“তুই কাকে বিয়ে করবি তিতির ? ” সোনা কাকুর প্রশ্নের উত্তরে গল্পের বই থেকে মুখ না তুলেই তিতির জবাব দিল “ফেলুদাকে !”সোনা কাকু হেসে বলল ” সামনের চায়ের দোকানের ফেলুদা ? ” তিতির মাথাটা দুদিকে নাড়িয়ে বলল “না! সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা !” সোনা কাকু বলল “আচ্ছা , কিন্তু কোন ফেলুদা ? সৌমিত্র চ্যাটার্জী ,সব্যসাচী চক্রবর্তী নাকি আবীর চ্যাটার্জী ? ” তিতির নির্বিকার ভাবে বলল “প্রদোষ মিত্র!” সোনা কাকু এবার আপাত গম্ভীর ভাবে বলল “তোর পছন্দ সত্যি প্রশংসনীয় তিতির ,পাত্র হিসেবে তার যোগ্যতা নিয়ে আমার কেন, কারোর কোনো সন্দেহের অবকাশ সে রাখেনি কিন্তু তাকে তোর মনের কথা জানিয়েছিস কি ?” তিতির বলল ” না !সরাসরি বলিনি তবে তার প্রত্যেকটা গল্প এভাবে বার বার করে পড়া , বিশেষ করে তার মুখ থেকে বেরোনো কথা গুলো একেবারে মুখস্থ করে ফেলার কারণ আর যার হোক তার মত বুদ্ধিমান মানুষের তো না বোঝার কথা নয় !” সোনা কাকু বলল ” তা সে ও কি তোকে বিয়ে করতে রাজী ?” তিতির নির্বিকার ভাবে বলল ” নাহলে সাতাশ বছর বয়স অব্দি তার কোনো মেয়ে বন্ধু না থাকার কারণ আর কি বা হতে পারে তুমি ই বল সোনা কাকু ?” সোনা কাকু গম্ভীর ভাবে বলল “তা বটে !!”
হঠাৎ সোনা কাকুর ফোনটা বেজে উঠলো। তিতির শুনলো সোনাকাকুর চিন্তিত গলার স্মর “আচ্ছা,আমি নিশ্চই যাব !” তিতির বই টা নামিয়ে রেখে বলল ” কি হয়েছে সোনা কাকু ?” সোনা কাকু বলল “অনন্তের ফোন ছিল ,ওর মাসতুতো বোন নাকি খুব অসুস্থ ,খুব করে বলল আমি যদি পারি তাহলে যেন একবার গিয়ে দেখে আসি !” তিতির বলল ” তা এতে চিন্তিত হবার কি আছে ? এত বড় ডাক্তার তুমি আর অনন্ত কাকু তো তোমার পুরনো বন্ধু!” সোনাকাকু বলল ” না রে তিতির, ব্যাপারটা অত সহজ নয় ,যে অসুখের কথা অনন্ত বলল তার চিকিৎসা ডাক্তারি শাস্ত্রে আছে বলে আমার জানা নেই! তাই আমি গিয়ে কতটা কি করতে পারব সন্দেহ হচ্ছে !” তিতির বলল “মানে ? কি অসুখ ?” সোনাকাকু চিন্তিত মুখে বলল “অনন্তের বোনকে নাকি ভুতে ধরেছে !” তিতির অল্প হেসে বলল ” তাই নাকি ? আমার যে ভূত দেখার ইচ্ছা সেই ছোটবেলা থেকে ,আমাকেও সাথে নিয়ে চলো সোনাকাকু ,রথ দেখা আর কলা বেচা দুই হবে !” সোনাকাকু বলল ” রথ দেখা আর কলা বেচা ? স্কুলে যে কি শেখাচ্ছে তোকে কে জানে ! এই কথা টার মানে তখনি হয় যখন ২ টো কাজ একটা লোকই করে ,আর এখানে আমি করব চিকিৎসা আর তুই দেখবি ভূত ! ” তিতির হেসে বলল “ওই হল ,তুমি আর আমি কি আলাদা নাকি ?” সেই শুনে সোনা কাকু আবার আপাত গম্ভীর ভাবে বলল “বুঝলাম !!”
তিতির আর সোনাকাকু গাড়ি থেকে নেমে একটা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো ,সোনাকাকু বলল “অনন্তের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী এই বাড়িটাই মনে হচ্ছে বুঝলি তিতির ?” সেটা শুনে তিতির দৌড়ে গিয়ে দরজায় আটকানো কলিং বেল টা বাজিয়ে দিয়ে এসে আবার সোনাকাকুর পাশে দাড়ালো।
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে বললেন , “ক্ষমা করবেন ,আপনাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না !” সোনাকাকু হাত জোড় করে বলল ” নমস্কার ,আমি Dr. স্বাগ্নিক মুখার্জী ,আর ও হলো তিতির ,আমার ভাইঝি ,আমাকে অনন্ত ফোন করেছিল।” বয়স্ক ভদ্রলোক এবার লজ্জিত হয়ে বললেন ” ও! আসলে আপনার নাম বহুবার শুনলেও কোনদিন চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অনন্ত আমাদের বলেছিল বটে কিন্তু আপনি যে বাড়িতে আসতে রাজী হবেন তা একবারও ভাবতে পারিনি ! দয়া করে ভিতরে আসুন। “
সোনাকাকুর সাথে যেকোনো জায়গায় গেলে এক অভাবনীয় আতিথেয়তা তিতির আগেও বহুবার উপভোগ করেছে,এটা কতটা আন্তরিক তা নিয়ে সে কোনদিন মাথা ঘামায়নি ,গুনের বা গুনীর আদর সব মানুষই করে বলে তার বিশ্বাস। যদিও সোনাকাকু তাকে বার বার বলেছে “পেটের দায়ে কয়েকটা পুথি পড়া লোক কে কখনোই গুনী বলা চলে না ,গুন হল জন্মগত জিনিস, একেবারে ভিতরের ,যাকে কেবল সময়ের সাথে শানিয়ে নেওয়া যায় !” তবুও তিতিরের চোখে সোনাকাকুই তার দেখা সবচেয়ে গুনী মানুষ।
তিতির সোনাকাকুর সাথে ভদ্রলোক কে অনুসরন করলো ।একটা ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে ভদ্রলোক সোনাকাকুর দিকে তাকিয়ে বললেন “আপনারা একটু বসুন ,রোহিনী মানে আমার ছেলের বউ ওদিকের ঘরে থাকে। আমি একবার ওকে গিয়ে বলে আসি ,তারপর আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি। ” সোনাকাকু বলল ” সে ঠিক আছে কিন্তু তার আগে আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল ! ” বয়স্ক ভদ্রলোক দরজার সামনে থেকে ফিরে এসে বললেন “আমার সাথে ? হ্যা নিশ্চই ! বলুন না। ” সোনা কাকু বলল ” কিছু মনে করবেন না মিস্টার সাহা,আপনার পুত্রবধু কে দেখতে যাওয়ার আগে আমার সবটা জানা দরকার,সব শুনে যদি আমার মনে হয় আমি সত্যি আপনাদের কিছু সাহায্য করতে পারব তাহলেই আমি এগোবো নাহলে শুধু শুধু সকলের মূল্যবান সময় নষ্ট করাতে আমার অমত! ” বয়স্ক ভদ্রলোক এবার সামনের সোফায় বসে বললেন “বুঝতে পারছি। আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করব আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে। ” তারপরের কথাবার্তা এরকম :
সোনাকাকু : আমাকে খোলাখুলি বলুন আপনার কেন মনে হয় যে আপনার পুত্রবধুকে ভূতে ধরেছে।
ভদ্রলোক : এটা মাস দুই আগেকার ঘটনা। প্রায় একবছর পর সমীর মানে আমার ছেলের বিদেশ থেকে ফেরার আগের দিন বাজার থেকে জ্যান্ত মাছ কিনে আনা হয়েছিল। কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে বন্ধ রান্না ঘরে বালতি ঢাকা মাছ পরের দিন সকালে একেবারে ভ্যানিশ যাকে বলে। এর কারণ নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে আবার নতুন মাছ কিনে আনায় পরদিন সকালে সেই একই ঘটনা ঘটল । মানদা হলো আমাদের পুরনো কাজের মেয়ে,সে নাকি ওই দুদিনই রোহিনীকে রান্না ঘরে