তানিম চমকে ওঠে। ও অস্ফুট স্বরে বলে, কে উঠে আসে বললি …তানিম টের পায়, ওর হাতের তালু ভিজে গেছে।
একটা মেয়ে। ফরসা ফুটফুইটা গায়ের রং।
ধ্যাত! তুই এসব কি উলটাপালটা কথা বলছিস।
সেই মেয়েরে আমি দেখছি …
কখন? মুহূর্তেই তানিমের শরীর জমেযায়। ও দিঘির দিকে তাকায়। কালো পানির অথই বিস্তার। মাঝখানে দ্বীপের মতন। গাছপালা আছে। ভাঙাচোরা দালান চোখে পড়ে।
ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় শাওন বলে, গতবছর, রাইতের বেলা, গরমে আমার ঘুমআসতেছিল না। আমি দুই তলার বারান্দায় আইসা দাঁড়াইলাম। চারিদিকে ধবধবা চান্দের আলো। তখনদেখি একটা মেয়ে দিঘি থেইকা উইঠা আসল। তারপর ঘাটে আইসা দাঁড়াইল। আমার দিকে চাইল।
তানিমের ছমছম করে ওঠে। ও কী বলবে ঠিক বুঝতে পারে না। শাওন এত সহজসরল যে ও মিথ্যে বলবে সেটাও তানিমের ঠিক বিশ্বাস হয় না।
পরদিন ভোরবেলা কমলদিঘিতে শাওনের লাশ ভেসে উঠেছিল। দৌজাবাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। দুঃসংবাদ শুনে গ্রামের মানুষ ভেঙে এসেছিল। উঠানে শাওনের লাশ পড়েছিল। ছেলের মৃতদেহের ওপর আছড়েপড়ে মনোয়ারা চাচী আর মোবাশ্বের চাচার সে কী কান্না। কেবল সিফাতজান ফুপু মুখ ছিল ভাবলেশহীন। যেন তিনি জানতেন শাওনকমলদিঘিতে ডুবে মারা যাবে …
শাওনের ব্যাপারটা কাউকে বলেনি তানিম। এমন কী মা কেও না …তবে শাওনের মৃত্যুর রাতে তানিমের ঘুমভেঙে গিয়েছিল। অন্ধকার ঘরে মিষ্টি গন্ধ। কে যেন ও পালঙ্কের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে … কে যেন ফিসফিস করে বলে, কইছিলাম না- আমারে টাইনা নিব। একদিন তোরেও নিব। তখন তর লগে আমার দেখা হইব …
তানিমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
এক ঝাঁক টিয়াপাখি টি টি শব্দ করতেকরতে উড়ে যায় কমলদিঘির ওপর দিয়ে …তানিম সম্বিৎ ফিরে পায়। ঝুঁকে নীচে পার্ক করা গাড়িটা একবার দেখল। পুরনো আমলের কালো রঙের ভক্সওয়াগেন। গাড়িটা বাবার। বাবা যন্ত্র-প্রকৌশলী ছিলেন বলেই হয়তোপুরনো সব ধ্যাড়ধেড়া জিনিসের প্রতি ঝোঁক। কিংবা প্রাচীন বংশের সন্তান ছিলেন বলেই হয়তো। শাওনে মৃত্যুর পর বাবা কী কারণে আর কমলনগর আসেননি। কথাটা বাবাকে জিগ্যেস করেছিল তানিম। বাবা প্রথম প্রথম এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তবে মৃত্যুর দিন কয়েক আগে মুখ খুললেন বাবা । বললেন, আমি সব তোর সিফাতজান ফুপুর কাছে শুনেছি। আমাদের বংশটা অভিশপ্ত।
অভিশপ্ত? কেন?
দৌজাবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা শাফাতউজ দৌজা নাকি অত্যাচারী লোক ছিলেন। এটা এক কারণ। আরেক কারণ হল, লোকে বলে, কমলদিঘি খননের পরও নাকি পানিওঠেনি। তখন শাফাতউজ দৌজা নাকি স্থানীয় এক তান্ত্রিক যোগীর পরামর্শে আপন কন্যাকে উৎসর্গ করেছিল। সেই কন্যার নাম, সিফাতজান।
সিফাতজান?
হ্যাঁ। সিফাতজান।
আশ্চর্য!
