ফড়ে—— অরুণ কুমার বিশ্বাস

মাছের বাণিজ্য ফরিদের। ঠিক জেলে নয়, তবে তার কাজ সব জেলেদের সাথেই।

নিজ হাতে মাছ ধরে না ফরিদ, বরং ধরায়। দাদন হিসেবে টাকা ধার দেয় ছাপোষা জেলেকে। সেই টাকা নিয়ে ফিবছর জাল, নৌকো, অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনে ওরা। তারপর ভরা মওসুমে মাছের খোঁজে নামে দাদনকারী জেলেরা।

ফরিদ লোক মন্দ নয়, তবে তার কাজেকামে কিছু চালিয়াতি আছে। খুব পোড়খাওয়া বিচক্ষণ লোক না হলে ফরিদের কর্মকাণ্ড জরিপ করা কঠিন। সে একজন মধ্যস্বত্বভোগী, আবার মহাজনও। কারণ জেলেদের সে টাকা ধার দেয়। ভাণ্ডারিয়া ফেরিঘাটে ফরিদের মোকাম। একটা বরফকলও আছে। জেলেরা মাছ ধরে সরাসরি বেচতে পারে না, ফরিদের হস্তক্ষেপ লাগে।

কন বাবা, সবখানে ফরিদ কেন! কী এমন হনু সে! প্রশ্ন উঠতে পারে। জুতসই জবাব আছে। ফরিদ নিজেই দেবে। বলবে, ঠিক হ্যায়, আমি আর নেই তোদের মাঝে। কাবাব মে হাড্ডি হবার কোন শখ নেই। এবার থেকে তোরা নিজেরাই মাছের কারবার কর। মওসুম শেষে হিসেব কষে দাদনের টাকাটা সুদসমেত দিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।

অমনি হাউমাউ করে ওঠে জেলেরা। না ভাই ফরিদ, তুমি না থাকলে আমরা চলি কি করে! তুমি মোদের মা-বাপ। কী, খটকা থেকেই গেল! যাবেই তো! এই দুনিয়ার সব খবর সব মুসাবিদা বাতলে দেবার কী দায় পড়েছে আমার! তাও বলছি, ফরিদ সত্যিই ওদের মা-বাপেরও বাড়া। বাপ মরলে শোক দুদিনেই ভুলে যাবে, কিন্তু ফরিদকে ছেড়ে ওরা দুদণ্ড থাকতে পারে না।

ফরিদ ক্ষমতাবান। কারণ তার টাকা আছে। তার থেকে দাদন না নিয়ে কেউ মাছের কারবার করতে পারে না। জেলেদের টিকি ওর হাতে বাঁধা। শুধু তাই নয়, পোড়খাওয়া ধীবরসমাজ ভাল করেই জানে, ফরিদের চোখের ইশারায় ওদের সমস্ত কাজ কারবার নিমিষে মুখ থুবড়ে পড়বে। জাল, নৌকা, মাঝিমাল্লা, এমন কি মাছও আছে বিস্তর, অথচ কেনার লোক নেই। ওষুধ খেতেও একজন পাইকার খুঁজে পাবে না। এত এত মাছ দিয়ে কী হবে! জমিয়ে রাখবে! কি করে! বরফকল, হিমঘরও যে ফরিদের জিম্মায়।

মোদ্দা কথা, ফরিদ এখানকার মা-বাপ শ্বশুর-শাশুড়ি সব। সে না চাইলে ঢাকা থেকে কোন পাইকার আসবে না। যদিও বা আসে, তারা মাছ নিয়ে লঞ্চ ভাসাতে পারবে না নদীতে। তার আগেই অদৃশ্য ইশারায় পানির মাছ পানিতে মিশে যাবে। হাবুডুবু খাবে শহুরে পাইকার।

এর নাম সিন্ডিকেট। কিংবা বলা যায় মাছের মাফিয়া। পানিতে যে মাছ তার মালিক সবাই, কিন্তু ডাঙায় তুললে ফরিদের বখরা চাই। তাই বলে সে চেয়ে বা হাত পেতে নেবে না কিছুই। তুমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে, আবার সালামও দেবে দুবেলা।

মানিকবাবুর পদ্মা নদীর মাঝি যে না পড়েছেন, সে জলদি চলে আসুন ভাণ্ডারিয়া ফেরিঘাটে। এখানে দেখবেন গণেশরা কেমন দিন দিন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে! মাছ আগেরচে পড়ে কম মানছি, তাও যা পড়ে তাতে কোনমতে খেয়েপরে বাঁচতে পারতো ওরা। কিন্তু মেছো-মাফিয়ারা তা চায় না। তাহলে যে ওর দাদনের সুদ কমে যাবে। আর্থিক স্বাবলম্বন জেলেদের কমজোরি মেরুদণ্ড সোজা করে দেবে। ফরিদকে তখন পুঁছবে কে!

যারা গরিব তারা স্বেচ্ছায় গরিব নয়, এমন কি চাইলেই চেষ্টা করেও তারা সচ্ছল হতে পারে না। কারণ ধনীরা চায় না ওরা উঠে আসুক। তাতে প্রতিযোগিতা বাড়বে, নিজেদের প্রতিপত্তি কমে যাবে, আর যখন তখন সেলাম ঠোকার লোকও যে থাকবে না। পাইক-বরকন্দাজ, হুঁকোবরদার জুটবে কোত্থেকে!

এবার আসল কথায় আসা যাক। ফরিদ মধ্যস্বত্বভোগী। খেটো বাংলায় দালাল বা ফড়িয়া। কথ্য ভাষায় ফড়ে, এই কাহিনীর শিরোনাম। ফরিদ মোটেও ভারিক্কি নয়, মহাজনদের মতো গালফুলানো গাম্ভীর্য নিয়ে থাকে না। বরং ফরিদ সব সময় ফড় ফড় করে। তড়বড় করে কথা বলে। সে কারণেই বোধ করি আড়ালে-আবডালে লোকে তাকে ফড়ে ফরিদ নামে ডাকে। ফরিদ নিজেও এসব জানে, তবে গায়ে মাখে না। সে বোঝে ফলবতী গাছে মানুষ ঢিল ছুড়বেই। তাতে কী এসে যায়! বরং সে যে দশজনের দোয়ায় খেয়েপরে ভাল আছে, এজন্য সে সবার কাছে কৃতজ্ঞ।

কাঁচা বয়সে টাকার গন্ধ পেয়েছে সে। বাপ বেঁচে নেই, মরেছে ক্ষয়রোগে। তাই ফরিদ তামাক ছেড়েছে। তামাকের বদলে জাহাজিদের কাছ থেকে দামি সিগ্রেট কিনে খায়। সে কখনও সিগারেট বলে না, এতে নাকি সিগ্রেটের গ্রেড নেমে যায়। ওর সিগ্রেট টানার কায়দাও আলাদা। ডানহাত মুঠো করে মধ্যমা ও তর্জনীর ফাঁকে অগ্নিদণ্ড খুঁজে আয়েশি ঢঙে টান মারে। শব্দটা এমন যেন পায়েস খাচ্ছে।

ফরিদের বউ আছে। আরাম-আয়েশ টাকা-পয়সা সব আছে। বিয়ে করেছে বছর দশেক। এত কিছু আছে, তাও যেন কিছু নেই। কারণ ওর বউ বাঁজা। বাচ্চা বিয়োনোর মুরোদ নেই। দুজনের সংসারে কী আর খরচ এমন! একটা ছেলে থাকলে বেশ হত। তাকে নিয়ে অবসর সময়টা বেশ কাটতো ফরিদের। কিন্তু স্রষ্টা বোধ হয় সবাইকে সব কিছু দেন না। যার খিদে আছে তার খাবার নেই। আবার যার বেশুমার খাবার আছে তার হার্টের রোগ বা ডায়াবেটিস। গুরুভোজন বারণ।

এমনই হয়, বুঝলেন, দুনিয়াতে পারফেক্ট বলে কিছু নেই। নেই সুখও। ও জিনিস না চাইলেই হয়! বেশি সুখ ভাল নয়।

ফরিদের চরিত্রদোষও আছে। কারণ তার সব আছে। এটুকু না থাকলে কি চলে! পুরুষ মানুষের চরিত্রদোষ অলংকারের মতোন। বেশ মানিয়ে যায়! আমার কথা নয়, ফরিদের। ফড়ে ফরিদ।

