Categories রূপকথা

বাঘ ও মানুষের কাহিনী — তিব্বতের লোককাহিনী

বনের মধ্যে এক বাঘিনী ও এক বাঘ থাকত । অনেক দিন পর তাদের তিনটি বাচ্চা হল। ভারি সুন্দর আর নাদুস-নুদুস বাচ্চাগুলো। কিন্তু তাদের বাবা হয়ে গিয়েছিল বুড়ো। দিন দিন তার শরীরও খারাপ হয়ে যেতে লাগল। বাঘ বুঝতে পারল তার মৃত্যুর আর দেরি নেই। তখন সে বাঘিনীকে সামনে রেখে বাচ্চাদের বলল, “শোন আমার ছানাপোনারা! মনে রাখিস তোরা হলি রাজার জাত । বনের রাজা । বন হল বাঘের নির্ভয়ে চলফেরার রাজ্য। ইচ্ছে মতো সে পশু শিকার করে, খায়। কেউ তাকে বাধা দেয়ার নেই। কিন্তু একজনকে তোরা এড়িয়ে চলবি । সে একাই এক শ’, বাঘের চেয়ে শক্তিমান এবং ধূর্ত। তার নাম মানুষ । মৃত্যুর আগে আমি তোদের সাবধান করে দিচ্ছি, খবরদার মানুষকে তোরা এড়িয়ে চলবি ৷ কোনো অবস্থাতেই তোরা মানুষ শিকার করতে যাস নে, মারতে যাবি নে। তারা খুব অসহায় কিন্তু ভীষণ চালাক ।

এই বলে বাঘ পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল এবং মারা গেল। বাঘের তিনটি বাচ্চা বাবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো এবং প্রতিজ্ঞা করল কোনোদিন তারা মানুষ শিকার করবে না। বড় ভাই তার বাবার বাধ্য ছেলে, কাজেই সে বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখে দিল । তারা বনের হরিণ, শুয়োরছানা ও অন্যান্য প্রাণী শিকার করে খেতে লাগল। যখনই তারা মানুষের গন্ধ পায় বা দূর থেকে দেখে অমনি তারা বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে বা পালিয়ে যায় । কিন্তু ছোট ভাইটি ছিল খুব স্বাধীনচেতা এবং অত্যন্ত কৌতুহলী । আস্তে আস্তে সে বড় হয়ে উঠল এবং বাবার নিষেধ তাকে খুব পীড়া দিতে লাগল। সে ভাবতে লাগল, ‘কেন আমি মানুষ মারতে পারব না? আমার ইচ্ছে হলে তাকে হত্যা করব না? বাবা বলেছে মানুষ হল সবচেয়ে অসহায় প্রাণী ।

তার হাত-পা দিয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে পারবে না। তার নখ ধারাল নয়, কামড় দিয়ে কোনো প্রাণীকে কাবু করতে পারে না, আমাদের মতো শক্ত দাতও নেই। আমি তার উপর এমন বেগে ঝাপিয়ে পড়ব এবং এমন নৃশংসভাবে জাপটে ধরব যে সে টু শব্দটি করার সুযোগ পাবে না। তাহলে কেন আমি তাকে হত্যা করব না, বা তার মাংস খেতে পারব না? এরকম বোকামি করে ও গর্ব ভরে সে নিজের এলাকা ছেড়ে মানুষের খোজে বেরিয়ে পড়ল। ওর বড় দু’ ভাই ও মা তাকে পই পই করে নিষেধ করল। তাদের মরা বাপের প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিল। কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না। শেষে একদিন সকালে সবার অনুরোধ ও পরামর্শ অবহেলা করে সে মানুষ শিকারে বেরিয়ে পড়ল । বনের ভেতর থেকে সে খুব একটা দূরে যেতেও পারে নি। সামনে পড়ল এক বুড়ো ষাড়। হাড় জিরজিরে সেই ষাড় বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল প্রচুর বোঝা । একা একা। পিঠের বোঝা দড়ি দিয়ে বাধা। বাঘটা আগে কখনও এমন হাড় জিরজিরে ষাড় দেখে নি।

কৌতুহলী হয়ে সে ষাড়ের কাছে গিয়ে বলল, দয়া করে বলো তো তুমি কে? তা তুমি নিশ্চয়ই মানুষ নও। ষাড় বলল, তা হব কেন? এই অধমের নাম বুড়ো ষাড়। তরুণ বাঘ বলল, তাই বলো! তাহলে তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারবে মানুষ কেমনতরো জীব। আমি তাকে হত্যা করে খাবার জন্য খুঁজে মরছি।’ বুড়ো ষাড় বলল, “হে তরুণ বাঘ, মানুষ থেকে সাবধান! মানুষ ভীষণ বিপজ্জনক ও চালাক। আমার দিকে তাকিয়েও তুমি বুঝতে পারছ না? সেই যুবক বয়স থেকে আমি মানুষের ফাইফরমাস খেটে যাচ্ছি। আমি তার চাকর । এক সময় আমি এর চেয়ে বেশি বোঝা বইতে পারতাম। আমার এখনকার অবস্থা দেখে অনুমান করে নাও । বহু বছর ধরে আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার কাজ করে যাচ্ছি। আমি যখন তাগড়া ছিলাম তখন সে আমাকে ভালো ভালো খাবার দিত, যত্ন করত, প্রশংসাও করত। কিন্তু বুড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবহার গেল পালটে ।

