বঙ্গদেশের আষাঢ়ে গল্প

মজিদ সাহেব ভুলোমনা মানুষ, ভুলোমনের জন্য জীবনে অনেক সমস্যায় পড়েছেন। কিন্তু কীভাবে যেন পারও পেয়ে গেছেন, নিশ্চয় ওপরওলার কৃপায়। আরও সমস্যায় তিনি পড়তে পারতেন, কিন্তু সেটি হতে দেয়নি তাঁর মেয়ে নিশাত, যার জন্ম হতে হতে তিনি অনেক সহজ হয়েছেন, তাঁর কঠোরতা কমেছে, গরম মেজাজ যথেষ্ট ঠান্ডা হয়েছে। নিশাতের বড় দুই ভাই বড় হয়েছে মজিদ সাহেবের কঠোরতার আমলে। বাবা থেকে এক শ হাত দূরে থাকতেই পছন্দ করে তারা। তাই শীতের সকালে নিশাতকে কোলে নিয়ে তিনি যখন খেলতেন, গল্প শোনাতেন, হাসতেন, আশপাশে ছেলে দুটির কোনো ছায়া পড়ত না। ছোট ছেলে আসেমের চেয়ে নিশাতের বয়সের পার্থক্য প্রায় দশ বছর, কিন্তু এ দূরত্বটা—এমনকি বারো বছরের বড় হাশেমের সঙ্গেও দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলল নিশাত। তবে এতে মজিদ সাহেবের সঙ্গে দুই ছেলের সম্পর্কের কোনো ইতরবিশেষ হলো না।
নিশাত কলেজে ঢুকতে ঢুকতে হাশেম এমএ পাস করে একটা ব্যাংকে চাকরি নিয়েছে। আসেম পড়ছে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে। কিন্তু আসেমকে নিয়ে মজিদ সাহেব কিছুটা চিন্তিত। ছেলেটা রাজনীতি করে—বাম রাজনীতি। তাতে মজিদ সাহেবের সমস্যা নেই, সমস্যা হলো, ছেলেটা প্রায়ই মার খায়। হয় বড় কোনো দলের ক্যাডার, না হয় পুলিশ তাকে পেটায়। জেলেও যায়। এ জন্য পাঁচ-ছ বছর ডাক্তারি পড়েও থার্ড ইয়ার শেষ করতে পারল না।
নিশাত তাঁকে অভয় দেয়, ‘ছটু ঠিক পথেই আছে।’
আসেমকে দুই বছর বয়স থেকে সে ছটু বলে ডাকে।
মজিদ সাহেব কিছুতেই বুঝতে পারেন না, ছটু কীভাবে ঠিক পথে থাকে। ঠিক পথ কি মাঝে মাঝে পিটুনি খেয়ে তক্তা হওয়ার, জেলের ভাত খাওয়ার, মাঝেমধ্যে বইপত্র লুট হওয়ার? তবে নিশাতের ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস। ও যখন বলেছে, হয়তো সেটি ঠিকই। হয়তো ওপরওলা এ পথটাই ঠিক করে রেখেছেন আসেমের জন্য। তাঁর লীলা বোঝা ভার।
নিশাত যত দিন কলেজে ছিল, বাড়িতেই ছিল; আর মজিদ সাহেবের ভুলোমনের জন্য ঘটা নানা বিপত্তি সামাল দিত সে। এ কাজটি তাঁর স্ত্রী করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সারাটা জীবন যেন একটা ছায়া হয়ে কাটিয়ে দিতেই মনস্থ করেছিলেন। শিক্ষাদীক্ষা তেমন না থাকায় তাঁর কাছে বাড়ির বাইরের জগৎটাকে মনে হতো ভয়াবহ। সারা দিন ঘর-সংসার আর গরু-হাঁস-মুরগি নিয়েই কাটত তাঁর। মজিদ সাহেব যে পরীক্ষার খাতা দেখতে ভুলে গেছেন, সময়মতো রক্তচাপের ওষুধ খাননি, অথবা চশমা কোথায় রেখেছেন মনে করতে পারছেন না, বা আসেমকে মাসের টাকা পাঠানোর কথাটা উবে গেছে তাঁর মন থেকে—এসব বিষয় তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়ার কাজটা করার কথা তিনি ভাবতেই পারতেন না। তাঁর একটা বিস্ময় ছিল নিজেকে নিয়ে; হয়তো বলতেনও নিজেকে, ‘দেখলে, কেমন এক ভালোমানুষের সঙ্গে তোমার মতো অপদার্থের বিয়ে হলো, তিনটি সুসন্তানও তুমি উপহার দিলে, আর কী চাই? এখন চুপচাপ বসে এই আনন্দ উদ্যাপন করো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিশাত যখন ঢাকা গেল, মজিদ সাহেবের জীবন কঠিন হয়ে পড়ল। নিশাতের জায়গায় স্ত্রীকে বসাতে অনেক চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু ছায়া হয়ে থাকা স্ত্রীকে দিয়ে এ কাজ যে হবে না, শিগগিরই তিনি বুঝতেও পারলেন। স্ত্রী যে দু-একবার চেষ্টা করেননি, তা নয়; কিন্তু তাঁর চেষ্টা ছিল সাঁতার না জানা মানুষের পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে সাঁতরে সেটি পার হতে কত সময় লাগতে পারে, তার হিসাব নেওয়ার মতো।
২.
