তেজগাঁ ষ্টেশনে ট্রেন থামতেই নেমে পড়ে সহেলি। দশ বছরের মেয়ে শাবনূর বেশ চটপট। কাঁধে ঝুলানো ভারী ব্যাগ নিয়ে আগেই বেরিয়ে গেছে ভিড় ঠেলেঠুলে । ছেলেটি একেবারে বুকের সাথে লেপ্টে আছে । সহেলি ঠিক মত পা ফেলতে পারছে না। এত মানুষ এই ষ্টেশনে ! গিজগিজে ভিড়ে ঘাম গন্ধে বমি আসে ওর । তার উপর দুঃখে বুকটি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে আছে। আল্লাহ কি গরীবদের জন্যে কেবল দুঃখই রাখছে? ক্ষ্যামতা নাই আল্লার যাগোরা তিনবেলা ফেলাইয়া ছড়াইয়া খাইয়া পইরা হাউসে কান্দে হাসে তাগোরের জন্য একটু দুঃখ দিবারার !
ঘোমটা কমিয়ে ভিড়ের ভারে ঠোক্কর ঠোক্কর খেতে খেতে সহেলি এগিয়ে যায়। গন্ধে পেট ঘুলিয়ে যাচ্ছে। ওয়াক থুঃ । কে একজন তার গা ঘেঁষে চলে যায়। একজন আবার হুমড়ি খেয়ে ঠিক গায়ের উপর এসে পড়ে । সহেলি ভাবে ভিড়ে বোধহয় বেসামাল ঘটছে এসব। কিন্তু লোকটি সরে যাওয়ার আগে এমন একটি বিশ্রী কথা বলে যে সহেলির মুখের ভেতরটা নিম তেতো হয়ে যায়।
গ্রাম হলে সে কড়া করে উত্তর দিয়ে দিত শুয়োরের বাচ্চাটাকে। এমনিতেই মন ভাল নাই তার উপর হাঙ্গামা করতে ইচ্ছা করল না সহেলির। ওদিকে মেয়েটা আগে আগে চলে গেছে বলে দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। এই ষ্টেশন থেকে নাকি অহরহ মেয়ে পাচার হয়। পুলিশি পাহারা কম থাকে আর যারা থাকে তারাও দেখে না দেখার ভান করে বলে এখানে পাচাকারীদের পোয়াবারো।
ভিড় ঠেলে বেরিয়ে চোখ টেরিয়ে মেয়েকে বকা দেয়। ভয় দেখায় হারিয়ে যাওয়ার। মেয়েধরাদের কথা বলে মেয়েকে এবার সাথে সাথে রাখে। মেয়ে হাসে। সে নাকি মুখস্থ করে রেখেছে সবকিছু। এবার বৈশাখে ঢাকা এসেছিল ওরা। সেদিন ছিল পয়লা বৈশাখ । মোবাইলে সহেলিকে বলেছিল হারুন “তুই সোজা চইলে আইবি তেজগাঁ ইশটিশনে। আর শুন কের সাথে কথা কইছ না। নাইমা হলিক্রশ কলেজের শরীল ঘেইশ্যা মঞ্জুকাকার হোটেলে চা টা খাইয়া বইসা থাকবি। কাজ শ্যাষে আমি আইয়া পড়বাম ।”
চৈত্রের শেষ দিন সকালেই ট্রেনে উঠে পড়েছিল সহেলিরা। শাবনূর খুশীতে থই থই। পাশের বাসার লায়লাখালার ঘরে টিভি দেখে দেখে শাবনূরের মাথায় ঢাকা শহর ঢুকে গেছে। সে কিছুতেই আর গাঁও গেরামে থাকতে চায়না। হারুন বাড়ি এলেই বায়না করে , বাপ তুই কবে ঢাকায় নিবি ? আমরা ঢাকা যাইয়াম।” সহেলি মেয়ের তড়বর মুখকে ঠোনা দিয়ে বন্ধ করে , আমরার ঢাহা গেলে তোর দাদা দাদিকে দেখফার ক্যালা ? বাতাস খায়া এতহানি বড় হইছস নাকি।” শাবনূর তাও থামে না। হারুন বলে “এই তো যাইয়াম যাইয়াম। আয় বাড়বার ভাও করতাছি । তোরের ব্যাকটিতে ঢাহায় লইবাম।”
বড় ব্রিজ পার হয়ে এবার ওরা তেজগাঁ কলেজের সামনে দিয়ে গলি খুঁজে রাজাবাজার বস্তিতে রওনা হয়। রিকশাওয়ালা , ফেরিওয়ালা বেশির ভাগ মানুষই ময়মনসিং থেকে আসা। তারাই সাহায্য করে। রোদ্দুর মাথায় বস্তিতে পৌঁছে দেখে সাজেদাবু তখন বাসায় নাই। কাজের বাড়ি ধানমন্ডি। বুবুর জামাই রিকশা চালায়। সেইই সামনের দোকান থেকে ঠান্ডাই আর পাউরুটি চিপস কিনে আনে। সামান্য ফাঁকা জায়গা রেখে রেখে বস্তির ঘরগুলো বানানো। প্রচুর ভাড়া গুনতে হয় বলে একেক ঘরে আট দশজন করে থাকে খোলা গ্রামের মানুষরা । থাকা তো নয় কোনো রকমে রাত পার করে বেঁচে থাকা।
