বসন্ত এবং বিরহ—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

রামী। সখি, ঋতুরাজ বসন্ত আসিয়া ধরাতলে উদয় হইয়াছেন। আইস, আমরা বসন্ত বর্ণনা করি। বিশেষ আমরা উভয়েই বিরহিণী; পূর্ব্বগামিনী বিরহিণীগণ চিরকাল বসন্তবর্ণনা করিয়া আসিয়াছেন, আইস আমরাও তাই করি। বামী। সই, ভাল বলিয়াছ। আমরা বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখিয়া কেবল কুটনো কুটিয়া মরিলাম, আইস অদ্য কাব্যালোচনা করি। রামী। সই! তবে আরম্ভ করি। সখি‌! ঋতুরাজ বসন্তের সমাগম হইয়াছে। দেখ, পৃথিবী কেমন অনির্ব্বচনীয় ভাব ধারণ করিয়াছেন। দেখ, চূতলতা কেমন নব মুকুলিত- বামী। বৃক্ষে বৃক্ষে শজিনা খাড়া বিলম্বিত- রামী। মলয় মারুত মৃদু মৃদু প্রধাবিত- বামী। তদ্বাহিত ধূলায় দন্ত কিচ্‌কিচিত। রামী। দূর ছুঁড়ী-ও কি! শোন্। ভ্রমরগণ পুষ্পের উপর গুণ্ গুণ্ করিতেছে- বামী। মাছিগণ ভাতের উপর ভন্ ভন্ করিতেছে- রামী। বৃক্ষোপরে কোকিলগণ পঞ্চমস্বরে কুহু কুহু করিতেছে- বামী। গাজনতলায় ঢাকিগণ অষ্টমস্বরে চড় চড় করিতেছে। রামী। না ভাই, তোকে নিয়ে বসন্ত বর্ণন হয় না। আমি শ্যামীকে ডাকি। আয় সই শ্যামী, আমরা বসন্ত বর্ণনা করি।

(শ্যামী আসিল)

শ্যামী। আমি ত সখি তোমাদের মত ভাল লেখা পড়া জানি না; একটু একটু জানি মাত্র, আমি সকল বুঝিতে পারিব না-আমাকে মধ্যে মধ্যে বুঝাইয়া দিতে হবে। রামী। আচ্ছা! দেখ সখি, বসন্ত কি অপূর্ব্ব সময়! কেমন চূতলতা সকল নব মুকুলিত- শ্যামী। সই, আঁবের গাছই দেখিয়াছি, আঁবের লতা কোন্‌গুলা? রামী। আঁবের লতা আছে শুনিয়াছি, কিন্তু কখন চক্ষে দেখি নাই। দেখি না দেখি, চূতলতা ভিন্ন চূতবৃক্ষ কখন পড়ি নাই। তবে চূতলতাই বলিতে হইবে, চূতবৃক্ষ বলা হইবে না। শ্যামী। তবে বল। রামী। চূতলতিকা নব মুকুলিত হইয়া- শ্যামী। সই! এই বলিলে চূতলতা-আবার লতিকা হইল কেন? রামী। আরও কিছু মিষ্ট হইল। চূতলতিকা নব মুকুলিত হইয়া চারিদিকে সৌগন্ধ বিকীর্ণ করিতেছে- বামী। ভাই, আঁবের বোলে যে বসন্তকালে চুঁইয়ে গিয়া কড়েয়া ধরে। শ্যামী। বলিলে কি হয়, কেমন মিষ্ট হইল দেখ দেখি। রামী। তাহাতে ভ্রমরগণ মধুলোভে উন্মত্ত হইয়া ঝঙ্কার করিতেছে, শুনিয়া আমাদিগের প্রাণ বাহির হইতেছে। শ্যামী। আহা! সখি, সত্যই বলিয়াছ। সই, ভ্রমর কাকে বলে? রামী। মর্ নেকি, তাও জানিস্‌নে। ভ্রমর বলে ভোম্‌রাকে। শ্যামী। ভোম্‌রা কোন্‌গুলো ভাই? রামী। ভোম্‌রা বলে ভিম্‌রুলকে।