শেষ পরীক্ষার আগে আসেম পড়ল মহা বিপদে। এবার অস্ত্র মামলায় ফেঁসে সে ঠাঁই পেয়েছে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে। যে বাবা থেকে এক শ হাত দূরে থাকতে পছন্দ করত সে, সেই বাবার কাছেই পাঠাল আকুল বার্তা, ‘বাবা, বাঁচাও।’ সে-ও বুঝেছে, এযাত্রায় তার আর রক্ষা নেই, ছ-সাত বছর তাকে কাটাতে হবে এই ঠিকানায়। আসেমের পেছনে যিনি লেগেছেন, দিনাজপুরের সবাই তাকে এক নামে চেনে। থানা-পুলিশ, প্রশাসন, যাবতীয় ক্যাডার-মাস্তান—তাকে সবাই মান্য করে। তার হাতে আছে ক্ষমতা এবং ক্ষমতাকে ক্ষমতা বানায় যে দ্রব্য, সেই টাকা। তার পা মাড়িয়েছে আসেম। সরকারি খাসজমি দখল করে তিনি চামড়ার কারখানা বসাচ্ছেন। এতে পরিবেশ দূষিত হবে। উচ্ছেদ হবে ওই সরকারি জমিতে ঘর বানিয়ে থাকা সত্তুর পরিবার। তাই আসেমের দল গিয়েছিল দখল ও উচ্ছেদ ঠেকাতে।
বোকা না হলে এ কাজ কেউ করে, এই বঙ্গদেশে?
মজিদ সাহেবকেও বোকার দলে ফেলা যায়। তিনি আসেমের সব বৃত্তান্ত শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন, দিনাজপুরে গিয়ে দেখা করবেন সেই ক্ষমতাবানের সঙ্গে এবং তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনে ক্ষমতাবান নিশ্চয় বুঝতে পারবেন নিজের ভুল। হাশেমও দেখা যাচ্ছে আরেক বোকা—ক্ষমতাবানের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কাগজে লেখার জন্য তার এক সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছে সে, এবং বন্ধুটিও কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে চলে গেছে দিনাজপুর।
আসেমের যে বন্ধু তার বিপদভঞ্জনের আকুতি নিয়ে মজিদ সাহেবের কাছে এসেছিল, তাকে তিনি বললেন, একটা কিছু হবে, আসেম যেন চিন্তা না করে। কিন্তু আসেমের মুক্তির জন্য তিনি যে দিনাজপুর যাবেন, তা কী করে? হাশেমের ব্যাংক ছুটি-ছাটার ব্যাপারে রীতিমতো নিষ্ঠুর। মজিদ সাহেব একা যে যাবেন, সে উপায়ও নেই। তিনি বসে থাকলেন নিশাতের জন্য। বৃত্তির টাকা দিয়ে নিশাত তাঁকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছে, তাতে তাঁর ভুলোমনের জন্য তৈরি অনেক সমস্যার সমাধানও হয়। নিশাত বলেছে, সে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে বাবাকে নিয়ে দিনাজপুর যাবে। নিশাতও দেখা যাচ্ছে, বোকাদের দলের সর্বশেষ সদস্য।
৩.