বাবা বললেন, হ্যাঁ। সেই কন্যাই নাকি প্রতিশোধ নেয়। বংশের একটি করে পুত্রসন্তানকে টেনে নিয়ে যায়। আমার দাদুর ভাই শামসউল দৌজা,আমার মেজ ভাই, মানে তোর মোজাম্মেলচাচা কমলদিঘিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। তোর মোবাশ্বের চাচার ছেলে শাওনও তো ডুবে মরল।
তানিম স্তব্দ হয়ে থাকে। ও যে জগতেবাস করে সে জগতের সত্য এইসব কিংবদন্তীর চেয়ে একেবারে ভিন্ন …
বাবা বলেছিল, তুই কখনও কমলনগর যাবি না। এবার তোর টার্ন।
বাবা এরপর আর বেশি দিনবাঁচেননি …
তারপর মা যখন জমিজমার একটা ব্যবস্থা করতে কমলনগর আসার সিদ্ধান্ত নিল, তখন তানিম কেবল কিংবদন্তীর ওপর বিশ্বাস করে মাকেকমলনগরে আসতে বাধা দিতে পারেনি। দু’দিন পর ও আর্কিটেক্ট হয়ে বেরুবে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ। মায়ের কাছে মিছিমিছি হাস্যস্পদ হতে চায়নি। অবশ্য ওরও কৌতূহল ছিল। সবটাই কাকতালীয় কিনাসেটা জানার …
সিফাতজান ফুপুর সঙ্গে মায়ের কথা বন্ধ। মোবাশ্বের চাচাকেও মা বেশ কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিয়েছে। বলেছে, দু’দিন পর আপনাদের তানিম আর্কিটেক্ট হয়ে বেরুবে। ওর নিজেরফার্ম দেওয়ার ইচ্ছা। ওর ভাগের জমি বিক্রি করে ও টাকা নেবে। তাতেদোষ হল?
মোবাশ্বের চাচা মিনমিন করে বললেন, না, মানে ভাবী, জমির দলিলদস্তাবেজ কাগজপত্র সব কোথায় যে আছে। এতদিন ভাইয়েরা মিলেঝিলে বিশ্বাসের ওপর ভোগদখল করে আসছি … দৌজাবাড়ির জমাজমি এর আগে কখনও বিক্রয় হয় নাই ভাবী, তাই …
মা বলল, আমি অতকথা শুনতে চাই না ভাইজান। আপনি কালকের মধ্যেই তানিমের জমি ওকে বুঝিয়ে দেবেন।
মোবাশ্বের চাচার মুখ কেমন কালো হয়ে যায়। মায়ের মুখও থমথমে হয়ে ওঠে। মা রাতে খায়নি। ঘরে গিয়ে আলোনিভিয়ে শুয়ে পড়েছে।
তানিম ওর ল্যাপটপ নিয়ে পালঙ্কের ওপর বসেছিল। আজ সারাদিন প্রচুর ছবি তুলেছে। কমলদিঘির উত্তর দিকেনিবিড় শালজঙ্গল। তারই ভিতরে একটিপ্রাচীন মন্দির। মা সঙ্গে ছিল। বলল, এটা সম্ভবত নাথযোগীদের মন্দির। নাথযোগীরা ছিল মধ্যযুগের বাংলার এক গোপন তান্ত্রিক গোষ্ঠী। তানিম নাথযোগীদের মন্দিরের ছবি তুলল। মায়েরও ছবিও তুলল । সেসবই এখন ফেসবুকে আপলোড করছিল।
ঘরে বেশ গরম। ও একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় চলে আসে। গতকালের মত আজ রাতেও ধবধবে পূর্ণিমা ছড়িয়ে ছিল। সেই সঙ্গে উথালপাথাল হাওয়া । কমলদিঘির উত্তরের শালজঙ্গলের দিক থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। আকাশে একটি পরিপূর্ণ গোল চাঁদ। দিঘির জলে তারি ছায়া পড়েছে। ওদিকে তাকিয়ে তানিম- এর শরীর ছমছম করে ওঠে। ওই দিঘিতেই ডুবে মরেছিল শাওন। তার আগে একটা মেয়েকে দেখেছিল বলেছিল। শাওন ঠিক কাকে দেখেছিল? শাফাতউজ দৌজার মেয়ে সিফাতজান? যাকে পানির জন্য কমলদিঘিতে উৎসর্গ করা হয়েছিল? কিন্তু তা কি করে হয়?
পিছনে মৃদু শব্দ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।