বনমালী তুমি

ট্রেন-এ যেতে অঞ্জনের বরাবর ভালো লাগে। দুলুনি এনজয় করে, ঝাল মুড়ি (বড্ড দাম বেড়েছে) , ট্রেন এর বাউল দল। সবই মিলে যায়, শুধু এই হিজড়ে বাহিনী বড্ড অসুবিধে করে। এমনিতে সেক্সিস্ট জোকে দলের মহিলা সহযাত্রীদের অসুবিধে হয়, কিন্তু “এদের”ক্ষেত্রে “ছেলেদের” ওইটুকু ছাড় দেওয়া আছে। তার একটা সহজ কারন এদের দিদিমণিরাও বিশেষ পছন্দ করেন না। তাই শিখন্ডী বাহিনী ট্রেনে উঠলেই তাঁরা একমনে উল বুনতে থাকেন, আর পুরুষ দের সেন্স অফ হিউমার ক্রমশঃ কদর্যতার দিকে হেলতে থাকে। অঞ্জন বোলপুরের একটা স্কুলে মাস্টারি করে। ট্রেনের এই কামরা টা তাদের ইস্কুল মাস্টারদের ডেলি প্যাসেঞ্জারির বাঁধা ডিব্বা। ওদিকের মুরারই থেকে ওঠেন মিত্র দা। আর নলহাটী থেকে ওঠে সৌমেন। মিত্র দা বেশ সিনিয়ার তবে বেশ রসিক মানুষ, আর সৌমেন ছোকরা রিলায়েন্সের টাওয়ারে কাজ করে। বাকি সহকর্মিনী মানে মালবিকা দি, তপতী সবাই রাজগ্রামের দিক থেকে ওঠে। সব দিন মহিলাকুলের সবাই আসতে পারে না। আজ যেমন মহিলাকুলের কেউ নেই ট্রেনে, সবাই পরের ট্রেনে আসবে মনে হয়। মেয়েদের অনুপস্থিতিতে নিজেকে নিয়ে অতটাও সচেতন না হলেও চলে। অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়।
অঞ্জন ভাবতে বসে। ভাবাটা তার একটা গোপন বিলাস। এই যেমন আজকাল তার প্রায়শই মনে হয় জীবনটাও ফেসবুক টাইমলাইনের মত। শুধু অ্যাকাউন্ট খুললেই হল না, সেখানে একটা গল্প থাকা খুব জরুরী, প্রকাশ থাকা প্রয়োজন, কিছু প্রিয় বন্ধু থাকুক, কিছু আত্মীয়স্বজন, কিছু ঈর্ষা, কিছু লুকনো প্রেম, কিছু লাইক-ডিস্লাইক ক্ষমতার তর্জা, অপুর্ণ আকাঙ্ক্ষা, তৃপ্তি সব মিলিয়ে একটা গল্প হওয়া খুব দরকার। বচ্ছর শেষে যেন একটা ৫ মিনিটের ভিডিওতে জীবনের গল্প কথায় তার পূর্ণতা। নইলে একটা ভার্চুয়াল আস্তিত্ব যতখানি হাস্যকর, “বাস্তব” জীবন-ও ততখানি অর্থহীন। সবাই নিজের মতন করে মানে খুঁজে চলেছে। সক্কলেই নিজের গল্প বুনছে… ইস্কুল মাস্টারের এতখানি ফিলজফির-র কোনো প্রয়োজন ছিল না। আজ অঞ্জন এই যে জীবন আর ফেসবুকে অন্ত্যমিল খুঁজে পেতে চেষ্টা করছে তার প্রধান কারন বাড়ীতে সে বৌ এর কাছে ঝাড় খেয়েছে এবং এই হাফ ইয়ার্লি-র প্রায় দেড়শ টা খাতা দেখা বাকি। যখনি সঙ্কট অবস্থা এসে উপস্থিত হয়, অঞ্জন বৈরাগী মোডে চলে যায়। তা অঞ্জনের এই বৈরাগী মোড চলবে আজ সারাদিন কারণ আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। এমন সময় ট্রেনে আবির্ভাব হিজড়ে বাহিনীর। বাহিনী বলা ভুল। এ একা উঠেছে।
