ভারতের প্রাচীন ইতিহাস বলতে “বেদ” নামে পরিচিত ধর্মগ্রন্থের মাঝে বিশেষত ঋগ্বেদ-কেই বোঝানো হয় । আবার রামায়ন কিংবা মহাভারতকেও অনেকে প্রাচীন ভারতের মূল ইতিহাস বলে থাকেন । কিন্তু , অন্যান্য ইতিহাস বাদ দিলে এগুলোতে যে ইতিহাস আছে , তা প্রকৃত ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গন্য হয় না । তবে মুসলিম আর ইংরেজদের পরিপক্ক জ্ঞান সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাথে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এ সব গল্পকে হয়তো খাপ খাওয়ানো যেতে পারে ।
এখানে জেনে রাখা দরকার , পুরনো পুস্তক মানেই ইতিহাস না । যেমন মুসলিমদের পুঁথি । “ লাখে লাখে মর্দ্দছব ছহিদ হইল , লোহুতে লাল হইয়া দরিয়া বহিল” । এগুলো কোনো ক্রমেই ইতিহাস না ।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদারের মতে আর্য জাতির জন্ম সম্মন্ধে পুরান ও মহাভারতে আছে , দীর্ঘতমা নামে এক অন্ধ ঋষি যযাতির বংশজাত পুর্ব দেশের রাজা মহাধার্মিক পন্ডিত সংরামে অজেয় বলিয়া আশ্রয় লাভ করে এবং তাহার অনুরোধে তাহার রানী সদেজ্ঞা গর্ভে পাঁচটি পুত্র উৎপাদন করেন । তাদের নাম অঙ্গ , কলিঙ্গ , পুন্দ্র , সুক্ষ ও বঙ্গ । তাদের বংশধরেরা তাদের বাসস্থানও তাদের নামেই পরিচিত । অঙ্গ বর্তমানে ভগলপুর , কলিঙ্গ ও উড়িষ্যা তার দক্ষিনবর্তী ভূভাগ । পুন্দ্র , সুক্ষ ও বঙ্গ যথাক্রমে বাংলার উত্ত্র-পশ্চিম , দক্ষিন ও পূর্বভাগ । এসব কাহিনী মতে এসব প্রদেশের আদিবাসীরা এ জাতি এবং আর্য ব্রাক্ষ্মন ও ক্ষত্রিয়র মিশ্রনে সমদ্ভুত ।
এগুলো কোন ক্রমেই ইতিহাস বলে মানা যায় না ।
আবার ক্ষত্রিয় নারীরা তাদের স্বামীর আদেশক্রমে পরপু্রুষ বা ব্রাক্ষ্মনদের সাথে অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন করলে তাকে ক্ষেত্রজ সন্তান বলা হবে । বর্তমান যুগে একে কেউ ধর্ম বলবে না । এগুলো স্রেফ ব্যবিচার ।
ঋগ্বেদের ১০ম মন্ডলের ৯০ সূক্তটি “পুরুষ সূক্ত” হিসেবে বিখ্যাত । এ সূক্তের শেষের দিকে জাতি বিচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ।
“সেই বিরাট পুরুষের মুখ হইতে ব্রাক্ষ্মন , তার বাহুদ্বয় হতে ক্ষত্রিয় , উরদ্বয় হতে বৈশ্য সৃস্টি হয়েছে । পরে আরো বলা হয়েছে , “পদভ্যাং শুদ্র অজায়ত” যার অর্থ , পা হতে শুদ্রকে সৃস্টি করা হয়েছে ।”
এগুলো না ইতিহাস আবার না বিজ্ঞান !
সে সময় ভারতে নরবলী , সতীদাহ , সাগর সলিলে সন্তান বিসর্জন , অগ্নিপরীক্ষা , প্রবল জাতিভেদ , জড় পূজা , ঘৃনা , হত্যা , মারামারি , শোষন ইত্যাদিতে ভরপুর ছিল । মজার বিষয় হল , প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর যখন ভারত বিজয় করেন তখন মুসলিম সেনাবাহীনি তাদের এ উদ্ভত রীতিনীতি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন । তারা ভূতপ্রেতের ভয়ে দ্রুত এ অঞ্চল ত্যাগ করতে চাচ্ছিলেন !
আবার রুশ ঐতিহাসিক A.Z. MANFRED এর A SHORT HISTORY OF WORLD এর রেফারেন্স টেনে বলা যায় , সে সময় ব্রাক্ষ্মন্দের কোনো কর দিতে হত না । ক্ষত্রিয় ও শুদ্র শ্রেনীকে ছোট জাত বলে ধরা হতো । নব্বই বছর বয়স্ক ক্ষত্রিয় বৃদ্ধকে নয় বছর বয়স্ক ব্রাক্ষ্মন বালকের পদসেবা করতে হত । ছোট জাত নরহত্যা করলে শিরচ্ছেদ করা হতো । কিন্তু , ব্রাক্ষ্মনের ক্ষেত্রে সামান্য জরিমানা দিলেই হত !