ফরিদ একমনে অংক কষছে। এই মওসুমে কে কত ফেরত দিল। দাদন সব উসুল হল কি না। আসছে মওসুমে কাকে কত দেয়া যায়, এসব আর কি! একে একে নামগুলো চেক করে ফরিদ। হিসেবের মারপ্যাঁচ সে ভালই বোঝে। তাও সবখানে হিসেব চলে না, একটু বেহিসেবি হতে ভালই লাগে ফরিদের।

প্রায় সবাই দাদন মিটিয়ে দিয়েছে। যারা দেয়নি, তাদের নামের পাশে ক্রসমার্ক। এদের ধরতে হবে। ফড়ে ফরিদের টাকা মারবে এমন মানুষ পয়দা হয়নি এখনও। ময়েজ, রুহিদাস, পিকলু টিকাদার, হরিহর ধুরন্ধর, এরা এখনও টাকা দেয়নি। এদের সবকটাকে ধরে লটকাতে হবে। ফাজিল কোথাকার! টাকা নিয়ে টিটকিরি! একদম নয়! এমন ঢিঁট দেবে না!

শুধু এই পিকলু ছোড়াটার কাছে নিজেকে কেমন দুর্বল মনে হয়। ওর নাম মনে এলেই দাদন ফাদনের কথা ভুলে যায় ফরিদ। পিকলুর বউটা বড্ড সরেস যে!

সে-বার দাদন চাইতে এলো পিকলু। ফরিদ বলল, বাপু, আগে তো কখনও দেখিনি তোমায়। কোন বাড়ির পোলা তুমি?

আজ্ঞে, পিকলু টিকাদার! খাঁ বাড়ির পাশে।

ও, নতুন ঘর তুলছো তুমি! ফরিদ চিনতে পারলো। পারবে না, এটা তার নিজের জায়গা। খাসমহল যাকে বলে!

তা হঠাৎ নতুন বাড়ি কেন! আগেরটায় চলছিল না! চাল দিয়া পানি গড়ায়! ফরিদ কৌতূহলী হয়।

না মানে বিয়া করছি তো। নতুন বউ আইছে ঘরে।

ও, তাই কও। তা দাদন নেবা, সময়মতো ফেরত দিতে পারবা তো!

পারুম না ক্যান। ঘরে নয়া বউ। মনে ফূর্তি। জোশের সাথে কাজ করুম, বউরে নিয়া ভাল থাকমু। পিকলু হাসে। বা বলা যায় দাঁত কেলায়। এ জন্য বললাম, এই হাসিতে কোন প্রাণ নেই, যা আছে তাকে সোজা বাংলায় বলে তেলবাজি। উদ্দেশ্য হাসিলের কৌশল।

ফরিদও হাসে, তবে মনে মনে। ভাবে, তুমি পিকলু ভাল থাকলে তাতে আমার কি! বরং তোমার অবস্থা পড়লে বিস্তর লাভ। ঘরে নয়া বউ, আমার ঘরে বাঁজা বউ। বাজি জিততে চাও তো দাদন দাও ফরিদ। নয়া বউ তোমার ঘরেও আইবার পারে। তুমি জানো পিকলু দাদনের টাকা ফেরত দিবার পারবে না। তুমি মস্তবড় চালিয়াত। গরিব হলে মান-সম্মানও ক্ষয়ে যায়! এ রোগের কোন ওষুধ নাই রে!

ফরিদ মুখে বলল, দাদন নেবা নেও। তয় একখান কথা আছে, টাইমমতো ফেরত দিবার না পারলে কিন্তু বিপদ। নয়াবউ নিয়া টান দিমু। ফরিদ সশব্দে হাসে। মনের কথা বেরিয়ে পড়েছে। এমন কখনও হয় না। আজ হল, মানে ওর মন উচাটন। বাঁজা বউ নিয়া আর সুখ নাই।

ফরিদের অনুমানে ভুল নাই। মওসুম শেষে পিকলু হাজির ফরিদের মোকামে।

-আমারে বাঁচান হুজুর। এক্কেবারে জানে মইরা গেছি। টেকা দিয়া জাল-নাও সব কিনলাম। কিন্তু নদে এবার মাছ নাই। ইলিশের মুখও দেকবার পারি নাই হুজুর। হায় রে রুপার ইলিশ!