হাশেমের বন্ধু দৈনিক সৎচিন্তার স্টাফ রিপোর্টার পীযূষ রায় দিনাজপুরে নামল। পত্রিকাটি ‘সুনীতির পথে, সব সময়’ কথাটি মাস্ট হেডে লাগিয়ে প্রতিদিন দুর্নীতি, পুকুরচুরি—এসবের সংবাদ দেয়, এবং চমকপ্রদ সংবাদ দিয়ে সাড়া ফেলে দেয় দেশজুড়ে। সাংবাদিক হিসেবে পীযূষের নামধাম আছে, কয়েক জেলার পুলিশ চেনে তাকে। দিনাজপুর অবশ্য দেখা গেল ভিন্ন একটা জায়গা। কাজ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিছু লোক সার্কিট হাউসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল। সেখানে পুলিশের এক বিপন্ন চেহারার কর্তার সামনে ওই ক্ষমতাবান তাকে বললেন, তার জন্য দুপুরের কোচে টিকিট কাটা হয়েছে। সে যদি তাতে উঠে চলে যায়, তাহলে সঙ্গে বিনা মূল্যে এক বস্তা লিচুও চলে যাবে। দিনাজপুরে লিচুর সিজন চলছে। আর যদি কোচটা তাকে ছাড়া চলে যায়, তাহলে…
বাকিটা সেই বিপন্ন চেহারার পুলিশ তাকে বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘আপনি কে ভাই? মানুষ না অন্য কিছু?’
‘কেন?’ জানতে চাইল পীযূষ।
‘আমার কথা শোনেন। কোচে উঠে যান। লিচু নেওয়াটা অপশনাল। না-ও নিতে পারেন।’
পীযূষের দোনোমনা ছিল। তার বিভাগীয় সম্পাদকের সঙ্গে ফোনে সে কথা বলল। তিনি বিরক্ত, তাঁকে সবকিছু না জানিয়ে পীযূষ কেন গেল দিনাজপুরে। এ সময় বিভাগীয় সম্পাদককে পীযূষ বলল, দিনাজপুরে যাওয়ার আগে ক্ষমতাবানের নামটা তাঁকে বলার পর তিনি তথাস্তু বলেছিলেন।

এবার রেগে গেলেন বিভাগীয় সম্পাদক, ‘আজই ফিরে আসো,’ হুংকার দিলেন তিনি।
পীযূষ ফোন করল সম্পাদকের কাছে। তিনবার চেষ্টার পরও তাঁকে ধরা গেল না। তিনি ফোন ধরছেন না। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আছেন। এখন কী করে পীযূষ? সে-ও কি বোকার দলে নাম লেখাবে?
৪.
বোকা পীযূষকে দুপুরের কোচে ঠিকই পাওয়া গেল, একেবারে পেছনের সিটে, কিন্তু তার ক্যামেরাটা নেই, যে হাত দিয়ে সে ক্যামেরা ধরত সে হাতটি ভাঙা। সারা শরীরে ছোটখাটো জখম।
হাসপাতালে পীযূষকে দেখতে গেল হাশেম। শূন্য হাতে। হাত কেন শূন্য? কারণ কিছু যে কিনবে, সেই টাকা কোথায়? অথবা হঠাৎ চাকরি চলে গেলে কিছু কিনতে যে হাতে টান পড়ে, তাতে দ্রুতই হাতে শূন্যতা দেখা দিলে কী করে কেউ কিছু কেনে?
হাশেমের চাকরি গেল কেন? গেল, কারণ ব্যাংকের কোনো হিসাব থেকে চার লাখ বারো হাজার টাকা মেরে দিলে চাকরি কী করে থাকে?
পীযূষ কাতরকণ্ঠে তাকে বলল, ‘আসেমের সঙ্গে এখন তোরও একটা জায়গা বোধ হয় পাকা হয়ে গেল—চৌদ্দ সিকের পেছনে।’
৫.
