ফিনিক্স পাখি। কেমন দেখতে এরা ? কোন দেশেই-বা বাস করে ? ছোটোবেলায় খুব খুঁজেছি, পাইনি। কৈশোরকালে পাখি বিষয়ক বইপত্রও খুব ঘাঁটাঘাটি করেছি, বিফল হয়েছি। কোথাও কোনো তথ্য নেই এ বিষয়ে। আমার কৈশোরকালে কোনো নেট ছিল না, গুগলমামা ছিল ন। নিরাশ হয়ে খোঁজ-তালাশ বন্ধ রাখলাম।
এখন পড়ন্তবেলায় আবার গাঁইতি-কোদাল নিয়ে নেমে পড়লাম খননকার্যে। নেট আছে, গুগলমামাও আছে। কী পেলাম ? পেয়েছি, যা পেয়েছি সবই শেয়ার করার জন্যই নিবন্ধের অবতারণা।
না, বাস্তবে এ পাখির কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি রূপকথার চরিত্র, যেমন পক্ষ্মীরাজ। পৃথিবীর দেশে দেশে পৌরাণিক এ পাখি ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে নানাভাবে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। এ ছাড়া রাশিয়া, তাইওয়ানসহ আরও অনেক দেশের লোককাহিনি বা ধর্মীয় বিষয়াদিতে ফিনিক্স পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। ফিনিক্স পাখি নাকি যখন মানুষের দুঃখকষ্ট দেখে, তার চোখ থেকে জল গড়ায়, তার স্পর্শে মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠে । পাখিটি পুর্নজন্ম, নিরাময়, ধ্বংসের পরও বেঁচে থাকার আকাঙ্খা এবং অমরত্ম তথা দীর্ঘ জীবনের প্রতীক। আর এ কারণেই জনপ্রিয় শহুরে সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে একটি ফিনিক্স স্থায়ী রূপকার্থক প্রতীক। ফিনিক্স নবচেতনার উন্মেষ, সঞ্চারকে প্রতীকায়িত আদর্শ হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করে। সূর্যই পৃথিবীতে সম্ভব করেছে জীবন, যে জীবন কল্যাণকর। যে কারণে,ফিনিক্স পাখি সূর্যের প্রতীক হওয়ায় ফিনিক্স পাখির ভাবমূর্তিতে অমঙ্গলের চিহ্ন বিন্দুমাত্র নেই। প্রাচীন মিশরে ফিনিক্স হল সূর্যর প্রতীক। কোনওদিন সূর্য ধ্বংস হলে পৃথিবীও ধ্বংস হবে। প্রাচীন মিশরের মানুষ এই তথ্যটি জানত ? তারা চায়নি সূর্য ধ্বংস হোক। আমার মনে হয়,ফিনিক্স পাখির রূপায়ণের মধ্য দিয়েই মানুষের এই ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটেছে।
ফরাসি সাহিত্যিক ও দার্শনিক ভলতেয়ার ফিনিক্স পাখির বর্ণনা যে ভাবে দিয়েছেন,সেটি লক্ষ করুন — “ফিনিক্সের আকৃতি ঈগলের মতো বিশাল কিন্তু চোখগুলি নিষ্ঠুর ও ভীতিকর নয়, নির্দয় ঈগলের তুলনায় নিরীহ ও সংবেদনশীল। ঠোঁটগুলি গোলাপের মতো। গ্রীবা ও ঘাড় রংধনুসদৃশ বা আরও দীপ্তিমান। পালকগুচ্ছে খেলা করে স্বর্ণালি ছায়াচ্ছন্নতা। বেগুনি-লাল বা রূপালি তার পদযুগল”।
চিনে লোককাহিনির প্রাণী ড্রাগনের পরই ফিনিক্সের স্থান। চিনের কিংবদন্তিতে ফিনিক্স হচ্ছে এক ধরনের উপকারী পাখি। চিনারা “সোনালি ফিনিক্সকে” প্রতিকূল পরিবেশে বড়ো হওয়া সেরা ধীশক্তির উপমা হিসাবে ব্যবহার করে। চিনের ক্যারাটে দো অ্যাসোসিয়েশন এবং বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স পাখির লোগো ব্যবহার করে থাকে। চিনের বেজিং শহরে ফিনিক্সের স্ট্যাচু এখনও সম্মানের প্রতীক হয়ে আছে। এটিকে চিনের পাখিদের নেতাও বলা হয়। জাপানে ফিনিক্সকে ডাকা হয় অমরত্বের পাখি। চিনের প্রখ্যাত লেখক লাম কাম চুয়েন ফেঙ হুয়াঙ ফিনিক্স প্রসঙ্গে বলেন, “A mythical bird that never dies, the phoenix flies far ahead to the front, always scanning the landscape and distant space. It represents our capacity for vision, for collecting sensory information about our environment and the events unfolding within it. The phoenix, with its great beauty, creates intense excitement and deathless inspiration.”
