমেছিল ওর ব্যালকনিতে। মূর্ছনা লিখেছিল—আজ তুমি কোথায় পাবে আমার চোখের তারা? যার আলোয় ভেসে যাবে তুমি? দেখ চন্দ্রমল্লিকায় বসেছে যে ভ্রমর, ওর কালো শরীর জুড়ে অন্ধকার আজ। তোমার শুভ্র পোশাকের রঙও যেন সাত জনমের কালো রঙে ডুবিয়ে আনা। আমি পড়েছি তোমার প্রিয় লালপাড় সাদা শাড়ি। দেখতে পাচ্ছো কি সেই রঙ? অমবশ্যার সুতোয় লেখা শুধু তোমাকে হারানোর কাব্য। মূর্ছনা চিরকূটে লিখে এই কথাগুলো গোলাপের নতুন বাড়ির দরজায় রেখে এসেছিল। পরদিন গিয়ে দেখে দোপাটিতে ছেয়ে আছে গোলাপের নতুন বাড়ি। দোপাটির প্রতিটি পাপড়িতে লেখা— মূর্ছনা তোর জন্য। ঐ মুহূর্তে দরকার ছিল গোলাপের স্পর্শ। কিন্তু গোলাপ যে অন্দর মহলের কোন অতলে লুকিয়ে আছে, তাকে ছুঁতে পারে নি মূর্ছনা। দরজায় হাত বুলিয়েই ফিরে আসে ও।
ঐ রাতেই ঘরের আটজানালা খুলে বসেছিল মূর্ছনা। কেন যেন মনে হচ্ছিল গোলাপ আসবে। বাড়ির সবাই সেদিন একটু বেশি সময়ই যেন জেগে ছিল। রাত ফুরিয়ে যাচ্ছে, বাড়িতে নিস্তব্ধতা নেমে আসে না। বরং শোরগোলটাই যাচ্ছিল বেড়ে। মূর্ছনা ভাবছে সবার কাছে তো আসছে না গোলাপ। কথা হবে কেবল ওদের দুজনার। একান্ত কথোপকথন। হয়ত দুজনার ঠোঁটে উচ্চারিত হবে না কোনও শব্দ। কিন্তু মুখর থাকবে দুজনেই। মুখরিত হবে মূর্ছনার ঘর। নাহ, সেই রাতে যেন বাড়ির সবার মুখের আগল খুলে গেছে। সবাই চলে গেছিল ইতিহাসের বাড়ি। আড্ডার মধ্যমনি গোলাপ। গোলাপের সঙ্গে সবার খুনসুটি, অভিমান-অনুরাগের ফিরিস্তি। মূর্ছনা এসবের কোনওটিতেই কান পাতেনি। ও মনের খাতা খুলে বসল। পাতার পাতা অপরাজিতা, গন্ধরাজ, টগর এঁকে নিল। তারপর লিখল—দেখ তোমাকে সবাই আজ জানতে চাইছে, বুঝতে চাইছে। তুমি বাড়ি ছেড়ে যাবার পর। আর দেখ এই আমি, তোমার মূর্ছনা তোমাকে কেমন করে চিনতাম তোমার মনের পরতে পরতে। তুমি চোখ তুলে চাইতেই বুঝতাম আজ বৃষ্টিদিন। ফুচকা আর তেঁতুলে তোমার-আমার সন্ধ্যা। কখনও ঠোঁট-উল্টে বসে থাকা মানে, আজ পিৎজা হলে মন্দ হয় না। টেলিফোনে আমার অবস্থানের দূরত্ব নিয়ে অতি কৌতূহলের মানে ভাঁপা বা চিতই পিঠা। গোমরা মুখ মানেই শহরটা একটু একসঙ্গে ঘুরে দেখা। এই বায়নাটুকু কখনও কখনও রাখতে পারি নি, যখন একথা আজ ভাবছি, তখন পৃথিবীটাই যে আমার কাছে অচল মুদ্রা।
পরদিন সকালে বাড়ির সবার ঝিমুনি কাটার আগেই গোলাপের বাড়ির দরজায় মূর্ছনা। ওর জন্য অপেক্ষা করছে হলুদ গাঁদা। গাঁদা ফুলের পাপড়িতে লেখা—আমি তো গিয়েছিলাম ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে। বাড়িটা এত অন্ধকার ছিল, মন খারাপ করে ফিরে এসেছি।