ঢুকে কাঁচা মাছ খেতে দেখেছিল । শুধু তাই নয় ,তার কথা অনুযায়ী রোহিনী নাকি যখন তখন সামনের পুকুর ধারে ঘুরে বেড়ায় ,আর আশে পাশে কাউকে না দেখলেই পারের ধারে বসে পুকুরের কাঁচা মাছ ধরে খায়। সেদিন আমি মানদার কথায় কান না দিলেও তারপর কিছুদিন মাছ আনা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। হঠাৎ সমীর একদিন আবার সবার জন্য জ্যান্ত মাছ কিনে আনলো বাজার থেকে। সত্যি জানার কৌতুহলে সেদিন রাতে আমি আর আমার স্ত্রী কিছুতেই ঘুমাতে পারিনি। স্ত্রীর সাথে রান্নাঘরের পিছনের উঠোনে দেওয়ালের ধারে লুকিয়ে রান্না ঘরের দিকে চোখ রেখে অপেক্ষা করছিলাম। ক্লান্ত হয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পরেছিলাম, কিন্তু মাঝরাতের দিকে রান্নাঘর থেকে আসা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ,এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি স্বাগ্নিক বাবু ,রান্না ঘরে মাছের বালতির দিকে তাকিয়ে যে দাড়িয়ে ছিল ,সে আর কেউ নয় ,আমার পুত্রবধু রোহিনী। বেশ কিছুক্ষণ পর সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি আর আমার স্ত্রী রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম বালতি তে একটাও মাছ নেই। কিন্তু ছেলের মুখ চেয়ে একথা আমরা আর কাউকে বলতে পারিনি। কিন্তু এরপর যেটা হলো তাতে আর চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না। আমাদের বাড়িতে আমার স্ত্রী র নিয়ে আসা সাধের কাকাতুয়া ‘টিটু’ ওই বারান্দায় দাড়ের উপর রাখা থাকতো। গত রবিবার দুপুরে আমাদের এলসেশিয়ান কুকুর রক্সীর চিৎকারে আমাদের ভাত ঘুম ভেঙে গেলে দৌড়ে বাইরে বারান্দায় গিয়ে দেখি ,টিটুর পালক গুলো অবিন্যস্ত ভাবে বারান্দা জুড়ে ছড়িয়ে আছে ,আর হাতে মুখে রক্ত মেখে বসে থাকা রোহিনী প্রাণপণে রক্সীর গলা টিপে ধরার চেষ্টা করছে। সে দৃশ্য একবার দেখলে আপনিও আমাদের মত আর রাতে ঘুমাতে পারতেন না স্বাগ্নিক বাবু। টিটুকে না বাঁচাতে পারলেও রক্সী কে কোনো ভাবে রোহিনীর কবল থেকে ছাড়িয়ে আমরা রোহিনীকে ওপাশের ঘরে নিয়ে গেছিলাম। তারপর থেকেই ওই তালা বন্ধ ঘর থেকে আমরা আর রোহিনীকে বেরোতে দিতে পারিনি ,খুব অসহায় লাগছে নিজেকে কিন্তু আমাদের আর কি বা করার আছে বলুন। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না স্বাগ্নিক বাবু,একদিকে লোক লজ্জার ভয় অন্যদিকে এই বিপদ থেকে বের হওয়ার জন্য আকুলি বিকুলি প্রাণ ,আমরা যে কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ইতিমধ্যে গতকাল অনন্ত আসায় লজ্জার মাথা খেয়ে হলেও ওকে সব খুলে বলেছি। এখন যা আইন কানুন ,হয়তো লোক জানাজানি হলে অনেকেই ভাববে আমরা এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছি ,ছেলে বউ কে জব্দ করার জন্য নিজেদের আটা ফন্দি ,কিন্তু বিশ্বাস করুন রোহিনী কে আমরা ভীষণ ভালোবাসি ,ওর মত ভালো মেয়ে আজকাল কার দিনে দেখা যায় না।আপনি যদি ওকে চিকিৎসা করে ভালো করে তুলতে পারেন,আপনার কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ থাকবে না! “
সোনাকাকু : হুম বুঝলাম। আপনারা বাড়িতে কজন থাকেন ?
ভদ্রলোক :আমি ,আমার স্ত্রী ,সমীর ,রোহিনী ,সবুজ ,মানদা ,শ্যামচরণ আর রক্সী। সবুজ হল আমার নাতি আর শ্যামচরণও মানদার মত আমাদের অনেক পুরনো কাজের লোক।