তারপরও দিনাজপুর গেল বোকা বাহিনী। বাহিনীর নেতৃত্বে মজিদ সাহেব—তালপুর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক; সঙ্গে নিশাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী; সদ্য চাকরি হারানো ও মামলার ভয়ে কাতর হাশেম; এবং একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত (ও শরীরের শুকাতে থাকা নানা ক্ষত) নিয়ে পীযূষ।
পীযূষকে সৎচিন্তার বিভাগীয় সম্পাদক একটা সদুপদেশ দিয়েছিলেন, ‘দিনাজপুরে যাবা না। গেলে খবর আছে।’
পীযূষ বলেছিল, ‘লোকটার বিরুদ্ধে একটা লাইন না হয় না লিখলেন, কিন্তু তা বলে তাকে আড়াল করলেন? দেশবাসীকে জানালেন, আমি পড়েছিলাম ছিনতাইকারীর সামনে?’
‘যা ঘটছিল তা-ই তো ছাপা হইছে মিয়া। তোমার সঙ্গে ফরিদও তো ছিল। ও ছবি তুলছে। আর জুনায়েদ ঘটনা যা ঘটেছে, তা লিখেছে।’
ফরিদ দিনাজপুরে সৎচিন্তার স্থানীয় আলোকচিত্রী আর জুনায়েদ ওই দৈনিকেরই স্থানীয় প্রতিনিধি। এরপর ফোন না ধরা সম্পাদকের কাছে একটা ইস্তফাপত্র জমা দিয়ে বোকা বাহিনীর সঙ্গী হয়েছে পীযূষ।
৬.
দিনাজপুরে নামতেই পীযূষ দেখল বিপন্ন চেহারার সেই পুলিশের কর্তাকে। এবার তাঁকে বিমর্ষও দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘ভাই, কেন মিছামিছি গন্ডগোল করেন? কেন আইলেন?’
‘আপনি কেন বাসস্টেশনে? কী চান?
মাথাটা নিচু করলেন বিমর্ষ অফিসার, ‘ভাই, লোকটারে আপনি চেনেন না, আমি চিনি। সেই জন্য তার লোকজন আসার আগে আপনাদের সাবধান করতে এসেছি।’
বিমর্ষ অফিসারের বিমর্ষতা আরও বাড়িয়ে একটা ফোন এল, ‘স্যার,’ তিনি বললেন, ‘স্যার। স্যার।’
তারপর একটু বিপন্ন হেসে বললেন, ‘এখনো সময় আছে।’ তারপর চলে গেলেন।
তিনি চলে যেতেই একটি বাহিনী এসে হাজির। তাদের দুজন একটা মাইক্রোবাসে টেনেহিঁচড়ে তুলল নিশাতকে, তার মোবাইল ফোনটা মাটিতে ফেলে জুতা দিয়ে পিষতে পিষতে; চারজন একটা জিপে তুলল পীযূষ আর হাশেমকে, এবং একজন হাত ধরে টেনে মজিদ সাহেবকে নিয়ে বসাল একটা কাউন্টারের চেয়ারে। বলল ‘ওই যে বাসটা ধোঁয়া ছাড়তেছে, এইটাতে উঠে বগুড়া যান। বগুড়াতে গাড়ি চেঞ্জ করে ঢাকা যান।’
লোকটা হাসতে হাসতে একটা মোটরসাইকেলে উঠে দশ দিক কাঁপিয়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণ বিমূঢ় বসে থাকলেন মজিদ সাহেব। তাঁর কানে বাজছে নিশাতের আর্তচিৎকার, ‘বাবা, বাঁচাও।’
কী আশ্চর্য মিল দুই ছেলে-মেয়েতে। আসেম ‘বাবা, বাঁচাও’ এভাবেই বলেছিল নিশ্চয়। তাকে বাঁচাতেই দিনাজপুর এসেছিলেন তিনি। এখন নিশাতকে কে বাঁচাবে?
চেয়ারে বসে স্তব্ধ কয়েক মুহূর্ত—মজিদ সাহেব যেন চলে গেলেন ধ্যানের গভীরে, তিনি ওপরওলার কাছে জানতে চাইলেন, এখন কী হবে নিশাতের? হাশেম আর পীযূষের? মানিকগঞ্জ থেকেও বারো মাইল দূরের এক প্রাইমারি স্কুলের সাদাসিধে শিক্ষক মজিদ সাহেব। তিনিও বুঝলেন, মেয়ের কপালে কী আছে। চোখের সামনে তিনি দেখেছেন, তাঁর উনিশ বছরের মেয়েকে একটা গাড়িতে টেনে তুলল দুজন মানুষ। তাদের চোখেমুখে লালসার হাসি, যেন সুস্বাদু শিকার ধরা পড়েছে তাদের জালে। এখন শিকার আর শিকারির কোনো দূরত্ব থাকার কথা নয়।
এখন কান্না ছাড়া কী করার আছে মজিদ সাহেবের, এই বঙ্গদেশে? তিনি কাঁদলেনও। তাঁর পৃথিবীটা যে ভেঙে পড়েছে, সেটি বুঝলেন, কারণ ভাঙতে থাকা পৃথিবীর ভারটা তাঁকে মাটিতে প্রায় মিশিয়ে দিল। তাঁর মনে হলো, তিনি মাটিতেই মিশে যাবেন। নিশাত যাওয়ার আগেই তাঁকে চলে যেতে হবে; হাশেম, আসেম শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে শেষ হতে হবে—এ রকম একটি জরুরি বোধ তাঁকে অবশ করে দিতে থাকল ক্রমশ। কিন্তু মাটিতে মিশে যাওয়ার আগে হঠাৎ স্ত্রীর মুখটা ভেসে উঠল মজিদ সাহেবের চোখজুড়ে। বোকা বাহিনী নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা হওয়ার আগে ছায়া হয়ে থাকা স্ত্রী তাঁর হাতে ধরে বলেছিলেন, ‘তিনটা ছেলে-মেয়ে নিয়ে ফিরবেন, কথা দেন?’
কথা দিয়েছিলেন মজিদ সাহেব, বোকা বাহিনীর প্রধানের পক্ষে যা স্বাভাবিক।
মজিদ সাহেব চোখ খুলে দেখলেন, তাঁকে ঘিরে একটা ভিড়। একজন, দেখতে শুনতে যে আসেমের মতোই, তারই বয়সী, তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই হাত ধরে উঠলেন তিনি। এবার তাঁর চোখে পড়ল, ভিড়টা যথেষ্ট বড়। সেই ভিড়ে তিনি পেলেন বিমর্ষ চেহারার পুলিশ-কর্তাকেও। মজিদ সাহেবের চোখে পানি। তবে সেই পানি যেন কোনো অদৃশ্য আঁচল দিয়ে মুছে দিলেন তাঁর ছায়া হয়ে থাকা স্ত্রী। যেন নিচু স্বরে বললেন, ‘কথা দিয়েছেন কিন্তু।’
চোখ মোছা হাতটা এবার উঠল মাথার ওপরে। মাটিতে পড়ার আগে যে চেয়ারে বসে ছিলেন মজিদ সাহেব, সেই চেয়ারে হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন। হাতটা মাথার ওপর রেখেই ভিড়ের মানুষগুলোকে বললেন, ‘আমার মেয়েকে আর দুই ছেলেকে একটু আগে ওরা নিয়ে গেছে। আমি ওদের আনতে যাব। আপনারা আমাকে একটা দা দেন, যে রকম দা দিয়ে আমি আগাছা কাটি।’
মজিদ সাহেবের মাথার ওপর নতুন আসা আষাঢ়ের আকাশ। ঘোলাটে, বিভ্রম জাগানো। তাঁকে টেনে তোলা তরুণ বলল, ‘চাচা, আপনার দা লাগবে না, আমরা যাচ্ছি।’
মজিদ সাহেব বললেন, ‘আমি তালতলা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিদ মুন্সি।
আরেক তরুণ বলল, ‘স্যার, আমরা আছি।’
সেই তরুণ থেকে আরেক তরুণ, ওই তরুণ থেকে এক প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে পান দোকানদার, পান দোকানদার থেকে বিমর্ষ পুলিশ এবং পুলিশ থেকে নার্সের পোশাক পরা একটি মেয়ের গলায় একটা ঢেউয়ের মতো যেন কথাগুলো বাজতে লাগল। কত, কতজন, গুনে শেষ করতে পারবেন না মজিদ সাহেব—একে একে, একসঙ্গে, উঁচু গলায়, আকাশ কাঁপিয়ে বলতে লাগল, ‘স্যার, আমরা আছি।’
ধোঁয়া ছাড়তে থাকা বগুড়ার বাসের ড্রাইভার এসে বলল, ‘স্যার, আপনার ছেলে-মেয়েদের নিয়াই ঢাকা যামু। এখন চলেন, ওদের আনতে যাই।’
মজিদ সাহেবকেও বোকার দলে ফেলা যায়। তিনি আসেমের সব বৃত্তান্ত শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন, দিনাজপুরে গিয়ে দেখা করবেন সেই ক্ষমতাবানের সঙ্গে, তাঁর কথা শুনে ক্ষমতাবান নিশ্চয় বুঝতে পারবেন নিজের ভুল
৭.