কোনওভাবেই গোলাপকে একা পাওয়া যাচ্ছিল না। ওর যে এত সঙ্গী ছিল, মূর্ছনা দেখে অবাক। ও ছাড়া গোলাপের কেনও ‘আর কেউ’ থাকবে, ছিল? গোলাপ কেবলই মূর্ছনার। কিন্তু সবাই কেমন যেন গোলাপ বাগান করে নিয়েছে যার যার উঠোনে। সেখানে ঘাস ফুলই ফোটে না। অথচ গোলাপ বাগান বানিয়ে বসে আছে তারা। মূর্ছনা ভাবল, শহর ছেড়ে দূরে গেলেই বুঝি গোলাপকে নিজের মত করে পাওয়া যাবে। মূর্ছনা লেখে—তোমাকে নিয়ে কোথায় পালাই বলো তো? তোমার পিছু ছাড়ে না যে কেউ। অথচ দেখ আমি খসে পড়া তারাকেও বলেছি, ও যেন তোমার করতলে এসে লুকোয়। পূর্ণভবাকে বলেছি সামলে চল, আছড়ে পড়ো না গোলাপের গায়ে। জোনাককেও বলে রেখেছি—সে যেন বুঝে শুনে আলো দেয়, তার আলোয় তোমাকে যেন আর কেউ খুঁজে না পায়। তোমাকে কখনও কখনও চোখের পাতায় বুঁজে রাখতে ইচ্ছে করে। সেই বুঁজে রাখা চোখ নিয়ে কাটিয়ে দেব সারাটা জীবন। তুমি আর আমি। এই কথাটি লিখতে গিয়েই জানো, মনে পড়ল তোমার সুপারী বাগানের কথা। দিঘির পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো সুপারী গাছগুলোকে তোমার অতন্দ্র প্রহরী মনে হয় আমার। পাক-পেয়াদা নিয়ে তোমার রাজত্ব। মাঝখানটায় তুমি বসা। বলে যাচ্ছো কার কী করণীয়। ওদের পাতা নড়া দেখে মনে হয় তুমিও শুনে যাচ্ছো ওদের কথা। আমি কানপাতি মুগ্ধ হই, তোমাদের রসিকতায়। তাই ভাবছি কাটিয়ে আসি কয়টা দিন তোমার ঐ সুপারী রাজ্যে। তোমাকে পাব তো,আমার মত করে?
মূর্ছনা এই কথাগুলো গোলাপের বাড়ির দরজায় টাঙিয়ে দিয়ে আসতে গেছিল, গিয়ে দেখে এডমন্ডায় হলুদাভ হয়ে আছে বাড়িটা। শিশির জমেছে গোলাকার পাপড়িতে। এডমন্ডার একটিতে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়ে দেখে গোলাপ লিখে রেখেছে—ঠাণ্ডা। চাদরটা সঙ্গে রেখ। বিহবল হয়ে পড়ে মূর্ছনা। ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, তুমিই তো আমার সেই চাদর। কোথায় উড়ে গেলে? বলা হয় না। কিংবা হয়ত হয়। নিজের সঙ্গেই নিজের কথা বলা।
মূর্ছনা আজকাল ঠিক বুঝতে পারে, নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কখন যে ও গোলাপের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। সেদিনই যেমন নিজেকেই ও বলছিল—দেবদারু গাছের পাতায় ছুঁলে মনে হয়, তোমার হাত ধরে সেইদিনগুলোর মত শিল্পকলায় যাচ্ছি। আমার বেণী করা চুলে তুমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছো। মনে পড়ল জুঁই গুঁজে দিয়েছিলে একদিন। আচ্ছা বলতে পারো আমার মাঝে তুমি, তোমার মাঝে আমি কী এত মুগ্ধতা খুঁজে পেতাম? কোথা থেকে যেন গোলাপ কথা বলে ওঠে, ঠিক চাঁদটার মত। পৃথিবীর দিকে চাঁদের তাকানোর কীইবা আছে? চাঁদের সেই চড়কা বুড়িটার দিকেই বা কেন এত টান পৃথিবীর? এই প্রশ্ন জন্ম জন্মান্তরের। উত্তর খুঁজলেই বয়স বেড়ে যায়। তুমি আমার কাছে করতলের সেই কাপড়ের পুতুল হয়েই থাকছো না কেন? এক হিল্লোল বয়ে যায় মূর্ছনার শরীর জুড়ে। ও লাফিয়ে ওঠে, ইচ্ছে করে করবী গাছের মগডালে চড়ে বসে। গোলাপকে বলে—মনে পড়ে ঐ ছাপা কাপড়টার কথা? বেগুনী আর লাল রঙের ছাপা কাপড় এনে দিয়েছিলে তুমি। আমি পুতুল বানালাম পাটকাঠি আর ঐ কাপড়ে। তুমি বললে—ঠিক আমার মূর্ছনা। মূর্ছনার তালুর উপরে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মূর্ছনা সেই জলের উৎস খুঁজে পেল না।