ব্যভিচারের বিষয়টা এতো রমরমা ছিল যে , আমার লিখতেই লজ্জা লাগছে । রমেশ্চন্দ্র মজুমদারের “বাংলাদেশের ইতিহাস” গ্রন্থে লেখক লিখেন “সে যুগের পন্ডিতগন প্রামানিক গ্রন্থে অকুন্ঠচিত্তে লিখিয়াছেন শুদ্রকে বিবাহ করা অসংগত কিন্তু তাহার সহিত অবৈধ সহবাস করা তাদৃশ নিন্দনীয় নয় !” ইতিহাসবিদরা এ রকমের আরো বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন , তবে আমদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক অনেক পাঠক থাকায় এ বিষয়ে আর কিছু লিখলাম না ।
বিখ্যাত পর্যটক আল বিরুনী লিখেছেন , কোনো বৈশ্য ও শুদ্র বেদ অধ্যায়ন করলে তার জিহ্বা কেটে নেয়া হতো । উচ্চ জাতির লোক অপেক্ষা নিচু জাতিকে কঠিন শাস্তি দেয়া হতো । মনুর অনুজ্ঞাতে লেখা আছে , ব্রাক্ষ্মনের ভোজনের সময় কোনো “চান্দেলা” (অনুন্নত জাতি) , গ্রাম্য কুকুর অথবা শূকর দৃষ্টি দিতে পারবে না । চান্দেলাদের আবাসভূমি হবে গ্রামের বাইরের দিকে ।
এরকম আরো বহু কথা লেখা যেতে পারে , যার কোনো শেষ নেই ।
ভারতবর্ষের ইতিহাস বলতে গেলে “কুলীন” সমাজের কথা না বললে ইতিহাসটাই অসম্পুর্ন থেকে যাবে । কুলীন্দের কথা ভালো ভাবে জানলে এ আধুনিক সভ্যতা কেবল আশ্চর্যই হবে ।
ভারতবর্ষে সেন শাসনামলে “কুলীন ব্রাক্ষ্মন” নামে এক আশ্চর্য সমাজের সৃস্টি হয়েছিলো , যাদের জীবিকা ছিলো কেবল বিয়ে করা ! কেবল একটি উক্তি দিয়েই কুলীনদের নোংরামি তুলে ধরা সম্ভব ।
“ কুলীন ব্রাক্ষ্মন হিসেবই রাখতেন না তারা মোট কতটি মেয়েকে বিয়ে করেছে । তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য বিয়ে ও বিয়ের পর পাওয়া যৌতুকের হিসাব নিজেদের কাছে রেখে দিতেন । পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্বশুড়ালয়ে গেলে শ্বশুড়রা কি কি দিতেন তারও একটি তালিকা রাখতেন” ।
[ অধ্যাপক শ্রী বিনয় ঘোষের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্রষ্টব্য ]
[প্রসঙ্গত বলি , যৌতুকের মত মহামারী একটি ব্যাধী কিন্তু হিন্দুদের হাত ধরেই ছড়ায় । হিন্দু ধর্মমতে , মেয়ে তার বাবার সম্পত্তির কোনো অংশ পায় না । তাই বিয়ের সময় ছেলে পক্ষকে একেবারে কিছু উপহার বা অর্থ দিতে হতো । সেই থেকে শুরু এই যৌতুক প্রথা ।]
বিনয় ঘোষ আরো লিখেন , কুলিন জামাতারা যখন শ্বশুড়ালয়ে যেতো , তখন তাদের সম্মান রক্ষার্থে শ্বশুড়কে কিছু অর্থ অথবা উপহার দিতে হতো । এর ফলে বিবাহ বেশ লাভজনক পেশা হয়ে উঠেছিলো !