চেহারায় কোমলতার আভাস মাত্র নেই। হাত্তালি দিতে দিতে ক্রমশঃ নেমেসিসের মত এগিয়ে আসছে এই কামরায়। কিন্তু আজ তার তত বাজে লাগছে না। বৈরাগী মোডের একটা বড় লক্ষণ দুঃখবিলাস। কেউ জানলো না, কেউ বুঝলো না-এই এক পিস্‌ ই আমি। এ মর্মে সেও একপ্রকার অন্ত্যেবাসী জীবন বাঁচে। সে অর্থে এই মানুষটি কে আজ তার কাছের মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু অন্য যে কোন দিন সে বিরক্ত হয়। দু কামরা দূরে হিজড়েটা গান ধরেছে দামড়া গলায় “তুমি আমারই মতন জ্বলিও জ্বলিও বিরহ কুসুম হার গলেতে পরিও” তার গলায় এ গান মানায় না। যেমন চোয়াড়ে দেখতে সেরকম গলা। কিন্তু আজ অঞ্জনের সবি দুঃখের ঠেকছে, সবি ভারী ধূসর। একটা লজিক খাড়া করে মনে মনে- মানুষটার আর্তির কাছে সুর হয়ত বশ মানে নি, কিন্তু কথা গুলো তো অবয়ব ধরেছে। সে নপুংসকের গলায় কষ্ট দেখতে পায়।
ভাবতে চেষ্টা করে শ্রী রাধিকার আকুতি। পাশ দিয়ে মুড়িওয়ালা মুড়ি-চানাচুর হেঁকে চলে যায়। হজমি গুলি বিক্রি করতে আসে রোজ দিনকার সুধন দা, বইয়ের পাতা ধরে একটা নতুন ছোকরা ধুতির পাড় গোছাবার মত করে পাতা গুছোতে থাকে। চার্লি চ্যাপলিনের জীবনী থেকে শুরু করে সে বাসর রাতে জামাই ঠকানো প্রশ্নের সম্ভার বিলি করে বেড়ায়। অঞ্জন আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। হিজড়ে জীবন আর পুরুষ জীবন কি এক করা চলে? বাড়ি ফিরে সংসারের সুখ টাও এদের কাছে চরম বিলাসিতা। যৌনতা তার বরাবরি ওভাররেটেড মনে হয়। তবু থাকাটা দরকার। মানুষের সুখ দরকার, মানুষের সংসার চাই, মানুষের স্নেহ চাই, উঠোনে খেলে বেড়াবার মত সন্তান। যারা পায়নি, পাবে না, তারা জানবে না কি হারালো। বৈরাগী মেজাজ আর এই গানে অঞ্জন বিহ্বল হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আজ আর তার কিছুই ভালো লাগবে না। এমন সময় মিত্র দা বলে উঠলেন “এই মাল টাকে তো আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। সুধন দা- ও সুধন দা, বলি এটা কি এই লাইনে নতুন?” সুধন দা খুচড়ো পয়সা ফেরত দিতে দিতে “প্রায় এক হপ্তা হয়ে গেল দেখছি। নতুন মনে হয়।“ বলে অর্থপূর্ণ ভাবে একটা চোখ মারা হাসি দেন। সৌমেন লাই পেয়ে এক গাল হাসি দিয়ে বলে “হে হে হে নতুন? বলেন কি? ” বলে সকলে যাতে শুনতে পায় এমন করে গুন গুন করতে থাকে “কাদের কুলের বৌ গো তুমি কাদের কুলের বৌ”।
গাইতে গাইতে সৌমেন সবার দিকে একবার করে চোখ বুলিয়ে নেয় তার রসিকতা-র সমর্থনের জন্য। সুধন দা চশমার ফাঁক দিয়ে চিলতে প্রশ্রয় দেন। অঞ্জনের কানের পাশটা চিড়বিড় করতে থাকে। এই বার ভুলভাল ইতরামো শুরু করবে সৌমেন। সে জানে। সৌমেন ছেলেটা ফক্কড় আছে, অনেকেই তাকে বেশ পছন্দ করে মজা করতে পারার জন্য তবু মাঝে মাঝে শালীনতা পেরিয়ে যায়। আজ মহিলাকুলের অনুপস্থিতিতে শালীনতার সীমাটাও অনেকটাই আলগা। এই যে সে এত কিছু ভাবতে পারে, বোলপুরের ইস্টেশানের মোজাইক দেখে গর্ব বোধ করে, এর জন্যে নিজের কাছেই তার নিজের একটা আলাদা স্থান আছে। সৌমেন এর মত ইতরামো করতে তার বাধে। সকলের সাথে সহজ ভাবে কথা বলতে পারে না অঞ্জন-তার একটা জাস্টিফিকেশান পেয়ে আরাম বোধ করে। তবু হিজড়ে টা একটু দূরে আছে, একটা প্যাসেঞ্জারের গাল ধরে টানাটানি করছে। অঞ্জন সতর্ক হয়।