শ্যামী। তা ভাই ভিম্‌রুল আঁবের বোল দেখে পাগল হয় কেন? ভিম্‌রুলের পাগলামি কেমনতর? ওরা কি আবোল তাবোল বকে? রামী। কে বলেছে পাগল হয়? শ্যামী। ঐ যে তুমি বলিলে, “উন্মত্ত হইয়া ঝঙ্কার করিতেছে ,” রামী। কোন শালী আর তোদের কাছে বসন্ত বর্ণনা করিবে! শ্যামী। ভাই, রাগ কর কেন? তুমি বেশী লেখা পড়া শিখেছ, আমি কম শিখেছি-আমায় বুঝাইয়া দিলেই ত হয়। সকলেই কি তোমার মত রসিকে? রামী। (সাহঙ্কারে) আচ্ছা, তবে শোন্। ভ্রমরগণ মধুলোভে উন্মত্ত হইয়া ঝঙ্কার করিতেছে। তাহাদিগের গুণ্‌ গুণ্ রবে আমাদের প্রাণ বাহির হইতেছে। শ্যামী। সই, ভোম্‌রার ডাক “গুণ্ গুণ্” না “ভোঁ ভোঁ”? রামী। কবিরা বলেন, “গুণ্ গুণ্”। শ্যামী। তবে গুণ্ গুণ্‌ই বটে। তা উহাতে আমাদের প্রাণ বাহির হয় কেন? ভিম্‌রুল কামড়াইলে প্রাণ বাহির হয় জানি, কিন্তু ভিম্‌রুল ডাকিলেও কি মরিতে হইবে? রামী। এ পর্য্যন্ত সকল বিরহিণীগণ গুণ্ গুণ্ রবে মরিয়া আসিতেছে, তুই কী পীর যে মর্‌বি না? বামী। আচ্ছা ভাই, শাস্ত্রে যদি লেখে ত না হয় মরিব।

কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, কেবল কি ভিম্‌রুলের ডাকে মরিতে হইবে, না বোলতা মৌমাছি গুব্‌রে পোকার ডাক শুনিলেও অন্তর্জলে শুইব? রামী। কবিরা শুধু ভ্রমরের রবেই মরিতে বলেন। বামী। কবিদের বড় অবিচার। কেন, গুব্‌রে পোকা কি অপরাধ করেছে? রা। তোর মর্‌‌তে হয় মরিস্, এখন শোন্। বামী। বল। রামী। কোকিলগণ বৃক্ষে বসিয়া পঞ্চম স্বরে গান করিতেছে। শ্যামী। পঞ্চম স্বর কি ভাই? রা। কোকিলের স্বরের মত। শ্যামী। আর কোকিলের স্বর কেমন? রামী। পঞ্চম স্বরের মত। শ্যামী। বুঝিয়াছি। তার পর বল। রামী। কোকিলগণ বৃক্ষে বসিয়া পঞ্চম স্বরে গান করিতেছে; তাহাতে বিরহিণীর অঙ্গ জ্বর জ্বর হইতেছে। বামী। আর কুঁক্‌ড়োর পঞ্চম স্বরে অঙ্গ কেমন করে? রামী। মরণ আর কি, কুঁক্‌ড়োর আবার পঞ্চম স্বর কি লো? বামী। আমার তাতেই অঙ্গ জ্বর জ্বর হয়। কুঁক্‌ড়া ডাকিলেই মনে হয় যে, তিনি বাড়ী এলেই আমায় ঐ সর্ব্বনেশে পাখী রাঁধিয়া দিতে হবে। রামী। তার পর মলয় সমীরণ। মৃদু মৃদু মলয় সমীরণে বিরহিণী শিহরিয়া উঠিতেছে। শ্যামী। শীতে? রামী। না-বিরহে। মলয় সমীরণ অন্যের পক্ষে শীতল, কিন্তু আমাদের পক্ষে অগ্নিতুল্য। বামী। সই, তা সকলের পক্ষেই। এই চৈত্র মাসের দুপুরে রৌদ্রের বাতাস আগুনের হল্কা বলিয়া কাহার বোধ হয় না? রামী। ও লো, আমি সে বাতাসের কথা বলিতেছি না। শ্যামী। বোধ হয়, তুমি উত্তুরে বাতাসের কথা বলিতেছ। উত্তুরে বাতাস যেমন ঠাণ্ডা, মলয় বাতাস তেমন নয়।