মানবসভ্যতায় ঠিক কখন ফিনিক্স পাখির কল্পনা করা হল ? তা কি দিনক্ষণ গণনা করে বলা যায় ? তবে ফিনিসীয় সভ্যতাই নাকি প্রথম ফিনিক্স পাখির কল্পনা করেছিল। ফিনিসীয় সভ্যতায় ফিনিক্সের আবাসস্থল থাকত কোনো ঝরনা বা কূপের পাশে। ভোরে স্নান করার সময় ফিনিক্সের গাওয়া গান শোনার জন্য গ্রিক সূর্যদেবতা হেলিয়োস রথ থামাত। অমরত্ব আর পুনরুজ্জীবনের প্রতীক ফিনিক্স মৃত্যুর আগে হেলিওপোলিসে গমন করত। পারস্যের লোককাহিনি অনুযায়ী মহাবীর রুস্তমের বাবা জাল এই প্রতীক পাখিকে সযত্নে লালন করেছিলেন। গৃহহীন এই পাখিকে তিনি পেয়েছিলেন আলব্রুজ পাহাড়ে। লেবানন তাদের প্রাচীন এবং আধুনিক সংস্কৃতির প্রধান বাহক মনে করে ফিনিক্স পাখিকে। লেবানন ও বেইরুটের ইতিহাসে এই প্রতীকের ভাস্কর্য সাতবার ধ্বংস ও পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। পারস্যের ফিনিক্স। পারস্যের উপকথায় ডানাওয়ালা পাখিসদৃশ জীবের কল্পনা করা হয়েছে ; এর নাম সিমুর্গ। সিমুর্গ অতি বৃহৎ ও প্রাচীন। ফরিদউদ্দিন আত্তারের “কনফারেন্স অভ বাডর্স”-এ পাখিদের নেতা হিসাবে আমরা সিমুর্গকে দেখতে পাই। মহাকবি ফেরদৌসির “শাহনানামায়” সিমুর্গ পাখির উল্লেখ আছে।
বস্তুত পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে পবিত্র অনলপ্রভা থেকে ফিনিক্স পাখির সৃষ্টি। ফিনিসীয় পুরাণ (বর্তমান ইসরাইল,প্যালেস্টাইন,লেবানন, সিরিয়া), চিনাপুরাণ, গ্রিকপুরাণ এবং প্রাচীন মিশরীয়দের বর্ণনায়ও ফিনিক্স পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়। মিশরীয়রা ফিনিক্সকে বক জাতীয় পাখি মনে করে একে ডাকত বেন্নু পাখি বলে। বেন্নুকে বলা হয় সূর্যদেবতা “রা”-র আত্মা। পরবর্তী সময়ে রোমান চিত্রকলায় ফিনিক্স ঈগলরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। প্রাচীন গ্রিক পুরাণ অনুসারে ফিনিক্স হল এক পবিত্র “আগুনপাখি”। এটি এমনই এক পবিত্র আগুনপাখি, যার জীবনচক্র আবর্তিত হয় হাজার বছর ধরে। মনোলোভা স্বর্ণের লেজ এবং লাল,গোলাপি ও নীল রঙের পালক দ্বারা আবৃত ময়ূরসদৃশ এই পাখির প্রকৃত অর্থে কোনো মৃত্যু নেই। হাজার বছর নির্বিঘ্নে বেঁচে থাকতে পারে এরা। যমদূত আসার ঠিক আগেই ফিনিক্স পাখি নিজের বাসা নিজেই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আর নির্মমভাবে দগ্ধ হয় এই পাখি এবং তার বাসার ভস্ম থেকেই জন্ম নেয় নতুন ডিম। প্রাণ পায় নতুন জীবনের, শুরু হয় আবারও জাতিস্মর ফিনিক্সের অবিনাশী যাত্রা। বেঁচে থাকে আগের জনমের আয়ুষ্কালের মতোই। প্রচলিত লোককাহিনি মতে, ফিনিক্স পাখিকে হিংসুকেরা আঘাত করলে এর পালক থেকেও জন্ম নেয় নতুন প্রাণ। এদের অশ্রুজলও বদলে দিতে পারে কারও জীবন। অগ্নি ও পবিত্রতার কারণে এরা মৃত্যুপথযাত্রীদেরও সাময়িক জীবন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।
অপর এক কাহিনি অনুসারে ফিনিক্স পাখির পুড়ে যাওয়া ছাই ডিমের আকারে মমি করে মিশরের সূর্য শহর কিংবা গ্রিসের দ্য সিটি অব সান-এ রেখে দেওয়া হয়। একদিন ওই ছাইয়ের ডিম থেকেই পাখিটি পুনর্জন্ম লাভ করে এবং দেবপাখির প্রতীক হয়ে যায় গ্রিকদের কাছে।
সত্যি-মিথ্যা, লৌকিক-অলৌকিক, বাস্তব-অবাস্তব সব গুলিয়ে গেছে যেন। ফিনিক্স পাখি যেন হারতে হারতে বিজয়ী হওয়ার প্রতিশ্রুতি।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।