দাদন ফেরত দেও পিকলু। তোমার কান্দনে কোন সুখ নাই। যা কতা ছিল তাই দাও। ফরিদ বড় কঠিন এখন। সে জানে দাদন ফেরত নিবার সময় নরম কাটলেই বিপদ। সক্কলেই একথা সেকথা বলে টাকা বাকি রাখবে।

পিকলুর বেলায় ফরিদ খুব একটা কঠোর হয় না। কারণ ওর নয়া বউ মৌটুসি। পিকলু তারে টুসি বইলা ডাকে। গরিবের বউয়ের আবার এতবড় নামের কী দরকার! কথা কইতে শরীলের দম নষ্ট হয় না!

ফরিদ বলল, পিকলু, তর বাড়িতে একদিন বেড়াইবার আমু। তর বউরে কইস ভালমতো ইলিশ পাকাইতে।

সত্যি আইবেন! পিকলু চমকায়। এমন আমোদের কথা বোধ হয় সে কোন দিন শোনেনি।

সত্যি না তো মিছা নাকি! তর বউয়ের মুখ দেখলাম না। তুই আমার পাড়ার পোলা।

ফরিদের বাঁজা বউ ভিতরের ঘরে মনে মনে গজরায়। আহা, শখ কত! নয়া বউ দেখবার যাইবো!

ফরিদ কথা দিয়ে কথা রাখে। একদিন সত্যিই গিয়ে হাজির হয় পিকলুর বাড়ি। ওর নয়া বউ টুসির হাতে রান্না খাবে। পিকলু বেজায় খুশি। টুসিও। বাড়িতে মেহমান আসছে। এতবড় মেহমান! খুশি হবে না!

আহ কী ঢলোঢলো মুখ! মুখ তো নয়, যেন আকাশের চাঁদ নেমে এসেছে। তোমার দাদনের সব মাফ। এবারও লাগলে বলো, আরো দিব।

পিকলু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, চাবিটা কে টিপলো! কখন! ফড়ে ফরিদ আজ হঠাৎ এত দরাজ!

টুসি মুচকি মুচকি হাসে। মানে সে কিছুটা বুঝতে পারছে। কে কোন্ চোখে তাকায় মেয়েরা তা ভালই বোঝে। ওটা বোধ হয় সহজাত ব্যাপার।

পিকলুর টাকা পেতে অসুবিধা হয় না। সুদটুদ বাদ, আসল পেলেই হয়। ফরিদ বলল, পিকলু, তোমার সাথে কি আমার সুদের কারবার! তুমি আমার আত্মীয় বলে কথা! মাঝেমধ্যে এট্টু মেহমানদারি কইরো। তাতেই চলবো।

ওদিকে ফরিদের বাঁজা বউ সন্দিগ্ধ হয়। স্বামীর মতিগতি খুব ভাল ঠেকে না তার। লোকটা আর আগের মতো নেই। এখন সেই উচ্ছ্বাস কই! ফরিদ ভদ্র হয়ে গেছে। কিন্তু এমন ভদ্রতা সে চায়নি। বাঁজা বউ তার সেই বাঘের মতো হিংস্র ফরিদকেই ফেরত চায় আবার।

পিকলু ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ওর হাতে অনেক টাকা। সব যে মাছ বেচে তা নয়। তাও এসেছে। টাকা কখনও এক হাতে থাকে! যে চায় সে-ই পায়। তবে চাওয়ার মতো চাইতে হয় ভায়া!

টুসি বায়না ধরলো, এবার একটা ফ্রিজ চাই। ঘরে ভালমন্দ কিছু রাখা যায় না। তুমি এলে কী দেই খেতে বলো! পিকলু যখন মাঝদরিয়ায়, ইলিশের খোঁজে ব্যস্ত ফরিদ তখন পিকলুর ঘরে। পিকলু এসব জানে, বা জানে না। জানলেই বা কী! ফরিদের মোকামে যে সে সুখের বায়না দিয়ে এসেছে। সুখ কিনতে গেলে তো কিছু একটা ছেড়ে দিতেই হয়!