যেমন ও আগের মত খুঁজে পায়নি গিয়ে গোলাপের অতন্ত্র প্রহরীদের। কেমন বিষণ্ন, ক্লান্ত ওরা। রাজার আদেশ পালনের কোনও উৎসাহ নেই ওদের মধ্যে। কী এক অজ্ঞাত রোগ এসে ওদের ভেতর বাসা বেঁধেছে। সুপারীর পাতার সঙ্গে পাতার যে আলাপন, সেখানে এখন মৌনতা। মৌনতাও কখনও এমন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে—মূর্ছনার জানা ছিল না।
ও একটি সুপারীর দেহে হেলান দিতে গিয়ে দেখে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে সুপারীর গা। ভেতর থেকে দম বেরিয়ে যাওয়ার মত কাশি। সুপারী গাছটি কাশতে গিয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়তে চায় মূর্ছনার কোলে। মূর্ছনা দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে সুপারী গাছটাকে। কাশতে কাশতে একসময় ওর বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে নুয়ে পড়া সুপারী গাছটি। কত দীর্ঘরাত যে সুপারী গাছটাকে কোলে নিয়ে বসেছিল মূর্ছনা মনে পড়ছে না। হয়ত নিস্তেজ সেই দেহের উপর কাগজ রেখেই ও লিখে গেছে—তোমাকে কতবার বলেছি, এভাবে পুড়িও না। নিজেকে এভাবে পোড়ালে বলো, আমাকেও কি সেই আগুন থেকে দূরে রাখতে পারবে? তোমার হাসিতে তোমারই দিঘির মাছ হয়ত ভড়কে গিয়েছিল। নিজেকে পোড়াতেই যেন তুমি ভালোবাসতে। এখন কী ভাবি জানো? যে ভালবাসাটুকু দিলে, দগ্ধতায় আনা যায় হাওড়ের প্লাবন। অতোটুকু তোমার জন্য নিজেকে দিতে পারি নি। নিজেকে নিয়েই কিসব মিথ্যে দৌঁড়ে গিয়েছি, যাচ্ছি। কখন যে তুমি, তোমাকে ছেড়ে আমি চলে এসেছি, কিংবা তুমি চলে গেছো আমার চোখের সীমান্তের বাইরে, চড়ুই পাখিটা এত আগাম খবর দেয়। এই খবর তো দিল না। তাই আজকাল নিম-চড়ুই হয়েছে আমার সতীন। ফিরে এলাম, তোমার রাজ্য থেকে। যত রেখে আসছি, তোমার সাম্রাজ্য ততই ওরা যেন আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। বাঁশ বাগানের হঠাঁৎ কেন যে আমার কোঁকড়ানো চুলটাকে পছন্দ হল। সেই বেগুনী-লাল ছাপার জামাটাকে তোমার লোহার বেঞ্চিটার। ফিরতে ফিরতে পথ কমে আসে জানতাম। কিন্তু কী যে এক অনন্ত পথে আমি ফিরছিলাম জানি না। আচ্ছা একা একা এতটা পথ কখনও আমাকে যেতে দিয়েছো তুমি? সেই ধূঁ ধূঁ চর, সবুজ মাঠ কিংবা কংক্রিটের শহরে? তোমার এই বদলে যাওয়া কেন?
ফিরে এসে মূর্ছনা গোলাপের দরজার পাদদেশে লিখে রেখে এসেছিল এই কথাগুলো। ভেবেছিল পরদিনই গোলাপের কাছ থেকে উত্তর আসবে। একুশটা দিন গোলাপের কোনও সাড়া নেই। চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, গাঁদা, এডমন্ডা, বাগানবিলাস সবার রঙ অভিমানের। মূর্ছনা ওদের ছুঁলেই কেমন কুঁকড়ে যায় ওরা। গত কয়েকদিন তাই না ছুঁয়ে দূরে থেকেই বাড়িটা দেখে ফিরে গিয়েছে মূর্ছনা। কিন্তু আজ পণ করেছে—উত্তর না নিয়ে সে ফিরবে না। মূর্ছনা কড়া নেড়ে যেতে থাকে গোলাপের দরজায়—বাবা, বাবা। দেখ আমার তোলা তোমার রাজ্যের ছবিটা কত বড় করে এসেছে পত্রিকায়। গোলাপ অভিমানের কোন অতল থেকে কথা বলে উঠল—প্রেসক্রিপশনটা হারিয়ে গেছে খুঁজে পাচ্ছি না। এই বাড়িতেও যে একটা প্রহরী দরকার ব্যাটা!
–