সে আমাকে বনের মধ্যে ছেড়ে দিতে লাগল খাবার খুঁজে নেয়ার জন্য। আমি কি আর আগের মতো তাড়াতাড়ি গো-গ্রাসে গিলতে পারি। আমার দাত গেছে পড়ে, শক্তি গেছে কমে। আর ফেরার পথে এক পিঠ বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সে আগে আগে ঘরে চলে গেছে। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, খবরদার ওকে মারতে যেও না। সে ভীষণ ধূর্ত ও বিপজ্জনক। শেষে তুমি নিজেই ফেসে যাবে।’ কিন্তু তরুণ বাঘ বুড়ো ষাড়ের পরামর্শ ও সাবধানবাণীতে কান না দিয়ে হাসতে হাসতে নিজের পথে চলতে শুরু করল । এসময় সে বনপ্রান্তে এক হাতির দেখা পেল । হাতি সেখানে ঘাস ও লতাপাতা খাচ্ছিল । বয়সের ভারে তার গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে, ছোট ছোট চোখ-দুটির দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। বিশাল কুলোর মতো তার কানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে অনেক। হাতির মাহুত সেখানে অঙ্কুশ দিয়ে কত আঘাতই না করেছে। তরুণ বাঘ আগে কখনও হাতি দেখে নি।

সে অবাক হয়ে হাতির দিকে তাকিয়ে বলল, দয়া করে বলো তো তুমি কে? তা তুমি নিশ্চয়ই মানুষ নও।” হাতি বলল, তা হব কেন? এই ক্লান্ত, জীর্ণ বুড়ো অধমের নাম হাতি।’ তরুণ বাঘ বলল, তাই বলো। তাহলে তুমি বলতে পারবে মানুষ কেমনতরো জীব। আমি তাকে মেরে খাবার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছি।’ বুড়ো হাতি লতাপাতা চিবানো বন্ধ করে শুড় তুলল। ওর পিঠের ওপর একটা শালিক বসেছিল, সেও হাতির কথা শোনার জন্য উদগ্রীব হল । বুড়ো বলল, “হে তরুণ বাঘ, মানুষ থেকে সাবধান। মানুষ হল প্রাণিজগতে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও চতুর। আমার দিকে ভালো করে দেখো। আমি যদিও বনের প্রভু এবং সবচেয়ে বড় প্রাণী তবুও মানুষের হাত থেকে রেহাই পাই নি। সে আমাকে পোষ মানতে বাধ্য করেছে, শিক্ষা দিয়েছে।

তারপর বহু বছর তার ভৃত্য হয়ে আমি খেটে গেছি। সে আমার পিঠে গদি এঁটে বসে থাকে। লোহার অঙ্কুশ দিয়ে আমার মাথা ও কানের কুলো করেছে ক্ষতবিক্ষত। আমি যখন যুবক ও শক্তিমান ছিলাম সে আমার কদর করত খুব। দিনে যত খেতে পারতাম তত খেতে দিত। আমাকে প্রতিদিন একজন চাকর স্নান করাত, আমার যাবতীয় অভাব সে মেটাত। আস্তে আস্তে আমি বুড়ো হয়ে যেতে লাগলাম, আর আমার প্রতি যত্নও কমতে লাগল। শেষে ভারি কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়লে আমার মনিব আমাকে জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। এখন আমাকে নিজের খাবার নিজেকে জোগাড় করতে হয় । কাজেই আমার কথা যদি ধরে তবে বলি, মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে যেও না, যদি যাও তাহলে পরিণামে তোমার ভালো হবে না এই বলে দিলাম।” শুনে তরুণ বাঘ অবজ্ঞার হাসি হেসে আবার মানুষের খোজে চলল। চলতে চলতে গাছের গোড়ায় আঁচড় মেরে নখের ধার পরীক্ষা করে নিল ।

