বাঘের আত্নকাহিনী

খ্রিস্টের জন্মের খোঁজ বাদার বাঘ রাখে না। খ্রিস্টের জন্মের আগেও সে গরানের শ্বাসমূলকে সচকিত করে নিঃসাড়ে নদীর জলে নেমে ওপারে কোনো হতভাগ্যের মাংসে দাঁত বসিয়েছে। বালথাজার, মেলকিওর আর গাসপার যখন বেতলেহেমের রাস্তা ভুলে হাঁ করে আকাশের তারা দেখছিলো, তখনও বাঘ শেষ রাতের অন্ধকারে নদীর ওপর ঝুঁকে পড়া গাছের ছায়া ঠেলে অনায়াসে চড়াও হয়েছে এক তরুণ চিত্রলের ওপর। ক্যালেণ্ডার বাঘের কাছে বাহুল্য। বংশ পরম্পরায় বাদার বুক চিরে তরতর করে বয়ে চলা মন্থরা সব নদী পার হতে হতে কারা দুই হাজার তেরোবার খ্রিস্টীয় ক‌্যালেণ্ডারের পাতা ওল্টালো, সে খবর রাখার ফুরসত বাদার বাঘের নেই। পৌষের রাতে কনকনে ঠাণ্ডা জল ঠেলার শখ বাঘের ছিলো না। কিন্তু পেটের দায়ে তাকে নামতেই হয়। নদীর বুক চিরে এখন মালবাহী জাহাজ চলে সারাদিন সারারাত। কুয়াশার ভেতর সেগুলোর একটিমাত্র জ্বলন্ত চোখ নিভে যায়, হারিয়ে গিয়ে একটু পর পর মা-হারা হরিণবাছুরের মতো ভেঁপু বাজিয়ে একে অন্যকে ডাকে তারা।

জাহাজগুলোর রকমসকম দেখে মনে হয়, এই বুঝি একে অন্যের সাথে বাড়ি খেয়ে কাত হয়ে পড়ে গর্ভের সবকিছু নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে বনটাকে বিষিয়ে তুলবে তারা। নদীর এপারে হরিণের দল সেই কুয়াশাচর জলযানের রক্তচক্ষু আর আর্তধ্বনি একদম বরদাশত করতে পারেনি। তাদের করণীয় একটাই, সেটাই করেছে তারা, একের পর এক খাল আর খাঁড়ি টপকে সব সরে গেছে আরেক বাঘের তালুকে। বাঘের চেয়ে বড় তালুকদার আর কেউ বাদায় নেই। এক বাঘের তালুকে আরেক বাঘ ঢুকে পড়লে পরিণতির গায়ে রক্তের ছিটা লাগতে বাধ্য। হরিণ যেমন নাচতে নাচতে এক বাঘের তালুক থেকে আরেক বাঘের তালুকে সটকে পড়তে পারে, বাঘ তেমনটা পারে না। কিছুদিন পর পর নিজেই পিশু করে নিজের তালুকের অলঙ্ঘ্য সীমানা দাগিয়ে রাখে সে, তার ওপারে গেলেই অন্য কোনো বিটকেল বাঘের সঙ্গে মরণপণ কুস্তির খাটনি বাধ্যতামূলক।

নিজের তালুকের হরিণগুলো এভাবে শেয়ারবাজারের বখরার মতো চোখের সামনে লোকসান হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে বাঘ সাঁতরে নদী পার হয়। নদীর ওপারে মানুষের তালুক শুরু। ওপারে যে হরিণ নেই, সে কথা বাঘ জানে। কিন্তু আর যা-ই থাক, ঘাড় মটকে আজ সে একটা কিছু খাবেই খাবে। হপ্তাখানেক ধরে পেটে কিছু পড়েনি তার। ভুখা তালুকদারের মতো মরিয়া জীব আর কীই বা হতে পারে? পৌষের হিমে স্নাত নদীখানা পেরিয়ে বাঘ গা ঝাড়া দিয়ে শরীর থেকে জল ঝরায়, তারপর মানুষের চলাচলে প্রশস্ত হওয়া পথ ধরে চুপচাপ চলতে থাকে। কিছুদূর গেলেই গ্রাম পড়বে, গন্ধের সূত্র ধরে টের পায় সে। মানুষের গায়ের নোনতা গন্ধ ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকে পথের উজানে, বাঘ সে গন্ধের আঁচল ধরে চুপচাপ হাঁটে। নদীর শরীর বেয়ে বয়ে আসা হঠাৎ বাতাসে আশপাশে খাটো ঝোপঝাড় শিউরে ওঠে, বাঘের পায়ের শব্দ তাদের চেয়েও মৃদু।

হঠাৎ করেই বনের পরিচয় মুছে গিয়ে গ্রাম শুরু হয়। বাঘ নাকটা উঁচুতে তুলে বুক ভরে ঘ্রাণ নেয় একবার, তারপর নিশ্চিত পায়ে সামনে এগোয়। বলদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে কাছেই। হরিণের পর বলদই এখন তার ভরসা। বাদার মানুষ গরিব, গরু রাখার সামর্থ্য আছেই কয়েক ঘরের। তাদের গোয়ালের বেড়া গরুর আব্রু রক্ষা করে বড়জোর, বাঘের কাছে সেই বেড়া জাগপার শফিউল আলম প্রধানের মেঠো বক্তৃতায় হুমকির মতোই তুচ্ছ। দুই চাপড়ে বন থেকে চুরি করে কেটে আনা ধুন্দলের ডাল দিয়ে বাঁধা বেড়ার আনুষ্ঠানিকতা উড়িয়ে দিয়ে সে উবু হয়ে গোয়ালের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দুটো বলদ ঘুমাচ্ছিলো গোয়ালের ভেতরে, বাঘের গায়ের গন্ধ তাদের উত্তরাধুনিক স্বপ্নে খানিকটা ব্যাঘাত ঘটায়। একটা বলদ লেজ নেড়ে মাছি তাড়িয়ে বলে, ঘুমটা ভেঙে গেলো।

আরেকটা বলদ আধো ঘুমের মধ্যেই বলে, বলদের ঘুম সুন্দরী গরুর মনের মতো, অল্পতেই ভেঙে চুরমার। বাঘের খুব মেজাজ খারাপ হয়। বাদার হরিণ এতো বেয়াদব হয় না সাধারণত। বাঘের গন্ধ, শব্দ, দৃশ্য, কল্পনা ইত্যাদির তিলেকমাত্র উদয় হলেই তারা চম্পট দেয়। বাদার হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যই সেরকম। হরিণ দোতলা সমান লাফ দিয়ে খাল টপকে বনের মধ্যে উধাও হচ্ছে, এমন দৃশ্য না দেখলে বাঘের আঁতে মোচড় ঠিকমতো লাগে না। তার আগুন আর ধোঁয়ার ডোরায় ছাওয়া শরীরটার ভেতরে রুদ্ররস যোগায় কেবল হরিণের পলায়ন আর অন্য বাঘের আগমন। শুধু খালি পেট ভরাতেই সে গ্রামে ঢোকেনি, সঙ্গে একটু ক্রীড়ার বাসনাও তার ভুখা মনের এক কোণে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত মেহফিলের ডেকোরেটরের মতো চুপচাপ পড়ে ছিলো।

কিন্তু এই অশিক্ষিত বলদ দুটো তার পেট ভরাতে পারলেও মন যে ভরাতে পারবে না, তা সে বুঝে যায় এক ঝটকায়। একটা কাক তখনই কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে গোয়ালের ধোঁয়া তাড়ানোর ছোট্টো ঘুলঘুলিতে। গৌরচন্দ্রিকার ধার না ধেরেই সে বলে, খা খা খা। নাড়িভুঁড়ি আমাকে দিস। বাঘের মেজাজ আরেক কাঠি খারাপ হয়। বাদার পাখিরা এতো বেয়াদব হয় না। কাকটা মনে হয় শহর থেকে এসেছে। বলদগুলো এবার একটু ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। চোখ মিটমিট করে কান নেড়ে কানের মাছি তাড়িয়ে এক বলদ বলে, বাঘ ঢুকলো নাকি দোস্ত? অন্য বলদ একটু এগিয়ে গিয়ে ভালোমতো বাঘকে পরখ করে দেখে বলে, বাঘই তো মনে হচ্ছে। দাঁড়া চেটে দেখি। বাঘ প্রথমে একটা কড়া ধমক দিতে যায়, তারপর গেরস্তের কথা চিন্তা করে জিভ কেটে ফিসফিসিয়ে গর্জে বলে, জিভ সামলে কথা বল, বলদ কোথাকার। ঘুলঘুলিতে কাকটা এক পাক নেচে ওঠে গোয়ালের মশা তাড়ানো ধোঁয়ার মতো, বলে, বাঘ বাঘ বাঘ। এক বলদ বলে, গেরস্তকে খবরটা দেওয়া দরকার না দোস্ত? অন্য বলদ বলে, বিলক্ষণ।