সামনে এলেই টাকা দিয়ে দেবে, আজ আর “এদের” সাথে ছ্যাঁচড়ামো তার পোষাবে না। সৌমেন সিটে একটা রুমাল ফেলে উঠে যায় দরজার দিকে। এখন সে একটা সিগারেট খাবে। অঞ্জন আবার পারিপার্শ্বিকে মনোযোগ দেয়। এখানকার একটা স্টেশানের নাম আহমদপুর। সুলতানের অমরত্বকে নিজদের মত করে ঘরোয়া করে নিয়েছে। মুখে মুখে নাম হয়েছে আমোদপুর। এদিকে পাকুড় থেকে যত বোলপুরের দিকে আসা যায় কথা হিন্দি ঘেঁষা থেকে মুর্শিদাবাদ ঘেঁষা হয়ে ক্রমে দক্ষিণ বঙ্গের সাঁওতালির মিঠে টান ধরে তাতে। ক্রমশঃ বোলপুর পেরলেই চিকন কালো এক মৃদু ভাষী বোষ্টম ওঠেন। গান ধরেন “জয় রাধে রাধে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ গো-বিন্দ-ও -ও গো-পালো ব-লো রে”। সুরটা ভারি মিষ্টি। অঞ্জনের সুন্দরী দিদার যখন পাগল পাগল অবস্থা তখন তিনিও ফ্যালফ্যাল করে এই গান করতেন, এই সুরেই। আর হাতের থলির জপমালা শিশুর হৃদয়ের মত ধকধক করে নড়ত।
টুকটাক কথাবার্তায় ট্রেন সরগরম। ডিম টোস্ট, ডিমের মামলেট, মুড়ি চপ ৫ টাকা প্যাকেট। -কুথা গেইছিলি? টেন মাঝখানে দাড়িং আছে। তু খেং লে, আমার দেরি হবে। এক পুরুষ তার ক্ষুধার্ত মেয়ে কে বোঝায়। চায়- লেবান্ডি- চা লেবু- চা -কফি হবে-এ-এ হাঁকতে হাঁকতে চলে যায়। নতুন পড়ুয়া ল্যাপটপ খুলে সিনেমা দেখতে থাকে। বর্ধমান যাত্রী কালো কুলো মুনিষরা উঁকি মেরে সিনেমা দেখার চেষ্টা করে। ট্রেন অনেকক্ষন বাতাসপুরে দাঁড়িয়ে আছে। সদ্য কেনা ফোনে গেরস্থ মানুষ বাড়িতে খবর দেন… “হেই বাতাসপুরে দাঁড়ায়ঁ আছি, টিটি বুললে টেনের টায়ার বাস্ট হুং গেইছ্যে”। ফোনধারী নিজের রসিকতায় নিজেই মুচকি হাসে। চমক ভাঙে অঞ্জনের, সত্যিই তো ট্রেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে এইখানে। কেউ কারণ খোঁজার চেষ্টা করে মাল গাড়ী পাস করাচ্ছে মনে হয়। বিজ্ঞ ভদ্রলোক এক ঝটকায় উড়িয়ে দেন, না না মাল গাড়ী না। মালগাড়ী হলে এতক্ষণ অয়েট করাতো না। ইন্টারসিটি পাস করাচ্ছে, লোকালের মানুষরা তো বানের জলে ভেসে এসেচে।
উচ্চারনের পরীশীলতা শুনে অঞ্জন ফিরে তাকায়। কলকাতার মানুষ। দেখেই চেনা যায় এদের। যত্তসব চালিয়াত। হিজড়ে মানুষটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে এই কামরার দিকে। অঞ্জন ঠিক করে নেয় লোকটাকে আজ একটা ৫ টাকার কয়েন দেবে। পকেটে হাত দিয়ে সে বের করে রাখে। অনেক সময় এরা বুঝতে না পেরে এগিয়ে যায়। দেবার ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় দেওয়া যায় না। তাই দিতে চাইলে পকেটে হাত দিয়ে রাখাই শ্রেয়। ট্রেন চলতে শুরু করেছে আবার। সৌমেন আসার আগেই লোকটাকে টাকাটা দিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। এদের মস্করার পর সে যদি একটা হিজড়ে কে যেচে পয়সা দেয় সেটা একরকম সহযাত্রী দের অস্বীকার হবে এমনকি তারা অপমানিতও বোধ করতে পারে। দু একটা খিল্লির মন্তব্য তার দিকেও উড়ে আসতে পারে। অঞ্জন একটু এমনিতেই চুপচাপ। তার ওপর অন্যের দুর্বলতাকে যথেচ্ছ পরিমানে হেয় করতে না পারা টা তার একটা অযোগ্যতা। লোকে কি ভাববে? যথেষ্ট পরিমানে সে রসিক নয়। সহযাত্রী মহলে নিজের এই অবস্থান মেনে নিয়ে নিজেকে নিয়ে একটু বিব্রত থাকে সে। হিজড়ে টা এগিয়ে আসছে এই কামরায়, সৌমেন-ও এদিক পানে এগিয়ে আসছে গাড়ির দুলুনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। গাড়ি নদী পার হল গজগজ করতে করতে। নদী পেলে ট্রেন তখন পাড়ার মাস্তান। তার পার্সন্যালিটি-ই বদলে যায়। জাম্বো জেটের মত সে গুমরোতে থাকে। সৌমেন টলে যায় একটু। নদী পারের গাড়ির চলনে। নদী পার হতেই ক্রসিং। রেল লাইন ক্রসিঙে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক নারী পুরুষ এক দৃষ্টে দেখে গাড়ীর জানলা গুলোকে।
চলমান জীবনরাও গাড়ীর ভেতর থেকে দেখে থমকে যাওয়া সারি। গতি জীবনটাকে বোধহয় সহজ করে দেয়। বেশী ভাবতে হয় না, শুধু গতির সাথে বহতা হলেই চলে। অঞ্জন টাকাটা বের করতে যাবে, পাশ থেকে সৌমেন এগিয়ে এসে খপ্‌ করে হিজড়ে টার হাত চেপে ধরে। “বাবলা না? শালা মেকাপ দিয়ে হিজড়ে সেজেছিস?” আশেপাশের কিছু লোক জন ও সচকিত হয়ে ওঠে। আগের কামরায় একটা ছোকরার সাথে জোর করে টাকা নিয়েছিল মনে হয় সে উঠে আসে ভ্রূ কুঁচকে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু চারটে চড় লাথি পড়ে যায় এদিক সেদিক থেকে। ক্রমশঃ অন্য মানুষরাও এগিয়ে আসে হাতের সুখ করতে। অঞ্জনের হাতের তালুতে ৫ টাকার কয়েনটা ঘামতে থাকে। বেশ কয়েক ঘা বসিয়ে সৌমেন নিজের সিটে বীরদর্পে এসে বসে। উৎসুক মিত্র দা ও বাকিদের চোখের ওপর চোখ বুলিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলল “মাওয়া,খিক্‌ ইকি খিকক্‌ (খিল্লির হাসি) ইয়ে ইয়াকেবারে কেলীইয়েঙ্কারি কান্ড। বুঝলে কিনা…আমাদের পাড়ার বাবলা”। সবাই উৎসুক হয় জানতে, কে বাবলা, কি তাঁর বেত্তান্ত?। হিজড়ে না বাল, মাল্টা তো ছেলে, সৌমেন বলে যায়। ইয়াং ছেলে। ছোটতে পাড়ায় পার্ট করত মেয়ে সেজে। এট্টু লায়েক হতেই মাতাল বাপ লাথিয়ে বের করে দিয়েছে। চড়ে অ্যায়।