অকারণে একটা গর্জন মেরে বনভূমি কাপিয়ে তুলল। এভাবে কিছুদূর যেতেই সে গাছ কাটার শব্দ শুনতে পেল । আস্তে আস্তে সেই শব্দ আরও এগিয়ে আসতে লাগল তার হাটার সঙ্গে সঙ্গে । তারপর সে দেখতে পেল এক কাঠুরেকে। তরুণ বাঘ তাকে ভালো করে দেখল, কারণ এমন জীব সে আগে কখনও দেখে নি। নিৰ্ভয়ে সে তার কাছে গিয়ে বলল, বলো তো তুমি কে? দু’ পায়ের উপর দাড়িয়ে আছ, কেমনতরো জীব তুমি? ’কেমন বোকার হদ তুমি বাঘ? তুমি দেখতে পাচ্ছ না আমি মানুষ? তরুণ বাঘ বলল, ‘ও, তুমিই তাহলে মানুষ? কী সৌভাগ্য আমার! আর কী দুর্ভাগ্য তোমার! তোমার মতো একজনকেই আমি খুঁজছি খাওয়ার জন্য। আহ, চমৎকার হবে তোমাকে খেতে । নাও, এবার তৈরি হও তুমি আমার আহারের জন্য ।” শুনে কাঠুরের সে কী হাসি, আমাকে মারবে আর খাবে? তুমি কি জানো না যে মানুষ খুব বুদ্ধিমান ও ধূর্ত প্রাণী? বাঘের পক্ষে মানুষকে খাওয়া কত কঠিন তা কখনও শোনো নি? তাহলে শোনো। আমার সঙ্গে এসো।

এই একটু সামনে গেলেই এমন কিছু তুমি দেখতে পাবে যা তুমি আগে কখনও দেখো নি, যা শুধু মানুষই জানে। আর তা দেখাটা তোমার জন্য শিক্ষণীয়ও হবে । চলো।’ তরুণ বাঘ তখন ভাবল যে এটা বেশ ভালো একটা প্রস্তাব । কাজেই সে কাঠুরেকে অনুসরণ করে তার পিছু পিছু চলল। চলতে চলতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কাঠুরের ঘরের সামনে গিয়ে থামল। তরুণ বাঘ দেখল মোটা মোটা কাঠের গুড়ি ও তক্তা দিয়ে বানানো একখানা ঘর। তবে সে কী জিনিস তা সে জানত না । দেখে তরুণ বাঘ বলল, ওটা কি?’ ‘এর নাম ঘর। আমি তোমাকে দেখাচ্ছি কী করে আমি এই ঘরা বানিয়েছি’-এই বলে কাঠুরে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে খিল এটে দিল । ঘরের ভেতর থেকে কাঠুরে বলল, ‘এখন দেখো মানুষের তুলনায় তোমরা কত বোকা । তোমরা বোকার মতো গুহার মধ্যে থাকো, অথবা গর্তে। ঝড়, বৃষ্টি, শীত ও গরমের হাত থেকে রেহাই পাও না।

তোমার এত শক্তি থাকতেও তুমি আমার মতো এরকম একটা ঘর কখনও বানাতে পার না, পারবেও না। আর আমি নিজের হাতে ঘর বানিয়ে তার মধ্যে থাকি, ঝড়বাদলের কোনো ভয় নেই, শীত ঢুকতে পারে না, এমনকি বনের হিংস পশুরাও আমাকে কিছু করতে পারে না।’ শুনে তরুণ বাঘ রেগে কাই। গর্জে উঠে বলল, “তোমার মতো বদখত দু’ পেয়ে মানুষের এই ঘরে থাকার কোনো অধিকার নেই। তোমার না আছে শক্ত থাবা, না আছে তীক্ষ শক্ত নখ। আর দেখো, আমার গায়ে কী চমৎকার ডোরা কাটা দাগ, আমার দাঁত শক্ত ও থাবা কঠিন, আর কি চমৎকার লম্বা লেজ।

আমি তোমার চেয়ে বেশি যোগ্য এই ঘরে থাকার, আমার দাবিও বেশি। এক্ষুণি বেরিয়ে এসো ঘর থেকে এবং তোমার ঘর আমাকে দিয়ে দাও, এই মুহুর্তে।’ লোকটি ঘর থেকে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি বেরিয়ে আসছি। এই বলে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল এবং বাঘের ঢোকার জন্য দরজা খুলে রাখল। তরুণ বাঘও অমনি টুক করে ঢুকে পড়ল । মানুষের ঘর বিনা যুদ্ধে দখল করার গর্বে বাঘ মহাখুশি । সে বলল, “এখন আমার দিকে তাকিয়ে বলো তো তোমার ঘরে আমাকে কেমন মানিয়েছে? লোকটি বলল, সত্যিই, খুব মানিয়েছে।’ বলতে বলতে লোকটি ঘরের দরজা ঝট করে বাইরের থেকে বন্ধ করে দিয়ে হুড়কো বাড়ি দিয়ে খিল এটে দিল। তারপর কুড়োলটা তুলে নিয়ে চলে গেল বাঘটাকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় মরার সময় ও সুযোগ দিয়ে।

আরো পড়তে পারেন...

একটা আষাঢ়ে গল্প-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-১ম অংশ

দূর সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ । সেখানে কেবল তাসের সাহেব , তাসের বিবি , টেক্কা…

একটা আষাঢ়ে গল্প-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-২য় অংশ

এমনি তো কিছুকাল যায় । কিন্তু এই তিনটে বিদেশী যুবক কোনো নিয়মের মধ্যেই ধরা দেয়…

দূরবর্তী এক নদীর উপকথা

এই সকালে কুয়ালালামপুর শহরটা নরম রোদের আলোয় ডুবে রয়েছে। সেই সঙ্গে মৃদুমন্দ বাতাসও বইছে। রোদ…