একটি কুলিন ব্রাক্ষ্মনের যদি ৩০ টি স্ত্রী থাকে তাহলে কুলিন ব্রাক্ষন কয়েকদিন করে প্রত্যেক শ্বশুর বাড়ি থাকলেই সারা মাসের খরচ উঠে যেতো । ফলে তারা আর কাজকর্ম করত না । এ প্রথার ফলে কুলীন ব্রাক্ষ্মন সমাজ একটি নিস্কর্মা আর পরভূক শ্রেনীতে পরিনত হয়েছিলো , যারা বিয়ের মত পবিত্র একটা বিষয়কে ব্যবসা আর নোংরামী তে নিয়ে গিয়েছিলো ।
“কুলীন ব্রাক্ষ্মন্দের জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিলো বিয়ে করা । বৃদ্ধ কুলীন ব্রাক্ষ্মনরাও বিয়ে করত , অনেক সময় স্ত্রীদের সাথে তাদের সাক্ষাতও হতো না । অথবা ৩/৪ বছর পর একবার হতো । অনেক সময় শোনা যেতো কুলীন ব্রাক্ষ্মন দিনে ৩/৪ টি বিয়ে করেছে । কোনো কোনো সময় একজনের সবকটি কন্যা ও অবিবাহিত বোনদের একজনের সাথেই বিয়ে দেয়া হতো । কুলীন কন্যদের জন্য পাত্র পাওয়া খুব কঠিন বলে কুলিন কন্যদের অবিবাহিত থাকতে হতো । কুলীনদের এ ধরনের বহুবিবাহের ফলে ব্যাভিচার , গর্ভপাত , শিশুহত্যা ও বেশ্যাবৃত্যির মত অপরাধ হতো । ৮০ , ৭২ , ৬৫ , ৬০ , ৪২ টি স্ত্রী আছে এমন লোকদের কথা জানা গেছে । বর্ধমান ও হুগলী জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এমন কথা জানা গেছে । ’’ [ শ্রী বিনয় ঘোষের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গ্রন্থ ]
এখানে কেউ যেনো মনে না করেন এগুলো আদিম কালের কথা । এসব ঘটনা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায়ও ঘটতো । তার জন্ম ১৮২০ সালে এবং মৃত্যু ১৮৯১ সালে । এসব ঘটনার কারনে ১৮৬৭ সালে লেফট্যানেন্ট গভর্নরকে দরখাস্ত করা হয় যাতে আইন করে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয় ! ১৮৭১ ও ১৮৭৩ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বহু বিবাহ নিয়ে দুটি বই লিখেন । বিনয় ঘোষ তার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরে লিখেন , তিনি হুগলীর কুলীনরা কিভাবে বহুবিবাহ করতেন সে সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন । তিনি সে সব কুলীনদের নাম ও তাদের স্ত্রী সংখ্যাও তার বইয়ে উল্লেখ করেন ।
এই হলো সেই সময়ে ভারতবর্ষের অবস্থা !!!!!!!
আমরা এবার অন্য দিকে একটু দৃষ্টি দেই । ইসলামপূর্ব সময়ে আরব ভূমির অবস্থা কি ছিলো ? আরব ভূমির অবস্থা ভারতের মত এতো জঘন্য না হলেও খুব ভালো ছিলো না । সুদ , মদ , জুয়া আর ব্যাভিচার সেই সময় আরবদেরও কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো । জড় পূজা সেখানেও ব্যাপক হারে হত । মূর্তি ছাড়া একমূহুর্ত চলা যেতো না । চলাচলের সময় মুর্তি না থাকলে তাৎক্ষনিক গড়ে নিয়ে পথচলা শুরু হত । সামান্য বিষয় নিয়ে পুরুষানুক্রমে যুদ্ধ হতো । ইরানের আর চীনের অবস্থাও একইরকম ছিলো ।
আরববাসীর সৌভাগ্য , আল্লাহ তাদের কাছে এমন একজন মানুষকে পাঠিয়েছেন , যিনি তাদের অন্ধকারের যুগ থেকে আলোর যুগে নিয়ে গেছেন । দিয়ে গেছেন , বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আসন ।
আর আমদের সৌভাগ্য , মুসলিম সেনারা দয়া করে এ অঞ্চলে তাদের পদধূলি দিয়েছেন । তা না হলে আমরা হয়তো আজো সেই বিভৎস দিনগুলো অতিবাহিত করতাম ।
আমরা আজ দেখি , বেশ কিছু মুসলিম তরুণ-তরুণী আজ সেই সভ্যতাকে ভালোবাসছে , যাকে হয়তো সেই সভ্যতার সাধারন নিচু জাতের মানুষ ঘৃনা করত । ঘৃনা না করলেও ধর্মীয় রীতির কারনে মুখ বুজে সহ্য করতো । তারা কি জেনে বুঝে সেই সভ্যতাকে ভালোবাসছে ??
[ বি.দ্র : আমাদের পেজে অনেক হিন্দু পাঠক-পাঠিকা আছেন । আপনাদের অত্যন্ত বিনীত ভাবে বলছি , আমরা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বা একটা ধর্মকে হেয় করার উদ্দেশ্য এসব লিখি নি । ইতিহাস ইতিহাসই । একে অস্বীকার করার উপায় নাই । তাছাড়া , আমরা একপেশে কোন লেখা লিখি নাই । তারপরও আপনাদের কষ্ট দিয়ে থাকলে দুঃখিত ।
আর আমার ধর্মীয় ভাইদের বলছি , দয়া করে কোন বাজে মন্তব্য করবেন না ]
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।