সাজেদাবুর ঘরের সামনে ছোটখাটো ভিড় জমে যায় । একজন দুজন করে মানুষ সহেলিদের ঘিরে দুঃখের কথা বলতে শুরু করে। বুড়ো মত একজন বলে, গরীবের ভাগ্য আল্লায় নিজের হাতে লেখছে। এই দুন্নিয়া চালাইবার লাইগ্যা গরীবের রক্ত মাংস হাড় নিত্যই দরকার। তাই ত ঝড় বৃষ্টি কিছু নাই পাতরের বাঘটা ঠিক তোমার স্বামীর গতরের উপর ভাইঙ্গে পড়ল! হে গরীব পাতরের বাঘও জানে তা।” একটু পরেই চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে সাজেদাবু এসে পড়ে। সহেলিও কাঁদে । কিন্তু দম পায়না কাঁদার । বুড়ি শাশুড়ি আসার সময় বলে দিয়েছে,“ ও বউ আমরার কান্দন দেহার লোক কই? কান্দনে তো খাওন জুই্টপে না। ছেড়াছেড়ি বাঁচানোর লাইগপে যে বউ । যাও ঢাহায় চইলা যাও। আমরার বুড়োবুড়ি টুকায়বাছায়ে কোনো হরমে বাচুম নে মা।”
কাজ ঠিক করেই রাখছে সাজেদাবু। সকাল থেকে পাঁচ বাড়ি। ঘর মোছা, থালাবাসন কাপড় ধোয়া, তরকারি কাটাকুটি সব সংসারের কাজ । কাল থেকে বস্তির এক ঘরে চার জনের সাথে শেয়ার করে থাকবে সহেলি। সব কিছু এই চারদিনের মধ্যে ঠিক করে ফেলছে বু । গরীবের পেট বড় পেট। সঞ্চয় যে কিছুই থাকে না। দুদিন খাবার না পেলেই খাই খাই শুরু করে। আর গরীব রে গরীব ছাড়া বুঝবে কে ! দেকপে কে !
রাতে সাজেদাবুর কাছে সহেলি তার মনের গোপন ইচ্ছাটি জানায়। “বুবু আমগোরে কি সেই বাঘটা দেখাইবা একবার ?” সাজেদাবু জানায় “ হায় হায় বাঘটা যে অইদিন সকালেই সরায়ালাইছে রে বুন। কইত্থে দেখাইয়াম তরে ?” ছেলে হাবিবের পিঠে হাত রাখে সহেলি “লগে নাকি একটি বাঘের বাচ্চাও আছিল ?” “ হ আছিল তো। ফনেরার গো দেহাইবার লাইগা সুন্দর্য করছিল সরকারে। সেই পাতরের বাঘ খাইয়ালছে তর সোয়ামীরে।” “একবার যাইতে মন চায় গো বু। দেখবারের চাই সেই কারবালার প্যান্তর।” “লমুনে তোরে। কাল হারুনের মালিকের লগে তুই কথা কইয়া কিছু টাহা চাইয়া লছ। হেই সময় দেহাইমুনেরে। অর সামনে একডা ফুয়ারা আছে। ঝরঝর কইরা পানি আহে মাটির নীচ থেইকে । মনে কয় আবে জমজমের পানি ঝইরতাছে। বড় সুন্দর্য লাগে দেইখতে। এহন ঘুমা বুন । আজানের লগে উঠতে হইবো।”
সাজেদাবু ঘুমায়। একটুকরো ঘরে স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়ে অন্য মানুষদের নিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস নাই সহেলির। তার বড় লজ্জা লাগে। হারুনের কাছে শুনেছে এইরকম করেই বস্তির ঘরে থাকে গ্রাম থেকে আসা অভাবি খেটে খাওয়া মানুষগুলো। দড়িতে চাদর না হয় শাড়ি টাঙ্গিয়ে যে সামান্য ব্যবধান করা হয় তাতে চোখের আড়াল হলেও স্বামী স্ত্রীর জৈবিক চাহিদার ঘনঘটা সবই বোঝা যায়। প্রতিটি নিঃশ্বাস, শরীরি বিক্ষোভ, কাতরতা, সন্তুষ্টি, যৌন প্রলাপ শুনে ফেলে সবাই। এই জন্যে হারুন কারো ঘরে থাকত না। সব সময় বলত, “আগে নিজে কামাই হইরা ঘর লইয়াম পরে তোগোরে আনবাম । ঢাহায় আমরার কুত্তার লাহান জেবন রে বউ। সব কিছু ফকফকা। লাজ লজ্জা কিছছু নাই।” হারুন তাই ঘুমাত যে দোকানে ঠেলা টানত সেই দোকানের সামনের রাস্তায়। কেন যে সেদিন সোনার গাঁ হোটেলের সামনের বাঘের পায়ের কাছে শুতে গেছিল! তবে কি সেদিন জ্যোৎস্নাধারায় ভেসে গেছিল চারপাশ ? হারুন খুব দুধজ্যোৎস্না ভালবাসত। আকাশ ছেয়ে জ্যোৎস্না নামলেই বলত, বউ ল গাঙ পার যাই। নতুন গান বানছি । হুনবি চল।” সহেলিকে না পেয়ে সে কি পাথরের বাঘিনীকে শোনাতে চেয়েছিল তার রচিত গান ? অই গানেই কি পাথরের বাঘিনী জেগে ওঠেছিল আজন্মের ক্ষুধা নিয়ে? মরার আগে কি গান বানছিল তার আলাভোলা গাতক খসম তা আর কোনোদিন জানা যাবে না। সহেলির চোখ ভরে ওঠে জলে।
নাকি সেদিন দোকানের সামনের জায়গাটা দখল করে নিয়েছিল কোন রাত কামাইয়ের নারী? হারুন কত যে গল্প করেছে এইসব নারীদের। বসুন্ধরা নামে বড়লোকদের মার্কেটের সামনের ড্রাইভাররা এই রাত কামাই নারীদের গল্প করে রঙ্গ তামাশা করে। এরা শরীর বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়। বাড়ি টাকা পাঠায়। পুরুষরা বিক্রি করে শরীরেরর শক্তি আর মহিলারা ইজ্জত বিক্রি করে বেঁচে থাকে। অন্যদের বাঁচায় । খুব মায়া ছিল এদের জন্যে হারুনের মনে। গানে গানে এই জবালা মায়েদের কাহিনী সে শোনাত গ্রামের উৎসব অনুষ্ঠানে । সহেলিকে বলত, বউ এদেরগো কহনো হেলাঘেন্না করিস না। শইল হচ্ছে মন্দির মসজিদের মত পবিত্র। কত অকাম কুকামের মানুষ সেহানে যায় তাতে কি কোন ক্ষতি হয় মন্দির মসজিদের ?” একটুকরো দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহেলি ঘুমাতে চেষ্টা করে।
পরিষ্কার রুচির মানুষ ছিল হারুন। কত স্বপ্ন ছিল মানুষটার । ইচ্ছা ছিল মেয়েকে পড়ালেখা শেখানোর। শাবনূর চার কেলাসে পড়ে । টিচাররা বলে বড় খাঁটি মাথার মেয়ে। “তোমরার কষ্ট হইলেও মেয়েকে পড়াও হারুন মিয়া। এই সরকারে মাইয়াদের জন্যে অনেক সুবিদা দিছে। মাইয়ারা এহন ছাওয়ালদের চাইতে ভাল আয় করে সংসার দেখে।” একটি বাচ্চাই রাখতে চেয়েছিল হারুন । “ ছেড়া দিয়া কি করাম! আমারার ছেড়ি সব করব। ক্যারে বংগবন্ধুর নাম রাইখছে না শেখের বেটি হাসিনা। আমরার নবীজির তো ছেড়া আছিল না । তাতে কি হইছে।” বুড়ি মাকে সে বুঝাতো, ছেড়ি হইছে ঘরের লক্ষ্মী। নাতি নাতি কইরা গলা শুকাস না মা।” তবু ছেলেটা হয়ে গেল। ছেলেকেও পড়াবে বলে গভির রাতে তরিতরকারির ট্রাক থেকে মাল খালাসের কাজ নিয়েছিল হারুন। ঘুমাতে সে সময়ই পেত খুব কম। হেসে বলত ঘুমানো মানেই হল মরে যাওয়া। আমি মরতে চাই না।” তবে কি পাথরের বাঘ মৃত্যু হয়ে হারুনকে ডেকে নিয়েছিল অই রাতে ?
কাজ শেষে সোনার গাঁ হোটেলের সামনে আসে সহেলি । দোকানের এক কর্মচারী ওদেরকে নিয়ে আসে বাঘমূর্তির জায়গায়। হন্তারক বাঘিনিটি নেই। মন খারাপ করে শাবনূর। ছেলে হাবিব আঙ্গুল চুষতে চুষতে চিকেন ফ্রাইয়ের বিজ্ঞাপন দেখে লোভে লালা ফেলে। “খিদে লাইগছে মা, ওমা।” সহেলি মাথা উঁচু করে দেখে সাঁই সাঁই ছোট বড় গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। কেবল ছুটে যাচ্ছে । কই যায় সবাই? এই শহরে কি কোন গাঙ আছে ? তার পাড়ে নাবি ঘাসের বনে কি জ্যোৎস্না নামে ? এরাও কি হারুনের মত গান গায় জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মেখে মেখে ?
চিপসের প্যাকেট হাতে দিয়ে শাবনূর ভাইকে জানায়, এইহানে বাঘ আছিল বুঝছস ভাইডি। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। জাতীয় পশু। আমরার বাপকে খাইয়ালছে। তুই এহন ক দেহি ভাই, যে আস্তা মানুষ খাইয়ালে হে কি করে জাতীয় পশু হইবারের পারে ?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।