কিন্তু গেরস্ত তো ঘুমায়। ডাকলে যদি রাগ করে? বাঘ চোখ মিটমিট করে বলদ দুটোকে দেখে কিছুক্ষণ ধরে। বলদের কথা সে ছানাবেলায় মায়ের কাছে শুনেছে কেবল, কিন্তু বাস্তবে যে বলদ এতো বড় বলদ, শীত ঠেলে নদীটা না টপকালে সে কিছুতেই বুঝতো না। বাঘ দুই পা সামনে বাড়ে। কাকটা খুশিতে ডিগবাজি খেয়ে বলে, কা কা কা কা তব কান্তা কস্তে পুত্র? লাগ যা গলে কে ফির ইয়ে রাত হো না হো। বলদ দুটো এবার গলাগলি করে কাকের সঙ্গে পোঁ ধরে কী যেন একটা বিটকেলে গান গেয়ে ওঠে। কাকটাও বলদ দুটোর বলদামিতে অতিষ্ঠ হয়ে বলে, আরে তোদের গলাগলি করতে বলি নাই। বাঘকে বললাম তোদের ঘাড়ে নাজিল হতে। বলদ কোথাকার। এক বলদ অশ্রুসজল চোখে বাঘের দিকে এগিয়ে এসে বলে, আয় ভাই ভায়ে ভায়ে গলাগলি করে একটা গজল গাই।

বাঘ একবার পেছন ফিরে গোয়ালের বেড়ার গায়ে গর্তটাকে দেখে, কান খাড়া করে গ্রামভর নিদ্রার শব্দ শোনে, ঘুলঘুলির কাকের নাচ দেখে কিছুক্ষণ, তারপর জিভ দিয়ে নিজের গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, এটা মানুষের গ্রাম তো, নাকি? অন্য বলদ একগাল হেসে বলে, একদম। মানুষ ছাড়া বলদ পাবে কোথায়? বাঘ হতাশ হয়ে কাকের দিকে তাকায়, বলে, আরে কিছু বল না এ দুটোকে। বলদ আমাকে ভাই বলে ডাকে। দেবো নাকি গলাটা টিপে? কাকটা এবার একটু গম্ভীর হয়ে ঘুলঘুলির ওপর দাঁড়িয়ে গলা খাঁকরে বলে, বলদেরা আমার। তোমাদের গোয়ালে রাতবিরাতে বাঘ ঢুকেছে। কিছু বুঝলা? এক বলদ সলজ্জ মুখে বলে, বলদের কাছে এসে বাঘের কীই বা লাভ? আমরা গরু হলে একটা কথা ছিলো। অন্য বলদ গম্ভীর মুখে বলে, আমরা ওরকম বলদ নই।

বাঘ তিতিবিরক্ত হয়ে একবার ঘুরপাক খায় গোয়ালের ভেতরে। এ কেমন শিকার? বলদ দুটো বাবুরাম সাপুড়ের সাপের মতো নিরামিষ মাংস হয়ে থাকলে চলবে কীভাবে? আর্তনাদ কোথায়, আতঙ্কের ঘ্রাণ কোথায়, নিজের বুকে রুদ্ররসের দাপটে রক্তের লাফঝাঁপ কোথায়? কাকটা বাঘের বিরক্তি টের পায়, সে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, তোমরা বাঘের প্রেম নও, গেম। বাঘ তোমাদের মাংস চায়। এক বলদ অন্য বলদকে ফিসফিস করে বলে, বাদায় নাকি বাঘ কমে গেছে। এখন বোঝো ঠ্যালা। অভাবে স্বভাব নষ্ট। এই বেটার মতলব তো ভালো মনে হচ্ছে না। তুই আমার পেছনটা পাহারা দে, আমি তোর পেছনটা দিচ্ছি। খুব হুঁশিয়ার। বাঘ এবার আর মেজাজ সামলাতে পারে না, চাপা হুঙ্কার দিয়ে বলে, ধুত্তেরি! কাকের গলায় সহানুভূতি উপচে পড়ে, আহারে। থাক, রাগ করে না। বলছি বুঝিয়ে। ওরে বলদজোড়, আপাতত গাঁড়ের চিন্তা না করে ঘাড়ের চিন্তা কর।

বাঘ কাকের দিকে তাকিয়ে বলে, এরা কি সবসময়ই এরকম কাঠবলদ, নাকি আমাকে চ্যাতানোর জন্য এমন করে? কাক কাঁধের পালক ঝাঁকিয়ে বলে, মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে…। বাঘের থাবায় পলকে নখ বেরিয়ে আসে, সে গুঁড়ি মেরে এগোয় বলদ দুটোর দিকে। বলদেরা ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে যায়। এক বলদ অন্য বলদকে বলে, দোস্ত বাঘটা মনে হয় আমাদের ব্যথা দিতে চায়। অন্য বলদ বলে, ও লোক ভালো না। বাঘের মুডটাই নষ্ট হয়ে যায়, সে তড়পে উঠে বলে, খবরদার আর কথা কবি না! একদম চোপ! লড়েচ কি মরেচ! এক বলদ শুকনো মুখে বলে, কামন ড্যুড। এইভাবে তুমি রাতবিরাতে আমাদের গোয়ালে ঢুকে মস্তানি করতে পারো না। অন্য বলদ পাংশু হয়ে বলে, তাছাড়া দিস ইজ নট হাউ উই গো ডাউন। গেরস্ত বলেছে মরার আগে সে একবার আমাদের গাবতলি দেখাতে নিয়ে যাবে।

বাঘ গোয়ালের অন্ধকারে জুলজুল করে কিছুক্ষণ বলদ দুটোকে চোখ দিয়ে মেপে বলে, গাবতলি কী? এক বলদ মুগ্ধকণ্ঠে স্বপ্ন-স্বপ্ন চোখে বলে, গাবতলি এক স্বপ্নপুরী। সেখানে এন্তার খৈল আর ভুষি। মীরকাদিমের ফর্সা ফর্সা সুন্দরী গরুর কাজল দেওয়া চোখের ভিড় সেখানে। সারাদিন শুধু খাও আর শোঁকো। অন্য বলদও আনমনা হয়ে পড়ে, বলে, শুনেছি মীরকাদিমের গরুগুলো সারাক্ষণ লেজ তুলে রাখে, আর আড়ে আড়ে কেমন করে যেন তাকায়। তাছাড়া বলিউড থেকেও গরু আসে গাবতলিতে। শুনেছি তারাও খুব দুশ্চরিত্রা। তাদের কোনো বাপভাই নেই। বাঘ ধমক দিয়ে বলে, চোপ শালা কাষ্ঠুবলদ! গাবতলিতে গরু আসলে তোদের কী? ধুন্দুল পাকলে কুমীরের কী? এক বলদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, অবলোকনেও সুখ! অন্য বলদ শিউরে উঠে বলে, রজার দ্যাট! কাকটা কা কা করে হেসে উঠে বলে, সারা সাতক্ষীরায় গাবতলি যাওয়ার রাস্তা জামাতের লোকে কেটে রেখেছে। বাঘের বগলতলির চেয়ে বেশি কিছু দেখার কিসমত তোমাদের নাই, মাই সুইট ইডিয়টস।

এক বলদ আঁতকে উঠে বলে, সত্যি? তিন সত্যি? অন্য বলদের পাঁজুরে বুকে তবুও অনেক আশা কিলবিল করে, সে উতলা হয়ে বলে, গাবতলিতে লঞ্চে করে যাওয়া যায় না? বাঘ গোয়ালের মেঝেতে থাপ্পড় মেরে বলে, শাটাপ। ফাক গাবতলি। ফাক মীরকাদিমের গরু। ফাকিউ। কাক নাচতে নাচতে বলে, কা কা কা কামড়া! এক বলদ পিছু হটতে হটতে গোয়ালের কোণে অন্য বলদকে সঙ্গে নিয়ে ঠাসাঠাসি করতে করতে বলে, ঠিকাছে ড্যুড। যদি তোমার হাতেই আমাদের স্বপ্ন মারা পড়ে, আমরাও বলদ পীরের নামে পাল্টা অভিশাপ দিচ্ছি…। বাঘ আবার গুঁড়ি মেরেছিলো, অভিশাপের কথা শুনে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কার নামে? অন্য বলদ সব আশা ঝেড়ে ফেলে তার শীর্ণ বুক ফুলিয়ে বলে, বলদ পীর, বাদার সব বলদের ভরসা। বাঘ বিরক্ত হয়ে বলে, বনবিবিকে চিনি, বনের মালকিন।

দক্ষিণ রায়কে চিনি, বাঘের বড়ভাই। বলদ পীর কে? এক বলদ অন্য বলদের সঙ্গে গলাগলি করে সুর মিলিয়ে বলে, শুধু বাঘেরই বড়ভাই আছে, বলদের নাই? শোনো বাঘ, ইন দ্য নেইম অফ বলদ পীর, কার্সড বি দাই পিপল, ডেথ মোস্ট ফাউল বি আনফার্লড আপন দেম। বলদের মৃত্যু যেমন তোমার হাতে হচ্ছে, তোমার আর তোমার চোদ্দোগুষ্টির মৃত্যুও যেন কোনো বলদের হাতে হয়। বাঘ জাতির চিত্ত, বিত্ত আর পিত্ত যেন কোনো মহাবলদের ইশারায় ধূলিসাৎ হয়। চিত্তে ফাকিউ, বিত্তে ফাকিউ, পিত্তে ফাকিউ! বাঘ আর সময় দেয় না। গোয়ালের অন্ধকার এক কোণে কাকের শরীর ঠেলে ঘুলঘুলির বাকিটুকি গলে রাতের আকাশ থেকে এক ফোঁটা আলোর দুধ ছলকে পড়ে তার আগুনে শরীরে, এক বলদের শ্বাসনালী পিষ্ট হয় তার চোয়ালে, অন্য বলদের ঘাড়ের হাড় চূর্ণ হয় তার হাতের থাপ্পড়ে।

এক বলদকে মুখে করে বাঘ গোয়ালের দেয়ালের ফুটো আরেকটু বড় করে বাইরে বেরিয়ে পড়ে, অন্য বলদ গোয়ালেই পড়ে থাকে নিথর হয়ে। কাক কা কা কা করে নাড়িভুঁড়ির বখরা বুঝে নিতে বাঘের পেছন পেছন ছুটে নদী পেরিয়ে নির্ভয়ে বাদাবনে ঢুকে পড়ে নাছোড় জোটসঙ্গীর মতো। বলদের শরীর তার চোপার তুলনায় সামান্যই, তার ওপর সে খায় খড় আর ভুষি। বনের হরিণের মতো সে পত্রভূক নয় বলে তার মাংসে শুধু কোলেস্টেরোলের ইশারা। বাঘ ভোর পর্যন্ত পেট ভরে খেলেও তার একটু বদহজম হয়, তারপর কয়েকটা দিন সে চুপচাপ ঝোপের আড়ালে শুয়ে গড়াগড়ি করে আর একটা কান খাড়া রেখে ঘুমায়। স্বপ্নে সেও ছুটতে থাকে গাবতলিতে, সেটা যেন তার নিজেরই তালুক, আর সেখানে শত সহস্র মীরকাদিমের হরিণ দোতলা তিনতলা সমান লাফ দিয়ে তিড়িং বিড়িং নাচতে থাকে তার সামনে।

হপ্তা খানেক এভাবে ঘুমানোর পর এক বিকেলে বাঘের ঘুমের চটকা ভেঙে যায় কাকের কলরবে। বাঘ ঘুম ভেঙে এক গড়ান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাদা কাঁপিয়ে বুক খোলা ধমক দেয় কাককে, কা হুয়া? কাক একটা গেওয়া গাছের ডালে বসে কাহুতাশ করে বলে, সর্বনাশ হয়ে গেছে বাঘ। পলাও পলাও। মালয়েশিয়া চলে যাও। পুবদিকে এক মাস দৌড় দিলেই ট্রলার ধরতে পারবা। ভাগো বাঘ ভাগো। বাঘ বলে, কা মালয়েশিয়া যামু কা? কাক কাঁদতে কাঁদতে বলে, পাকিস্তান আবারো ভেঙে গেছে রে বাঘা। পাপিষ্ঠ বাকশাল ইজ ব্যাক। বাঘ বলে, তাতে আমার কী? কুমীর মরলে ধুন্দুলের কী? কাক হাহাকার করতে না পেরে কাকাকার করে বলে, এইবার বন ও পরিবেশমন্ত্রীর গদি পেয়েছে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু! তোমার চিত্ত, বিত্ত, পিত্তের খবরই আছে এইবার! বাঘের পেটে হজমের অপেক্ষায় থাকা এক টুকরো বলদ গুড়গুড়িয়ে বলে, ইত্তেফাকিউ!

আরো পড়তে পারেন...

ডিলিউশান

পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলার সময় বাসটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। জানালা দিয়ে পাহাড়, বড় বড় গাছ…

টিউবলাইট —- ঋতম সেন

বারান্দার সামনে দিয়ে তিনটে সাদা তার চলে গ্যাছে। রাস্তার ওপারের গাছটা ঝাঁকড়া হয়ে ল্যাম্পপোস্টটাকে প্রায়…

টাইটানিক বৃষ্টি– ইন্দিরা মুখার্জি

সেদিন তিন্নি পার্কে বসেছিল দাদুর সাথে। উঠল ভীষণ ঝড়, পড়ল বাজ, চমকাল বিদ্যুতমালা আকাশের গায়…