বরফের গুলতি,কানি বুড়ি অথবা কতিপয় কল্পনার সারমর্ম

আজ সন্ধ্যেবেলা থেকেই শরীরটা একদম বেঁকে বসে আছে,ঠিক সেরকম, যেমন মাঝে মাঝে তোমাকে আদর করার সময় বাঁকিয়ে নিতাম তোমার নিপুন শরীরটিকে,আদরের ভঙ্গিমা পরিবর্তনের প্রয়োজনহেতু।আজ সেই সন্ধ্যেবেলা থেকে আমার শরীরও একইভাবে বেঁকে সেঁটে আছে বিছানায়,হয়তো ইচ্ছে করলেই খানিকটা সোজা হয়ে নিতে পারবো,কিন্তু তারপরও সোজা হতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে ক্ষুধাহীন,প্রকৃতির কোন ডাক সাড়াহীন যদি এইভাবে অথর্ব হয়ে পরে থাকা যায় তাহলে বেশ হয়। কিন্তু সব তো আর আমার ইচ্ছে মতো হবেনা সুহাসিনী,খানিক বাদেই হয়তো মূত্রথলি ভারী হয়ে যাবে, টয়লেটে গিয়ে অনন্ত ঝরনা ঝরিয়ে তবেই না খালাস হওয়া যাবে, কিংবা কিছুক্ষণ পরেই হয়তো দু-চোয়াল চুলকাতে শুরু করবে সিগারেট ফুঁকার তৃষ্ণায়, কিছুই মনের মত হয়না আমার, যেমনটি তুমি হওনি আমার ক্ষেত্রে। জানালা দিয়ে তাকালাম, বাইরে খুব তুষারপাত হচ্ছে, খোলা মাঠে ৪-৫ টা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বরফের গুলতি বানিয়ে একে অন্যের গায়ে ছুঁড়ে মারছে, তুমি পাশে থাকলে এখন নিশ্চয়ই আমার সাথে অনেকক্ষণ বক্‌বক্‌ করতে,বলতে ছেলেমেয়েগুলির দুষ্টুমির কথা আর ঠোঁট বাঁকা করে নালিশ জানাতে ছেলেমেয়েগুলির বাবা-মার উদ্দেশ্যে। জানো,বেশ লাগতো ওইসব দিনগুলিতে আমার, আমি জানতাম তোমার এইসব বলার উদ্দেশ্য কি, জানতাম একটু বাদেই খুব পরিপাটি করে চুল আঁচড়াবে, ঠোঁটে খুব যত্ন করে লিপস্টিক ঘষবে আর সাড়া শরীরে মাখবে পুরো পৃথিবী ভুলে তোমাতে ডুবে থাকা যায় এমন জাদুমাখা এক সুগন্ধি, এইসব কোন কিছুই অজানা ছিল না আমার। আর ভাল লাগতো তোমার কপট রাগ, নাহ রাগ করলে কখনোই তোমার চেহারা লাল হয়ে যেতোনা, কেননা রাগ করলে চেহারা লাল হওয়ার জন্য গায়ের রঙ যতটুকু সাদা হতে হয় তার ধারের কাছেও ছিল না তোমার গায়ের রঙ। তোমার গায়ের রঙ ছিল অনেকটা কালোই বটে, অনেকে আদর করে যেটাকে বলে “উজ্জল শ্যামবর্ণ ”। রাগ করলে তোমাকে অনেকটা অসহায়ই লাগতো আর পাতলা ঠোঁটগুলো কাঁপতে থাকতো হাওয়ার সাথে। তখন তোমাকে বেশ লাগতো দেখতে এবং আমার এইসব ভাল লাগা গুলো তুমি জানতে, আর জানতে বলেই আমাকে দিনে-রাতে অনেকবার তোমার এই কপট রাগ ভাঙ্গাতে নানা ভঙ্গিমায় আদরের কৌশল আবিষ্কার করতে হতো। আবার ইচ্ছে হচ্ছে জানালা দিয়ে চোখ গলিয়ে বাচ্চাগুলোকে দেখে নিতে, ইশ্‌, ছেলেমেয়েগুলো এখনও আগের মতোই বরফের গুলতি বানিয়ে পরস্পর পরস্পরের গায়ে ছুঁড়ে মারছে, এরা আর কতক্ষণ এইভাবে বরফ ছুড়াছুড়ি খেলবে ভেবে কূল পেলাম না। এখনও তুষার পড়ছে, সাদা সাদা রঙয়ের ফোঁটা যেন ওইদূর আকাশ থেকে কেউ একজন অবিরত ছুঁড়ে দিচ্ছে এই দিগন্তের দিকে। আহা,তুষার কণাগুলো যদি আরেকটুকু বড় হয়ে ঠিক বরফের গুলতিগুলোর সমান হয়েই উপর থেকে ঝরে পড়তো,তাহলে বেশ হতো, শুধু শুধু বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে আর কষ্ট করে এমন ঠাণ্ডায় হিম হয়ে বরফের গুলতি বানাতে হতো না। আমরাও ছোট বেলায় এমন একটা খেলা খেলতাম, কিন্তু তা এমন হিম তুষার কণাকে গুলতি বানিয়ে নয়, আমাদের দেশে তো তুষারের প্রশ্নই আসেনা,বর্ষাকাল শেষ হওয়ার কালে যখন পানি একেবারে যাবো যাবো শুরু করতো, মানে খেতের মধ্যে পানির গভীরতা প্রায় দু-এক হাতে নেমে আসতো তখন আমরা ন্যাংটো হয়ে সেই পানিতে নেমে খেতের তলা থেকে খামচিয়ে কাদা তুলতাম, তারপর দুই হাত দিয়ে কৌশল করে সেই কাদার গুলতি বানাতাম, এবার ছুঁড়ে মারো একজন আরেকজনের দিকে। কাদার গুলতি কারো চোখে মারা বারন ছিল, গ্রামের কানি বুড়ি বলতো কাদার গুলতি চোখের মনিতে লাগলে নাকি চোখ কানা হয়ে যাবে। আমাদের মাঝে ছিল কানা হওয়ার ভয়, কেননা কানা ছেলেকে নাকি কোন মেয়ে বিয়ে করতে চায় না। আমার ছিল ভারী বিয়ের শখ, তাই পারতপক্ষে কেউ জোরাজোরি না করলে আমি ওই কানা হওয়ার কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি খেলতে যেতাম না। তারপরও অন্য সব ছেলেমেয়েরা যখন চলে যেতো, আমার
তখন খুব একা বোধ হতো, কান্না পেতো, ছুটে যেতাম আমাদের বাড়ির উত্তরের বাড়ির কানি বুড়ির কাছে, খুব মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করতাম দিদা সত্যিই কানা হয়ে গেলে কেউ বিয়ে করতে পারেনা? কানি বুড়ি আমার কাতর দশা বুঝতো তাই আমার ভয় দিতো আরো বাড়িয়ে, আমিও কম যেতাম না, বলতাম, বারে দিদা, তোমারও তো এক চোখ কানা, তোমার বিয়ে হল কিভাবে? বুড়িটাও ছিল হাড়ে হাড়ে বজ্জাত, সেও ফোড়ন কেটে বলতো-আমি তো মেয়ে মানুষ, আমার তো বিয়ে হবেই, আরে মেয়ে মানুষ যে মায়ের জাত! খুব কান্না পেতো কাদার গুলতি খেলতে না যাওয়ার জন্য, মনটা হু-হু করতো আর বুড়িকে মনে মনে দিতাম গাল। তোমাকে এইসব গল্প বলেছি অনেকবার, শুনে তুমিও অনেকবার আমাকে খেপিয়েছ আবার মাঝে মাঝে বায়না ধরেছ বর্ষাকালে আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আমার সাথে কাদার গুলতি খেলার। তখন দাবার চাল্ টা আমার হাতেই চলে আসতো বেশ, আমিও ওই কানি বুড়ির মতই অনুরূপ ফোড়ন কেটে বলতাম, বারে খেতের মাঝে এই দুই আঙ্গুল সমান একেকটা জোঁক, তোমার ওখান্‌টা যে নরম! একটা জোঁক ওখান দিয়েই ঢুকে যাবে নির্ঘাত। এইসব শুনে তোমার চোখ ভয়ে ভরে উঠতো, বেশ চিন্তিত মনে হতো তোমাকে, তারপর উদোম হয়ে আমার বুকে বুক পেতে তবেই না তোমার ভয় দূর হতো। বেশ সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে, সিগারেট নিয়ে কি বারান্দায় যাবো? নাহ! বাঁকা হয়ে থাকা শরীরটাকে আর জাগাতে ইচ্ছে করছে না, এটা এইভাবেই অথর্ব হয়ে পড়ে থাক। তুমি তো জানো সবকিছুই আমার সাথে প্রতারণা করে, যেমন করছে এই শরীর,একটুকু যে নিজের মত করে থাকবো সেই সামর্থ্যটুকুও নেই। যেমন সামর্থ্য ছিলনা তুমি যেদিন তোমার পাহাড়ের মত বন্ধুটার হাত ধরে, সব কিছু গুছিয়ে রেখে চলে গেলে। হ্যাঁ, ওইদিনও আমি এমন অথর্বের মতই পড়ে ছিলাম। জানো, কিছুদিন আগে বাংলাদেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম, দেখা হল একটি মেয়ের সাথে, ঠিক তোমারই মত অনেকটা, কথাবার্তা হল, বেশ কিছু দিনে ঘনিষ্ঠতাও হল, তারপর যা হওয়ার তাই হল, অনেকদিন পরে আবার কাউকে আদর করতে হল, কিন্তু উঁহু! কিছুতে নিজেকে ঠিক করতে পারছিলাম না, তখন আলো নিভিয়ে দিলাম, আর আমার সমগ্র কিছু জেগে উঠলো, মনে হল এটা আসলে তুমিই বটে! তুমিতো আমাকে জানোই তারপর যা হওয়ার তাই হল, ঠিক যেমনটি তোমার সাথে হতো। আচ্ছা, ওই পাহাড়ের মত লোকটার সাথে যখন তুমি শুতে যাও তখন তোমারও কি এমনই হয়, তুমিও কি বাতি নিভিয়ে দাও? অন্তরের অন্তরে আমাকেই কল্পনা কর? নাকি তুমি শুধু শুয়েই থাকো একদম শব্দহীন,পাথরের মত। একটু কি পান করবো, ভেবোনা আমি মাতাল হবো, ক্ষুধার্ত রবাহূতের মতো আমি জেগে থাকবো, আর পশ্চিম থেকে পুব আকাশে তল্লাশি চালিয়ে যাবো, দেখবো আমাকে চাঁদ ভেবে তুমি অন্য কারো সাথে উলঙ্গ সঙ্গমে মেতেছ কিনা!
এখনো জানালা দিয়ে বেশ ভালভাবে দেখা যাচ্ছে ছেলেমেয়েগুলোকে, এইসব ছেলেমেয়েগুলো আজ মনে হয় আর ঘরে ফিরবে না, সারারাত তুষারের কণা দিয়ে গুলতি বানাবে, আর একে অন্যের গায়ে ছুঁড়ে দেবে। আচ্ছা, এদের কি আমার মত কোন কানি দিদা বুড়ী নেই, যে এদের মিথ্যে মিথ্যে বলতে পারতো-বরফের গুলতি চোখে লাগলে চোখ কানা হয়ে যাবে আর কানা লোক কখনো বিয়ে করতে পারেনা!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!