সৎচিন্তার স্থানীয় সাংবাদিক জুনায়েদ বসে ছিল সার্কিট হাউসের বাইরে। ক্ষমতাবান একটা পদ পেতে যাচ্ছেন, সাংবাদিকদের ডেকেছেন তা জানানোর জন্য। সে খবর পেল, বাসস্টেশনে একটা অবাক কিছু ঘটেছে। সে ভাবল, আগে ব্রেকিং নিউজ, তারপর ক্ষমতাবানের গল্প।
বাকিটা জুনায়েদের জবানিতে:
‘দুপুরের আগেই গোটা দিনাজপুর ভেঙে পড়ল সার্কিট হাউসের মাঠে। হাজার হাজার মানুষ, সকলের হাত মুষ্টিবদ্ধ। কোনো হাতে একটা অস্ত্রও নেই। শুধুই হাত। হাজারে হাজারে হাত। একসময় ডিসি-এসপির অফিস ঘিরে ফেলল মানুষ। ঘিরে ফেলল ক্ষমতার সব কটি ঠিকানা। রাস্তায় রাস্তায় শুধু মানুষ। নিচে মানুষ, ওপরে আষাঢ়ের আকাশ। গাড়িঘোড়া চলা বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-আদালত, স্কুল-কলেজ, বাজার-কালোবাজার—সব বন্ধ। শুধু স্রোতের মতো মানুষ। সবার গলায় একটাই কথা, ‘স্যার, আমরাও আছি।’
সার্কিট হাউসের ফোন বেজেছে, সারা দেশে সব ক্ষমতার অফিসে ফোন বেজেছে সমস্ত দুপুর। একটা আতঙ্ক সবখানে—না না, আতঙ্ক মানুষের মধ্যে না, আতঙ্ক অন্য জায়গায়। সেই আতঙ্কে দিনাজপুরের ক্ষমতাবান এক ঘণ্টায় যেন বুড়ো হয়ে গেলেন। কাঁপতে কাঁপতে ডিসিকে তিনি বললেন, ‘কিছু একটা করেন।’
কিছু একটা করা এরপর সহজ হলো। ক্ষমতা শুনল মানুষের গলা। দিনাজপুর মেডিকেলের ছাত্র মোহাম্মদ আসেম ছাড়া পেল ঢাকায়, তুলে নেওয়া হলো তার বিরুদ্ধে থাকা মামলা। মজিদ সাহেবের মেয়ে নিশাত উদ্ধার হলো, তাঁর ছেলে হাশেম, সৎচিন্তার স্টাফ রিপোর্টার পীযূষ রায়কে মজিদ সাহেবের কাছে নিয়ে আসা হলো। ফিরিয়ে দেওয়া হলো হাশেমের চাকরিও। ব্যাংকের কতিপয় কর্তার কল্লা ধুলায় গড়াল।
শেষ খবর, সরকার তিন সদস্যের এক শক্তিশালী কমিটি করেছে ব্যাপারটা তদন্তে। ক্ষমতাবানকে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে জেলে নিয়ে গেছে।
একটা বিশাল অদলবদল যে ঘটেছে, আরও এবং আরও যে ঘটবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
জুনায়েদের রিপোর্ট অবশ্য ছাপা হলো না, কারণ সৎচিন্তার নতুন বিভাগীয় সম্পাদক তার প্রতিবেদন পড়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এসব কী ছাইপাঁশ লিখেছে।’
তিনি ভাবলেন, পীযূষকেই বলতে হবে। পীযূষই পারবে ঠিকঠাক একটা রিপোর্ট লিখতে।

দুঃখিত!