বরিশ্যাল্যা ভূত !

ঘটনাটা বরিশালের, বাউফল থানার মুলাদি গ্রামের! ঘটনা ৪০ বছর আগের! আমার এক নিকট আত্মীয়ের ঘটনা এবং তার কাছ থেকে শোনা! তার ভাষায়! আমার বয়স তখন ২২ বছর! আমার বাবার খুবই ডায়রিয়া হয়েছিল! গ্রামের এক কবিরাজকে দেখিয়েছি এবং সে বলে, “না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শহরে নিয়ে ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে!” কারণ তখনকার দিনে গ্রামের দিকে কোনো ডাক্তার ছিল না! আর শহর ২৫ কিলোমিটার দূরে! শহরে যেতে হবে নৌকায় করে! যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল নদীপথ! ভাল রাস্তা তখন ছিল না!

বাবাকে নিয়ে যখন রওনা করি, তখন বেলা ১২টা বাজে! প্রথমে আকাবাকা ছোট খাল পেরিয়ে বড় নদী, ও তার ওই পাড়ে শহর! শহরে পৌছাতে আরো ঘণ্টা আড়াই লেগেছে! বিকাল ৫টার দিকে বাবা মারা যায়! বাবার লাশটা নিয়ে আমি আবার বাড়ির দিকে রওনা দেই! বড় নদীটা যখন পার করি, খালের দিকে নৌকা ঢুকাই, তখন দেখতে পাই নৌকা আর চলছে না, কাঁদায় আটকে গিয়েছে! তখন ভাটা চলছে! জোয়ার আসবে রাত ১২টার দিকে! তখন সময়টা আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা হবে! শীতেরকাল থাকায় ঐ সময় অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল চারপাশ! আকাশে জোত্নার আলো ছিল খুব! জনমানবশূন্য একটি স্থানে এসে নৌকাটা আর চলছে না! খালটার বামপাশে একটু দূরে একটি পরিত্যক্ত শ্মশান আর ডানপাশে গভীর জঙ্গল! জঙ্গলের বটগাছগুলো দানবের মত দাঁড়িয়ে আছে! বটগাছের ডালে কিছু বাদুর ঝুলে আছে! এতটাই নির্জন জায়গা যে, কোনো শব্দ হলেই বুকের ভিতরে কেমন যেন করে ওঠে! ভয়ে বাবার লাশটা স্পর্শ করে বাবার পাশে বসে থাকি! শুধু অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই! একটা চাদর দিয়ে বাবার লাশটা ঢেকে দিয়েছি!

রাত যত বাড়তে থাকে, ভয় ততটাই তীব্র হতে থাকে! মনে হয়, জঙ্গল থেকে কিছু একটা বেরিয়ে এসে আমাকে ধরবে! হঠাৎ নৌকাটা কেমন যেন একটু দুলে উঠলে মনে হল, আমার মৃত বাবা নড়ে উঠছে! বাবার ঠান্ডা শরীর থেকে হাতটা সরিয়ে নেই! দোয়া যতটুকু পারি, সবই পড়তে চেষ্টা করছি, কিন্তু ভয় পেয়ে কিছুই মনে নেই! ইচ্ছা করছিল চিৎকার করি, “বাঁচাও! বাঁচাও!” বলে! কিন্তু আমি জানি, আমার এই চিৎকার কারো কানে পৌঁছাবে না! না পারছি এখান থেকে যেতে, না পারছি থাকতে! নিজের মৃত বাবাকেও ভয় করছে!

আনুমানিক রাত ১১টার দিকে একটা ছায়া দেখতে পেলাম বট গাছের অড়াল থেকে, বেরিয়ে এসে আমাদের নৌকার কাছে আসলো এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কোথায় যাবে?” লোকটি একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে আছে এবং তার মুখটা চাদরে ঢাকা ছিল! লোকটি ইশারায় যে দিকে দেখালো, ঐ দিকেই আমরা যাচ্ছি! লোকটিকে বললাম, “জোয়ার আসলে যাব!” লোকটি নৌকায় উঠলো ও বাবার কাছে বসলো, কিন্তু বাবার সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না! একদৃষ্টিতে বাবার লাশটার দিকে চেয়ে ছিল! লোকটার মুখটা আমি তখনো দেখতে পাইনি! এই গহীন জঙ্গলে এত রাতে তার আগমনের কারণটা পর্যন্ত জানতে ইচ্ছা করছিল! আগমনে শস্তি পেয়েছি!

রাত ১২টার দিকে জোয়ার আসলে আমি নৌকাটা চালাতে শুরু করি! নৌকা যত সামনের দিকে যাচ্ছে, ততই একটা গন্ধ নাকে লাগছে! ধীরে ধীরে গন্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে! কিছু কচুরিপনা, কলাগাছ এবং মরা একটি গরুর ফুলে থাকা দেহ একসাথে জটলা করে এমনভাবে নৌকা সাথে আটকে আছে যে আমি অনেক চেষ্টা করেও নৌকাটাকে কিছুতেই সামনের দিকে নিতে পারছি না! বাধ্য হয়ে আমি নৌকা থেকে পানিতে রশি ধরে টানতে থাকলাম! প্রায় ৫ মিনিট টানার পর আমি নৌকার কাছে আসি! তখন যা দেখলাম, বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠলো! দেখি লোকটা বাবার বুকের কাছে বসে, বাবার বুকের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কলজটা বের করে নিয়েছে!

তখন আমি কোনো উপায় না দেখে বৈঠাটা হাতে নিয়ে লোকটার মাথায় আঘাত করি একাধিকবার! লোকটা আমার দিকে যখন ফিরে তাকাল, তখন ঠিক গলার মাঝখানে বৈঠাটা ঢুকিয়ে দেই! এতে লোকটা পানিতে পড়ে যায়! আমি পানিতে খুব জোরে জোরে বৈঠা দিয়ে আঘাত করি ও চিৎকার করি, “সাহস থাকলে সামনে আয়!” চাঁদের আলোতে লোকটার রক্তমাখা লোমশ হাতটা দেখেছিলাম! বড় বড় নখ এবং কোঠরে ঢোকানো চোখের নীল আভা মনে পড়লে বুকটা শুকিয়ে যায়! দাতগুলো লালচে, খুব ছোট ছোট, তীক্ষ্ণ এবং ধারালো!

আমার চিৎকার শুনে টর্চলাইট নিয়ে কয়েকজন লোক ছুটে আসে! তাদের সব কিছু খুলে বলি! সব কিছু শুনে তারা বাবার লাশটা দেখে! তখনও বাবার বুকের ছোপ ছোপ রক্তগুলো শুকায়নি! ঐ রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর রাত! সেই রাতের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না! ঐটা ছিল একটা পিশাচ!

জমির ভূত

একটি ভূতের কাহিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *