গ্রামের নাম কাঞ্চনবাড়ি। চারদিকে আমবাগান। মাঝে মাঝে ছোট আমের গাছের মধ্যে আখ ও ধানের ক্ষেত। গ্রামের উপর দিয়ে বিশ্বরোড চলে গেছে সোনামসজিদ চেকপোষ্ট পর্যন্ত। সে গ্রামে চার সন্তান নিয়ে বসবাস করে নান্টু পাজি। নান্টু পাজির অঢেল জমি জমা ও সম্পদের অভাব ছিল না। সন্তানের মধ্যে মাসুদ সবার ছোট। কিন্তু অন্ধ। তাকে নিয়ে পরিবারের চিন্তা ভাবনা থাকলেও খুব ভেঙ্গে পড়ত না। কারণ নান্টু পাজি’ একজন বড় গেরস্থ। প্রতিবছর আমের বাগান থেকে লাখ লাখ টাকা, শত শত মন ধান, শত শত মন আখের গুড় পায়। ছেলেরা ব্যবসা বানিজ্য করে, জমি চাষাবাদ করে। কোন কিছুর অভাব নেই। খোদা তাকে ষোল কলা দিয়ে পরিপূর্ণ করেছেন। শুধু একটি সন্তান অন্ধ, এই যা।
পরিবারের লোকজন তেমন শিক্ষিত নয়। শিক্ষার মূল্যও জানে না। জানে টাকা কিভাবে রোজগার করা যায়। মাসুমকে অন্ধদের স্কুলে ভর্তি করার জন্য কোন খোঁজ রাখে নি। সে বড় হয়েছে। মা ও অন্য ছেলেদের বড়-ঝিরা কাজ কর্মে ব্যস্ত। মাসুম যৌবনে পদার্পণ করেছে। বিয়ের জন্য বউ খোঁজা-খুঁজি শুরু হয়েছে। গেরস্থ পরিবারের মেয়েদের খুঁজলেও মিলছে না।
পাশ্ববর্তী গ্রাম লা-ভাঙ্গা । সেখানে রয়েছে এক দিন মজুরের কন্যা। নাম তার ফুল বানু। দেখতে সুন্দরী। যৌবনের রূপ যেন উপচে পড়ছে। কিন্তু গরিব বলে বিয়ে হচ্ছে না। বাবা পরের বাড়ী হাড় ভাঙ্গা খাটুনি করে কোন মতে সংসার চালায়। বিয়েতে বর পক্ষ মোটাংকের যৌতুক দাবি করে বসে। যৌতুকের টাকা জোগাড় করতে না পারায় বিয়ে হচ্ছে না। দিন যত যায় ফুল বানুর বাবার মাথায় তত চিন্তা বাড়ে।
নান্টু পাজি খবর শুনে তার অন্ধ ছেলের সাথে বিয়ে দিল। বিয়ের আগে মাসুমের নামে আধা বিঘা বাগান দলিল করে দিয়েছে। কিন্তু তাকে শাশুড়ি ও জা’য়েরা দাসীর মত মর্যাদা দেয়। সারাদিন কাজ কর্ম করেও নিস্তার নেই। মাঝে মধ্যে মানসিকভাবে নির্যাতন করে। তবে স্বামী ও শ্বশুর ভালোবাসে। কিন্তু কোন উপায় নেই। বিধাতা গরিব করে সৃষ্টি করেছে। তাই ভবিষ্যত জীবনের আশায় সব মনোবেদনা, দুঃখ- কষ্ট সইতে হবে। না হলে আবার বাবার বাড়ী ফিরে যেতে হবে। কাটাতে হবে অনাহারের জীবন।
বেশ কিছুদিন পর তাঁর গর্ভ থেকে একটি কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করে। কন্যাটির নাম রাখে নাজিফা। এবার কিছুটা হলেও মনে সুখ অনুভব করে। কন্যার বয়স দুই বছর পূর্ণ হতে না হতেই মাসুম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বহু চিকিৎসা করেও আরোগ্য হতে পারেন নি। কাতরাতে কাতরাতে একদিন সে মৃত্যুবরণ করে। এবার ফুল বানু অসহায়। প্রিয় মানুষটিও দুনিয়াতে নেই। ভাগ্যে সুখ দিয়ে হয়ত: বিধাতা তাকে পৃথিবীতে পাঠায় নি। তবু মেনে নিতে হবে। ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন। শ্বশুর বাড়ীতে মেয়েকে নিয়ে থাকে আর কাজ-কাম করে। শ্বশুর নান্টু পাজি দু’মাস পরে সৌদী আরবে পবিত্র হজ্জে যাবে। সব প্রস্তুতি শেষ। একদিন তিনি পবিত্র মক্কায় গেলেন।
চৈত্র মাস । চৈতালি ফসল ঘরে উঠার সময়। ফজরের আযানের পূর্বে ফুল বানু কন্যাকে ঘুম দিয়ে মছারি টাঙ্গিয়েছে। বিদুৎ চলে যাওয়ায় চেরাগ জ্বালিয়েছে। নিজেদের ঢেঁকি ভেঙ্গে যাওয়ায় অন্য এক বাড়ীতে ঢেঁকিতে ধান ভাংতে গেছে। নান্টু পাজি’র বড় ছেলে বিল্টু সুযোগের সদব্যবহার করে। কারণ কন্যাটিকে মারতে পারলে অনেক সম্পদ পাওয়া যাবে। বাবা তার ভাই মাসুম কে বিশ বিঘা জমি উইল করেছে। এসব জমি-জমা ভবিষ্যতে নাজিফা পাবে। তার হিংসায় ফেটে পড়ে।
বিল্টু মছারিতে আগুন ধরিয়ে দিল। নাজিফার সারা শরীর আগুনে পুড়ে গেল। মা ধান ভাংগা শেষে বাড়ীতে দ্যাখে আজব কান্ড। হাউ মাও করে কাঁদতে শুরু করলো। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা না করায় নাজিফা মারা গেল। তাকে কবর দেওয়া হল। এরপর ইউডি মামলা হল অজানা থানাতে। কিন্তু ওসিকে মোটাংকের ঘুষ দেয়া হল। ফলে থানা পুলিশ নীরব। থানায় মামলা করেও কিছু হল না। পরে ফুল বানুকে একলাখ টাকা দিয়ে মিটমাট করা হল। সে হাত পেতে তা নিল। কোন প্রতিবাদ করল না। প্রতিবাদ করলে জীবন যাবে। নিঃসঙ্গ ফুলবানু বাবার বাড়ী চলে গেল। এখন দুঃখ হল তাঁর নিত্য দিনের সাথী।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।