-আঃ পাবে পাবে, সব পাবে। এবার ভাল করে একখিলি পান বানিয়ে আনো দিকি! ফরিদ ক্রমশ মজে যায়। চাঁদি গরম হয়, নিঃশ্বাস দ্রুততর। টুসি পান নিয়ে আসে, ফিরে যায় না। এখন সে এক চালবাজ ফড়িয়ার কব্জায়। ফরিদের শক্ত লোমশ হাত তাকে জাপটে ধরে। টুসি সরে না। পিকলু এখন কোথায়! এসব টের পাচ্ছে কি! পেলেই বা! এই বিষাক্ত সাপটাকে কে এনেছে ঘরে! টুসি, না পিকলু! নাকি সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য!

ফড়ে ফরিদ আরো ঘনিষ্ঠ হয়। দিন দিন ওর বায়নাক্কা বাড়ে। টুসিরও। টুসি তাকে কাছে পেতে চায়, রোজ। চিরকালের মতো। অমনি বেঁকে বসে ফরিদ। সে তো ফড়ে, মাল হাতবদল করে, ধরে রাখতে জানে না। প্রয়োজনও নেই কোন। তাতে বিষম ঝামেলা।

না টুসি না, এত্ত লোভ ভাল না। তোমার সাথে আমার কথা কী ছিল! বেচারা পিকলু কষ্ট পাবে। ছেলেটা ভাল, ওরে তুমি কষ্ট দিও না টুসি। বিবেক নামে একটা কথা আছে তো!

টুসি মনে মনে গজরায়। কী আমার বিবেকঅলা মানুষ রে! এগুলো টুসির মনের কথা, মুখের নয়। সে জানে, ফরিদ বড় গভীর পানির মাছ। তারে ঘাঁটতে গেলে নিজের জীবন সংশয় অইবার পারে। এত্ত লোভ ভালা না।

টুসির ঘরে নতুন ফ্রিজ। ফরিদ কিনে দিয়েছে। একদিন পিকলুকে ডেকে বলল, হ্যারে পিকলু, তর একটা ঠাণ্ডা মেশিন অইলে ভাল হয়, না কি! মেয়েটা এত কষ্ট করে রোজ পাকায়। তুই দিনভর পানিতে থাকস, অর কষ্ট কী বুঝবি!

পিকলু কী বোঝে কে জানে। মিটিমিটি হাসে, ছুঁচালো চোখে ফরিদের চাহনি জরিপ করে সে। টুসিটা দিন দিন বড় দুষ্টু হচ্ছে। পিকলু যেন বুঝেও বোঝে না! মন্দ কী! ঘরে ফ্রিজ এলে সবদিক থেকেই সুবিধা। ফরিদ মাঝেসাঝে এলে টুসি ঝটপট কিছু বানিয়ে খাওয়াতে পারে! বাঁজা বউয়ের হাতে কিচ্ছু ভাল লাগে না আর।

পিকলু বলে, ভালাই তো! আপনে যহন কইছুইন, ঠাণ্ডা মেশিন থাকলে মাছটাছ জমিয়ে রাখবার পারুম। আপনার বরফকলে চাপ পড়বো না। পিকুল সাগ্রহে মাথা নাড়ে। ওর দুচোখে বিগলিত চাহনি। টুসিও খুশি। লোকটারে এমনি ছাড়বে না সে। সময় সুযোগমতো দুয়ে নেবে।

টুসির ঘর এখন বাড়বাড়ন্ত। চৌচালা টিনের ঘরে নতুন আসবাব, ফ্রিজ, রঙিন টিভি, ফ্যানও আছে একটা। এ নিয়ে পাড়ার দুচারজন কানাঘুষা করে। ওদের বড় ঈর্ষা। কানু মোল্লা তার বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, টুসির মতো মেইয়েলোক পাইলে আর কী লাগে! ফরিদের কাছে মানুষ হত্যে দিয়ে দাদন পায় না, আর পিকলু! ম্যাঘ না চাইতেই পানি! ওর দাদনে কোন সুদ নাই। এমুন কি আসলও মাফ। কার জইন্যে! সব ওই টুসি! কপাল বটে পিকলু ছোকরার! বউয়ের ভাগ্যে অর সৌভাগ্য আইলো।

কানুর বউ কাওসার বেগমও কিছু কম যায় না। সে মুখ ঝামটে বলে, ওই সব কলাকৌশল রঙঢঙ টুসির মতোন মাইয়া মানুষরে সাজে, আমাগোরে না। পরপুরুষের সাথে দিনে-রাইতে ফুসুরফাসুর গুজুরগুজুর।

ইস, কী আমার ইজ্জতঅলা মাইয়া রে! অয় পারলে তুমি ক্যান পারবা না শুনি! ফরিদ যার তার কাছে ধরা দেয় না, বুঝলা কাওসারী। তোমার সেই যোগ্যতা নাই। কানু মনের ঝাট মিটিয়ে বউকে দুকথা শোনায়। কানুর মতো লোকেরা দাদনের সুদ দিতে না পেরে ক্রমশ ক্ষয়ের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছে।

কিন্তু ফরিদের হিসেবে কিছু ভুল ছিল। টুসি এক সময় বুঝতে পারে, ফরিদরা কখনও ওর নয়, হবেও না।

আচ্ছা, পিকলুকে কি চালিয়াত বলা যায়! সে ফরিদের ক্রীড়নক, নাকি ফরিদ ওর! পিকলুর টাকার দরকার। ফরিদ টাকা তাকে দিয়েছে। বিনা সুদে দাদন, যা অন্য কেউ পায়নি। কিন্তু তাতেও তার টাকার খাঁকতি মেটেনি। আরো চাই তার। টুসি ফরিদের নজর কাড়ে প্রথম দেখায়। সেটা টুসি যেমন বোঝে, ফরিদও তেমনি টের পায়।

টুসি যখন টের পায় ফরিদের কাছে তার আকর্ষণ নিঃশেষিত প্রায়, অমনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সে ভাগবে। দূরে কোথাও। এত কিছুর পরেও পিকলু নিশ্চয়ই তাকে ফেলে দেবে না। পিকলুর হাতে টাকা আছে। আছে টুসিরও। নগদ কড়কড়ে নোট। স্বামী সরে গেলে সমস্যা নেই।

মজার ব্যাপার, টুসির হিসেবেও ভুল ছিল। সে যথেষ্ট চতুর, কোন সন্দেহ নেই। তবে পিকলু খুব বোকা, এমন ভাবারও কারণ নেই। ফরিদকে সে চরম শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সাথে টক্করে পারবে না পিকলু জানে। তাই সে ফরিদের বাঁজা বউয়ের শরণাপন্ন হয়। পিকলুর চেয়ে বয়সে বড় হলেও বিয়ে আটকায় না। ফরিদের বউও এমন কিছু ভাবছিল। তার সোয়ামি গায়ে হাত না তুললেও বাঁজা বলে অনেক অসম্মান করেছে। তার অসাক্ষাতে অন্য মেয়ের ঘরে হানা দেয়। ফরিদকে এর জবাব দিতে। পিকলু এক্ষেত্রে তার হাতিয়ার হতে পারে।

দুজনের উদ্দেশ্য এক, স্বার্থও অভিন্ন। বাঁজা বউ বলল, আমি রাজি। আমি তারে ডিভোর্স দিব। তুমি ব্যবস্থা করো পিকলু। এ কাজে এগিয়ে আসে উকিল আমজাদ। ফরিদ তার পরম শত্রু। শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়। এই সূত্রে বাঁধা পড়ে পিকলু, ফরিদের বউ আর উকিল আমজাদ।

একদিন সকালে ফড়ে ফরিদ ঘোরলাগা চোখে দেখে, পিকলু ওর বাঁজা বউকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সবার সামনে দিয়ে। বলাবাহুল্য, এমন বউয়ের প্রয়োজন তার আরো আগেই ফুরিয়েছিল। কিন্তু কথা সেটা নয়, দাদনদার ফরিদ যেন একহাট লোকের সামনে ঠাটিয়ে চড় খেল। তার একজন সামান্য দাদনি-চাষা, ওইটুকুন পিকলু কিনা ঘরের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে! বাঁজা হোক বউ তো! সে কি সত্যি চলে যাচ্ছে পিকলুর হাত ধরে! বড্ড অবিশ্বাস্য ঠেকে ফরিদের। ওর মাথায় খুন চড়ে যায়, কিন্তু কিচ্ছু করতে পারে না। ওদিকে টুসি দাঁড়িয়ে আছে যে! খুনরঙ চোখে রাজ্যের অভিযোগ।

নতুন সঙ্গী নিয়ে পিকলু এগিয়ে যায়।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!