রামী। বসন্তানিলস্পর্শে অঙ্গ শিহরিয়া উঠে। বামী। গায়ে কাপড় না থাকিলে উত্তুরে বাতাসেও গায়ে কাঁটা দিয়া ওঠে। রামী। মর্ ছুঁড়ী, বসন্তকালে কি উত্তুরে বাতাস বয় যে, আমি বসন্তবর্ণনায় উত্তুরে বাতাসের কথা বলিব? বামী। উত্তুরে বাতাসই এখন বয়। দেখ, এখনকার যত ঝড়, সব উত্তুরে। আমার বোধ হয়, বসন্তবর্ণনে উত্তুরে বাতাসের প্রসঙ্গ করাই উচিত। আইস, আমরা বঙ্গদর্শনে লিখিয়া পাঠাই যে, ভবিষ্যতে কবিগণ বসন্তবর্ণনে মলয় বাতাস ত্যাগ করিয়া উত্তুরে ঝড়ের বর্ণনা করেন। রামী। তাহা হইলে বিরহীদের কি উপায় হইবে? তাহারা কি লইয়া কাঁদিবে? শ্যামী। সখি, তবে থাক। এক্ষণে তোমার বসন্তবর্ণনা-উহুঃ উহুঃ সখি! মোলেম, মোলেম, গেলেম রে! গেলেম রে! [ভূমে পতন, চক্ষু মুদ্রিত] রামী। কেন, কেন, সই, কি হয়েছে, হঠাৎ অমন হলে কেন? শ্যামী। (চক্ষু বুজিয়া) ঐ শুনিলে না? ঐ সেওড়া গাছে কোকিল ডাকিতেছে। রামী। সখি, আশ্বস্তা হও, আশ্বস্তা হও,-তোমার প্রাণকান্ত শীঘ্রই আসিবেন। সই, আমারও ঐরূপ যন্ত্রণা হইতেছে। নাথের সন্দর্শন ভিন্ন আমার বাঁচা ভার হইয়া উঠিয়াছে। (চক্ষু মুছিয়া) পাড়ার সকল পুকুরের যদি জল না শুকাইত, তবে এত দিন ডুবিয়া মরিতাম। হে হৃদয়-বল্লভ, জীবিতেশ্বর‌! হে রমণীজনমনোমোহন! হে নিশাশেষোন্মেষোন্মুখকমলকোরকোপমোত্তেজিতহৃদয়সূর্য্য! হেঅতলজলদলতলন্যস্তরত্নরাজিবন্মহামূল্যপুরুষরত্ন! হে কামিনীকণ্ঠবিলম্বিতরত্নহারাধিক প্রাণাধিক! আর প্রাণ বাঁচে না। আমি অবলা, সরলা, চঞ্চলা, বিকলা, দীনা, হীনা, ক্ষীণা, পীনা, নবীনা, শ্রীহীনা,-আর প্রাণ বাঁচে না।আর কত দিন তোমার আশাপথ চাহিয়া থাকিব? যেমন সরোবরে সরোজিনী ভানুর আশা করে, যেমন কুমুদিনী কুমুদবান্ধবের আশা করিয়া থাকে, যেমন চাতক মেঘের জলের আশা করিয়া থাকে-আমি তেমনি তোমার আশা করিতেছি। শ্যামী। (কাঁদিতে কাঁদিতে) যেমন রাখাল, হারাণ গোরুর আশায় দাঁড়াইয়া থাকে, যেমন বালকে ময়রার দোকান হইতে লোক ফিরিবার আশায় দাঁড়াইয়া থাকে, যেমন অশ্ব তৃণাহরক গ্রাসকটের আশা করিয়া থাকে, হে প্রাণবন্ধো! আমি তেমনি তোমার আশা করিয়া আছি।

