ফিরে আসা

স্পেশাল ট্রেনটা অমৃতসর থেকে ছেড়ে গেছিল দুটোর সময়। লাহোরে পৌঁছল আট ঘন্টা পর। পথে মৃত্যু হয়েছে অনেকের, বহু মানুষ আহত, আরও অসংখ্য মানুষ নিরুদ্দেশ… সবার মনে এক আতঙ্কের থাবা বসিয়ে দিয়েছে এই ভয়াবহ দাঙ্গা… পরদিন সকাল দশটায় জ্ঞান ফিরল সিরাজুদ্দিনের। দেখল ও ধুলোর মধ্যে পড়ে আছে। আশেপাশে অসংখ্য পুরুষ নারী শিশুদের চিৎকার। কি হচ্ছে ঠিক মালুম হল না ওর। স্থির হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। এইসময় পাশ দিয়ে কেউ গেলে তার হয়তো মনে হত একটা বুড়ো লোক গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। আসলে কিন্তু তা নয় । বিরাট একটা ধাক্কা লেগেছে ওর… ভয়ঙ্কর একটা শূন্যতা… চোখের সামনে যেন একটা অন্ধকার অন্তহীন শূন্যতা।

একটু একটু করে ওর সম্বিত ফিরল… চোখটা একটু ঘোরাতে চোখ পড়ল সূর্যটার দিকে। সুতীব্র সেই আলোয় চমকে উঠে ও খেয়াল করল আশেপাশের মানুষগুলোকে। আবার পরমুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েকটা টুকরো দৃশ্য – দাঙ্গা… আগুন… দৌড় দৌড় দৌড়… রেল স্টেশন… অন্ধকার রাত্রি… সাকিনা… হ্যাঁ সাকিনা। ওর মেয়ে। চকিতে উঠে বসে উদভ্রান্তের মত চারিদিকে খুঁজতে লাগল… রিফিউজি ক্যাম্পের জনারণ্যের মধ্যে… সাকিনাকে। “সাকিনা! সাকিনা!” চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াল। সাকিনা কোত্থাও নেই। চারপাশে সবাই এরকমই তাদের হারানো ছেলে, মেয়ে, মা, বোনের খোঁজ করে ফিরছে। আরো কিছুক্ষণ খুঁজে হাল ছেড়ে দিল সিরাজুদ্দিন। একটু দূরে গিয়ে নিরিবিলিতে বসল সে। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে ঠিক কিভাবে সাকিনা হারিয়ে গিয়েছিল। আর সাকিনার মা? তার কি হল? হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর স্ত্রীর মৃতদেহটা। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। ছবিটা ভুলে যেতে চাইল সিরাজুদ্দিন। কিন্তু এ ছবি সহজে ভোলার নয়। সাকিনার মা মারা গেছে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ওর চোখের সামনেই শেষ হয়ে গেছে সে। তার শেষ কথাটা কানে বাজতে থাকে সিরাজুদ্দিনের – “আমায় ফেলে পালাও… পালাও… মেয়েটাকে নিয়ে পালাও!” বাপ আর মেয়ে ততক্ষণে দৌড়তে শুরু করেছে। সাকিনার ওড়নাটা মাটিতে পড়ে গেছিল, সেটা তুলতে যায় সিরাজুদ্দিন… “আব্বা ওটা ছেড়ে দাও!” – চেঁচিয়ে ওঠে সাকিনা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কাপড়ের দলা অনুভব করল সিরাজুদ্দিন। হ্যাঁ সাকিনার ওড়নাটাই বটে।

কিন্তু সাকিনা কোথায়? বাকি কথা মনে পড়েনা ওর। মেয়েকে কি রেল স্টেশন অব্ধি আনতে পেরেছিল সে? ওর সাথে ট্রেনে চাপতে পেরেছিল সাকিনা? দাঙ্গাবাজগুলো কি ট্রেন থামিয়ে সাকিনাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল? কিছুই মনে পড়েনা। গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে ওর। কিন্তু চোখে জলও আসেনা। কারো সাহায্যের খুব দরকার। কিন্তু কে ওকে সাহায্য করবে?   কদিন পর একটা সুযোগ মিলল। একটা ট্রাকে করে আটটা জোয়ান লোক যাওয়া আসা করছিল। হাতে তাদের বন্দুক। ওরা নাকি ওপারে ফেলে আসা বৌ বাচ্চাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। ওদের কাছে মেয়ের বর্ণনা দিল সিরাজুদ্দিন – “খুব সুন্দর দেখতে মেয়েটা… না না আমার মত না, ওর মায়ের মত দেখতে… সতেরো বছর বয়েস… বড় বড় চোখ, কালো চুল, বাঁ গালে একটা তিল…” “ওকে খুঁজে এনে দাও বাবারা…”  কাতর গলায় বলল সিরাজুদ্দিন, “আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন”।
ওরা বললে – “তোমার মেয়ে বেঁচে থাকলে আমরা ঠিক খুঁজে বার করব।” ওরা চেষ্টা করল সে মতই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অমৃতসরে গেল, উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে এল অনেক নারী আর শিশুকে। কিন্তু সাকিনার কোনো পাত্তা পাওয়া গেলনা। পরের ট্রিপে ওরা রাস্তার ধারে হঠাতই খুঁজে পেল একটা মেয়েকে। ভীত সন্ত্রস্ত মেয়েটা ওদের দেখে দৌড়ে পালাতে চাইছিল। ট্রাক থামিয়ে তাকে ধরে আনল ওরা। দেখল মেয়েটার বাঁ গালে একটা তিল… সে বেশ সুন্দরী তাতেও সন্দেহ নেই। জিজ্ঞেস করল – “তোমার নাম কি সাকিনা?” শুনে আরো ঘাবড়ে গেল মেয়েটা।

তারপরে যখন শুনল ওরা ওকে উদ্ধার করতে এসেছে তখন সে স্বীকার করল হ্যাঁ সে সিরাজুদ্দিনের বেটি সাকিনাই… লোকগুলো ওকে খাবার দিল, দুধ দিল, একজন একটা জ্যাকেটও দিল যাতে সে নিজেকে ঢেকে নিতে পারে। দিব্যি বোঝা যাচ্ছিল ও ওড়নার অভাবে অস্বস্তি বোধ করছে। বারবার হাত দিয়ে নিজে বুকটা আড়াল করার চেষ্টা করছে। তারপর ওরা সাকিনাকে ট্রাকে তুলে রওনা দিল।     *********************************     বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এখনও মেয়ের কোনো খবর পায়নি সিরাজুদ্দিন। সারাক্ষণ সে দৌড়োদৌড়ি করে বেড়ায় এ ক্যাম্প থেকে সে ক্যাম্পে। সাকিনার খোঁজে। রাত হলে আল্লার কাছে প্রার্থনা করে যেন ঐ লোকগুলো তার মেয়েকে খুঁজে পায়। ওদের শেষ কথা গুলো ওর কানে বাজে – “তোমার মেয়ে বেঁচে থাকলে আমরা ঠিক খুঁজে বার করব।” একদিন ক্যাম্পে ঘুরতে ঘুরতে সে দেখা পেল লোকগুলোর। ওরা ট্রাক চালিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। “বাবা, সাকিনার কোনো খোঁজ পেলে কি তোমরা?” – জিজ্ঞেস করল সিরাজুদ্দিন। “পাব, পাব। ঠিক পাব…” ওরা সমস্বরে বলে ওঠে। সিরাজুদ্দিন ওদের জন্য প্রার্থনা করে আবার। একটু শান্তি পায় সে। সেই সন্ধ্যায় সিরাজুদ্দিন দেখল কি যেন একটা ঘিরে হইচই পড়ে গেছে ক্যাম্পে।

কাছে গিয়ে শুনল চারজন লোক রেললাইনের ধার থেকে অজ্ঞান অবস্থায় একটা মেয়েকে উদ্ধার করেছে। তাকে ক্যাম্পের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের পিছু পিছু হাসপাতালের দিকে যায় সিরাজুদ্দিন। হাসপাতালের বাইরেটায় দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবে এক মহূর্ত, তারপর ঢুকে পড়ে ভিতরে। একটা ঘরে স্ট্রেচারের উপর রাখা আছে মেয়েটাকে। ডাক্তারবাবু এসে আলোটা জ্বালতে দেখা যায় অচেতন অবস্থায় স্ট্রেচারে শুয়ে আছে একটা সুন্দরী মেয়ে… বাঁ গালে তিল… “সাকিনা!” চেঁচিয়ে ওঠে সিরাজুদ্দিন। ডাক্তারবাবু ওর দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকান। “আমি ওর বাবা…” আমতা আমতা করে বলে সে। অবশ শরীরটাকে পরীক্ষা করেন ডাক্তারবাবু। নাড়ি দেখেন। তারপর সিরাজের দিকে তাকিয়ে জানলাটা দেখিয়ে বলেন “খুলে দাও!” হঠাৎ যেন একটু নড়েচড়ে ওঠে মেয়েটা। ওর হাতটা নিচে নেমে হাতড়াতে থাকে সালওয়ারের দড়িটা। ধীরে ধীরে সে দড়ির ফাঁসটা আলগা করে সালওয়ারটা নিচে নামিয়ে দেয়। তারপর ফাঁক করে দেয় পা দুটো। “ও বেঁচে আছে!” – আনন্দে চিৎকার করে ওঠে সিরাজুদ্দিন।

একটা ভয়ঙ্কর আশঙ্কায় ডাক্তারবাবুর হাড় হিম হয়ে আসে।     [মূল গল্পটির লেখক সাদাত হাসান মান্টো। গল্পটি দেশভাগ ও দাঙ্গার সময়ের চিত্র। এই বিষয় নিয়ে যাঁরা সাহিত্য রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে সাদাত হাসান মান্টো সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ। মূল গল্পটি উর্দুতে লেখা। উর্দু না জানা থাকায় আমায় গল্পটির ইংরেজী তর্জমা পড়েই ক্ষান্ত থাকতে হয়েছে। অনুবাদ করেছি সেখান থেকেই। ইংরেজী অনুবাদ করেছেন খালিদ হাসান, গল্পের নাম দ্য রিটার্ন]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…