বটবৃক্ষ

এক, একটা দিন পুরোনো সুখের সৃতি দ্বারা এখনকার বেদনাগুলো চাপা দিতে চেয়েছিলাম ; কিন্তু ততটা চাপা দিতে পারিনি । হয়ত বর্তমানে বেদনার আপেক্ষিক গুরুত্বটা বেশি । কিছুই করার নেই । যতই বেদনার ঝড় জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যক জীবনটাতো আর থেমে থাকবে না । জীবন চলতেই থাকে ; হয়ত বেদনা-ক্লান্ত মনে কিছুটা ধীরে অথবা আনন্দের মনে দ্রুত গতিতে । এখন আমার বর্তমানটা একটু ধীর গতিতে চলছে ; কিন্তু এ চলা আর কতদিন । আমার কাছে যে সম্পদটা রয়েছে তার সামনে যদি বেদনায় আক্রান্ত এই মুখটা নিয়ে দাঁড়াই তবে যে সেই সম্পদটি আমার হারিয়ে যাবে । আমার স্ত্রী গত হয়েছে উনচল্লিশ দিন আগে । আজ বাসায় কয়েকজন মাদ্রাসার ছেলেরা এসেছে , কুরআন তেলাওয়াত করছে ।

বাসায় মা , শ্বশুর বাড়ির মানুষ রয়েছে ; এছাড়াও অন্যান্য আত্মীয় স্বজন আছে । আমি আমার ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে আছি আর আমাকে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের অংশ , আমার চিন্তা- চেতনা , আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ , আমার ভবিষ্যৎ , আমার সন্তান । আমার আর মুক্তার বিয়ে হয়েছিল প্রায় আট বছর পূর্বে । প্রথমে ভালবাসা দিবসে পরিবারকে জানানো এরপর বিয়ে । বন্ধুমহলের আড্ডায় আমরা দারুণ সমাদৃত , ছিলাম । ওদের সাথে যখনই আড্ডায় জমিয়ে সময় কাটাতাম তখন আমাদের সাথে ছোট্ট একজন বন্ধু থাকতো , এখনো সে আছে আমায় জড়িয়ে ; আমার মেয়ে ছায়া । ছায়ার বয়স এখন প্রায় ছয় । দুই, আমার সাত বছর বয়সে বাবা মারা গেছে , তাইতো একমাত্র সন্তান হয়ে আমি মায়ের ভাণ্ডারের আদর , ভালবাসা , দোয়া সবই পেয়েছি ; পেয়েছি অফুরন্ত সম্পদ । বাবা মারা যাবার পর আমার একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল মা ; বাবাকে অনেক মনে করতাম , ভাবতাম বাবা ফিরে আসবে , আমায় জড়িয়ে ধরবে বুকে । ভাবনা গুলো ক্ষীণ হতে থাকে ।

ভালবাসা সত্যিই সাহসী , একটি দুর্বল ভীতু জীবনকে স্বার্থহীন ভালবাসা জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সহায়ক । মুক্তা আমায় ততটাই সাহস জুগিয়েছে যা না পেলে আমি হয়ত অনেক আগেই জীবন যুদ্ধে হার মানতাম । আমার মা অথবা পরিবারের কেউ আমার জন্য কিছু করেনি সেকথা বলছি না ; তারা আমার জন্য যা করেছে সেই ঋণ শোধ হওয়ার নয় । আমার মা আমায় সবসময় আগলে রেখেছে , চোখের আড়াল হলে কত কি ভেবেছে । কতদিন খাবার টেবিলে ঘুমিয়েছে । বাবাকে বেশি ভালোবাসতাম , আর যখন বাবা চলে গেল তখন যেন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম ।

মনে হল , আমার বয়স মাত্র সাত বছর তাহলে তো আমায় আরও অনেক পথ চলতে হবে আর এই পথ চলতে গিয়ে যখন খরাতাপে ক্লান্ত হয়ে যাব তখন আমি যে বটবৃক্ষ তলে নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে শান্ত হবো , যে বৃক্ষ আমায় ছায়া দিয়ে ক্লান্ত দেহটাকে পুনরায় সচল করবে সেই বটবৃক্ষটি আমার ঝড়ে ভেঙে গেছে । আমি জীবনকে প্রকৃতি দিয়ে ভাবতাম । যদি জীবন পথে আমি পথিক হই তাহলে বাবা ছিল আমার বটবৃক্ষ আর মা শীতল বাতাস । তিন, আমার সংসার জীবনের এক বছর পেরিয়ে গেছে । আমি বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আর মুক্তা অনার্সের ফলাফল প্রত্যাশী । সেদিন মুক্তার বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম , ফলাফল জানতে। খুব ভাল করেছে মুক্তা আর তার ফলাফল দেখেই ও লাফাতে লাগলো , একপর্যায়ে আমায় জড়িয়ে ধারে বলল আজ সারাদিন বাইরে ঘুরবে । রাজি হয়ে গেলাম । রাত এগারোটার দিকে বাসায় ফিরে দুজনই বেশ ক্লান্ত ।