হাল্কা দাড়ি দেখে বোঝেননি? তবে সলিড মেকাপ দিয়েচে, আমি ১০ হাত দূর থেকেই বুঝিনি… অঞ্জন ভাবে এই যে বাপ খ্যাদানো মা খ্যাদানো ছেলেটা সেও তো অন্ত্যেবাসী, সেও প্রান্তিক। তবু তারও প্রান্তিকতার অন্য খোলস প্রয়োজন হল। কিছুক্ষণ রসিয়ে রসিয়ে ব্যাপারটা সবাই উপভোগ করল। সৌমেন পিঠ চাপড়ানিও পেলো। অঞ্জন ৫ টাকাটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষন ধরে বসে থাকল। কি করবে টাকাটা? দেবে, দেওয়া উচিত হবে, এই কেলেঙ্কারীর পর? পাবলিকের কাঁচা খিস্তি আর চড় থাপ্পরে ছেলেটা মুষড়ে দরজার ধারে জড়সড় হয়ে বসে বসে আছে। ক্যালকাটা 71 এর একটা দৃশ্য মনে পড়ল। তবু সেখানে একটা বিস্ফোরণের আভাস ছিল। দেখে নেওয়ার স্পর্ধা … এ ছেলে ম্যাদামারা। অঞ্জন উঠে গিয়ে ছেলেটার পাশে দাঁড়ায়। চমকে গিয়ে ছেলেটা কুঁকড়ে গেলো। পকেট থেকে একটা ১০ টাকার নোট বের করে অঞ্জন বলে “নে ধর, পকেটে রাখ”।
সবাই দেখল কোঁকড়ানো শরীর টা ক্রমশঃ টানটান হচ্ছে ছেলেটার। “বাঁড়া, কেলিয়ে এখন ১০টাকা দিতে আসছেন? শালা মায়া দেখাচ্ছেন-মায়া? মাস্টারি করেন বলে দয়া মারাচ্ছেন?” তীব্র শিসের মত হিস হিস শব্দে তার খিস্তি ছুটে আসছিল। আশে পাশের সবাই নাটকের এহেন মোড় পরিবর্তনে বেশ মজা পেয়ে গেল। যে লোকটাকে জনতা বিচার করে শাস্তি দিল, তাকে কেন আবার ঘটা করে মাথায় তুলে আহা উহু করা! বেশ হয়েছে খিস্তি খাচ্ছে মাস্টার। অবতার সাজতে যাওয়া!! এমনিতেই মাইনে বেড়ে এরা সাপের পাঁচ পা দেখে। তাদেরি এক প্রতিনিধি অপমানিত হচ্ছে। ছেলেটা আস্তে আস্তে ফণা মেলতে থাকে। “কি করেছিলাম শালা? পেট চলে না বলে দুটো টাকাই তো চাইছি। এমনি এমনি কেউ দেয় না, তাই রঙ মেখেই আসি। ভদ্দরলোক? মুখে পেচ্ছাপ এমন ভদ্রলোকের।” তার দৃপ্ত ভাষণে গালাগালির ব্যাবহার ক্রমশঃ বাড়তে থাকে, ভাষনে উঠে আসে তার দরিদ্র পরিবার, বঞ্চনা আর অন্যায়ের সত্যি মিথ্যে মাখা তড়কা। সৌমেনও চুপ। বুঝেছে হাওয়া ঘুরছে… সহযাত্রীরা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে ছেলেটার কথা। কেউ কেউ অবাক, কেউ মাথা নাড়ায়। অঞ্জন স্পষ্ট দেখে অ্যান্টনি ভাষন দিচ্ছে একটা হিজড়ের শবের সামনে… অঞ্জন কুঁকড়ে যায়।
পিছু হটতে হটতে ধপ করে বসে পড়ে নিজের সিটে। ছেলেটার ভাষণ কমে আসে ধীরে ধীরে। সহযাত্রী রা বিভিন্ন ভাবে দুজনকেই দেখতে থাকে। অনেকক্ষন পরে সবাই চুপচাপ, সামনে স্টেশান আসছে। মিত্র দা মুখ খোলেন “কি দরকার ছিল আপনার টাকা দিতে যাওয়ার?” গলার সুরে সান্ত্বনার আভাস। “জানেন তো যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। শুদুমুদু অপমান হলেন।” সৌমেন বাঁকা হাসি হাসে। অঞ্জন কিছু না বলে মাথা হাতটা হাঁটুর কাছে জড় করে মাথা নামিয়ে থাকে। সামনে প্রান্তিক স্টেশান আসছে, বেশীরভাগ লোক সেখানেই নেমে যাবে আজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…