যেমন মাছ ধুইতে গেলে পরিচারিকার পশ্চাৎ পশ্চাৎ মার্জ্জর গমন করে, তেমনি তোমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আমার মন গিয়াছে। যেমন উচ্ছিষ্টাবশেষ ফেলিতে গেলে, বুভুক্ষু কুক্কুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ যায়, আমার অবশ চিত্ত তেমনি তোমার পশ্চাৎ গিয়াছে। যেমন কলুর ঘানিগাছে প্রকাণ্ডাকার বলদ ঘুরিতে থাকে, তেমনি আশা নামে আমার প্রকাণ্ড বলদ, তোমার প্রণয়রূপ ঘানিগাছে ঘুরিতেছে। যেমন লোহার চাটুতে তপ্ত তৈলে কৈমাছ ভাজে, তেমনি এই বিরহচাটুতে বসন্তরূপ তপ্ত তৈলে আমার হৃদয়রূপ কৈমাছকে অহরহ ভাজিতেছে। যেমন এই বসন্তকালের তাপে শজিনা খাড়া ফাটিতেছে, তোমার বিরহসন্তাপে তেমনি আমার হৃদয় খাড়া ফাটিতেছে।

যেমন এক লাঙ্গলে যোড়া গোরু যুড়িয়া ক্ষেত্রকে চাষা ক্ষতবিক্ষত করে, তেমনি এক প্রেমলাঙ্গলে বিরহ এবং বারস্ত্রীভক্তিরূপ যোড়া গোরু যুড়িয়া আমার স্বামী চাষা আমার হৃদয়ক্ষেত্রকে ক্ষতবিক্ষত করিতেছেন। কথায় আর কি বলিব। বিরহের জ্বালায় আমার ডালে নুণ হয় না, পানে চূণ হয় না, ঝোলে ঝাল হয় না, ক্ষীরে মিষ্ট হয় না। সখি, বিরহের দুঃখ যে দিন মনে হয়, সে দিন আমি তিন বেলা বই খাইতে পারি না; আমার দুধের বাটি অম্‌নি পড়িয়া থাকে। (চক্ষু মুছিয়া) সখি, তোমার বসন্তবর্ণনা সমাপ্ত কর, দুঃখের কথায় আর কাজ নাই। রামী। আমার বসন্তবর্ণনা শেষ হইয়াছে। ভ্রমর, কোকিল, মলয় মারুত এবং বিরহ, এই চারিটির কথাই বলিয়াছি, আর বাকি কি? বামী। দড়ি আর কলসী।

আরো পড়তে পারেন...

সুবর্ণগোলক—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কৈলাসশিখরে, নবমুকুলশোভিত দেবদারুতলায় শার্দ্দুলচর্ম্মাসনে বসিয়া হরপার্ব্বতী পাশা খেলিতেছিলেন। বাজি একটি স্বর্ণগোলক। মহাদেবের খেলায় দোষ এই-আড়ি…

গর্দ্দভ– বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

হে গর্দ্দভ! আমার প্রদত্ত, এই নবীন সকল ভোজন করুন।১ , আমি বহুযত্নে, গোবৎসাদির অগম্য প্রান্তর…

বাবু–বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

জনমেজয় কহিলেন, হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে, কলিযুগে বাবু নামে এক প্রকার মনুষ্যেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত…