বহে নিরবধি—- সুহৃদ আকবর

প্রকৃতিতে শো শো দখিনা বাতাস বইছে। বাতাসের দাপটে গাছের ডালপালা কেমন নেচে নেচে উঠছে। একটা সুর ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে। নিচু একটা জমিতে কাঁচি দিয়ে আনমনে ঘাস কাটছে ছমির উদ্দিন। জমির পাশে রয়েছে টিলার মত একটা উঁচু জায়গা। সেখানে রয়েছে কাশের বন। সে বনে ফুটে রয়েছে অসংখ্য কাশফুল। কাশফুল বাতাসে এদিক সেদিক দোল খাচ্ছে। টিলার পাশ ঘেষে বয়ে গেছে একটা নদী। ছমির উদ্দিন এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কাশফুলের দিকে। তাকিয়ে কেমন যেন একটা স্নিগ্ধ পরম অনুভব করছে সে। নদীতে ভরপুর যৌবনের উন্মাদনা। নদী যেন পানিতে উপচে পড়ছে। নদীর পানি ঘটঘট ঘটঘট শব্দ করে বয়েই চলছে অবিরাম। নদীর তীরে পানকৌড়ি, বালিহাঁস যে যার মত বিচরণ করছে। শালিক, ময়না, বাবুই আর টিয়া পাখিরা দলবেঁধে ধান খেতে এসেছে। ফড়িং খেলা করছে ধানের শীষের উপর। পাখিরা ধান খাওয়ার শেষে ফড়িং শিকার করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছে তাদের বাচ্চার জন্য।
অদূরে একটি বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়িটির চারপাশে এতবেশি সবুজ গাছপালা; দেখলে মনে হয় সবুজ চাদর দিয়ে কেউ বুঝি বাড়িটিকে মুড়িয়ে দিয়েছে। ধান ক্ষেতের ভেতর থেকে ব্যঙ ডাকছে কাতর স্বরে। মনে হয় ব্যঙটিকে সাপে ধরেছে। পাশের বাড়ির সবুজ গাছগাছালি ভেদ করে একটা ঝাউ গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ঝাউ গাছের চূড়ায় একটি পাখি আনমনে গান করছে। পাখিটির গলার স্বর ভারি মিষ্টি। পথিকেরা ডাক শুনে এদিক ওদিক চেয়ে পাখিটিকে দেখে নেয়। দুই-তিনজন লোক জাল নিয়ে মাছ ধরতে এসেছে। এবারে জোয়ারের পানির সাথে প্রচুর রুই, কাতলা, গজার, বোয়াল, শৈল, শিং, বাইলা, চিংড়ি এসেছে সাগর থেকে। নদীর কূলে যারা বসবাস করে তারা সাধারণত মাছ শিকার, হাঁস মুরগী পালন, গরু, মহিষ, ছাগল পালন, কৃষিকাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কেউ কেউ অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করে থাকে। ছমিরও বর্গা চাষীদের দলে। বর্গা চাষীদের মাঝে তার অবস্থা কিছুটা স্বচ্ছল বলা চলে। সে এবার দশ গন্ডা জমি চাষ করেছে। দু’টি হালের বলদ একটা দুধের গাভী আছে তার। স্ত্রী শাহানা, ছেলে আরিফ মেয়ে তারিনকে নিয়ে তার সুখের সংসার। ছেলেটি দশম শ্রেণিতে আর মেয়েটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। মেয়েটা দেখতো হয়েছে তার মায়ের মত। একেবারে যেন শাহানা খাতুনের কার্বন কপি। তবে পার্থক্য এতটুকু যে শাহানা সোজা সরল, মেয়েটি বেজায় চঞ্চল। ছমির ভাবে শাহানাও বোধহয় ছোটবেলায় এ রকম চঞ্চল ছিল। সময় কিভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে তা ভেবে অবাক হয় ছমির। সারাদিন হৈ হুল্লোড়, হুডোহুডি, ছুটোছুটি বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, পানিতে মাছ ধরা, কাদা মাখামাখি করেই দিন কাটে মেয়েটির। ছেলেটাও কম যায় না। স্কুল থেকে এসেই মাঠে চলে যায় খেলতে। কখনো বা যায় বনে। কোন গাছে কি ফুল ফুটেছে। কোন পাখি কোন গাছে বাসা বেঁধেছে। কোন বনে কাউ ফল ধরেছে। কোন বাঁশের আগায় কাক বাসা বেঁধেছে এ নিয়ে তার কাজ কারবার। অবশ্যই ভাই-বোন প্রায় সময় একসাথেই থাকে। দু’জনকে দেখলে পথের পাঁচালীর অপু আর দূর্গার কথা মনে পড়ে যায়।
একসাথে থাকলে কি হবে- দিনে কম করে হলেও দুই তিনবার ঝগড়া করবেই। কিন্তু একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারেনা। তারা যেন এক মাণিকজোড়। আজ ভাই-বোন দু’জনই স্কুল থেকে এসে নেমে পড়েছে মাছ ধরতে। বাড়ির সামনে একটা পানি নিচু জায়গা। সেখানে পানি জমে আছে। সেই পানিতে মাছ ধরছে আরিফ আর তারিন।
ঘাস কেটে বাড়ি ফিরছে ছমির উদ্দিন। মাথার উপর খাঁচা ভর্তি সবুজ ঘাস। ছমির উদ্দিন বাড়ির সামনে এসে দেখে ছেলে-মেয়ে একসাথে মাছ ধরছে। জমির তাদেরকে দেখে কোন বকাঝকা করল না। বরং এক দৃষ্টে চেয়ে থাকলো নিজের দু’টো অবুঝ শিশুর দিকে। ছমির উদ্দিন ভাবে, এ তো আমারই দু’টি অসিত্মত্ব। তারা একদিন লেখাপড়া করে মানুষের মত মানুষ হবে। ছেলেকে কোরআনে হাফেজ আর মেয়েটিকে হাদীস বিভাগে কামিল পাশ করিয়ে একজন প্রভাষক বানানো তার ইচ্ছা। বাকীটা উপরওয়ালার উপর ভরসা। কেননা শুক্রবার মসজিদের হুজুরের মুখে সে শুনেছে নেক সমত্মান রেখে যাওয়া সদকায়ে জারিয়া। তাই ছমির উদ্দিন চায় তার ছেলে-মেয়েও এভাবে বড় হোক। মৃত্যুর পর তারা যেন তার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে পারে। এভাবে সারাদিন খেটেখুটে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে ছমির উদ্দিন। বাড়িতে এসে যখন সমত্মান দু’টিকে দেখে তখন তার চোখজোড়া তৃপ্তিতে ভরে যায়। সকল ক্লামিত্ম যেন নিমিষেই দূর হয়ে যায়। সে মনে প্রচন্ড একটা জোর পায়। তার সকল কষ্ট যেন জীবন সঞ্চারণী রূপ লাভ করে।
প্রকৃতিতে হেমমেত্মর আগমনি সুর শোনা যাচ্ছে। হেমমত্ম মানেই তো ধান কাটার মৌসুম। মাঠের পর মাঠ শুধু ধান ক্ষেত আর ধান ক্ষেত। ধান ক্ষেত বাতাসে দোল খাচ্ছে। ছমির উদ্দিন আর শাহানার মনে আনন্দের বন্যা। চোখে আগামীর স্বপ্ন। তাদের স্বপ্নের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে আরিফ আর তারিনের মধ্যে। ছমির উদ্দিন রাসত্মায় দাঁড়িয়েই এসব ভাবছে। এমন সময় তারিনের চোখ পড়লো বাবার দিকে। তারিন এক দৌড়ে বাবার কাছে ছুটে গেল। কাদা মাখা শরীরের মেয়েকে জাপটে ধরলো ছমির উদ্দিন। আরিফও ডেকে বলে-
-বাবা তুমি এসেছো? যাওনা বাড়িতে ঘাস রেখে একটু এখানে এসো। জানো বাবা আজ এখানে অনেক মাছ জমা হয়েছে।
ছমির উদ্দিন ছেলের কথা শুনে মৃদু হেসে বলল-
-হ বাবা, তুই থাক আমি আসতাছি।
অদূরে দু’টো চীনা হাঁস পানির জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঠে গরু ডাকছে। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি। সোনালি রোদের কিরণ খেলা করছে হলুদ ধান ক্ষেতের উপর। এভাবে প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের জীবনও নিরবধি এগিয়ে যাচ্ছে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!