ফটোকপি-প্রশান্ত মন্ডল

সিরাজ উদ্দৌল্লা রোডের বাম পাশ ধরে চার পাঁচ মিনিট হাঁটতেই নামহীন পুরোনো একটি দোকান। চারপাশের দোকানগুলো সব নতুন, নামও আছে। কিন্ত পাশে পুরোনো সেই দোকানটি থাকাতে কেমন যেন বেমানান লাগে। সামনে ব্যস্ত সড়কটি দিয়ে অনবরত মানুষের চললাচল। মানুষের গুঞ্জন, যানবাহনের শব্দ। সব মিলিয়ে ব্যস্ত রাস্তা যেম হয় ঠিক তেমন। দূর থেকে দোকানটিতে কিসের তা বোঝা দুষ্কর। একে তো নাম নেই তার ওপরে একটি সাটার ফালানো। অবশ্য কাছে গিয়ে উঁকি মারলে বোঝা যায়। এটি একটি ফটোকপির দোকান। শহরে এমন রাস্তায় ঠিক যেন মানায় না। কিন্তু হঠাৎ দু একটি এমন দোকান থাকলে মন্দও হয়না। এক রকমের দোকান এক জায়গাতে দেওয়া শহরের দোকানিদের একটা স্বভাব।
যেমন আল জয়নাল প্লাজাতে গেলে শুধু স্বর্ণের দোকান, খাজা মার্কেটে বই, একতা মার্কেটে কাপড়। ঠিক ফটোকপির দোকানের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম না। তাই শহরে দ্রুত কোন
কিছু করতে চাইলে ঘুরতে হয় অনেকটা পথ। এই ক্ষেত্রে নামহীন দোকানটা এখানেই মানায়। তাই নামহীন দোকানটাকেই বেছে নিয়েছেন লেখক সতীশ চট্টোপাধ্যায়। নামহীন
দোকানটার পাশে যে টাইলস্ করা টোকিও প্লাজাটা আছে তার চার তলাতে থাকেন তিনি। ভালো লেখকও বটে। পাঠ্যপুস্তকে তাঁর লেখা পাঠ্য করা হয়েছে। তিনি অবশ্য নামহীন দোকানটাকে নামহীন দেখেন না। কারন দোকানিকে তিনি অনেক আগে থেকেই চিনেন। দোকানদারের নাম আজগর আলী। পুরোনো দোকানটাতে
ফটোকপি করেই জীবন চলে তার। ফটোকপি করার মেশিনটা অনেক জীর্ণ শির্ণ প্রায়। মাঝে মধ্যে কাগজ আটকে যায়। খুলতে হয় মেশিনের ঢাকনাটা খুলে। আবার কিছুক্ষণ ভালই
চলে। কখনো কোন গুরুত্বপূর্ন কাজ করতেই কালি বেশি পড়ে যায়। ফলে সময় বেশি লাগে তার। সেও লেখককে ভাল করেই চিনে। প্রায়ই তিনি
ছড়া, কবিতা, গল্প ছাপিয়ে নিয়ে যান। সেই সুবাদেই বেশি চেনা। তাছাড়া ছেলের মুখেও তার কথা শুনেছে সে। সেই থেকে চট্টোপাধ্যায়কে আরও ভালভাবে চেনা।
বেশ কয়েকদিন হলো লেখাটা শেষ হয়েছে। সম্পাদককে দেওয়ার জন্য লেখাটা ফটোকপি করা দরকার। আসলটা নিজের কাছে থাকবে আর ফটোকপিটা সম্পাদককে দেওয়া হবে। তাই আজগর আলীর দোকানে আসতে হল তাঁকে। আজগর আলী তাঁকে দেখতেই মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার আগেই জানা আছে। লেখক এখানে আসলে লেখা ফটোকপি করা ছাড়া আসবেন না। আজগর আলীর হাতে পান্ডুলিপিটা তুলে দিয়ে চেয়ারে বসলেন তিনি। “মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, নামের গল্পটা কপি কর।” আজগরকে বললেন লেখক চট্টোপাধ্যায়। “আচ্ছা। স্যার।” বলেই কাজ শুরু করে দিল আজগর আলী। প্রথম পাঁচ পৃষ্ঠা ভালই ছাপল সে। কিন্ত এখন আর ছাপা যাচ্ছেনা। মেশিনে কোন সমস্যা আছে কিনা দেখল আজগর। কিন্তু না, মেশিনেতো কোন সমস্যা দেখা যাচ্ছেনা। অন্য কাগজ দিয়ে কপি করলে কপি হয়। আজব তো! অন্য লেখা হচ্ছে কিন্তু চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের ষষ্ঠ পৃষ্ঠাটি ছাপছেনা কেন? “স্যার লেখাটা কেন জানি ছাপতাছেন।” চট্টোপাধ্যায়কে বলল আজগর।“মেশিন চেক কর।” “করছি, অন্যগুলো হইতাছে। খালি আপনের শেষ পৃষ্ঠাডা হইতাছে না।”
“তাই নাকি, দেখি।” বিস্মিত হয়ে বলে চট্টোপাধ্যায়। ঠিকই তো অন্য সব লেখা কপি হচ্ছে তাঁর লেখাটা হচ্ছেনা। তাও আবার শুধু শেষ পৃষ্ঠাটি। লেখকের কৌতুহল জাগে। কাগজে সমস্যা। না ফটোকপিরর কাজে কাগজে কোন সমস্যা হয় না। লেখা স্পষ্ট হলেই হয়। পান্ডুলিপিটা হাতে নেন তিনি। শেষ পৃষ্ঠাটিতে যেহেতু সমস্যা তাই সেটিই পড়তে শুরু করেন। গল্পটার শেষে মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়, তাকে ভুলে যায় সবাই। যোদ্ধার দেখা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় না। সবাই মাতৃভূমির উপর অত্যাচার করে। পড়তে গিয়ে হোঁচট খায় লেখক নিজেই। কি মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা! মুক্তিযোদ্ধাকে ভুলে গেছে সবাই! এখানে দীর্ঘ ভাবনার বিরাম চিহ্ন বসান চট্টোপাধ্যায়। লেখাটি ঠিক হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাকে কখনো হত্যা করা যায়না, মুক্তিযোদ্ধারা অমর, মুক্তিযোদ্ধাকে কেউ ভুলতে পারেনা, মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন কখনো বিফল হতে পারেনা। পৃথিবীর বুকে তাঁরা জলন্ত উপমা, চির অম্লান, পাহাড়ের বুকে এভারেস্টের চূড়া। তাই অনেক ভাবনার যোগ বিয়োগ করে লাইন গুলো কেটে দেন তিনি। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু হয়নি, মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ ভুলে যায়নি, মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন সত্যি
হওয়ার পথে। স্বাধীনতার সূর্য পতাকা হয়ে আকাশে উড়ে। চট্টোপাধ্যায় পান্ডুলিপিটা পুনরায় তুলে দেয় আজগরের হাতে। আজগর আলী মুহুর্তেই লেখাটাকে ফটোকপি করে দিয়ে দেয়।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!