আমি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলাম । মুক্তা এখনো বের হয়নি হয়ত মুখ দুচ্ছে ; মেয়ে মানুষ মুখে কতকিছু যে দেয় তাই পরিষ্কার হতে তো একটু সময় লাগবেই । “তুমি বাবা হবে” সারাদিন অনেক খাটনি গেছে কখন যে ঘুমের রাজ্যে নিজেকে ঠেলে দিয়েছি বুঝি নাই ; স্বপ্ন দেখছি । “ওই তুমি বাবা হবে” লাফিয়ে উঠলাম , ঘুমের রাজ্য স্বপ্নের দেবতা সবাই পালিয়েছে । যেভাবে উঠেছি তাতে মুক্তাই ভয়ে সরে গেছে তাহলে ঘুমের রাজ্য কতটা ভেঙে চুরমার হয়েছে এবং স্বপ্নের দেবতা কতদূর পালিয়েছে অনুমান করা যাবে নহ ; হয়ত স্বপ্ন দেবতা আমার চোখে আর কখনোই ভর করবেই না । দেবতার ভাবনা বাদ দিয়ে আমি মুক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম । “কি বলছ এসব ?” আমি বোকার মতো প্রশ্ন করা শুরু করলাম বউকে । “কি বলছ এসব ? সত্যিই আমি বাবা হবো ? কীভাবে হল এসব ?” আমার এসব কথা শুনে মুক্তা হাসবে না কি বলবে বুঝতে পারলো না । শুধু আমার বোকা বনে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়েই রইল।

“হুম , তুমি বাবা হবে আর আমি হবো তোমার সন্তানের মা।” আমি এতটাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছি যার কারণে বউটাকে কি প্রশ্ন করছি , কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে অজানা এক আনন্দে বোবা হয়ে রয়েছি , মুক্তাকে কি আর বলবো বুঝে ওঠার আগেই ও আমায় জড়িয়ে ধরল । আমি বাবা হবো এই আনন্দে চোখে জলের আগমন কখন ঘটলো বুঝতে পারিনি । বাম হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বোকার মতো মুক্তাকে একটি কথাই বলেছিলাম “তুমি খুব ভাল ।” চার, সারারাত ঘুম হয়নি । অনেক ধরনের ভাবনা আমার মাথায় ঘুরপাক করতে লাগলো । অনেক রঙের ভাবনা । আমি বাবা হতে যাচ্ছি ; আমার চোখে ভাসছে দুটো তুলতুলে হাত আমার মুখ স্পর্শ করছে আর কিছু না বুঝেই এদিক-ওদিক সে তার পা নাড়িয়ে যাচ্ছে । ও কি যেন আমায় বলতে চাচ্ছে । উফ চিন্তাটাই অন্যরকম । আজ খুশির সংবাদটা পেয়েছি আর আমি আজি চিন্তা করতেছি আমার সন্তানের কি নাম রাখবো। ছেলে হলে কি নাম আর মেয়ে আসলে কী বলবো ওকে ।

ওহ সুখের চিন্তায় আমি বিহ্বল হয়ে যাচ্ছি । আমার সন্তানটিকে আমি কীভাবে বড় করবো ওর ভবিষ্যৎ কীরকম হবে এসব অনেক ভাবনা ভাবছি । আমার একটা ভাবনা হৃদয়ে উদয় হল । বিধাতা আমায় আমার জীবনে বাবার ভালবাসা , বাবার শাসন , বাবার আদেশ শোনার সময় বেশি দেন নাই । জীবনের কয়েকটা বছর বাবা আমার পাশে ছিলেন । আমার সন্তানটিও কি আমার মতো বটবৃক্ষহীন জীবন পথের পথিক হবে ? পাঁচ, বাবার মৃত্যুর সময় মায়ের বয়স কম ছিল । মা যদি চাইতেন তাহলে তিনি তো বিয়ে করতে পারতেন । কিন্তু মা বিয়ে করেনি । দাদি , চাচা, মামা-খালা বলেছিল বিয়ের কথা কিন্তু মায়ের উত্তর ছিল “না”। মা বলেছিল সৃষ্টিকর্তা তার বেঁচে থাকার অবলম্বন , উপাদান , শক্তি , প্রেরণা তাঁকে দিয়েছে তাহলে আর বিয়ে কেন ? মা আমায় তার বেঁচে থাকার অবলম্বন করে যেভাবে কাটিয়েছে আমিও আমার মেয়েটাকে জীবনের অবলম্বন করে কাটিয়ে দিবো ।

কেননা আমিই যে ওর বটবৃক্ষ । ছয়, একটা আফসোস সারাজীবন আমি বয়েই যাব হয়ত শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত । বাবা হতে চলেছি সংবাদটি পাওয়ার পর বিধাতার কাছে যে ভয় প্রকাশ করেছিলাম তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন তবে ভিন্ন ভাবে । আমার জীবন পথ ছিল শীতল বাতাসে সিক্ত বটবৃক্ষের ছায়াহীন রোদে ভরা আর আমার সন্তান জীবন পথে বটের ছায়া পেলেও পাবেনা শীতল বাতাসের পরশ । আমার জীবনে পিতা নামক মানুষটির সৃতি খুবই কম । এজন্যই জীবনের পথে বটবৃক্ষের প্রয়োজন কতটা সেই সম্পর্কে আজ লিখছি । আজ থেকে অনেক বছর পরে দেখা যাবে আমার মেয়েটাও লিখবে । তখন হয়ত ওর লেখার বিষয় হবে “ ক্লান্ত জীবনের শীতল বাতাস।” (গল্পটি নিতান্তই কল্পনার বহিঃপ্রকাশ) –সংগৃহীত

বানর আর বিড়াল-এর গল্প

সাগরতীরের পর্যটক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *